চারদিক-সবুজ মাঠে শিবের মেলা by শান্তনু চৌধুরী
কবিগুরু বলেছেন, ‘নিশি অবসান ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত...ক্ষমা করো আজিকার মতো/ পুরাতন বয়সের সাথে পুরোনো অপরাধ যতো।’ পুরাতন বছরকে বিদায় জানাতে, পুরোনো জীর্ণতা ঝেড়ে ফেলতে হাজির হয়েছিলাম চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার উত্তর ঢেমশা গ্রামে।
শিব-গৌরীর নৃত্য শেষে কাঁঠাল পাকা রোদে ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাঠ দিয়ে চলছি গরম জিলাপি আর কিছুটা পুণ্য সঞ্চারীদের মুখ দেখব বলে। দোল পূর্ণিমায় (২ চৈত্র) শুরু হয় মূল উৎসব। এরপর চলে প্রায় মাসব্যাপী। এ মেলা এখনো চলছে। মেলা শেষ হয় চৈত্রের শেষ দিনে। এর মধ্যে একদিন উৎসবের আমেজ কতটা জমে উঠল, তা-ই দেখতে হাজির হই সেখানে। যতটা সাদামাটা ভেবেছিলাম, আয়োজন দেখা গেল তার চেয়ে অনেক বড়। সরাসরি মেলার মাঠে যাওয়ার আগে গৃহস্থবাড়ির অন্দরমহলে ঢুঁ মারি। সেখানে দলে দলে গায়ে হলুদ আর লবণ-পানি মেখে স্নান করতে চলছে যুবক-যুবতীর দল। উদ্দেশ্য একটাই- শরীর থেকে সব রোগবালাই দূর করে দিতে হবে। এরপর পাঁচ পুকুরের পানি দিয়ে স্নান। স্নান শেষে নতুন কাপড়-চোপড় পরে শত্রুকে প্রতীকী কচুকাটা করা।
যেখানে ক্ষেত্রপাল মেলা শুরু, সেখানে গিয়ে দেখি সকাল সাতটায়ও সবকিছু অসম্পূর্ণ। নাগরদোলার শরীরে পেরেক লাগছে। ভ্যান-রিকশা, ছোট-বড় লরি কেউ বা হাতে করে মালপত্র নিয়ে আসছে। ডাবের থোড় নামছে ঠেলাগাড়ি থেকে। তরমুজ-বাঙ্গির গন্ধ ভাসছে। বাঁশিওয়ালা ছোট পাটি বিছিয়ে তাঁর বাঁশিতে সুর তোলার আগে ‘টিউন’ করে নিচ্ছেন। উৎসব শুরুর আগে ঢুলির দল নীল পাগলের গানের সুরে একটানা বাদ্য বাজিয়ে চলছে। পুকুরে একটি জংলি বাঁশ নামিয়ে সেটাকে ভালোমতো ‘স্নান’ করিয়ে নেওয়া হলো। তারপর জড়িয়ে দেওয়া হলো লাল পাড় সাদা কাপড়। এভাবেই শুরু হলো ক্ষেত্রপাল মেলা। এ উৎসবটির নাম নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ বলে বৈশাখী মেলা, কেউ বা চৈত্রসংক্রান্তি। আবার কেউ কেউ চড়ক মেলাও বলে থাকে। তবে মূল চড়ক মেলা বা পূজার সঙ্গে এটির পার্থক্য রয়েছে বলে জানালেন পুণ্যার্থীরা। সূর্য মাঠে নামতে নামতেই শুরু হয় মূল পূজা বা উৎসব। ভাবাবস্থায় থাকা নারীরা ‘মা মা’ করে বিলাপ করতে শুরু করেন। তাঁরা নানা অলৌকিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন বলে কথিত আছে।
ভিড় বাড়ে। এসব এড়িয়ে সারা বছরের পূজারি কৃষ্ণা বিশ্বাস চঞ্চলার কাছে যাই। তিনি জানালেন, ঢেমশা গ্রামের এ পূজা অতি প্রাচীন। আনুমানিক ৩০০ বছর ধরে এ পূজা চলে আসছে। নিত্যানন্দ ও রাজবল্লব সেনের বংশধরেরা মুহুরিগীরি করতে এসে ঢেমশায় এ পূজার প্রচলন করেন। বর্তমানে তাঁদের কাছে একটি ছোট ঘট রয়েছে। এটিকেই মূলত পূজা করা হয়। এ ঘটটি ঘিরেও নানা লোককথা প্রচলিত আছে। ঢেমশা গ্রামের অনেকে বিশ্বাস করে, এ ঘটটি চুরি করার জন্য অনেক গ্রামের লোক তৎপর। কারণ, এটি ছিনিয়ে নিতে পারলে ঢেমশার এ লোক-উৎসব অন্য গ্রামে চলে যাবে। তবে এ উৎসবের পেছনে কৃষকসমাজের একটি সনাতন বিশ্বাস কাজ করে বলেও জানালেন গ্রামের একজন বয়সী কৃষক। চৈত্র থেকে বর্ষার শুরু পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত থাকে তখন সূর্যের তেজ কমাতে ও বৃষ্টিলাভের আশায় গ্রামের মন্দিরগুলোতে এ আয়োজন চলে। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুযায়ী এ দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতিকে পুণ্যজনক বলে মনে করা হয়। মেলা উপলক্ষে গৃহস্থেরা নাতি-নাতনিসহ মেয়ে জামাইকে সমাদর করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সম্পন্ন গৃহস্থেরা সবাইকে নতুন জামাকাপড় দেন এবং উন্নতমানের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেন। নাড়ু, চিঁড়া, খই, দুধ-কলাসহ নানা মিষ্টান্ন দিয়ে অতিথিকে আপ্যায়ন করা হতে থাকে।
এসব দেখতে দেখতে মেলা যে কোন সময় জমে উঠেছে, টের পাইনি। ঢাকের বাদ্য, ধূপ-ধুনোর গন্ধ আর উলুধ্বনিতে যেন গা ছমছম করা পরিবেশ। গেরুয়া পরা সন্ন্যাসীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন এখানে-সেখানে। শঙ্খ বাজে, ঘণ্টা বাজে, বাজে করতাল, মদুর মৃদঙ্গ বাজে শুনিতে রসাল। মানত পূরণ করতে নানা স্থান থেকে ছুটে আসা অনেকে আসছেন লালসালুর বাঁধন খুলতে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, কোনো ভক্ত মানত করে লালসালুতে একটি গিঁট দিয়ে যান, পরে সে মনোবাসনা পূরণ হলে এসে গিঁট খুলে দেন। সে রকম গিঁট খুলতে এসে পাওয়া গেল শুক্লা ও শতাব্দী নামে দুই বোনকে। এত বিশাল আয়োজনের মধ্যেও রয়েছে ফাঁক। মেলার স্থান কম, আশপাশে বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই শৌচাগার, মেলায় বিক্রেতাদের চাঁদা দেওয়াসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। পুণ্যার্থীরা স্নান সেরে সরাসরি মণ্ডপে যেতে চাইলে নানা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। তবে আয়োজকেরা জানান, তাঁদের কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর পরও এ আয়োজনকে কীভাবে আরও সুন্দর করা যায় এবং পুণ্যার্থীদের যাতে সমস্যা না হয়, সে চেষ্টা চলছে। উৎসব উপলক্ষে একত্র হয়েছেন গ্রামের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ সবাই। কোনো ভেদাভেদ নেই। ফিরতি পথ ধরি। গ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নানা আয়োজন ভেসে আসে। কেউ একজন দরদি কণ্ঠে নজরুলের গান ধরেন—‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তার প্রাণ।’
যেখানে ক্ষেত্রপাল মেলা শুরু, সেখানে গিয়ে দেখি সকাল সাতটায়ও সবকিছু অসম্পূর্ণ। নাগরদোলার শরীরে পেরেক লাগছে। ভ্যান-রিকশা, ছোট-বড় লরি কেউ বা হাতে করে মালপত্র নিয়ে আসছে। ডাবের থোড় নামছে ঠেলাগাড়ি থেকে। তরমুজ-বাঙ্গির গন্ধ ভাসছে। বাঁশিওয়ালা ছোট পাটি বিছিয়ে তাঁর বাঁশিতে সুর তোলার আগে ‘টিউন’ করে নিচ্ছেন। উৎসব শুরুর আগে ঢুলির দল নীল পাগলের গানের সুরে একটানা বাদ্য বাজিয়ে চলছে। পুকুরে একটি জংলি বাঁশ নামিয়ে সেটাকে ভালোমতো ‘স্নান’ করিয়ে নেওয়া হলো। তারপর জড়িয়ে দেওয়া হলো লাল পাড় সাদা কাপড়। এভাবেই শুরু হলো ক্ষেত্রপাল মেলা। এ উৎসবটির নাম নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কেউ বলে বৈশাখী মেলা, কেউ বা চৈত্রসংক্রান্তি। আবার কেউ কেউ চড়ক মেলাও বলে থাকে। তবে মূল চড়ক মেলা বা পূজার সঙ্গে এটির পার্থক্য রয়েছে বলে জানালেন পুণ্যার্থীরা। সূর্য মাঠে নামতে নামতেই শুরু হয় মূল পূজা বা উৎসব। ভাবাবস্থায় থাকা নারীরা ‘মা মা’ করে বিলাপ করতে শুরু করেন। তাঁরা নানা অলৌকিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন বলে কথিত আছে।
ভিড় বাড়ে। এসব এড়িয়ে সারা বছরের পূজারি কৃষ্ণা বিশ্বাস চঞ্চলার কাছে যাই। তিনি জানালেন, ঢেমশা গ্রামের এ পূজা অতি প্রাচীন। আনুমানিক ৩০০ বছর ধরে এ পূজা চলে আসছে। নিত্যানন্দ ও রাজবল্লব সেনের বংশধরেরা মুহুরিগীরি করতে এসে ঢেমশায় এ পূজার প্রচলন করেন। বর্তমানে তাঁদের কাছে একটি ছোট ঘট রয়েছে। এটিকেই মূলত পূজা করা হয়। এ ঘটটি ঘিরেও নানা লোককথা প্রচলিত আছে। ঢেমশা গ্রামের অনেকে বিশ্বাস করে, এ ঘটটি চুরি করার জন্য অনেক গ্রামের লোক তৎপর। কারণ, এটি ছিনিয়ে নিতে পারলে ঢেমশার এ লোক-উৎসব অন্য গ্রামে চলে যাবে। তবে এ উৎসবের পেছনে কৃষকসমাজের একটি সনাতন বিশ্বাস কাজ করে বলেও জানালেন গ্রামের একজন বয়সী কৃষক। চৈত্র থেকে বর্ষার শুরু পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত থাকে তখন সূর্যের তেজ কমাতে ও বৃষ্টিলাভের আশায় গ্রামের মন্দিরগুলোতে এ আয়োজন চলে। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুযায়ী এ দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতিকে পুণ্যজনক বলে মনে করা হয়। মেলা উপলক্ষে গৃহস্থেরা নাতি-নাতনিসহ মেয়ে জামাইকে সমাদর করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সম্পন্ন গৃহস্থেরা সবাইকে নতুন জামাকাপড় দেন এবং উন্নতমানের খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেন। নাড়ু, চিঁড়া, খই, দুধ-কলাসহ নানা মিষ্টান্ন দিয়ে অতিথিকে আপ্যায়ন করা হতে থাকে।
এসব দেখতে দেখতে মেলা যে কোন সময় জমে উঠেছে, টের পাইনি। ঢাকের বাদ্য, ধূপ-ধুনোর গন্ধ আর উলুধ্বনিতে যেন গা ছমছম করা পরিবেশ। গেরুয়া পরা সন্ন্যাসীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন এখানে-সেখানে। শঙ্খ বাজে, ঘণ্টা বাজে, বাজে করতাল, মদুর মৃদঙ্গ বাজে শুনিতে রসাল। মানত পূরণ করতে নানা স্থান থেকে ছুটে আসা অনেকে আসছেন লালসালুর বাঁধন খুলতে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, কোনো ভক্ত মানত করে লালসালুতে একটি গিঁট দিয়ে যান, পরে সে মনোবাসনা পূরণ হলে এসে গিঁট খুলে দেন। সে রকম গিঁট খুলতে এসে পাওয়া গেল শুক্লা ও শতাব্দী নামে দুই বোনকে। এত বিশাল আয়োজনের মধ্যেও রয়েছে ফাঁক। মেলার স্থান কম, আশপাশে বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই শৌচাগার, মেলায় বিক্রেতাদের চাঁদা দেওয়াসহ নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। পুণ্যার্থীরা স্নান সেরে সরাসরি মণ্ডপে যেতে চাইলে নানা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। তবে আয়োজকেরা জানান, তাঁদের কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর পরও এ আয়োজনকে কীভাবে আরও সুন্দর করা যায় এবং পুণ্যার্থীদের যাতে সমস্যা না হয়, সে চেষ্টা চলছে। উৎসব উপলক্ষে একত্র হয়েছেন গ্রামের হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ সবাই। কোনো ভেদাভেদ নেই। ফিরতি পথ ধরি। গ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নানা আয়োজন ভেসে আসে। কেউ একজন দরদি কণ্ঠে নজরুলের গান ধরেন—‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম, হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তার প্রাণ।’
No comments