চারদিক-ওরা গান করে, নাচ শেখে by ফেরদৌস ফয়সাল

‘মাইনষের বাসায় ঝিয়ের কাম করি, মাস শেষে ৬০০ ট্যাকা পাই। সেই ট্যাকা মা-বাবারে দেই। স্কুলে যাই, সেভেনে পড়ি। সপ্তাহে তিন দিন গান শিখতে আসি। এইখানে শুধু গান না, নাচ, ছবি আঁকা ও কম্পিউটার শিখায়। খুব কষ্ট হয় সবকিছু ঠিক রাখতে। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ বস্তিতে থাকি।


কাজের ফাঁকে যেইটুকু অবসর পাই, সবটাই কাজে লাগাই।’ বলছিল সুরের ধারার শিক্ষার্থী রাফিজা ইসলাম। শুধু রাফিজাই নয়, রাফিজার মতো আরও ২৮ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু সুরের ধারা গানের স্কুলের উন্নয়নের জন্য সংগীত প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া পায়নি তারা। ভালো জামাকাপড় তো দূরের কথা, দুবেলা দুমুঠো খাবারও জোটে না তাদের। নেই কোনো ভালো আবাসের ব্যবস্থা। থাকে রাজধানীর ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে সরকারের খাসজমির বস্তিঘরে। সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশু সুরের ধারার উন্নয়নের জন্য সংগীত (মিউজিক ফর ডেভেলপমেন্টের) শিক্ষার্থী। এই শিশুদের নাচ-গান শেখান সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা।
ঢাকার লালমাটিয়ায় গানের স্কুলেই হয় সুরের ধারার কাজ। গত বছরের জুন মাসে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড মসজিদসংলগ্ন বস্তি থেকে খোঁজখবর করে ৬০ জন শিশুকে নির্বাচন করা হয়। সেখান থেকে ২৮ জনকে বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এর হলো রুবেল, জুয়েল রানা, সবুজ, শরিফা, মাইশা, ফিরোজ, আলী, রুপালি, আসমা, জিয়াসমিন, নাসরিন, শাহিদা, চম্পা, ডলি, শারমিন, হালিমা, তানিয়া, শুভ আকতার, পলি, সোনিয়া, রুবিনা, সাবিনা, রাফিজা, স্বপন, মো. জুয়েল প্রমুখ। এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে চারজন, চতুর্থ শ্রেণীতে পাঁচজন, পঞ্চম শ্রেণীতে ১২ জন এবং ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে একজন করে।
শিক্ষার্থী সাবিনা ইয়াসমিন বলল, ‘সারেগামা, রবীন্দ্রসংগীত, দেশের গান, ছড়াগান, পল্লীগীতি ১৩টি গান শিখেছি। শুধু নিজেই শিখিনি, বস্তিতে গিয়ে আমার বন্ধুদের পাঁচটি গান শিখিয়েছি।’
উন্নয়নের জন্য সংগীত প্রকল্প ব্যবস্থাপক রেমিজিওস রেমি জানালেন, মাত্র ছয় মাসের মধ্যে শিশুরা চমত্কার শিখেছে। তিন বছর এদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, চিড়িয়াখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ওদের বাসা থেকে ভ্যানে করে সুরের ধারায় আনা হয়। দেওয়া হয়েছে নির্ধারিত পোশাক ও ব্যাগ। এখানে খাবারও দেওয়া হয়। গানের পাশাপাশি নাচ, ছবি আঁকা, কম্পিউটার শেখান তপতী ভেরনিকা রোজারিও, সীমা সরকার।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বাসার আশপাশে মাদক ব্যবসা জমজমাট। এই শিশুরা যেন মাদকমুক্ত থাকতে পারে, সেই কৌশলও শেখানো হয় এখানে। এক শুক্রবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেল মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ মোহিত কামাল কথা বলছেন এদের সঙ্গে। আর সবাই তাঁর কথা শুনছে আগ্রহ নিয়ে। কয়েকজন শিশু নিজেদের অভিজ্ঞতাও বিনিময় করল মোহিত কামালের সঙ্গে।
মোহিত কামাল যখন বললেন, মাদক নিয়ে তোমাদের কোনো অভিজ্ঞতা বলতে পারো। তখন ফিরোজ জানাল, ‘আমার বড় ভাই গাঞ্জা খাইত। এই কথাটা বাবাকে বলি। বাবা ভাইরে ধইরা মারল। মাইর খাইয়া সে আমারে মাইর দিসে, কেন আমি বাবারে কইলাম।’ নাসিমা জানাল তার ভাইয়ের কথা, নেশার টাকা জোগাড় করতে অনেক খারাপ কাজ করত। নাসিমা বলল, মাদক নিচ্ছে একজন আর দুঃখ পাচ্ছে অনেকে। সখের বশেও মাদক না নেওয়ার অনুরোধ জানায় নাসিমা উপস্থিত বন্ধুদের।
এই শিশুদের জীবন ছিল পঙ্কিল। প্রতিদিনের বিবর্ণ জীবনযাপনে জীবনের অর্থই যাচ্ছিল পাল্টে। হঠাত্ ওরা পেয়েছে আশার আলো। গান ও নাচ শেখার মাধ্যমে মনে ঢুকছে সংস্কৃতির সুর। এখানে তাই উত্সাহ নিয়েই আসে ওরা। চিড়িয়াখানায় গিয়ে নানা ধরনের পশুপাখি দেখে ওদের মন আনন্দে ভরে ওঠে। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওরা মন খুলে দিতে পারে কম্পিউটারে। এখন ওদের জীবনযাপনে এসেছে ছন্দ।
মাঝে মাঝে কবিতাও পড়ে ওরা। মাহমুদা আক্তার ক্লাস নিতে গিয়ে দারুণ আনন্দ পেয়েছেন। একবার দেখিয়ে দিলেই কবিতার ছন্দ-তাল-লয়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে ওরা। নিজেরাই গুন গুন করে গান করছে, আবৃত্তি করছে কবিতা কিংবা একপাক নেচে মনে করিয়ে দিচ্ছে, আমরাও পারি।
মোহিত কামাল তো ওদের ভাবনার ধরন দেখে অবাক। সত্যিই, প্রখর বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভাবার ক্ষমতা আছে ছেলেমেয়েগুলোর। যেখানে ওরা থাকে, সেখানে মাদকাসক্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। কিন্তু মোহিত কামালের মনে হয়েছে, এভাবে সচেতনতার সঙ্গে ভাবতে পারলে মাদক ওদের স্পর্শ করতে পারবে না।
প্রশিক্ষণ শেষে সত্যিই যদি এই শিশুরা সাদা মনের মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তাহলে সেই অর্জন নিয়ে সবাই গর্ব করতে পারবে।

No comments

Powered by Blogger.