যুদ্ধাপরাধী বিচার এবং পদ্মা সেতু by রাহাত খান
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের ওপর বর্বর-পিশাচ পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস এবং পাকিস্তান মতাবলম্বী আরও দু’একটি রাজনৈতিক দল সুপরিকল্পিতভাবে নির্বিচার হত্যা, লুণ্ঠন, নারী-নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের যে নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছিল তার সঙ্গে শুধু তুলনা করা চলে
কম্বোডিয়ায় অকমিউনিস্ট নিধনের নামে ৩০ লাখ লোকের জঘন্য হত্যাকা- এবং বর্ণবাদী ও ফ্যাসিস্ট হিটলার বাহিনীর হাতে অন্যূন ৪০ লাখ ইহুদী হত্যার ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে। বাংলাদেশে যাদের বয়স পঞ্চাশের ওপরে তারা অবশ্য গোলাম আযম, নিজামী, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান গংয়ের চেহারা এবং বীভৎস কর্মকা-ের কথা ভুলে যাননি। এসব সংগঠন এবং সংগঠনের নেতাদের কাছে হিন্দু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতার পক্ষের লোকমাত্রই ছিল শত্রু এবং নির্বিচারে হত্যা করার পাত্র। আর পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে বাঙালী মাত্রই ছিল দুশমন, কৌম কা দুশমন, তাদের পাইকারি হারে ধরে লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল বাঙালী নিধনের।
পুরনো ঘটনা কেন আবার বিবৃত করছি এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমার জবাব, পুরনো হলেও যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ইতিহাস ও ইতিহাসের অনুলিপি সংরক্ষিত থাকবে, ততদিন বাংলাদেশে বর্বর পাকবাহিনী এবং তাদের অনুগত এ দেশীয় পিশাচ, নরপশুদের কর্মকা- ঘৃণার সঙ্গে মানুষ স্মরণ করবেন। যেমন ফ্যাসিস্ট হিটলার এবং উগ্র কমিউনিস্ট লননলের নৃশংস হত্যাকা- এখনও ঘৃণা ও ধিক্কারের সঙ্গে আমরা স্মরণ করছি।
অবশ্য বিএনপি ক্ষমতায় এলে বন্দীদশা থেকে আলবদর, রাজাকারেরা যে ‘সসম্মানে’ মুক্তি পাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। রাজাকারদের কারও গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকাও শোভা পেতে পারে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তো তাঁর রোডমার্চের প্রথম দিককার জনসভায় প্রকাশ্যেই বলতেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ বলতে কোন কিছু সংঘটিত হয়নি। আর রাজাকারদের বিচারের জন্য যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে তা অবৈধ।
থাক নেত্রী বেগম জিয়ার কথা। ১৯৭১ সালের ন’মাস তিনি তো বাংলাদেশে বাস করতেন না। তিনি বাস করতেন সে সময় পাকিস্তানের খাস এলাকা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সহি-সালামতে সেখানে দিন গুজরান করেছেন বলেই তো জানি। তাঁর এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা তাঁর স্বামী জেনারেল জিয়ার কথা তো বলে লাভ নেই। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎপ্রাপ্তির পর বাহুবলে ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার রাজনীতির প্রধান লক্ষ্যই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ আর চেতনা লুপ্ত করে শুধু নামটা বজায় রেখে বাংলাদেশকে বেনামে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করা। খালেদা জিয়া ও তাঁর নেতৃত্বাধীন বর্তমান বিএনপির লক্ষ্যও তাই। এর ‘থোড়াসা’ নমুনা ২০০১-২০০৬ সালে তিনি দেখিয়েছেন। আর একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে তিনি যে তাঁর মিশন পূর্ণ করার কার্যোদ্যোগে পুরোপুরি নেমে যাবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য ততদিনে অবশিষ্ট পাকিস্তান ভেঙ্গে দুই টুকরা, তিন টুকরা হয়ে যায় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
বেগম খালেদা জিয়ার কথা নয়, আমি বলতে চাইছিলাম যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কথা। যেমন ‘দ্রুততার’ সঙ্গে তারা বিচার কার্যকলাপ চালাচ্ছেন, তাতে অন্তত অভিযুক্ত চার-পাঁচজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার যে ২০২০ কিংবা ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য এই সময় পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব থাকবে কিনা সেটা বলা সন্দেহ। ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন বাদী-বিবাদী পক্ষ প্রতিপক্ষের আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা ‘স্বচ্ছতার’ প্রশ্নে যে রকম উদার চিত্তে সময় ক্ষেপণ করছেন কিংবা ‘আইনী’ উপরোধে সময় ক্ষেপণ করতে যে রকম বাধ্য হচ্ছেন তাতে সন্দেহ প্রকাশ না করে উপায় কি?
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররাও তো আইনের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই স্বচ্ছতা বজায় রেখেই বাঙালীদের হত্যা করত এবং বাঙালী নারীর ওপর ধর্ষণ কাজ চালাত! আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের প্রতি আমার পুরোপুরি শ্রদ্ধা বরাবর ছিল। এখনও আছে। রাষ্ট্রীয় কাজের ব্যস্ততার মধ্যে একটুখানি সময় নিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিষয়টা একবার ভাবুন তো! দু’টোর জায়গায় পাঁচটা অনুরূপ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে এবং বিচারের সময়সীমা বেঁধে দেয়াটা তো বেআইনী কিছু হতো না। সেটা কেন করলেন না তাঁরা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশেই দেওয়ানী বা ফৌজদারি যে কোন বিচারের সময়সীমা ছ’মাসের মধ্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে। অযথা এবং উদ্দেশ্যমূলক সময় ক্ষেপণ স্বচ্ছ বিচারের কোন ক্রাইটেরিয়া নয়! আইনমন্ত্রী দয়া করে কথাগুলো ভেবে দেখবেন। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক দেশের বিশাল তরুণ সমাজ (তারা কিন্তু নির্বাচনে ভোটারও) ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। স্বচ্ছতা বজায় রেখেই বিচার হবে বৈকিÑতবে প্রসিকিউশনের বহু ক্ষেত্রে দুর্বল উপস্থাপনা কিংবা খামোকা সময় ক্ষেপণের সুযোগ দেয়া কিন্তু ন্যায্য বিচারের পক্ষেও যায় না।
মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে সবে সূচনা বক্তব্য শেষ হয়েছে। গত ৮ জুলাই শুরু হয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণ। এখন আল্লা মাবুদ জানেন আসামি নিয়োজিত আইনজীবীদের অযথা সময় ক্ষেপণ কতদিন চলে। প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা দু’টি। গত দেড় বছর, পৌনে দু’বছরে আপাতত অভিযুক্ত আট ব্যক্তির একজনের বিচারও সম্পন্ন হতে পারল না! এই দুঃখ কাকে বলি। চলতি বছরের মধ্যে বর্তমানে কারাগারে নিক্ষিপ্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার নিষ্পন্ন হবে, এটা ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এখন দেখা যাক, সময়ে কি দাঁড়ায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আমি কোন অসহিষ্ণুতা কিংবা ধৈর্যহীনতা প্রকাশ করছি না। তবে কিছু কুলাঙ্গার এবং কুসন্তান ছাড়া যে গোটা বাঙালী জাতিই অভিযুক্তদের বিচারের রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে অধীর হয়ে, উৎকণ্ঠিত হয়ে, ক্ষুব্ধ হয়ে, সেটা ভাষান্তর করে সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেয়া ভাল বলে মনে করছি।
এই প্রসঙ্গে এর অধিক বলার আর কিইবা থাকতে পারে! প্রসঙ্গ পাল্টে বরং বলা যাক পদ্মা নদীর ওপর বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুত সেতু নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে। মধ্যযুগে কানু বিনে কোন গীত ছিল না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক বিশেষ করে শহুরে লোকদের মধ্যেও পদ্মা সেতু নিয়েই আলোচনা পর্যালোচনা বেশি চলছে। এর একটা কারণ অবশ্যই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করার সিদ্ধান্তটি। দ্বিতীয় কারণ, নির্বাচনের বাকি আছে তো আর দেড় বছর। গত সাড়ে তিন বছরে পদ্মার ওপর একটা পিলারও বসাতে দেখা গেল না, বাকি দেড় বছরে পদ্মা সেতু নির্মিত হবে তাহলে কোন্ জাদু বলে। সরকার প্রদত্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিটি কি শেষ পর্যন্ত তাহলে ‘হতে যাচ্ছে’, ‘হয়ে যাবে’ ইত্যাকার আশাবাদেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে?
বলা যায় আগামীতে নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক দল আওয়ামী লীগের জন্য। উল্লিখিত দুটো ক্ষেত্রে সাফল্যের ওপরই নির্ভর করছে বাঙালী জনগণের ভাগ্য। স্বাধীনতাবিরোধী দল ও জোটের কাছে ভোটযুদ্ধে ক্ষমতা লাভের সম্ভাবনা দেখা দেবে তখনই যখন আলোচিত দু’টি ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পক্ষের দল ও জোট সময়ের কারণে কিংবা অন্য কোন কারণে সাফল্যের দেখা না পায়। টাইম বা সময় সেই বিচারে নিঃসন্দেহে উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের জন্য।
দেড় বছর তো মাত্র সময়! এমন নয় পদ্মা সেতু নির্মাণে রাতারাতি কোন জাদুর ভেল্কি দেখানো যাবে। তার মানে দেড় বছর সময়সীমার মধ্যে কি সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করা যাবে? সেতু নির্মাণে অর্থায়ন এবং প্রযুক্তিগত অসুবিধা ছাড়াও তো রয়েছে শত জটিলতা। শুধু আশাবাদ ব্যক্ত করা এবং বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অর্থায়ন বাতিল করার সমালোচনা করাটাই তো যথেষ্ট নয়। কাজ করে অর্থাৎ সেতু নির্মাণ করে দেখাতে হবে যে আশাবাদ ও স্বপ্নের সীমা ডিঙ্গিয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবে নির্মিত হয়েছে।
এই ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের জন্য সুসংবাদ, অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সেতু নির্মাণের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। তবে এই অর্থ সংগ্রহ এবং নিয়ম-নীতির মধ্যে বিন্যস্ত করাটাও সময়ের ব্যাপার। সেই উদ্যোগ এখনও চোখে পড়ছে না। আবার অযথা সময় ক্ষেপণের কথাটা এসে যায়। বলতে হয় আমাদের আমলাতন্ত্র তো বহুক্ষেত্রে শ্বেতহস্তির সাথে তুলনীয়। আস্তে ধীরে দুলকি চালে চলে। জাতি কি সেটা এফোর্ড করতে পারে?
আমার ধারণা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে হয়ত পদ্মা সেতু নির্মাণে কঠিনতর কিছু শর্তে শেষ পর্যন্ত একটা চুক্তি সম্পন্ন হতে পারবে! এর জন্যও চাই কিছু বাড়তি সময়। অনেকের মতো আমিও মনে করি বিশ্বব্যাংকের অপশন হাতে রেখে সরকারের উচিত আগামী দেড়-দুই মাসে অভ্যন্তরীণ খাতের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে দেয়া। সময়ের সীমাবদ্ধতার প্রশ্নটি সুরাহা করতে চাইলে অনতিবিলম্বে সেতু নির্মাণ শুরু করে দেয়ার কোন বিকল্প নেই।
স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ যত আস্ফালন করুক, কঠোর কর্মসূচী দেয়ার নামে সরকারবিরোধী আন্দোলন করার যত হুঁশিয়ারি দিকÑ ওদের আসলে আন্দোলনে সাফল্য পাওয়ার মতো কোন ইস্যুই নেই। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে ৮০ ভাগ সাফল্য দেখাতে পারলেও নির্বাচনী-রাজনীতিতে আগামীতে বিএনপি-জামায়াতের ভরাডুবি কেউ ঠেকাতে পারবে না। সরকার ও দল কতটা প্রস্তুত, সেটাই প্রশ্ন।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক
পুরনো ঘটনা কেন আবার বিবৃত করছি এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আমার জবাব, পুরনো হলেও যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ইতিহাস ও ইতিহাসের অনুলিপি সংরক্ষিত থাকবে, ততদিন বাংলাদেশে বর্বর পাকবাহিনী এবং তাদের অনুগত এ দেশীয় পিশাচ, নরপশুদের কর্মকা- ঘৃণার সঙ্গে মানুষ স্মরণ করবেন। যেমন ফ্যাসিস্ট হিটলার এবং উগ্র কমিউনিস্ট লননলের নৃশংস হত্যাকা- এখনও ঘৃণা ও ধিক্কারের সঙ্গে আমরা স্মরণ করছি।
অবশ্য বিএনপি ক্ষমতায় এলে বন্দীদশা থেকে আলবদর, রাজাকারেরা যে ‘সসম্মানে’ মুক্তি পাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। রাজাকারদের কারও গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকাও শোভা পেতে পারে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তো তাঁর রোডমার্চের প্রথম দিককার জনসভায় প্রকাশ্যেই বলতেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ বলতে কোন কিছু সংঘটিত হয়নি। আর রাজাকারদের বিচারের জন্য যে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে তা অবৈধ।
থাক নেত্রী বেগম জিয়ার কথা। ১৯৭১ সালের ন’মাস তিনি তো বাংলাদেশে বাস করতেন না। তিনি বাস করতেন সে সময় পাকিস্তানের খাস এলাকা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। সহি-সালামতে সেখানে দিন গুজরান করেছেন বলেই তো জানি। তাঁর এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা তাঁর স্বামী জেনারেল জিয়ার কথা তো বলে লাভ নেই। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎপ্রাপ্তির পর বাহুবলে ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার রাজনীতির প্রধান লক্ষ্যই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ আর চেতনা লুপ্ত করে শুধু নামটা বজায় রেখে বাংলাদেশকে বেনামে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করা। খালেদা জিয়া ও তাঁর নেতৃত্বাধীন বর্তমান বিএনপির লক্ষ্যও তাই। এর ‘থোড়াসা’ নমুনা ২০০১-২০০৬ সালে তিনি দেখিয়েছেন। আর একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে তিনি যে তাঁর মিশন পূর্ণ করার কার্যোদ্যোগে পুরোপুরি নেমে যাবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য ততদিনে অবশিষ্ট পাকিস্তান ভেঙ্গে দুই টুকরা, তিন টুকরা হয়ে যায় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
বেগম খালেদা জিয়ার কথা নয়, আমি বলতে চাইছিলাম যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কথা। যেমন ‘দ্রুততার’ সঙ্গে তারা বিচার কার্যকলাপ চালাচ্ছেন, তাতে অন্তত অভিযুক্ত চার-পাঁচজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার যে ২০২০ কিংবা ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য এই সময় পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব থাকবে কিনা সেটা বলা সন্দেহ। ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন বাদী-বিবাদী পক্ষ প্রতিপক্ষের আইনজীবীরা ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা ‘স্বচ্ছতার’ প্রশ্নে যে রকম উদার চিত্তে সময় ক্ষেপণ করছেন কিংবা ‘আইনী’ উপরোধে সময় ক্ষেপণ করতে যে রকম বাধ্য হচ্ছেন তাতে সন্দেহ প্রকাশ না করে উপায় কি?
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররাও তো আইনের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই স্বচ্ছতা বজায় রেখেই বাঙালীদের হত্যা করত এবং বাঙালী নারীর ওপর ধর্ষণ কাজ চালাত! আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের প্রতি আমার পুরোপুরি শ্রদ্ধা বরাবর ছিল। এখনও আছে। রাষ্ট্রীয় কাজের ব্যস্ততার মধ্যে একটুখানি সময় নিয়ে তিনি যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিষয়টা একবার ভাবুন তো! দু’টোর জায়গায় পাঁচটা অনুরূপ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে এবং বিচারের সময়সীমা বেঁধে দেয়াটা তো বেআইনী কিছু হতো না। সেটা কেন করলেন না তাঁরা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশেই দেওয়ানী বা ফৌজদারি যে কোন বিচারের সময়সীমা ছ’মাসের মধ্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে। অযথা এবং উদ্দেশ্যমূলক সময় ক্ষেপণ স্বচ্ছ বিচারের কোন ক্রাইটেরিয়া নয়! আইনমন্ত্রী দয়া করে কথাগুলো ভেবে দেখবেন। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক দেশের বিশাল তরুণ সমাজ (তারা কিন্তু নির্বাচনে ভোটারও) ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। স্বচ্ছতা বজায় রেখেই বিচার হবে বৈকিÑতবে প্রসিকিউশনের বহু ক্ষেত্রে দুর্বল উপস্থাপনা কিংবা খামোকা সময় ক্ষেপণের সুযোগ দেয়া কিন্তু ন্যায্য বিচারের পক্ষেও যায় না।
মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে সবে সূচনা বক্তব্য শেষ হয়েছে। গত ৮ জুলাই শুরু হয়েছে সাক্ষ্যগ্রহণ। এখন আল্লা মাবুদ জানেন আসামি নিয়োজিত আইনজীবীদের অযথা সময় ক্ষেপণ কতদিন চলে। প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা দু’টি। গত দেড় বছর, পৌনে দু’বছরে আপাতত অভিযুক্ত আট ব্যক্তির একজনের বিচারও সম্পন্ন হতে পারল না! এই দুঃখ কাকে বলি। চলতি বছরের মধ্যে বর্তমানে কারাগারে নিক্ষিপ্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার নিষ্পন্ন হবে, এটা ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। এখন দেখা যাক, সময়ে কি দাঁড়ায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আমি কোন অসহিষ্ণুতা কিংবা ধৈর্যহীনতা প্রকাশ করছি না। তবে কিছু কুলাঙ্গার এবং কুসন্তান ছাড়া যে গোটা বাঙালী জাতিই অভিযুক্তদের বিচারের রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে অধীর হয়ে, উৎকণ্ঠিত হয়ে, ক্ষুব্ধ হয়ে, সেটা ভাষান্তর করে সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেয়া ভাল বলে মনে করছি।
এই প্রসঙ্গে এর অধিক বলার আর কিইবা থাকতে পারে! প্রসঙ্গ পাল্টে বরং বলা যাক পদ্মা নদীর ওপর বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুত সেতু নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে। মধ্যযুগে কানু বিনে কোন গীত ছিল না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক বিশেষ করে শহুরে লোকদের মধ্যেও পদ্মা সেতু নিয়েই আলোচনা পর্যালোচনা বেশি চলছে। এর একটা কারণ অবশ্যই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করার সিদ্ধান্তটি। দ্বিতীয় কারণ, নির্বাচনের বাকি আছে তো আর দেড় বছর। গত সাড়ে তিন বছরে পদ্মার ওপর একটা পিলারও বসাতে দেখা গেল না, বাকি দেড় বছরে পদ্মা সেতু নির্মিত হবে তাহলে কোন্ জাদু বলে। সরকার প্রদত্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিটি কি শেষ পর্যন্ত তাহলে ‘হতে যাচ্ছে’, ‘হয়ে যাবে’ ইত্যাকার আশাবাদেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে?
বলা যায় আগামীতে নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন দুটোই খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু মহাজোট সরকারের প্রধান শরিক দল আওয়ামী লীগের জন্য। উল্লিখিত দুটো ক্ষেত্রে সাফল্যের ওপরই নির্ভর করছে বাঙালী জনগণের ভাগ্য। স্বাধীনতাবিরোধী দল ও জোটের কাছে ভোটযুদ্ধে ক্ষমতা লাভের সম্ভাবনা দেখা দেবে তখনই যখন আলোচিত দু’টি ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পক্ষের দল ও জোট সময়ের কারণে কিংবা অন্য কোন কারণে সাফল্যের দেখা না পায়। টাইম বা সময় সেই বিচারে নিঃসন্দেহে উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের জন্য।
দেড় বছর তো মাত্র সময়! এমন নয় পদ্মা সেতু নির্মাণে রাতারাতি কোন জাদুর ভেল্কি দেখানো যাবে। তার মানে দেড় বছর সময়সীমার মধ্যে কি সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করা যাবে? সেতু নির্মাণে অর্থায়ন এবং প্রযুক্তিগত অসুবিধা ছাড়াও তো রয়েছে শত জটিলতা। শুধু আশাবাদ ব্যক্ত করা এবং বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অর্থায়ন বাতিল করার সমালোচনা করাটাই তো যথেষ্ট নয়। কাজ করে অর্থাৎ সেতু নির্মাণ করে দেখাতে হবে যে আশাবাদ ও স্বপ্নের সীমা ডিঙ্গিয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবে নির্মিত হয়েছে।
এই ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের জন্য সুসংবাদ, অভ্যন্তরীণ খাত থেকে সেতু নির্মাণের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব। তবে এই অর্থ সংগ্রহ এবং নিয়ম-নীতির মধ্যে বিন্যস্ত করাটাও সময়ের ব্যাপার। সেই উদ্যোগ এখনও চোখে পড়ছে না। আবার অযথা সময় ক্ষেপণের কথাটা এসে যায়। বলতে হয় আমাদের আমলাতন্ত্র তো বহুক্ষেত্রে শ্বেতহস্তির সাথে তুলনীয়। আস্তে ধীরে দুলকি চালে চলে। জাতি কি সেটা এফোর্ড করতে পারে?
আমার ধারণা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে হয়ত পদ্মা সেতু নির্মাণে কঠিনতর কিছু শর্তে শেষ পর্যন্ত একটা চুক্তি সম্পন্ন হতে পারবে! এর জন্যও চাই কিছু বাড়তি সময়। অনেকের মতো আমিও মনে করি বিশ্বব্যাংকের অপশন হাতে রেখে সরকারের উচিত আগামী দেড়-দুই মাসে অভ্যন্তরীণ খাতের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে দেয়া। সময়ের সীমাবদ্ধতার প্রশ্নটি সুরাহা করতে চাইলে অনতিবিলম্বে সেতু নির্মাণ শুরু করে দেয়ার কোন বিকল্প নেই।
স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ যত আস্ফালন করুক, কঠোর কর্মসূচী দেয়ার নামে সরকারবিরোধী আন্দোলন করার যত হুঁশিয়ারি দিকÑ ওদের আসলে আন্দোলনে সাফল্য পাওয়ার মতো কোন ইস্যুই নেই। সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে ৮০ ভাগ সাফল্য দেখাতে পারলেও নির্বাচনী-রাজনীতিতে আগামীতে বিএনপি-জামায়াতের ভরাডুবি কেউ ঠেকাতে পারবে না। সরকার ও দল কতটা প্রস্তুত, সেটাই প্রশ্ন।
লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক
No comments