ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-গতিহারা চার লেন by আনোয়ার হোসেন
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প গতি হারিয়েছে। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের ৭১ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করার কথা ছিল গত এপ্রিল মাসে। অথচ কাজ হয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ। গত মার্চ থেকেই প্রকল্পের কাজ প্রায় বন্ধ। মূলত অর্থসংকটে এখন কাজ আগাচ্ছে না।
প্রকল্পের সবচেয়ে বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশনের বেশ কিছু কর্মকর্তা দেশে ফিরে গেছেন। প্রকল্প শেষ করতে যত দেরি হচ্ছে, এর ব্যয় তত বাড়ছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা চলতি ২০১২ সালে। আর তৈরির পর এক বছর সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণ করবেন ঠিকাদারেরা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়ার সময় আরও কমিয়ে আনার জন্য ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রতিফলন নেই।
বাংলাদেশ নিট পোশাক মাালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা এত কথা বলছি, অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম যোগাযোগব্যবস্থা ভালো করাটাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সেটা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘এ রকম এক প্রকল্পই আমরা শেষ করতে পারছি না, অথচ আমরা কোটি কোটি ডলারের বিশাল বিশাল প্রকল্পের স্বপ্ন দেখছি।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বিদ্যমান সড়কের পাশে মাটির স্তূপ করে রাখা হয়েছে। মাটি এসে মহাসড়কে পড়ছে। নির্মাণসামগ্রীসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে মহাসড়কে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে যানজট বেড়েছে। যান চলাচলের সময় ধুলায় অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক। কিছু স্থানে কালভার্ট তৈরির জন্য গর্ত করা হয়েছে।
প্রকল্পের শুরুতে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সে অনুযায়ী এত দিনে পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়ে যেত। প্রকল্প কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিন ঘুরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কয়েকটি কারণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রকল্পের কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ না করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া একটা বড় কারণ। চার লেনের ঠিকাদার নিয়োগ হয় ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। আর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পায় ২০১১ সালের নভেম্বরে। ঠিকাদারেরা ১৬৫ কোটি টাকা অগ্রিম নিলেও পরামর্শক নিয়োগ না হওয়ার অজুহাতে এক বছর কোনো কাজ করেননি। আবার প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ঠিকাদারেরাও দেরি করে যন্ত্রপাতি এবং মালামাল সংগ্রহ করেন।
পরামর্শক নিয়োগে সওজের ব্যর্থতা ও ঠিকাদারদের গাফিলতি ঢাকতে কাজের শুরুতেই অবাধে পাহাড় কাটা শুরু করেন ঠিকাদারেরা। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর অবাধে পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে কাজ বন্ধ থাকে। এরপর আবার শর্তসাপেক্ষে পাহাড় কাটার অনুমোদন দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এই শর্ত অমান্য করায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও পরিবেশ অধিদপ্তর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সরেজমিন ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার লেন প্রকল্পের নাম করে অনেকেই পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরও কাজ শুরু হয়নি। এখন দেখা দিয়েছে অর্থসংকট। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের দাবি, ঠিকাদারেরা ১০৫ কোটি টাকা বিল পাবেন। টাকা দেওয়া যাচ্ছে না বলে তাঁরা কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন। আরেকটি কারণ হচ্ছে, এখনো জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি।
এর আগে দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৬ সালে চার লেন প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া ও ২০০৮ সালে দরপত্র বাতিল করা হয়েছিল।
জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক ইবনে আলম হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মাটির সংকটের কারণে কাজের গতি কমেছে। অর্থসংকট কেটে যাবে। আর বর্ষা মৌসুমে এমনিতেও কাজ কম হয়। সময়মতো কাজ শেষ করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’
প্রকল্পের অগ্রগতি: প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চার লেন প্রকল্পের মোট কাজের মধ্যে মাটির কাজের অংশ মাত্র ১২ শতাংশ। এই কাজের ৭২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। সঙ্গে কিছু ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণের কাজও রয়েছে। মাটি ও কালভার্টের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হওয়ার পর বালু, ইট-বালুর সংমিশ্রণের বিভিন্ন স্তর দিতে হবে। এরপর হবে পিচ ঢালাইয়ের কাজ।
কাগজে-কলমে সময় আছে আর দেড় বছর। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৃষ্টি-বর্ষায় কাজ একেবারে বন্ধ থাকে। অতি গরমেও কাজের গতি কমে যায়। সে হিসেবে, আগামী দেড় বছরের মধ্যে পুরোদমে কাজ করার সময় পাওয়া যাবে বড়জোর আট থেকে দশ মাস। এই সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে না। ফলে ব্যয় আরও বাড়বে।
প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পর্যন্ত চার লেন প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৪৮৪ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হলে আগামী দুই অর্থবছরে বরাদ্দ দিতে হবে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এই সময়ের মধ্যে বিশাল অঙ্কের বরাদ্দ পাওয়া এবং পেলেও খরচ করা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার। আর এই অসাধ্য সাধন করতে না পারলে বর্তমান সরকারের আমলে চার লেন প্রকল্প যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের প্রায় পুরোটাই সওজের জমিতে হচ্ছে। মাত্র ৩৫ একর ভূমি ব্যক্তি-মালিকানাধীন এবং সেটা অধিগ্রহণ করার কথা। কিন্তু এখনো তা করা হয়নি।
সরেজমিন: গত সোমবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চার লেন প্রকল্পের কাজ ঘুরে দেখা গেছে, দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চার লেনে উন্নীত করার কাজ বলতে কেবল মাটি ফেলা এবং ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণ। মাটি ফেলার কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। গড়ে ১২ ফুট পর্যন্ত মাটি ফেলার কথা, এখন পর্যন্ত ছয় থেকে আট ফুট উঁচু করে মাটি ফেলা হয়েছে। দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ বাজার, মিরসরাই বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে চার লেন করার কাজের কোনো চিহ্নই নেই।
সওজ সূত্র জানায়, ১৯২ কিলোমিটার প্রকল্প এলাকার মধ্যে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় কোনো কাজই হয়নি। প্রকল্প এলাকায় অবৈধ স্থাপনা থাকায় এবং কিছু এলাকায় জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় এসব স্থানে কাজ শুরু হয়নি বলে ঠিকাদার ও সওজের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম গেটের কাছে প্রকল্প এলাকায় ক্রিসেন্ট মার্কেট এখনো সরানো হয়নি। এই মার্কেটের মালিকানা নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সওজের দ্বন্দ্ব রয়েছে। মিরসরাইয়ে চার লেন প্রকল্পের জায়গায় তিনতলা ভবনও দেখা গেছে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রায় এক হাজার ১৬৫ কোটি টাকায় এই প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত ১৯২ কিলোমিটার পথ দুই থেকে চার লেনে উন্নীত করা হবে। ১০ ভাগে ভাগ করে এই কাজের সাতটি ভাগের কাজ পেয়েছে চীনা কোম্পানি সিনোহাইড্রো। বাংলাদেশের রেজা কনস্ট্রাকশন দুটি ও তাহের ব্রাদার্স একটি ভাগের কাজ পেয়েছে।
অর্থসংকট: সওজ সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন উন্নীতকরণ প্রকল্প দেশীয় অর্থে নেওয়া। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। ৪০০ কোটি টাকা জাপান ঋণ মওকুফ তহবিলের এবং বাকি অর্থ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন।
সওজ ও ঠিকাদারি সূত্র জানায়, প্রকল্প চালু হওয়ার পর অর্থসংকট হয়নি। চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পে ১৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু এই টাকা খরচ হয়ে আরও ১০৫ কোটি টাকা বকেয়া হয়ে গেছে। ঠিকাদারেরা এই অর্থের জন্য কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন। নিয়মানুযায়ী, ঠিকাদারেরা বিল জমা দেওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে টাকা দেওয়ার কথা। অনেক বিল ২৮ দিন পেরিয়ে গেছে।
সিনোহাইড্রোর একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, চার লেন প্রকল্পের সাতটি ভাগের কাজে চীনা ২০০ এবং দেশীয় প্রায় এক হাজার লোক নিয়োজিত ছিল। বিল আটকে থাকায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের আপত্তি এবং বৃষ্টির কারণে মার্চের পর থেকে তাদের কাজ বন্ধ আছে। অধিকাংশ চীনা কর্মকর্তা দেশে চলে গেছে। এ দেশীয়দেরও ছুটি দেওয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা জানান, আগামী তিন-চার মাস বৃষ্টি থাকবে। এ সময় আর কাজ করা যাবে না। ফাঁকে ফাঁকে কিছু কালভার্টেও কাজ করার চেষ্টা করা হবে। পুরোদমে কাজ শুরু হবে আগামী অক্টোবর থেকে। একই কথা জানিয়েছে রেজা কনস্ট্রাকশন ও তাহের ব্রাদার্সের কর্মকর্তারাও।
সেতু-ফ্লাইওভারের কাজই শুরু হয়নি: চার লেন প্রকল্পের অধীনে ছয়টি সেতু, তিনটি ফ্লাইওভার (উড়ালসড়ক) নির্মাণ হওয়ার কথা। কিন্তু এগুলোর কোনোটারই কাজ শুরু হয়নি। সওজ সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রোজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেড (পিবিএল) ও ভারতের গ্যানন ডেনকারলি নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩৭৫ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে। তবে শুষ্ক মৌসুম আসার আগে সেতু ও উড়ালসড়কের কাজ শুরু হচ্ছে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আনা-নেওয়ার সময় আরও কমিয়ে আনার জন্য ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রতিফলন নেই।
বাংলাদেশ নিট পোশাক মাালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে আমরা এত কথা বলছি, অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম যোগাযোগব্যবস্থা ভালো করাটাই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সেটা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘এ রকম এক প্রকল্পই আমরা শেষ করতে পারছি না, অথচ আমরা কোটি কোটি ডলারের বিশাল বিশাল প্রকল্পের স্বপ্ন দেখছি।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বিদ্যমান সড়কের পাশে মাটির স্তূপ করে রাখা হয়েছে। মাটি এসে মহাসড়কে পড়ছে। নির্মাণসামগ্রীসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে মহাসড়কে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে যানজট বেড়েছে। যান চলাচলের সময় ধুলায় অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক। কিছু স্থানে কালভার্ট তৈরির জন্য গর্ত করা হয়েছে।
প্রকল্পের শুরুতে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সে অনুযায়ী এত দিনে পিচ ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়ে যেত। প্রকল্প কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিন ঘুরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কয়েকটি কারণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে প্রকল্পের কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ না করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া একটা বড় কারণ। চার লেনের ঠিকাদার নিয়োগ হয় ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। আর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ পায় ২০১১ সালের নভেম্বরে। ঠিকাদারেরা ১৬৫ কোটি টাকা অগ্রিম নিলেও পরামর্শক নিয়োগ না হওয়ার অজুহাতে এক বছর কোনো কাজ করেননি। আবার প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ঠিকাদারেরাও দেরি করে যন্ত্রপাতি এবং মালামাল সংগ্রহ করেন।
পরামর্শক নিয়োগে সওজের ব্যর্থতা ও ঠিকাদারদের গাফিলতি ঢাকতে কাজের শুরুতেই অবাধে পাহাড় কাটা শুরু করেন ঠিকাদারেরা। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর অবাধে পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে কাজ বন্ধ থাকে। এরপর আবার শর্তসাপেক্ষে পাহাড় কাটার অনুমোদন দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এই শর্ত অমান্য করায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে আবারও পরিবেশ অধিদপ্তর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সরেজমিন ও স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার লেন প্রকল্পের নাম করে অনেকেই পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরও কাজ শুরু হয়নি। এখন দেখা দিয়েছে অর্থসংকট। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের দাবি, ঠিকাদারেরা ১০৫ কোটি টাকা বিল পাবেন। টাকা দেওয়া যাচ্ছে না বলে তাঁরা কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন। আরেকটি কারণ হচ্ছে, এখনো জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি।
এর আগে দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৬ সালে চার লেন প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগপ্রক্রিয়া ও ২০০৮ সালে দরপত্র বাতিল করা হয়েছিল।
জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক ইবনে আলম হাসান প্রথম আলোকে বলেন, মাটির সংকটের কারণে কাজের গতি কমেছে। অর্থসংকট কেটে যাবে। আর বর্ষা মৌসুমে এমনিতেও কাজ কম হয়। সময়মতো কাজ শেষ করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’
প্রকল্পের অগ্রগতি: প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চার লেন প্রকল্পের মোট কাজের মধ্যে মাটির কাজের অংশ মাত্র ১২ শতাংশ। এই কাজের ৭২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। সঙ্গে কিছু ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণের কাজও রয়েছে। মাটি ও কালভার্টের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হওয়ার পর বালু, ইট-বালুর সংমিশ্রণের বিভিন্ন স্তর দিতে হবে। এরপর হবে পিচ ঢালাইয়ের কাজ।
কাগজে-কলমে সময় আছে আর দেড় বছর। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৃষ্টি-বর্ষায় কাজ একেবারে বন্ধ থাকে। অতি গরমেও কাজের গতি কমে যায়। সে হিসেবে, আগামী দেড় বছরের মধ্যে পুরোদমে কাজ করার সময় পাওয়া যাবে বড়জোর আট থেকে দশ মাস। এই সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে না। ফলে ব্যয় আরও বাড়বে।
প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পর্যন্ত চার লেন প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৪৮৪ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হলে আগামী দুই অর্থবছরে বরাদ্দ দিতে হবে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। প্রকল্পের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এই সময়ের মধ্যে বিশাল অঙ্কের বরাদ্দ পাওয়া এবং পেলেও খরচ করা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার। আর এই অসাধ্য সাধন করতে না পারলে বর্তমান সরকারের আমলে চার লেন প্রকল্প যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের প্রায় পুরোটাই সওজের জমিতে হচ্ছে। মাত্র ৩৫ একর ভূমি ব্যক্তি-মালিকানাধীন এবং সেটা অধিগ্রহণ করার কথা। কিন্তু এখনো তা করা হয়নি।
সরেজমিন: গত সোমবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চার লেন প্রকল্পের কাজ ঘুরে দেখা গেছে, দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চার লেনে উন্নীত করার কাজ বলতে কেবল মাটি ফেলা এবং ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণ। মাটি ফেলার কাজও পুরোপুরি শেষ হয়নি। গড়ে ১২ ফুট পর্যন্ত মাটি ফেলার কথা, এখন পর্যন্ত ছয় থেকে আট ফুট উঁচু করে মাটি ফেলা হয়েছে। দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ বাজার, মিরসরাই বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে চার লেন করার কাজের কোনো চিহ্নই নেই।
সওজ সূত্র জানায়, ১৯২ কিলোমিটার প্রকল্প এলাকার মধ্যে প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় কোনো কাজই হয়নি। প্রকল্প এলাকায় অবৈধ স্থাপনা থাকায় এবং কিছু এলাকায় জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় এসব স্থানে কাজ শুরু হয়নি বলে ঠিকাদার ও সওজের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম গেটের কাছে প্রকল্প এলাকায় ক্রিসেন্ট মার্কেট এখনো সরানো হয়নি। এই মার্কেটের মালিকানা নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সওজের দ্বন্দ্ব রয়েছে। মিরসরাইয়ে চার লেন প্রকল্পের জায়গায় তিনতলা ভবনও দেখা গেছে।
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রায় এক হাজার ১৬৫ কোটি টাকায় এই প্রকল্পের ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রামের সিটি গেট পর্যন্ত ১৯২ কিলোমিটার পথ দুই থেকে চার লেনে উন্নীত করা হবে। ১০ ভাগে ভাগ করে এই কাজের সাতটি ভাগের কাজ পেয়েছে চীনা কোম্পানি সিনোহাইড্রো। বাংলাদেশের রেজা কনস্ট্রাকশন দুটি ও তাহের ব্রাদার্স একটি ভাগের কাজ পেয়েছে।
অর্থসংকট: সওজ সূত্র জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন উন্নীতকরণ প্রকল্প দেশীয় অর্থে নেওয়া। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। ৪০০ কোটি টাকা জাপান ঋণ মওকুফ তহবিলের এবং বাকি অর্থ সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন।
সওজ ও ঠিকাদারি সূত্র জানায়, প্রকল্প চালু হওয়ার পর অর্থসংকট হয়নি। চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পে ১৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। কিন্তু এই টাকা খরচ হয়ে আরও ১০৫ কোটি টাকা বকেয়া হয়ে গেছে। ঠিকাদারেরা এই অর্থের জন্য কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছেন। নিয়মানুযায়ী, ঠিকাদারেরা বিল জমা দেওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে টাকা দেওয়ার কথা। অনেক বিল ২৮ দিন পেরিয়ে গেছে।
সিনোহাইড্রোর একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, চার লেন প্রকল্পের সাতটি ভাগের কাজে চীনা ২০০ এবং দেশীয় প্রায় এক হাজার লোক নিয়োজিত ছিল। বিল আটকে থাকায়, পরিবেশ অধিদপ্তরের আপত্তি এবং বৃষ্টির কারণে মার্চের পর থেকে তাদের কাজ বন্ধ আছে। অধিকাংশ চীনা কর্মকর্তা দেশে চলে গেছে। এ দেশীয়দেরও ছুটি দেওয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা জানান, আগামী তিন-চার মাস বৃষ্টি থাকবে। এ সময় আর কাজ করা যাবে না। ফাঁকে ফাঁকে কিছু কালভার্টেও কাজ করার চেষ্টা করা হবে। পুরোদমে কাজ শুরু হবে আগামী অক্টোবর থেকে। একই কথা জানিয়েছে রেজা কনস্ট্রাকশন ও তাহের ব্রাদার্সের কর্মকর্তারাও।
সেতু-ফ্লাইওভারের কাজই শুরু হয়নি: চার লেন প্রকল্পের অধীনে ছয়টি সেতু, তিনটি ফ্লাইওভার (উড়ালসড়ক) নির্মাণ হওয়ার কথা। কিন্তু এগুলোর কোনোটারই কাজ শুরু হয়নি। সওজ সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রোজেক্ট বিল্ডার্স লিমিটেড (পিবিএল) ও ভারতের গ্যানন ডেনকারলি নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩৭৫ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে। তবে শুষ্ক মৌসুম আসার আগে সেতু ও উড়ালসড়কের কাজ শুরু হচ্ছে না।
No comments