মুফতি মুফীযুর রাহমান-লক্ষ ফুলের সুবাস নিয়ে তুমি এলে হে রাসুল (সা.)

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই পৃথিবীর বুকে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদতের জন্য। সাজিয়েছেন এই পৃথিবীকে তাদের সুখ-শান্তির অজস্র উপকরণ দিয়ে। প্রতি মুহূর্তে মানুষ উপভোগ করছে আল্লাহপাকের অসংখ্য নিয়ামত।


আল্লাহপাকের নিয়ামতভোগী এই মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন নবী-রাসুল। উম্মতের হেদায়াতের পথে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন তাঁরা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রেরিত এমনই এক নিষ্পাপ কাফেলার সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) আবির্ভূত হয়েছিলেন, যিনি কিয়ামত পর্যন্ত আগতব্য সব মানুষের নবী।
আল্লাহর সৃষ্টি লাখো-কোটি ফুল যেমন সুবাস ছড়ায় এ ধরার বুকে নিঃস্বার্থভাবে, তদ্রূপ দ্বীনের সুবাস ছড়ালেন তিনি সর্বস্তরে। তাঁর এমনই এক বিমুঙ্কর সুবাসে মুখরিত হয়ে জাহেলি যুগের মানুষ তাঁর নিয়ে আসা ধর্মের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিল। এমনই এক মহামানবকে চিনতে-জানতে এবং তাঁর ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় করে দিতে কার মন না চায়? প্রত্যেক মহৎ মুমিনের অন্তরে রয়েছে তাঁকে চেনার, জানার ও ভালোবাসার মতো এক উচ্চাকাঙ্ক্ষা। যাঁর জীবনের প্রতিমুহূর্তই ছিল উম্মতের জন্য শিক্ষণীয় এবং অনুসরণীয়। এমনই এক মহামানব যখন এই ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন, তখন মানুষ ছিল গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতার আঁধারে নিমজ্জিত। জুলুম-অত্যাচারের রাজত্ব চলছিল যখন। খুন-খারাবি, জিনা-ব্যভিচারের মতো জঘন্যতম অপরাধ ছিল মানুষের নিত্যদিনের কর্ম। মানুষ তাদের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে মূর্তি পূজার মতো নিন্দনীয় কর্মে লিপ্ত হয়েছিল। এহেন মুহূর্তে লক্ষ ফুলের সুবাস নিয়ে সর্বপ্রকার উত্তম গুণাবলি ও চরিত্রের পূর্ণতাস্বরূপ এ ধরার বুকে এলেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর আগমনে দূর হলো সব পথভ্রষ্টতা। পথভোলা মানুষ ফিরে পেল সঠিক পথের দিশা। সবাইকে তিনি দাওয়াত দিলেন এক আল্লাহর দিকে। 'হে লোক সকল, তোমরা বলো আল্লাহ এক, তাহলে সফল হয়ে যাবে।' সত্য পথের এমন দিশা দিতে ছুটে গেলেন প্রত্যেক মানুষের দ্বারে দ্বারে। সহ্য করলেন অনেক অমানবিক আচরণ।
শত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোনোটাই কাজে লাগালেন না তিনি। বরং হে আল্লাহ, আমার সম্প্রদায়কে ক্ষমা করে দাও। কারণ তারা বুঝে না। মহান প্রভুর দরবারে উম্মতের জন্য এমন দোয়াই করলেন নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে। সর্বদাই তাঁর হৃদয়ে একটি যাতনা। কী করে পথভ্রষ্টতা ও কুফুরির আঁধারের ঘন পর্দা চিরে ইমানের আলোতে আলোকিত করা যায় এ ভুবনকে। কিন্তু তা কি আর সম্ভব? এ মহান স্বপ্নপূরণে রক্ত ঝরেছে তাঁর শরীর থেকে।
কিন্তু এমন সব কঠিন মুহূর্তেও রাসুল (সা.) ছিলেন ধৈর্যশীল এবং সহনশীল। মক্কার কাফির-মুশরিকরা মিলে রাসুল (সা.)-এর বিরুদ্ধে কত রকম চক্রান্ত-দুর্ব্যবহার করেছে। কত কষ্টই না দিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু মানবতার মুক্তির দূত রাসুল (সা.) ছিলেন সবার প্রতি সহনশীল। একে একে তিনটি বছর মক্কার কাফিররা রাসুল (সা.) এবং বনি হাশেমকে বয়কট করে রেখেছিল। কষ্টের সেই দিনগুলোর বর্ণনা প্রতিটি পাষাণ হৃদয়েও প্রভাব ফেলে। মুহূর্তে অশ্রুজলে বুক ভিজে যায়। কিন্তু সেই কঠিন মুহূর্তেও রাসুল (সা.) ছিলেন ধৈর্যে অটল।
আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি জীব মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ রাসুল হিসেবে রাসুল (সা.)-এর বিনয় ও সরলতা ছিল ঠিক তেমনি শ্রেষ্ঠ। একদা রাসুল (সা.)-এর কাছে কিছু দানের চাদর এলে তিনি তা বণ্টন করে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে গেলেন। এমন সময় জনৈক সাহাবি দানের চাদরের জন্য তাঁর ছেলেকে নিয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে এলেন। অতঃপর তাঁর ছেলে রাসুল (সা.)-এর খোঁজ করতে গিয়ে দেখলেন রাসুল (সা.) ঘুমাচ্ছেন। ছেলে এসে বাবাকে তাঁর ঘুমের কথা জানালে বাবা বললেন, রাসুল (সা.)-কে ডাক দাও। বাবার আদেশ পেয়ে ছেলে বললেন, আমরা কি এই একটি স্বার্থের জন্য দোজাহানের সরদারকে ডাকব? বাবা বললেন! শুন হে বৎস! তিনি যেমন দোজাহানের সরদার, তেমনি তিনি বিনয়ী এবং সরলও বটে। বাবার এমন বর্ণনায় নির্বিঘ্নে ছেলে গিয়ে রাসুল (সা.)-কে ডাকলে তিনি হাসিমুখে বের হয়ে এসে তাঁদের একটি চাদর দান করলেন। রাসুল (সা.)-এর মতো এমন বিনয়ী মানুষ মিলবে না আর এ ধরাতে।
ইনসাফ ও সুবিচারবিহীন সমাজের লোকেরা কখনো সুখ-শান্তির দেখা পায় না। যে জাতির মধ্যে যত বেশি ইনসাফ ও সুবিচার রয়েছে, সে জাতি ততই শ্রেষ্ঠ। আসুন, আমরা রাসুল (সা.)-এর জীবনের ইনসাফ দেখি। বদরযুদ্ধে ৭০ জন কাফির বন্দি হলো। এদের মধ্যে রাসুল (সা.)-এর চাচা হজরত আব্বাসও (রা.) ছিলেন। সব বন্দির মতো তাঁকেও রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হলো। বুড়ো মানুষ হিসেবে রাসুল (সা.)-এর চাচা আব্বাসের খুবই কষ্ট হচ্ছিল। ব্যথায় তিনি আহ! আহ! করছিলেন। চাচার আহ! শব্দ শুনে গভীর রাতে নবীজির ঘুম আসছিল না। চাচার কষ্টে রাসুল (সা.) ছটফট করছিলেন। নবীজির একটু ইশারা হলেই তাঁর চাচা আব্বাসের বাঁধন ঢিলা করা কিংবা খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু নবীজি এমন করবেন কেন? তিনি তা করেননি, কারণ আপন-পর সবার সঙ্গে সমান ব্যবহারই যে ইনসাফের দাবি। এমন ইনসাফগার ও সুবিচারকই ছিলেন আমাদের প্রিয় নবীজি।
আসুন, আমরা লক্ষ ফুলের সুবাস নিয়ে আগমনকারী রাসুল (সা.)-এর উত্তমাদর্শে আদর্শবান হই। তাহলেই সফল হবে আমাদের ইহকাল ও পরকাল।

লেখক : মুহাদ্দেস, জামিয়া বিন নূরিয়া আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসা, মিরপুর-১০ ও খতিব বায়তুল আমান জামে মসজিদ, সাভার, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.