প্রতিক্রিয়া-‘বঙ্গবন্ধু’ বনাম ‘শহীদ জিয়া’ by মোজ্জাম্মেল খান
অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু’ বনাম ‘শহীদ জিয়া’ শিরোনামের লেখাটিতে অনেক সুন্দর উদাহরণ, উপাত্ত ও যুক্তি দিয়ে এক ধরনের ‘নিরপেক্ষতা’ বজায় রাখার চেষ্টা নিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সমর্থক ও ‘শহীদ জিয়া’র সমর্থকদের একই মাপের দোষে দোষী হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন।
প্রথমেই তিনি প্রয়াত জিয়াউর রহমানকে ‘শহীদ’ জিয়া হিসেবে বিএনপির দেওয়া বিশেষণই মেনে নিয়েছেন। প্রয়াত কোন ব্যক্তিকে ‘শহীদ’ হিসেবে উল্লেখ করা হবে, আর কাকে করা হবে না, সে ব্যাপারে আমার খুব পরিষ্কার ধারণা নেই। তবে সাধারণত ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণ-আন্দোলনসহ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা আত্মদান করেছেন, তাঁদের সবাইকে শহীদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রয়াত জিয়াকে শহীদ হিসেবে উল্লেখ করলে প্রয়াত খালেদ মোশাররফ, কর্নেল তাহের, মেজর হায়দার বা একইভাবে যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের সবাইকে কি তিনি ‘শহীদ’ হিসেবে উল্লেখ করবেন?
তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু জিয়াকে স্নেহ করতেন, জিয়া বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করতেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার একটি বাজে শব্দ উচ্চারণ করেনি জিয়া সম্পর্কে। জিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পর কোনো দিন কখনো খারাপ মন্তব্য করেননি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে।’ এ কথাগুলোর সবই কি সত্য? বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় জিয়া ছিলেন সামরিক বাহিনীর উপপ্রধান আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন সরকারপ্রধান। জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু অপেক্ষাকৃত কম বয়সী সবাইকে স্নেহ করতেন। বর্তমান ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর একটি বইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নৈশভোজের পর এক কথোপকথনে জিয়া বঙ্গবন্ধুকে তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন (স্মৃতি থেকে লিখছি), ‘স্যার, আপনার বুকে কোনো গুলি লাগার আগে সে গুলি আমার বুকের ভেতর দিয়ে যেতে হবে।’ সময়কালে জিয়া সে আশ্বাসের মর্যাদা কতটুকু রেখেছিলেন, সেটা ইতিহাসের প্রতিপাদ্য। বঙ্গবন্ধু সরকারপ্রধান থাকা অবস্থায় তাঁর প্রতি জিয়ার সম্মান স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনিক। কিন্তু জিয়ার প্রশাসনে সব সময়েই সরকারি প্রচারমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তো দূরের কথা, শেখ মুজিব নামটিও নিষিদ্ধ ছিল। আমার মনে আছে, ১৯৭৭ সালে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের একটি প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত টাকার নোট আমরা দিয়েছিলাম। তখন দেশ থেকে সদ্য আসা একটি ছাত্র বলল, ‘আরে, এ আপনারা কী করছেন, দেশে তো এ ছবিসংবলিত টাকা নিষিদ্ধ।’ এর মাধ্যমে কি প্রমাণ হয়, ‘জিয়া বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করতেন?’
আজকে যে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নিরন্তর বিকৃতিতে ব্যস্ত, তার শুরু কি জিয়ার শাসনামলেই শুরু হয়নি? আজকে যে বিএনপির নেতারা জিয়াকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, তার শুরু কি জিয়ার শাসনামলেই শুরু হয়নি? অধ্যাপক নজরুল কি অস্বীকার করবেন, বিএনপির শাসনামলেই অতিশয়োক্তি দিয়ে জিয়াকে আমাদের মহান মুক্তি-সংগ্রামের একমাত্র নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। স্যাটেলাইট টিভির বদৌলতে ২০০৬ সালের স্বাধীনতা দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্র্রচারে দেখেছিলাম, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের একটি ছবির বিপরীতে পুরো স্টেডিয়ামে জিয়াউর রহমানের শত শত ছবি শোভা পাচ্ছে; অন্য কারও উপস্থিতি সেখানে নেই। এ ধরনের চরম ইতিহাস বিকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার সত্যিকার অবদান সম্পর্কেও তাচ্ছিল্যকর মন্তব্য করে ফেলেন। এ তাচ্ছিল্য সৃষ্টির কারণ, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিএনপির নেতাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য। এর বিপরীতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কি প্রচারমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অতিশয়োক্তি করছে?
জিয়ার ২৭ মার্চের বেতার ঘোষণার (যেটাকে বিএনপি ২৬ মার্চ বানিয়েছে) গুরুত্ব (যেটা তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিয়েছিলেন) কি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা অস্বীকার করেছেন? অধ্যাপক নজরুল জিয়ার ঘোষণা সম্পর্কে এ কে খন্দকারের অতীব ইতিবাচক বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ওই উক্তির পরও তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রী। এটা কি প্রমাণ করে না, তাঁর উক্তির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো বিরোধ নেই?
অধ্যাপক নজরুল লিখেছেন, ‘জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত করা হয় আজকাল।’ কিন্তু এর পক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই। যেহেতু অধ্যাপক নজরুল আইনের শিক্ষক, আমি তাঁর ছাত্র হলে জানতে চাইতাম, ‘পারিপার্শ্বিক প্রমাণ’ (circumstantial evidence) কি প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়? আত্মস্বীকৃত খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দেওয়া, সংবিধানে তাঁদের খুনের ইনডেমনিটি দেওয়া কি ‘পারিপার্শ্বিক প্রমাণ’-এর পরিধির আওতায় পড়ে না? এ ধরনের ‘পারিপার্শ্বিক প্রমাণ’ দিয়ে আদালতে খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
আমি অধ্যাপক নজরুলের সঙ্গে একমত, বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের ‘অবিনশ্বর’ ও মহত্তম পুরুষ। তাঁর অবদানের উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে আর যাঁদের কথা আসবে, তাঁদের কথা বলার পর কোনো আলোচনায় খুব কম সময়ই বাকি থাকবে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কিছু বলার। ভালো বা মন্দ যা-ই হোক না কেন, না বুঝে এটা যাঁরা করেন, তাঁরা প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধুকে অবমূল্যায়নই করেন।
মোজ্জাম্মেল খান: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, শেরিডান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, টরন্টো, কানাডা।
তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু জিয়াকে স্নেহ করতেন, জিয়া বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করতেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার একটি বাজে শব্দ উচ্চারণ করেনি জিয়া সম্পর্কে। জিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পর কোনো দিন কখনো খারাপ মন্তব্য করেননি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে।’ এ কথাগুলোর সবই কি সত্য? বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় জিয়া ছিলেন সামরিক বাহিনীর উপপ্রধান আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন সরকারপ্রধান। জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু অপেক্ষাকৃত কম বয়সী সবাইকে স্নেহ করতেন। বর্তমান ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর একটি বইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নৈশভোজের পর এক কথোপকথনে জিয়া বঙ্গবন্ধুকে তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন (স্মৃতি থেকে লিখছি), ‘স্যার, আপনার বুকে কোনো গুলি লাগার আগে সে গুলি আমার বুকের ভেতর দিয়ে যেতে হবে।’ সময়কালে জিয়া সে আশ্বাসের মর্যাদা কতটুকু রেখেছিলেন, সেটা ইতিহাসের প্রতিপাদ্য। বঙ্গবন্ধু সরকারপ্রধান থাকা অবস্থায় তাঁর প্রতি জিয়ার সম্মান স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনিক। কিন্তু জিয়ার প্রশাসনে সব সময়েই সরকারি প্রচারমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু তো দূরের কথা, শেখ মুজিব নামটিও নিষিদ্ধ ছিল। আমার মনে আছে, ১৯৭৭ সালে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের একটি প্রদর্শনীতে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত টাকার নোট আমরা দিয়েছিলাম। তখন দেশ থেকে সদ্য আসা একটি ছাত্র বলল, ‘আরে, এ আপনারা কী করছেন, দেশে তো এ ছবিসংবলিত টাকা নিষিদ্ধ।’ এর মাধ্যমে কি প্রমাণ হয়, ‘জিয়া বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করতেন?’
আজকে যে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নিরন্তর বিকৃতিতে ব্যস্ত, তার শুরু কি জিয়ার শাসনামলেই শুরু হয়নি? আজকে যে বিএনপির নেতারা জিয়াকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, তার শুরু কি জিয়ার শাসনামলেই শুরু হয়নি? অধ্যাপক নজরুল কি অস্বীকার করবেন, বিএনপির শাসনামলেই অতিশয়োক্তি দিয়ে জিয়াকে আমাদের মহান মুক্তি-সংগ্রামের একমাত্র নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। স্যাটেলাইট টিভির বদৌলতে ২০০৬ সালের স্বাধীনতা দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্র্রচারে দেখেছিলাম, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের একটি ছবির বিপরীতে পুরো স্টেডিয়ামে জিয়াউর রহমানের শত শত ছবি শোভা পাচ্ছে; অন্য কারও উপস্থিতি সেখানে নেই। এ ধরনের চরম ইতিহাস বিকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার সত্যিকার অবদান সম্পর্কেও তাচ্ছিল্যকর মন্তব্য করে ফেলেন। এ তাচ্ছিল্য সৃষ্টির কারণ, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিএনপির নেতাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য। এর বিপরীতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কি প্রচারমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অতিশয়োক্তি করছে?
জিয়ার ২৭ মার্চের বেতার ঘোষণার (যেটাকে বিএনপি ২৬ মার্চ বানিয়েছে) গুরুত্ব (যেটা তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে দিয়েছিলেন) কি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা অস্বীকার করেছেন? অধ্যাপক নজরুল জিয়ার ঘোষণা সম্পর্কে এ কে খন্দকারের অতীব ইতিবাচক বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। ওই উক্তির পরও তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রী। এটা কি প্রমাণ করে না, তাঁর উক্তির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো বিরোধ নেই?
অধ্যাপক নজরুল লিখেছেন, ‘জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত করা হয় আজকাল।’ কিন্তু এর পক্ষে কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই। যেহেতু অধ্যাপক নজরুল আইনের শিক্ষক, আমি তাঁর ছাত্র হলে জানতে চাইতাম, ‘পারিপার্শ্বিক প্রমাণ’ (circumstantial evidence) কি প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়? আত্মস্বীকৃত খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দেওয়া, সংবিধানে তাঁদের খুনের ইনডেমনিটি দেওয়া কি ‘পারিপার্শ্বিক প্রমাণ’-এর পরিধির আওতায় পড়ে না? এ ধরনের ‘পারিপার্শ্বিক প্রমাণ’ দিয়ে আদালতে খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
আমি অধ্যাপক নজরুলের সঙ্গে একমত, বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের ‘অবিনশ্বর’ ও মহত্তম পুরুষ। তাঁর অবদানের উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে আর যাঁদের কথা আসবে, তাঁদের কথা বলার পর কোনো আলোচনায় খুব কম সময়ই বাকি থাকবে জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কিছু বলার। ভালো বা মন্দ যা-ই হোক না কেন, না বুঝে এটা যাঁরা করেন, তাঁরা প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধুকে অবমূল্যায়নই করেন।
মোজ্জাম্মেল খান: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, শেরিডান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, টরন্টো, কানাডা।
No comments