তথ্য অধিকার আইন-এক বছরে কী কাজ হলো? by মশিউল আলম

কদিন আগে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তথ্য অধিকার আইন পাসের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সরকারের তথ্যমন্ত্রী, তথ্যসচিব, তথ্য কমিশনের সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রেসক্লাবের সভাপতি, তথ্য অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংস্থার নেতৃবৃন্দ, আইনবিদ, অধ্যাপক এবং সাংবাদিকেরা সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।


মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে একটি সেমিনার পেপার উপস্থাপন করা হলো, যার শিরোনাম ছিল ‘এক বছরে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯: বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ কর্মকৌশল’। সেই পেপারের ওপর বিভিন্ন বক্তা নিজেদের মতামত ব্যক্ত করলেন। তথ্য কমিশনের সচিব তাঁদের কমিশনের লোকবল নিয়োগ ইত্যাদি প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানালেন। কিন্তু আইনটি জাতীয় সংসদে গৃহীত (২৯ মার্চ ২০০৯) ও দেশজুড়ে তা কার্যকর হওয়ার (১ জুলাই ২০০৯) পর থেকে এই এক বছরে দেশের কতজন নাগরিক তথ্য চেয়ে আবেদন করেছেন, কতজন প্রার্থিত তথ্য পেয়েছেন, কতজন পাননি, কতজন তথ্য না পেয়ে তথ্য কমিশনের কাছে আপিল করেছেন, তথ্য কমিশন সেসব আপিলের শুনানি করেছে কি না—এই গোড়ার প্রশ্নগুলোই কারোর মুখে উচ্চারিত হলো না। তথ্য অধিকার আইন কত উপকারী বস্তু, এ আইন প্রয়োগ করে সমাজ, রাষ্ট্র, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কতখানি স্বচ্ছ, জবাবদিহিপূর্ণ, দায়িত্বশীল করা যায়, গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটানো যায়, গণমানুষের ক্ষমতায়ন ঘটানো যায়, দুর্নীতি লাঘব করা যায়—এই সমস্ত পুরোনো কথা, যা আমরা প্রায় আট বছর ধরে বলে আসছি, সেগুলোরই পুনরাবৃত্তি চলল।
অবশ্য কিছু কাজের কথাও জানা গেল। যেমন, ওই সেমিনার পেপারে দেওয়া তথ্য: ‘ইতোমধ্যে তথ্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। বিধি ও প্রবিধান চূড়ান্তকরণ ও প্রকাশের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। তথ্য কমিশন বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসন, বেসরকারি, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সুশীল সমাজ, সংবাদকর্মী ও স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের তথ্য অধিকার আইন অবহিতকরণ সভার আয়োজন করেছে। প্রায় তিন হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে আইনবিষয়ক অবহিতকরণ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে (তথ্য প্রদানের) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তালিকা-সম্পর্কিত ডেটাবেইজ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং কাজটি চলমান আছে। তথ্য মন্ত্রণালয় আইনটির বিষয়ে তথ্য কর্মকর্তাদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করে।’
সরকারি পর্যায়ে এই হলো এক বছরের অগ্রগতি! বিস্ময়কর হলো, এই আইনটির বিধিমালা ও প্রবিধানমালা তৈরি ও প্রকাশের কাজটি সম্পন্ন হতেই সময় লেগে গেল এক বছর। ভারতে এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল আইন গৃহীত হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে। বিধিমালা ও প্রবিধান তৈরি না-হওয়া পর্যন্ত তথ্য কমিশন কার্যত তার মূল কাজ শুরু করতে পারে না, সেটা তারা আসলেই করতে পারেনি। তথ্য কমিশনাররা জেলায় জেলায় গিয়ে আইনটি সম্পর্কে অবহিতকরণ সভা করছেন। গত সাত-আট মাস ধরে এটিই তথ্য কমিশনের প্রধান কাজ বলে জেনেছি। কিন্তু এটি তথ্য কমিশনের কার‌্যাবলির তালিকায় দশ নম্বর কাজ।
আইন বাস্তবায়নের জন্য প্রথমেই যা দরকার তা হলো তথ্য প্রদানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সৃষ্ট সকল সংস্থা, সরকারের সব মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সকল বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তরসহ সমস্ত অফিস, বেসরকারি যেসব সংস্থা/প্রতিষ্ঠান সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হয় বা সরকারি তহবিল থেকে সাহায্য পায়, যেসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বিদেশি সাহায্য পায়—এমন সকল কর্তৃপক্ষের প্রত্যেক তথ্য প্রদান ইউনিটের জন্য একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান স্পষ্টভাবে আইনে লেখা রয়েছে। নাগরিকেরা এসব দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছেই তথ্য চেয়ে আবেদন করবেন। গত এক বছরে, সরকারের দেওয়া হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে মাত্র এক হাজার ৬০০। সরকারের সব দপ্তরের মোট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা হবে সাত লাখের বেশি। তাহলে এক বছরে কতটুকু কাজ হলো এই ক্ষেত্রে? আইনে কিন্তু পরিষ্কার ভাষায় সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে: এই আইন জারির ষাট দিনের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। ষাট দিন মানে দুই মাস। কিন্তু ১ জুলাই আইন কার্যকর হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে আট মাস। সরকারি পর্যায়ে যেমন, বেসরকারি পর্যায়েও তেমন। দেশে কর্মরত প্রায় আড়াই হাজার এনজিওর মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে মাত্র ৩২টিতে। কী আশ্চর্য, যেসব এনজিও তথ্য অধিকার আইনের দাবিতে আন্দোলন করেছে, আইনটি পাস হয়ে যাওয়ার পর তারাই এখন নিজ নিজ সংস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করছে না। মনে হয়, তাদের এই অনীহার একটা অর্থ আছে। এতে বোঝা যায়, জনগণের তথ্য পাওয়ার অধিকারের ব্যাপারে এই এনজিওগুলি আন্তরিক নয়; সোজা কথায়, তারা নিজেদের সম্পর্কে জনগণকে তথ্য জানাতে আগ্রহী নয়। দাতাগোষ্ঠীর অর্থে তারা তথ্য অধিকার আইনের পক্ষে নানা রকম সভা-সেমিনার করছে, আইন পাসের পর অনেক এনজিও তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে জনঅবহিতকরণমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নিজেদের অঙ্গীকারের আন্তরিকতাই তারা দেখাচ্ছে না। তারা যদি আন্তরিক হতো তাহলে ৩২টি নয়, অন্তত ৮০টি এনজিও আইন জারির ষাট দিনের মধ্যেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারত। কারণ কমপক্ষে ৮০টি এনজিও তথ্য অধিকার আইন পাসের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
লক্ষ করা দরকার, তথ্য প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য নতুন লোকবলের প্রয়োজন নেই, প্রতিটি দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই কোনো একজনকে এই দায়িত্ব দেওয়ার কথা। এতে বাড়তি কোনো খরচের বিষয় নেই, যার কারণে এই নিয়োগে এত বিলম্ব হতে পারে। আইনে যে ষাট দিন সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তা নিশ্চয়ই এ বিষয়টি মাথায় রেখেই। তাহলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে তথ্য প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে গাফিলতি, শিথিলতা, অনীহা ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?
যতটা উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে আমরা তথ্য অধিকার আইনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিলাম, আইনটি পাস হওয়ার পর তার বাস্তবায়নে তত উৎসাহ-উদ্দীপনা কোনো তরফেই লক্ষ করা যাচ্ছে না। আগে দুটি পক্ষ ছিল: সরকার ও নাগরিক সমাজ। সরকারের কাছে নাগরিক সমাজ আইনটি গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছিল, সরকারগুলো দেব-দিচ্ছি করে সময় পার করছিল। ২০০২ সাল থেকে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বলে আসছিল, এই আইন হয়ে যাচ্ছে, আর দেরি হবে না। প্রতিবছর মে মাসে বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসের অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বক্তৃতায় নানা রকম আশ্বাস দিতেন। এভাবে তাঁরা তাঁদের মেয়াদ পার করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদের বিশেষ আগ্রহে তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ ২০০৮ জারি হলে একটা বড় অগ্রগতি ঘটে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সেই অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত করে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই। সে জন্য এই সরকার নিজে অনেক গৌরব করে, নাগরিক সমাজও তার অনেক প্রশংসা করে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সেদিনের অনুষ্ঠানেও এ জন্য সরকারের অনেক প্রশংসা করা হয়। আমরা সম্পাদকীয় লিখে, উপ-সম্পাদকীয় লিখে সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েছি অনেকবার। নাগরিক সমাজের তরফ থেকে সরকারের প্রতি এখন আর সে রকম দাবি-দাওয়া নেই যেটাকে আন্দোলন বলা যায়, আইন পাসের দাবিতে যে রকম চলেছিল। এখন সরকার ও নাগরিক সমাজ অভিন্ন পক্ষ। তাই তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে এক বছরের অর্জন বা অগ্রগতির নিষ্প্রভ চিত্র নিয়ে খুব একটা আওয়াজ নেই।
তাহলে কি এমন ঢিলেঢালা গতিতেই চলবে তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের কাজ? ভারতে আইনটি কার্যকর হওয়ার পর এক বছরে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের কাছে আপিল করেছিলেন দুই হাজারের বেশি নাগরিক, যাঁরা তথ্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তথ্য কমিশনের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। মোট তথ্যপ্রার্থী আবেদনকারীর সংখ্যা প্রায় সত্তর হাজার। আর আমাদের কী দুর্ভাগ্য, দেশের প্রথম প্রধান তথ্য কমিশনার এ আজিজুর রহমানের সৌভাগ্য হলো না একটি আপিলেরও শুনানি করার। কোনো নাগরিক তথ্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তথ্য কমিশনের কাছে আপিল নিয়ে হাজির হওয়ার আগেই প্রথম প্রধান তথ্য কমিশনারের চাকরির বয়সসীমা পার হয়ে গেছে, তিনি বিদায় নিয়েছেন। নতুন প্রধান তথ্য কমিশনার হিসেবে যোগ দিয়েছেন সাবেক সচিব ও কূটনীতিক মোহাম্মদ জমির। একটি সংবাদের অপেক্ষা করছি: তাঁর নেতৃত্বে তথ্য কমিশন একজন তথ্যপ্রার্থী নাগরিকের আপিল পেয়ে শুনানি করেছেন এবং সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তথ্য কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই নাগরিককে তাঁর প্রার্থিত তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে। এমন একটি সংবাদ শিরোনামের জন্য আমাদের কত দিন অপেক্ষা করতে হবে?
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.