চারদিক-শুধু বিয়ের জন্য... by ফারুখ আহমেদচারদিক-শুধু বিয়ের জন্য... by ফারুখ আহমেদ
এখন মিন্টো রোডে পা রাখলেই চোখ জুড়িয়ে যাবে হলুদ সৌন্দর্যে। পুরো এলাকা পেল্টোফোরামে ছেয়ে গেছে। দৃষ্টি যেখানেই প্রসারিত করেন, মনে হবে এ যেন হলুদ দুনিয়া। প্রতিদিন মিন্টো রোডের এ পথ ধরে একবার হলেও যাতায়াত করতে হয়। প্রতিদিনকার মতোই সেদিন মিন্টো রোড হয়ে বাড়ি ফিরছিলাম।
হেয়ার রোডের কাছে এসে থমকে দাঁড়াই। পাদাউক গাছে ফুল ফুটে আছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে। সঙ্গে ক্যামেরা ছিল, নেমে পড়ি। তারপর চলে ফটাফট ছবি তোলা। আগের রাতের ঝড়ে গাছের অনেকগুলো ডাল ভেঙে পড়েছে। বয়স হয়েছে গাছের, এভাবে ঝড় হলে তার আঘাতে একদিন পুরো গাছটাই ভেঙে পড়তে পারে, ভাবছি আর ছবি তুলছি। এর মধ্যে দমকা বাতাস আমার গলার গামছাটা উড়িয়ে নিয়ে গেল। আমি হইহই করে আটকানোর চেষ্টা করেও বিফল হলাম। গামছা তোলার জন্য যেই পা বাড়িয়েছি দেখি, দুজন পথচারী গামছাটা মাটি থেকে তুলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। দিনমজুর ধরনের মানুষ। আমাকে গামছাটা বুঝিয়ে দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়াতেই আমার ডাক, ‘ভাই, শোনেন’।
দুজনই থমকে দাঁড়ালেন। এবার আমি খুব ভালো করে দেখি দুজনকে। একটু বোকা বোকা ধরনের মনে হলো, এই নগরে নবাগত।
‘দাঁড়ান, আপনেগো ছবি তুলি’—বলতেই দুজন তৎপর হয়ে মাথার চুল-জামা একটু পরিপাটি করে নিলেন। ‘তুলেন, ছবি কুনদিন তুলি নাই। ভাই, কন তো, ছবি নিমু কেমনে?’
আমি ছবি তুলি আর বলি, মোবাইল নম্বর দেব। ফোন দিয়েন, ছবি দিয়া যামু। তারপর জানতে চাই, আপনে গো বাড়ি কি রংপুর? আমার প্রশ্নের উত্তরে দুজনের সহাস্য জবাব, ‘না, আমরা নাটোর থেকা আইছি।’ এভাবেই আমাদের মধ্যে আলাপচারিতা এগিয়ে চলে। আমার ধারণা ভুল। দুজনই একটু গোবেচারা ধরনের হলেও তাঁরা প্রায় পাঁচ বছর ঢাকায়। আর তাঁদের ঢাকা আসার কারণ শুনে আমি যারপরনাই বিস্মিত। দুজনই বিয়ে করার জন্য ঢাকা এসেছিলেন। এসেছিলেন এই জন্য বললাম, যে স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা ঢাকা এসেছিলেন, তা ফিকে হয়ে গেছে বহু আগে। অধরাই থেকে গেছে তাঁদের বিয়ে করার স্বপ্ন। এই পাঁচ বছরে তাঁরা বিয়ে করতে পারেননি। তাঁদের বিয়ের জন্য কোনো টাকার বন্দোবস্ত হয়নি। ‘পেটই চলে না, আবার বিয়া!’—বলে দুজনই একে অপরের গায়ে হেসে গড়াগড়ি খান।
সিরাজ মিয়া ও মনির। ঠিক যেন মানিকজোড়। ঢাকা এসেছেন একসঙ্গে। চলাফেরা-কাজকর্মও চলে একই সঙ্গে। বাড়িতে বিয়ের জন্য কেউ চেষ্টা চালাননি। কীভাবে চালাবেন—মা নেই, বাবা নেই। দুজনই সেই ছোট বয়সে মারা গেছেন। ধাক্কা-গুঁতায় জীবন চলেছে। একটা ভাই আছে আর ছোট বোন। এই হলো সিরাজের সংসার। জায়গাজমি বলতে কিছুই নেই। সরকারি জমিতে ঘর বানিয়ে থাকেন। আর মনির জন্মের পর আপন কাউকে দেখেননি। কবে সিরাজের সঙ্গে দেখা, তা-ও মনে নেই। সিরাজের সঙ্গেই বেড়ে ওঠা। গ্রামে এর-ওর ফুট-ফরমায়েশ করে জীবন চলত। এভাবেই ত্রিশটি বসন্ত কেটে যায়। সিরাজ তাঁর ভাইকে বিয়ের কথা বলেছিলেন। ভাই লাঠিপেটা করে তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন। সিরাজের অবস্থা দেখে সেই চেষ্টাও করেননি মনির। নিজেরাও যে চেষ্টা করেন না, তা-ও নয়। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না, শেষে বুদ্ধি করে দুজন চলে আসেন এই নগরে। যদি আয়-রুজি হয় তাহলে বিয়েটা করা যাবে। তাঁদের কথা থেকেই বোঝা গেল, একটু বোকা ধরনের বলে মানুষ খাটিয়ে নেয়। টাকার জোগাড় আর হয় না। পড়ালেখা নেই। নেই কোনো কাজের অভিজ্ঞতা। ভালো কাজও পান না। টাকাও জমে না। কোনো রকম খেয়ে-পরে জীবনযাপন। তাঁদের কাজকর্ম বলতে নষ্ট হওয়া রাস্তার অচল গাড়ি ঠেলা আর বোতল ও কাগজ টোকান। এসব করে সারা দিনে ৫০-৬০ টাকার মতো রোজগার হয়। তা দিয়ে পেটই চলে না, সুতরাং বিয়ের কথা ভুলেই গেছেন তাঁরা। ওপার কেরানীগঞ্জে ইসমাইল নামের এক এলাকার মাতব্বর কিসিমের মানুষের বাড়িতে রাতযাপন। ইসমাইল খুব ভালো মানুষ, দুজনকেই আদর করতেন। বিনিময়ে ইসমাইলের বাড়ির কাজ করে দিতে হতো, আবার না করলেও কোনো বকাঝকা করতেন না। কিছুদিন আগে ইসমাইল মারা গেলে তাঁর বাড়িতে সিরাজ-মনিরের থাকা একটু সমস্যা হয়ে যায়। ইসমাইলের ছেলেরা চান তাঁরা অন্যত্র চলে যান। তাঁরাও ভাবছেন, চলে যাবেন। কিন্তু টাকা তো জমে না। ‘টাকা জমাতে পারলে দেশে চলে যাব ভাবছি’, বলে দুজনই হাঁটা ধরেন। এবার আমি চিৎকার করে জানতে চাই, তাহলে বিয়ে? সিরাজ মিয়ার জবাব, জীবনই চলে না, আবার বিয়ে!
ফারুখ আহমেদদুজনই থমকে দাঁড়ালেন। এবার আমি খুব ভালো করে দেখি দুজনকে। একটু বোকা বোকা ধরনের মনে হলো, এই নগরে নবাগত।
‘দাঁড়ান, আপনেগো ছবি তুলি’—বলতেই দুজন তৎপর হয়ে মাথার চুল-জামা একটু পরিপাটি করে নিলেন। ‘তুলেন, ছবি কুনদিন তুলি নাই। ভাই, কন তো, ছবি নিমু কেমনে?’
আমি ছবি তুলি আর বলি, মোবাইল নম্বর দেব। ফোন দিয়েন, ছবি দিয়া যামু। তারপর জানতে চাই, আপনে গো বাড়ি কি রংপুর? আমার প্রশ্নের উত্তরে দুজনের সহাস্য জবাব, ‘না, আমরা নাটোর থেকা আইছি।’ এভাবেই আমাদের মধ্যে আলাপচারিতা এগিয়ে চলে। আমার ধারণা ভুল। দুজনই একটু গোবেচারা ধরনের হলেও তাঁরা প্রায় পাঁচ বছর ঢাকায়। আর তাঁদের ঢাকা আসার কারণ শুনে আমি যারপরনাই বিস্মিত। দুজনই বিয়ে করার জন্য ঢাকা এসেছিলেন। এসেছিলেন এই জন্য বললাম, যে স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা ঢাকা এসেছিলেন, তা ফিকে হয়ে গেছে বহু আগে। অধরাই থেকে গেছে তাঁদের বিয়ে করার স্বপ্ন। এই পাঁচ বছরে তাঁরা বিয়ে করতে পারেননি। তাঁদের বিয়ের জন্য কোনো টাকার বন্দোবস্ত হয়নি। ‘পেটই চলে না, আবার বিয়া!’—বলে দুজনই একে অপরের গায়ে হেসে গড়াগড়ি খান।
সিরাজ মিয়া ও মনির। ঠিক যেন মানিকজোড়। ঢাকা এসেছেন একসঙ্গে। চলাফেরা-কাজকর্মও চলে একই সঙ্গে। বাড়িতে বিয়ের জন্য কেউ চেষ্টা চালাননি। কীভাবে চালাবেন—মা নেই, বাবা নেই। দুজনই সেই ছোট বয়সে মারা গেছেন। ধাক্কা-গুঁতায় জীবন চলেছে। একটা ভাই আছে আর ছোট বোন। এই হলো সিরাজের সংসার। জায়গাজমি বলতে কিছুই নেই। সরকারি জমিতে ঘর বানিয়ে থাকেন। আর মনির জন্মের পর আপন কাউকে দেখেননি। কবে সিরাজের সঙ্গে দেখা, তা-ও মনে নেই। সিরাজের সঙ্গেই বেড়ে ওঠা। গ্রামে এর-ওর ফুট-ফরমায়েশ করে জীবন চলত। এভাবেই ত্রিশটি বসন্ত কেটে যায়। সিরাজ তাঁর ভাইকে বিয়ের কথা বলেছিলেন। ভাই লাঠিপেটা করে তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন। সিরাজের অবস্থা দেখে সেই চেষ্টাও করেননি মনির। নিজেরাও যে চেষ্টা করেন না, তা-ও নয়। কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না, শেষে বুদ্ধি করে দুজন চলে আসেন এই নগরে। যদি আয়-রুজি হয় তাহলে বিয়েটা করা যাবে। তাঁদের কথা থেকেই বোঝা গেল, একটু বোকা ধরনের বলে মানুষ খাটিয়ে নেয়। টাকার জোগাড় আর হয় না। পড়ালেখা নেই। নেই কোনো কাজের অভিজ্ঞতা। ভালো কাজও পান না। টাকাও জমে না। কোনো রকম খেয়ে-পরে জীবনযাপন। তাঁদের কাজকর্ম বলতে নষ্ট হওয়া রাস্তার অচল গাড়ি ঠেলা আর বোতল ও কাগজ টোকান। এসব করে সারা দিনে ৫০-৬০ টাকার মতো রোজগার হয়। তা দিয়ে পেটই চলে না, সুতরাং বিয়ের কথা ভুলেই গেছেন তাঁরা। ওপার কেরানীগঞ্জে ইসমাইল নামের এক এলাকার মাতব্বর কিসিমের মানুষের বাড়িতে রাতযাপন। ইসমাইল খুব ভালো মানুষ, দুজনকেই আদর করতেন। বিনিময়ে ইসমাইলের বাড়ির কাজ করে দিতে হতো, আবার না করলেও কোনো বকাঝকা করতেন না। কিছুদিন আগে ইসমাইল মারা গেলে তাঁর বাড়িতে সিরাজ-মনিরের থাকা একটু সমস্যা হয়ে যায়। ইসমাইলের ছেলেরা চান তাঁরা অন্যত্র চলে যান। তাঁরাও ভাবছেন, চলে যাবেন। কিন্তু টাকা তো জমে না। ‘টাকা জমাতে পারলে দেশে চলে যাব ভাবছি’, বলে দুজনই হাঁটা ধরেন। এবার আমি চিৎকার করে জানতে চাই, তাহলে বিয়ে? সিরাজ মিয়ার জবাব, জীবনই চলে না, আবার বিয়ে!
farukh.ahmed@gmail.com
No comments