বিচারপতি নিয়োগ-আগে আইন, পরে নিয়োগ by শাহদীন মালিক
বেশ কয়েক বছর ধরে ‘ল ১০১’ পড়াই। কিছুটা বিদেশি স্টাইলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোর্স বা সাবজেক্ট আমরা সংখ্যা দিয়ে বুঝাই—‘ল ১০১’। যে বিষয়টা পড়াই, সেটা হলো বাংলাদেশের আইনব্যবস্থা, যেটা সংক্ষেপে ‘ল ১০১’। অর্থাৎ যারা আইন পড়তে ভর্তি হয়, তাদের জন্য একেবারে প্রথম বিষয়।
প্রথম বর্ষের বিষয়গুলো একশ র ঘরের সংখ্যা অর্থাৎ ‘ল ১০১’, ‘ল ১০২’ ইত্যাদি। দ্বিতীয় বর্ষের বিষয়গুলো দুই শর ঘরে, অর্থাৎ ল ২০১, ল ২০২ এবং এভাবেই তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের বিষয়গুলোকে তিন শ ও চার শর ঘরের সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ক্লাস বা পরীক্ষার রুটিন বা অন্যান্য ব্যাপারে পুরো টাইটেল যেমন ল অব ট্রাস্ট অ্যান্ড ইকুইটি না লিখে আমরা সংক্ষেপে ব্যবহার করি ‘ল ২০৪’। ছাত্রছাত্রীরা জানে ‘ল ২০৪’ মানে কোন বিষয়।
প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে সদ্য ভর্তি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আনকোরা ছাত্রছাত্রীদের ‘ল ১০১’ পড়াতে গিয়ে প্রথম সপ্তাহেই যে বিষয় দিয়ে শুরু করি তা হলো—অ্যাডভোকেট কাহাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কী কী।
বুঝিয়ে বলি, অ্যাডভোকেট মূলত তিন প্রকার—ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের অ্যাডভোকেট, হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট আর আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট। আরও এক বিশেষ ধরনের অ্যাডভোকেট আছেন, যাঁরা হলেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট। এখানে বয়সের কারণে একজন অ্যাডভোকেট সিনিয়র হয়ে যান না। ‘সিনিয়র অ্যাডভোকেট’ একটা বিশেষ পদবিগোছের—প্রধান বিচারপতি অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ সাপেক্ষে গুটিকতক বিশিষ্ট আইনজীবীকে এই পদবি প্রদান করেন। আগে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছেন এবং তারপর সিনিয়র অ্যাডভোকেট হয়েছেন এমন উদাহরণও দু-একটা আছে। আর সবাই বিচারপতি হন সিনিয়র অ্যাডভোকেট পদবি পাওয়ার অনেক আগে। গত প্রায় চল্লিশ বছরে যে দুই শতাধিক বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন, তার মধ্যে (আমার জানামতে) কুল্লে দুজন ছিলেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট।
আগেই বলেছি, প্রথম ধাপ জেলা বা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট। এলএলবি পাস করে, ছয় মাস শিক্ষানবিশি শেষ করে বার কাউন্সিলের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করে ওকালতির সনদ পেয়ে কোনো একটা জেলা বারে নাম লিখিয়ে অ্যাডভোকেট হন। ইংল্যান্ডের এলএলবি পাস করে ওই দেশের বার কাউন্সিলের পরীক্ষা পাস করলে ইংল্যান্ডের অ্যাডভোকেটকে বলে ব্যারিস্টার, অর্থাৎ আপনি বিলাতি আইন জানেন, বিলাতি কোর্টে ওকালতি করতে পারবেন। বিলাতি ব্যারিস্টারদেরও বাংলাদেশে এসে শিক্ষানবিশি করে বাংলাদেশের বার কাউন্সিলের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করে অ্যাডভোকেটের সনদ নিতে হয়। অ্যাডভোকেট না হয়ে শুধু ব্যারিস্টার হওয়ার কারণে বা যোগ্যতায় বাংলাদেশের কোনো আদালতে ওকালতি করা যায় না।
যা হোক, জেলা বা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট হওয়ার পর দুই বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলে হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হওয়ার জন্য দরখাস্ত করা যায়। আবার সেই লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা; এ ধাপে কড়াকড়িটা একটু বেশি। এ ধাপ উতরাতে পারলে হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট।
তারপর অন্তত এক যুগ হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করার পর অনেকেই আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতি বরাবর দরখাস্ত করেন। আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে অনুমতি দেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে হাইকোর্ট বিভাগের প্রত্যেক বিচারপতির মতামত নেওয়া হয়। কারণ বিচারপতিরা তাঁদের কোর্টে কে কত দক্ষ, বিচক্ষণ ও আইনজান্তা, তার মূল্যায়ন করতে পারেন।
আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হওয়ার পর আপিল বিভাগের বিচারপতিরা কাকে সিনিয়র অ্যাডভোকেট পদবি প্রদান করবেন তা নির্ধারণ করেন।
২.
বিচারপতি নিয়োগসংক্রান্ত সংবিধানের অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপ: ‘প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন।’
গত বিএনপি আমলে তার আগের আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বেশ কয়েকজন অতিরিক্ত বিচারপতির ‘স্থায়ীকরণ’ না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত মামলা-মোকাদ্দমা, যা ‘দশ বিচারপতির মামলা’ হিসেবে প্রচলিত হয়েছে—শেষতক বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির মতামতের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে অতিরিক্ত বিচারপতি এবং দুই বছর পর অতিরিক্ত বিচারপতিদের ‘স্থায়ী’ (যদিও ‘স্থায়ী’ শব্দটা সংবিধানে নেই) করার ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির মতামত প্রাধান্য পাবে।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট রায়ে (বাংলাদেশ বনাম মো. ইদ্রিসুর রহমান, ২৯ বিএলডি এডি ৭৫) এটাও বলা হয়েছে, বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির আইনি দক্ষতা, বিচক্ষণতা ইত্যাদির বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের পূর্বাপর বৃত্তান্ত (Antecedent) সম্পর্কে সরকারের মতামত গ্রহণযোগ্য হবে। অর্থাৎ আইনজীবীর আইনি দক্ষতা বা যোগ্যতার ব্যাপারগুলো প্রধান বিচারপতির বিবেচ্য। কিন্তু আইনি জগতের বাইরের যে জীবন, সে ব্যাপারে সরকারের কোনো তথ্য থাকলে উভয় বিষয় পর্যালোচনা করে যোগ্যতম ব্যক্তিদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, প্রধান বিচারপতি কীভাবে এই গুরুদায়িত্ব পালন করবেন? বর্তমানে বা নিকট অতীতে যাঁরা প্রধান বিচারপতি আছেন বা ছিলেন, তাঁরা প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে কমবেশি প্রায় এক দশক আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে কাজ করেছেন। হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট, যাঁরা আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হননি, তাঁরা তো আপিল বিভাগে ওকালতি করেন না।
এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে, ততক্ষণে হয়তো অনেক নতুন অস্থায়ী বিচারপতির নিয়োগ হয়ে যাবে। বেশ কয়েক দিন ধরে অনেকেরই নাম নিয়ে আলাপ-আলোচনা-গুঞ্জন চলছে। কিছু নাম পত্রপত্রিকায়ও এসেছে। জানা মতে, বেশির ভাগই আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত নন।
৩.
সংবিধানে বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার শুধু দুটি যোগ্যতার কথা উল্লেখ আছে—সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা অথবা বিচার বিভাগীয় পদে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা। একইভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওযার জন্য সংবিধানে দুটি যোগ্যতা (বাংলাদেশের নাগরিক ও অন্তত ২৫ বছর বয়স) এবং পাঁচটি অযোগ্যতা (অপ্রকৃতিস্থ, দেউলিয়া, বিদেশি নাগরিক ইত্যাদি) উল্লেখ করা আছে। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সংশ্লিষ্ট ৬৬ অনুচ্ছেদের ২(ছ) উপ-অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা হয়েছে, অযোগ্যতার ব্যাপারে শর্ত আরোপ করে আইন করা যাবে, অর্থাৎ আইনের দ্বারা আরও অযোগ্যতা নির্ধারণ করা যাবে। এই ৬৬(২)(ছ) উপ-অনুচ্ছেদের আওতায় জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এ বিভিন্ন সময় অনেক অযোগ্যতা—ঋণখেলাপি বা বিলখেলাপি না হওয়া, সরকারি চাকরি অবসানের পর অন্তত তিন বছর অতিবাহিত হওয়া, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক বা চুক্তিগত কোনো সম্পর্ক না থাকা ইত্যাদি।
একইভাবে বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে আগে উল্লিখিত সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে ১০ বছর অভিজ্ঞতাসংক্রান্ত যোগ্যতার পর ৯৫(২)(গ)তে বলা আছে যে, আইন দ্বারা বিচারপতি নিয়োগ লাভের অন্যান্য যোগ্যতা নির্ধারণ করা যাবে।
সংবিধানের বয়স ৪০ বছর ছুঁইছুঁই করছে। বিচারপতি পদে নিয়োগের জন্য যোগ্যতাসংক্রান্ত আইন এখনো হয়নি। গত প্রায় ৪০ বছরে প্রণীত আইনের (সংশোধনী আইনসহ) সংখ্যা অন্তত দুই হাজার। কিন্তু বিচারপতির নিয়োগ ও যোগ্যতাসংক্রান্ত আইন এখনো নেই। এই আইন কেন হয়নি, তা পাঠক অতি সহজেই অনুমান করতে পারবেন। বিচার বিভাগ যাতে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়, সে জন্য এই আইনটা অত্যাবশ্যক; তাও পাঠক নিশ্চয় আঁচ করতে পারবেন।
ভালো, যোগ্য, বিজ্ঞ, দক্ষ লোককে বিচারপতি নিয়োগ করার আগে এ-সংক্রান্ত আইন এখন অত্যাবশ্যক। শুধু প্রধান বিচারপতির ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। বিশেষত প্রধান বিচারপতি যখন এমন অনেক অ্যাডভোকেটের নাম অন্তর্ভুক্ত করছেন তার তালিকায়, যাঁরা সম্ভবত তাঁর সামনে আইনজীবী হিসেবে একটা মামলাও করেননি।
লোকমুখে শুনেছি, অতীতে প্রধান বিচারপতিরা বিচারপতি নিয়োগের তালিকা তৈরির আগে অন্যান্য বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। সেটা এখন আর হয় না বলেই জানি। অবশ্য আমার সব ‘জানা’ যে সঠিক, সে দিব্যি দিতে পারব না।
৫০ বছরের কম বয়সী কাউকে বিচারপতি নিয়োগ করা সম্পূর্ণ অসমীচীন। এসএসসি থেকে এমএ বা এলএলবি পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষায় অন্তত একটা ফার্স্ট ডিভিশন/ক্লাস থাকা বাঞ্ছনীয়। নিদেনপক্ষে কোনো থার্ড ক্লাস/ডিভিশন যাতে না থাকে, সেটা তো নিশ্চিত করতে হবে। হাইকোর্টের যাঁরা জ্যেষ্ঠ বিচারপতি অর্থাৎ কমবেশি ১০ বছর বিচারপতি হিসেবে বিচার করেছেন, তাঁদের মতামত নিতে হবে। প্রধান বিচারপতি যেহেতু বহু বছর আপিল বিভাগে বসেন, সেহেতু হাইকোর্ট ডিভিশনের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিরাই কোন আইনজীবী বিচারপতি হওয়ার যোগ্য, সে ব্যাপারে বেশি ওয়াকিবহাল।
এখন তো টিন (TIN) নম্বর এবং অন্তত গত পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্নের ফিরিস্তি এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণী ছাড়া বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নই ওঠা উচিত নয়।
আইন দ্বারা যোগ্যতা নির্ধারিত না হলে স্বেচ্ছাচারিতা হতে বাধ্য। মামলার জট আছে জানি যুগ যুগ ধরে। দুই মাস পর বিচারপতিদের নিয়োগ করলে মামলার ভারে সুপ্রিম কোর্ট ভেঙে পড়বে না। আইন ছাড়া নিয়োগ করলে আস্থাহীনতার চাপে বরং কোর্ট নুয়ে পড়তে পারে।
‘দশ বিচারপতি’ রায়ে ওপরে উল্লিখিত বিএলডির ১৩৪ পৃষ্ঠায় আছে: ‘Therefore, the entire process of consultation leading to appointment should be put into writing containing the materials considered against each candidate in support of their suitability.’ অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের জন্য যাঁদের নাম সুপারিশ করেছেন, সেই প্রতিটি সুপারিশের পক্ষে কারণ বা বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে হবে। আইন পাস হওয়ার আগেই আবার যদি বিচারপতি নিয়োগ হয়, তাহলে আমরা প্রধান বিচারপতির লিখিত বক্তব্য জানতে চাইব। কারণ, এই রায়েই বলা আছে, নিয়োগ-প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।
প্রথম বর্ষের প্রথম সেমিস্টারে সদ্য ভর্তি হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আনকোরা ছাত্রছাত্রীদের ‘ল ১০১’ পড়াতে গিয়ে প্রথম সপ্তাহেই যে বিষয় দিয়ে শুরু করি তা হলো—অ্যাডভোকেট কাহাকে বলে, উহা কত প্রকার ও কী কী।
বুঝিয়ে বলি, অ্যাডভোকেট মূলত তিন প্রকার—ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের অ্যাডভোকেট, হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট আর আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট। আরও এক বিশেষ ধরনের অ্যাডভোকেট আছেন, যাঁরা হলেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট। এখানে বয়সের কারণে একজন অ্যাডভোকেট সিনিয়র হয়ে যান না। ‘সিনিয়র অ্যাডভোকেট’ একটা বিশেষ পদবিগোছের—প্রধান বিচারপতি অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ সাপেক্ষে গুটিকতক বিশিষ্ট আইনজীবীকে এই পদবি প্রদান করেন। আগে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছেন এবং তারপর সিনিয়র অ্যাডভোকেট হয়েছেন এমন উদাহরণও দু-একটা আছে। আর সবাই বিচারপতি হন সিনিয়র অ্যাডভোকেট পদবি পাওয়ার অনেক আগে। গত প্রায় চল্লিশ বছরে যে দুই শতাধিক বিচারপতি নিয়োগ পেয়েছেন, তার মধ্যে (আমার জানামতে) কুল্লে দুজন ছিলেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট।
আগেই বলেছি, প্রথম ধাপ জেলা বা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট। এলএলবি পাস করে, ছয় মাস শিক্ষানবিশি শেষ করে বার কাউন্সিলের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করে ওকালতির সনদ পেয়ে কোনো একটা জেলা বারে নাম লিখিয়ে অ্যাডভোকেট হন। ইংল্যান্ডের এলএলবি পাস করে ওই দেশের বার কাউন্সিলের পরীক্ষা পাস করলে ইংল্যান্ডের অ্যাডভোকেটকে বলে ব্যারিস্টার, অর্থাৎ আপনি বিলাতি আইন জানেন, বিলাতি কোর্টে ওকালতি করতে পারবেন। বিলাতি ব্যারিস্টারদেরও বাংলাদেশে এসে শিক্ষানবিশি করে বাংলাদেশের বার কাউন্সিলের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করে অ্যাডভোকেটের সনদ নিতে হয়। অ্যাডভোকেট না হয়ে শুধু ব্যারিস্টার হওয়ার কারণে বা যোগ্যতায় বাংলাদেশের কোনো আদালতে ওকালতি করা যায় না।
যা হোক, জেলা বা জজকোর্টের অ্যাডভোকেট হওয়ার পর দুই বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলে হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হওয়ার জন্য দরখাস্ত করা যায়। আবার সেই লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা; এ ধাপে কড়াকড়িটা একটু বেশি। এ ধাপ উতরাতে পারলে হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট।
তারপর অন্তত এক যুগ হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করার পর অনেকেই আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হওয়ার জন্য প্রধান বিচারপতি বরাবর দরখাস্ত করেন। আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে অনুমতি দেওয়া হবে কি না, সে ব্যাপারে হাইকোর্ট বিভাগের প্রত্যেক বিচারপতির মতামত নেওয়া হয়। কারণ বিচারপতিরা তাঁদের কোর্টে কে কত দক্ষ, বিচক্ষণ ও আইনজান্তা, তার মূল্যায়ন করতে পারেন।
আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হওয়ার পর আপিল বিভাগের বিচারপতিরা কাকে সিনিয়র অ্যাডভোকেট পদবি প্রদান করবেন তা নির্ধারণ করেন।
২.
বিচারপতি নিয়োগসংক্রান্ত সংবিধানের অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপ: ‘প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারপতিগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন।’
গত বিএনপি আমলে তার আগের আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত বেশ কয়েকজন অতিরিক্ত বিচারপতির ‘স্থায়ীকরণ’ না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত মামলা-মোকাদ্দমা, যা ‘দশ বিচারপতির মামলা’ হিসেবে প্রচলিত হয়েছে—শেষতক বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির মতামতের প্রাধান্য স্বীকৃত হয়েছে। অর্থাৎ প্রথমে অতিরিক্ত বিচারপতি এবং দুই বছর পর অতিরিক্ত বিচারপতিদের ‘স্থায়ী’ (যদিও ‘স্থায়ী’ শব্দটা সংবিধানে নেই) করার ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির মতামত প্রাধান্য পাবে।
অবশ্য সংশ্লিষ্ট রায়ে (বাংলাদেশ বনাম মো. ইদ্রিসুর রহমান, ২৯ বিএলডি এডি ৭৫) এটাও বলা হয়েছে, বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির আইনি দক্ষতা, বিচক্ষণতা ইত্যাদির বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের পূর্বাপর বৃত্তান্ত (Antecedent) সম্পর্কে সরকারের মতামত গ্রহণযোগ্য হবে। অর্থাৎ আইনজীবীর আইনি দক্ষতা বা যোগ্যতার ব্যাপারগুলো প্রধান বিচারপতির বিবেচ্য। কিন্তু আইনি জগতের বাইরের যে জীবন, সে ব্যাপারে সরকারের কোনো তথ্য থাকলে উভয় বিষয় পর্যালোচনা করে যোগ্যতম ব্যক্তিদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, প্রধান বিচারপতি কীভাবে এই গুরুদায়িত্ব পালন করবেন? বর্তমানে বা নিকট অতীতে যাঁরা প্রধান বিচারপতি আছেন বা ছিলেন, তাঁরা প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে কমবেশি প্রায় এক দশক আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে কাজ করেছেন। হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট, যাঁরা আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হননি, তাঁরা তো আপিল বিভাগে ওকালতি করেন না।
এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে, ততক্ষণে হয়তো অনেক নতুন অস্থায়ী বিচারপতির নিয়োগ হয়ে যাবে। বেশ কয়েক দিন ধরে অনেকেরই নাম নিয়ে আলাপ-আলোচনা-গুঞ্জন চলছে। কিছু নাম পত্রপত্রিকায়ও এসেছে। জানা মতে, বেশির ভাগই আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত নন।
৩.
সংবিধানে বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার শুধু দুটি যোগ্যতার কথা উল্লেখ আছে—সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা অথবা বিচার বিভাগীয় পদে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা। একইভাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওযার জন্য সংবিধানে দুটি যোগ্যতা (বাংলাদেশের নাগরিক ও অন্তত ২৫ বছর বয়স) এবং পাঁচটি অযোগ্যতা (অপ্রকৃতিস্থ, দেউলিয়া, বিদেশি নাগরিক ইত্যাদি) উল্লেখ করা আছে। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সংশ্লিষ্ট ৬৬ অনুচ্ছেদের ২(ছ) উপ-অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা হয়েছে, অযোগ্যতার ব্যাপারে শর্ত আরোপ করে আইন করা যাবে, অর্থাৎ আইনের দ্বারা আরও অযোগ্যতা নির্ধারণ করা যাবে। এই ৬৬(২)(ছ) উপ-অনুচ্ছেদের আওতায় জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এ বিভিন্ন সময় অনেক অযোগ্যতা—ঋণখেলাপি বা বিলখেলাপি না হওয়া, সরকারি চাকরি অবসানের পর অন্তত তিন বছর অতিবাহিত হওয়া, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়িক বা চুক্তিগত কোনো সম্পর্ক না থাকা ইত্যাদি।
একইভাবে বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে আগে উল্লিখিত সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে ১০ বছর অভিজ্ঞতাসংক্রান্ত যোগ্যতার পর ৯৫(২)(গ)তে বলা আছে যে, আইন দ্বারা বিচারপতি নিয়োগ লাভের অন্যান্য যোগ্যতা নির্ধারণ করা যাবে।
সংবিধানের বয়স ৪০ বছর ছুঁইছুঁই করছে। বিচারপতি পদে নিয়োগের জন্য যোগ্যতাসংক্রান্ত আইন এখনো হয়নি। গত প্রায় ৪০ বছরে প্রণীত আইনের (সংশোধনী আইনসহ) সংখ্যা অন্তত দুই হাজার। কিন্তু বিচারপতির নিয়োগ ও যোগ্যতাসংক্রান্ত আইন এখনো নেই। এই আইন কেন হয়নি, তা পাঠক অতি সহজেই অনুমান করতে পারবেন। বিচার বিভাগ যাতে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়, সে জন্য এই আইনটা অত্যাবশ্যক; তাও পাঠক নিশ্চয় আঁচ করতে পারবেন।
ভালো, যোগ্য, বিজ্ঞ, দক্ষ লোককে বিচারপতি নিয়োগ করার আগে এ-সংক্রান্ত আইন এখন অত্যাবশ্যক। শুধু প্রধান বিচারপতির ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। বিশেষত প্রধান বিচারপতি যখন এমন অনেক অ্যাডভোকেটের নাম অন্তর্ভুক্ত করছেন তার তালিকায়, যাঁরা সম্ভবত তাঁর সামনে আইনজীবী হিসেবে একটা মামলাও করেননি।
লোকমুখে শুনেছি, অতীতে প্রধান বিচারপতিরা বিচারপতি নিয়োগের তালিকা তৈরির আগে অন্যান্য বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন। সেটা এখন আর হয় না বলেই জানি। অবশ্য আমার সব ‘জানা’ যে সঠিক, সে দিব্যি দিতে পারব না।
৫০ বছরের কম বয়সী কাউকে বিচারপতি নিয়োগ করা সম্পূর্ণ অসমীচীন। এসএসসি থেকে এমএ বা এলএলবি পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষায় অন্তত একটা ফার্স্ট ডিভিশন/ক্লাস থাকা বাঞ্ছনীয়। নিদেনপক্ষে কোনো থার্ড ক্লাস/ডিভিশন যাতে না থাকে, সেটা তো নিশ্চিত করতে হবে। হাইকোর্টের যাঁরা জ্যেষ্ঠ বিচারপতি অর্থাৎ কমবেশি ১০ বছর বিচারপতি হিসেবে বিচার করেছেন, তাঁদের মতামত নিতে হবে। প্রধান বিচারপতি যেহেতু বহু বছর আপিল বিভাগে বসেন, সেহেতু হাইকোর্ট ডিভিশনের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিরাই কোন আইনজীবী বিচারপতি হওয়ার যোগ্য, সে ব্যাপারে বেশি ওয়াকিবহাল।
এখন তো টিন (TIN) নম্বর এবং অন্তত গত পাঁচ বছরের আয়কর রিটার্নের ফিরিস্তি এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বিবরণী ছাড়া বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নই ওঠা উচিত নয়।
আইন দ্বারা যোগ্যতা নির্ধারিত না হলে স্বেচ্ছাচারিতা হতে বাধ্য। মামলার জট আছে জানি যুগ যুগ ধরে। দুই মাস পর বিচারপতিদের নিয়োগ করলে মামলার ভারে সুপ্রিম কোর্ট ভেঙে পড়বে না। আইন ছাড়া নিয়োগ করলে আস্থাহীনতার চাপে বরং কোর্ট নুয়ে পড়তে পারে।
‘দশ বিচারপতি’ রায়ে ওপরে উল্লিখিত বিএলডির ১৩৪ পৃষ্ঠায় আছে: ‘Therefore, the entire process of consultation leading to appointment should be put into writing containing the materials considered against each candidate in support of their suitability.’ অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের জন্য যাঁদের নাম সুপারিশ করেছেন, সেই প্রতিটি সুপারিশের পক্ষে কারণ বা বক্তব্য লিপিবদ্ধ করতে হবে। আইন পাস হওয়ার আগেই আবার যদি বিচারপতি নিয়োগ হয়, তাহলে আমরা প্রধান বিচারপতির লিখিত বক্তব্য জানতে চাইব। কারণ, এই রায়েই বলা আছে, নিয়োগ-প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে।
ড. শাহদীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট।
No comments