খাদ্যনিরাপত্তা-কৃষির নীরব ঘাতক ‘পার্থেনিয়াম’ by শাইখ সিরাজ

পথঘাটে, বনবাদাড়ে কতই না উদ্ভিদ চোখে পড়ে। এর মধ্যে কোনোটি উপকারী, কোনোটি অপকারী। শত্রু পোকা, বন্ধু পোকার মতো শত্রু উদ্ভিদ ও বন্ধু উদ্ভিদ রয়েছে। কার্যত সবই প্রকৃতির অংশ। একসময় গ্রামাঞ্চলে খুব বেশি দেখা যেত, এখন বিপন্ন বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এমন উদ্ভিদের সংখ্যাও কম নয়।


কোনো কোনো আগাছা ফসলের জন্য কখনো কখনো ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। ফসলি গাছ মাটি থেকে যে খাবার খায়, তাতে ভাগ বসায় আগাছা। এ কারণে আগাছা দমন করা কৃষকের ফসল পরিচর্যার একটি অংশ। কিন্তু একটি আগাছা ভয়াবহ এক আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। বলা যেতে পারে ঘাতক আগাছা, যার নাম ‘পার্থেনিয়াম’। এই ঘাতক উদ্ভিদ রীতিমতো ভয় ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। ভয়ের জায়গা কয়েকটি। প্রথমত, এই উদ্ভিদ খাদ্যশস্যের ফলন কমিয়ে দিতে পারে ৪০ শতাংশ, বিশেষ করে ভুট্টার ক্ষেত্রে এই আগাছা ফল ধরার পর প্রাথমিক অবস্থায় মোচার ফল ধারণক্ষমতা ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া ধান, ছোলা, সরিষা, গম, বেগুন ও মরিচের ক্ষেত্রে এই আগাছা বীজের অঙ্কুরোদ্গম ও বৃদ্ধি কমিয়ে দিয়ে ফসলের ফলন অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। জনস্বাস্থ্যের জন্য এর ভয়াবহতা মেলানো যায় আর্সেনিকের সঙ্গে। সঙ্গে আরও যোগ করে বলা যায় যে শ্বাসকষ্ট, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমাসহ জটিল রোগের কারণ হতে পারে পার্থেনিয়াম। এই আগাছার সংস্পর্শে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে গবাদিপশুও।
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই আগাছা সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। কৃষকেরাও জানেন না এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে। রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে পার্থেনিয়াম। রাস্তার পাশ থেকে ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ফসলের মাঠেও।
পার্থেনিয়ামের মূল উৎপত্তিস্থল মেক্সিকো। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে একে একে আমেরিকা, আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশে। এই আগাছা খুব সহজেই পানি, মেশিনারি, শস্যবীজের মাধ্যমে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে দিনে দিনে নতুন এলাকা এই আগাছায় আক্রান্ত হচ্ছে। পার্থেনিয়াম নিয়ে ভারতে রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়ে গেছে। সেখানে এটির পরিচিতি ক্যারট উইড বা গাজর ঘাস হিসেবে। পার্থেনিয়ামের একটি গাছ চার হাজার থেকে ২৫ হাজার অতিক্ষুদ্র বীজের জন্ম দিতে পারে। একটি গাছ বাঁচে তিন থেকে চার মাস। এই সময়ের মধ্যেই তিনবার ফুল ও বীজ দেয়। এত ক্ষুদ্র বীজের সাধারণত গবাদিপশুর গোবর, গাড়ির চাকার কাদামাটি, পথচারীদের জুতা-স্যান্ডেলের তলার কাদামাটি, সেচের পানি, বাতাসের সঙ্গে বিস্তার ঘটে থাকে।
ভারতে এই বিষাক্ত আগাছার বিস্তার ঘটেছে ভয়ানকভাবে। ১৯৭৫ সালে এর বিস্তার ঘটে ৫০ লাখ হেক্টরে, যা আমাদের এক মৌসুমের ধান আবাদি জমির সমান। ২০১০ সালে তা গিয়ে পৌঁছায় ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর বা সাড়ে তিন কোটি হেক্টরে, যা আমাদের মোট আবাদি জমির প্রায় চার গুণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পার্থেনিয়াম ভারতের মহারাষ্ট্রে আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৬ সালে। তারপর তা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করীম ইতিমধ্যে পার্থেনিয়াম নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর নিবিড় পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে, এই আগাছা অধিকাংশ খাদ্যশস্যের উৎপাদন ৪০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এটি আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি। রেজাউল করীম যে তথ্য দিচ্ছেন, তা রীতিমতো আতঙ্কজনক। তিনি বলছেন, পার্থেনিয়াম আগাছার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টিকে ইংরেজিতে বলে ওয়াইল্ড ফায়ার। জঙ্গলে আগুন লাগলে যেমন তা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না, একইভাবে পার্থেনিয়ামের বিস্তার রোধও কঠিন ব্যাপার। পার্থেনিয়াম আগাছা থেকে একধরনের রাসায়নিক দ্রব্য নিঃসৃত হয়, যা পার্শ্ববর্তী ফসলের অঙ্কুরোদ্গম ও বর্ধন কমিয়ে দেয়। এই আগাছা মাটি থেকে ধানের চেয়ে অনেক বেশি হারে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। অধ্যাপক করীম ২০০৯ সালে এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উল্লেখ করেন, পার্থেনিয়াম আমাদের জন্য আতঙ্ক হয়ে এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে তিনি একটি প্রকল্পও জমা দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, প্রকল্পটি গৃহীত হয়নি।
পার্থেনিয়াম ঘাসসহ অন্যান্য পশুখাদ্যের উৎপাদনও কমিয়ে দেয় মারাত্মকভাবে। এই বিষাক্ত আগাছা মানুষ ও পশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ। মানুষ এই আগাছা স্পর্শ করলে, তা থেকে প্রাথমিকভাবে অ্যাজমা ও চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। পরে এর বিস্তৃতি ঘটে আরও ভয়াবহ রোগে। সবচেয়ে আতঙ্কের খবর হলো, ভারতের পুনেতে পার্থেনিয়ামজনিত বিষক্রিয়ায় এ পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ভারতের মধ্যপ্রদেশের জাবলপুরের আগাছাবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র প্রায় ২০ বছর গবেষণা করে পার্থেনিয়ামের কয়েকটি ব্যবস্থাপনা বের করেছে। পার্থেনিয়াম আগাছা তোলার সময় গাছটির সরাসরি স্পর্শ এড়ানোর জন্য অবশ্যই হাতে প্লাস্টিক অথবা পলিথিন গ্লাভস পরতে হবে। কোনোভাবেই কেটে এই আগাছা দমনের উদ্যোগ নেওয়া যাবে না। রাসায়নিক আগাছানাশকের একটি মিশ্রণও পার্থেনিয়াম দমনের জন্য কাজে লাগতে পারে।
জৈব পদ্ধতিতে পার্থেনিয়াম দমনের বিষয়টি পরিবেশবান্ধব। এ ক্ষেত্রে ম্যাক্সিকান ঘাসখেকো বন্ধু পোকা জাইকোগ্রারামা বিকোলোরাটা প্রয়োগ করলেও ভালো ফল পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া জৈব পদ্ধতিতে পার্থেনিয়াম দমনের অংশ হিসেবে কিছু পরিবেশবান্ধব উদ্ভিদ রয়েছে, যেগুলো পার্থেনিয়ামের বিস্তার রোধ করতে পারে বলেও জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পার্থেনিয়ামের মতো ক্ষতিকর আগাছা আর দ্বিতীয়টি নেই। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার প্রশ্নে এ এক নীরব ঘাতক। জনস্বাস্থ্য, প্রাণিসম্পদ থেকে শুরু করে সামগ্রিক কৃষি ও পরিবেশের জন্য চরম হুমকি। বাংলাদেশে এখনো পার্থেনিয়ামের বিস্তৃতি প্রাথমিক অবস্থায় আছে বলা যায়। এখনই এই আগাছা দমনের কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হলে কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না বড় ধরনের বিপর্যয়। কৃষিসংশ্লিষ্ট সব সরকারি-বেসরকারি গবেষণা ও সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এখনই কৃষকসহ সাধারণ জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করে তোলার প্রয়োজন রয়েছে।
শাইখ সিরাজ: টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব।
shykhs@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.