বখাটের উপদ্রব-আত্মহত্যার বিকল্পের সন্ধান দিতে হবে আমাদেরই
বখাটেদের উপদ্রবের শিকার হওয়া, তা থেকে নিস্তার পাওয়ার সম্ভাব্য সব উপায় অন্বেষণের পরও তার কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় কিশোরী অথবা তরুণীর নিজের জন্য, পরিবারের জন্য নিরুপদ্রব শান্তির উপায় হিসেবে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার সাম্প্রতিক ভয়াবহ প্রবণতায় আমরা দারুণভাবে উদ্বিগ্ন।
নির্যাতিত এই মেয়েরা আত্মহননকে মুক্তির অনিবার্য উপায় বিবেচনা করায় আমরা যেমন উদ্বিগ্ন তেমনি আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার তাদের সামনে এর কোনো উপযুক্ত বিকল্প হাজির করতে পারছে না বলে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ।
আমরা অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ওই কিশোরী বা তরুণীর উদ্দেশে বলি—নিজের জীবনকে কেন শেষ করে দেওয়া? এটা তো কোনো সমাধান নয়! কিন্তু আমরা কি ভুলে গেছি সিমি বানুর কথা? তাঁর প্রতিবাদ, বখাটেদের উত্পীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর ক্রমাগত লড়াই এবং শেষ অবধি আত্মহননকেই প্রতিবাদের চূড়ান্ত উপায় হিসেবে বেছে নেওয়ার কথা? আমরা কি ভুলে গেছি সিমি বানুর প্রতি আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ (এসআই বাশার), রাষ্ট্র, সমাজ এবং তাঁর পরিবারের নেতিবাচক ভূমিকার কথা? বখাটেদের শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে সিমিকেই দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা? মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া সিমির ছোট্ট অথচ সুতীব্র প্রতিবাদের চিরকুট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—শুধু পালানোর পথ হিসেবেই এই মেয়েরা আত্মহননকে বেছে নেয় না, আত্মহননকে প্রতিবাদের অনিবার্য উপায় বলেও মনে করে এবং এর মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থার প্রতি তার চূড়ান্ত অনাস্থার কথাটিও জানিয়ে দেয়।
শুধু সিমি কেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াতেও আমরা বারবার ওই সব কিশোরী-তরুণীকে কি এই বার্তাই দিচ্ছি না যে একমাত্র মৃত্যুর পর তাদের কণ্ঠস্বর আমাদের কান অবধি পৌঁছায়। গণমাধ্যমে মৃত্যুর খবর ওঠার পরই কেবল আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটু নড়েচড়ে ওঠে। আমরাও বসে পড়ি কলম নিয়ে। সেই নড়াচড়াও হয়তো ততটা সময় চলে না, যতটা সময় ওই মৃত্যুর মাতম আকাশে ভেসে বেড়ায়। মৃত্যুর মাতম ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে। কিন্তু তার চেয়েও দ্রুততর সময়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করে বরফকঠিন স্থিরতা।
নির্মম বেদনাদায়ক একেকটি মৃত্যুর পর আমরা দেখি রাষ্ট্রযন্ত্রকে কিঞ্চিত্ সচল হয়ে উঠতে। ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানোর কথা ভাবা হয়, স্কুল গেটে সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েনের কথা চিন্তা করা হয়। কিন্তু বখাটেদের উত্পাত তো আর এখন শুধু রাস্তাঘাট, স্কুল-মার্কেটে সীমাবদ্ধ নেই, তারা ঢুকে গেছে নির্যাতিত মেয়েটির ঘর-বৈঠকখানা অবধি। পুলিশি পন্থায় এটাকে আমরা সামাল দেব কীভাবে? সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে এগুলোর ছিটেফোঁটা ফল দেখা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু যদি অপরাধীর যথাযথ শাস্তি না নয়, যদি দুষ্টের দমন না হয়, যদি ওই সব উত্পীড়নকারী তরুণের বিবেকবোধকে নাড়া না দেওয়া যায় এবং ভুক্তভোগী মেয়েটি পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে যথাযথ মানসিক সমর্থন না পায়, তবে এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হতে বাধ্য। যেমনটি আমরা আগেও দেখেছি।
আজ আমাদের নিবিষ্ট ও আন্তরিকভাবে ভাবতে হবে—সিমি, তৃষা, ফাহিমা, মহিমা, ইলোরা, পিংকি অব্যাহতভাবে এ রকম শত শত নামই কি শুধু যুক্ত হতে থাকবে আমাদের পরিসংখ্যানে? নীরবতা ভেঙে আমরা কি বেরিয়ে আসব না? তৈরি করব না প্রতিবাদের বাঁধভাঙা জোয়ার, গড়ে তুলব না প্রতিরোধের ইস্পাতকঠিন দেয়াল! কিশোরী তরুণী নারীদের জন্য আনন্দপূর্ণ, নিরুপদ্রব এক সমাজ প্রতিষ্ঠা কি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই দায়িত্ব নয়? নির্যাতিত মেয়েদের আত্মহননে নিরুত্সাহিত করতে তাদের সামনে আত্মহননের বিকল্প পথের সন্ধান দিতে হবে আমাদেরই। ইভ টিজিং ও যৌন হয়রানিকে সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে আইনি কাঠামো এবং সেই আইনের যথাযথ ও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশের আলোকে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ গ্রহণ কমিটি গঠন করা দরকার, যেখানে ভুক্তভোগী মেয়েরা নির্বিঘ্নে ও মুক্তভাবে তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারবে। এলাকা ভিত্তিতেও অভিভাবকদের তরফে এমন কমিটির কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার—সবাইকে। পরিবার আর সমাজকে পূর্ণ শক্তি নিয়ে নির্যাতিত মেয়েটির পাশে দাঁড়াতে হবে। দোষী হিসেবে চিহ্নিত করে পুনরায় উত্পীড়নের পরিবর্তে তাকে দিতে হবে মানসিক শক্তি-সমর্থন। উত্পীড়নকারী তরুণদের বিবেকবোধকে নাড়া দিতে সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রকে নিতে হবে আইন প্রণয়ন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং নির্যাতিত মেয়েটির সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব। তখনই কেবল নির্যাতিত ওই মেয়েরা জীবনের পরিসমাপ্তিতে সমাধান নয়, দেখতে পাবে নতুন আলোর দিশা।
লেখকেরা শিক্ষাবিদ, মানবাধিকার কর্মী, উন্নয়নকর্মী ও সাহিত্যিক।
আমরা অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ওই কিশোরী বা তরুণীর উদ্দেশে বলি—নিজের জীবনকে কেন শেষ করে দেওয়া? এটা তো কোনো সমাধান নয়! কিন্তু আমরা কি ভুলে গেছি সিমি বানুর কথা? তাঁর প্রতিবাদ, বখাটেদের উত্পীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর ক্রমাগত লড়াই এবং শেষ অবধি আত্মহননকেই প্রতিবাদের চূড়ান্ত উপায় হিসেবে বেছে নেওয়ার কথা? আমরা কি ভুলে গেছি সিমি বানুর প্রতি আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ (এসআই বাশার), রাষ্ট্র, সমাজ এবং তাঁর পরিবারের নেতিবাচক ভূমিকার কথা? বখাটেদের শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে সিমিকেই দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা? মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া সিমির ছোট্ট অথচ সুতীব্র প্রতিবাদের চিরকুট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—শুধু পালানোর পথ হিসেবেই এই মেয়েরা আত্মহননকে বেছে নেয় না, আত্মহননকে প্রতিবাদের অনিবার্য উপায় বলেও মনে করে এবং এর মাধ্যমে সমাজ, রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থার প্রতি তার চূড়ান্ত অনাস্থার কথাটিও জানিয়ে দেয়।
শুধু সিমি কেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াতেও আমরা বারবার ওই সব কিশোরী-তরুণীকে কি এই বার্তাই দিচ্ছি না যে একমাত্র মৃত্যুর পর তাদের কণ্ঠস্বর আমাদের কান অবধি পৌঁছায়। গণমাধ্যমে মৃত্যুর খবর ওঠার পরই কেবল আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটু নড়েচড়ে ওঠে। আমরাও বসে পড়ি কলম নিয়ে। সেই নড়াচড়াও হয়তো ততটা সময় চলে না, যতটা সময় ওই মৃত্যুর মাতম আকাশে ভেসে বেড়ায়। মৃত্যুর মাতম ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে। কিন্তু তার চেয়েও দ্রুততর সময়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করে বরফকঠিন স্থিরতা।
নির্মম বেদনাদায়ক একেকটি মৃত্যুর পর আমরা দেখি রাষ্ট্রযন্ত্রকে কিঞ্চিত্ সচল হয়ে উঠতে। ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানোর কথা ভাবা হয়, স্কুল গেটে সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েনের কথা চিন্তা করা হয়। কিন্তু বখাটেদের উত্পাত তো আর এখন শুধু রাস্তাঘাট, স্কুল-মার্কেটে সীমাবদ্ধ নেই, তারা ঢুকে গেছে নির্যাতিত মেয়েটির ঘর-বৈঠকখানা অবধি। পুলিশি পন্থায় এটাকে আমরা সামাল দেব কীভাবে? সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে এগুলোর ছিটেফোঁটা ফল দেখা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু যদি অপরাধীর যথাযথ শাস্তি না নয়, যদি দুষ্টের দমন না হয়, যদি ওই সব উত্পীড়নকারী তরুণের বিবেকবোধকে নাড়া না দেওয়া যায় এবং ভুক্তভোগী মেয়েটি পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে যথাযথ মানসিক সমর্থন না পায়, তবে এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হতে বাধ্য। যেমনটি আমরা আগেও দেখেছি।
আজ আমাদের নিবিষ্ট ও আন্তরিকভাবে ভাবতে হবে—সিমি, তৃষা, ফাহিমা, মহিমা, ইলোরা, পিংকি অব্যাহতভাবে এ রকম শত শত নামই কি শুধু যুক্ত হতে থাকবে আমাদের পরিসংখ্যানে? নীরবতা ভেঙে আমরা কি বেরিয়ে আসব না? তৈরি করব না প্রতিবাদের বাঁধভাঙা জোয়ার, গড়ে তুলব না প্রতিরোধের ইস্পাতকঠিন দেয়াল! কিশোরী তরুণী নারীদের জন্য আনন্দপূর্ণ, নিরুপদ্রব এক সমাজ প্রতিষ্ঠা কি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই দায়িত্ব নয়? নির্যাতিত মেয়েদের আত্মহননে নিরুত্সাহিত করতে তাদের সামনে আত্মহননের বিকল্প পথের সন্ধান দিতে হবে আমাদেরই। ইভ টিজিং ও যৌন হয়রানিকে সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে আইনি কাঠামো এবং সেই আইনের যথাযথ ও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশের আলোকে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ গ্রহণ কমিটি গঠন করা দরকার, যেখানে ভুক্তভোগী মেয়েরা নির্বিঘ্নে ও মুক্তভাবে তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারবে। এলাকা ভিত্তিতেও অভিভাবকদের তরফে এমন কমিটির কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার—সবাইকে। পরিবার আর সমাজকে পূর্ণ শক্তি নিয়ে নির্যাতিত মেয়েটির পাশে দাঁড়াতে হবে। দোষী হিসেবে চিহ্নিত করে পুনরায় উত্পীড়নের পরিবর্তে তাকে দিতে হবে মানসিক শক্তি-সমর্থন। উত্পীড়নকারী তরুণদের বিবেকবোধকে নাড়া দিতে সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রকে নিতে হবে আইন প্রণয়ন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং নির্যাতিত মেয়েটির সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব। তখনই কেবল নির্যাতিত ওই মেয়েরা জীবনের পরিসমাপ্তিতে সমাধান নয়, দেখতে পাবে নতুন আলোর দিশা।
লেখকেরা শিক্ষাবিদ, মানবাধিকার কর্মী, উন্নয়নকর্মী ও সাহিত্যিক।
No comments