শেয়ারবাজার-কিছু ঝুঁকি, কিছু কেলেঙ্কারি থাকবেই! by আবু আহমেদ
তপন আমার ওপর অনেকটা রাগ হয়ে গেলেন। বয়সে ছোট এবং অখ্যাত হলে মনে হয় ঘর থেকেই বের করে দিতেন। বয়সে ভারী বলে এবং চেনাজানা বলে অনেকটা অনুযোগের সুরে বললেন, আপনারা কিছু লোক সব সময় শেয়ারবাজারে জুয়া দেখেন এবং কেলেঙ্কারি খোঁজেন।
আপনারা এসব করেন বলে সংবাদমাধ্যমও ওইগুলোর পিছু লেগে আছে। দেখুন, ওদের খবর, ওরা মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে কারসাজি দেখে, আর মূল্য পড়ার মধ্যে ষড়যন্ত্র দেখে। তাহলে শেয়ারবাজারটা কি এক মূল্যের বাজার হবে? আর আপনারা যাঁরা মৌলভিত্তির কথা বলে অহরহ বক্তব্য দেন, তাঁরা একবারও ভেবে দেখেছেন, এখানে মৌলভিত্তিও মিথ্যা? এখানে শুধু কোম্পানিই মিথ্যা কথা বলে না, অডিটরও মিথ্যা কথা বলে। তাদের সম্পর্ক হলো পারস্পরিক সুবিধার এবং দেনা-পাওনার। তাহলে একটা বিরাট মিথ্যার ওপর তো শেয়ারবাজার দাঁড়িয়ে। এই অবস্থায় এই বাজারে সত্যতা খোঁজেন কেন? আর এই বাজারে জুয়া না থাকলে এবং কেলেঙ্কারি না ঘটলে কি এত বিনিয়োগকারী আসত?
লাখ লাখ লোকের মধ্যে কেউ ঝুঁকি নেবেন, জুয়া খেলবেন, কেউ শেয়ার ব্যবসায়ী হবেন, আর কেউ শেয়ার বিনিয়োগকারী হবেন। অথচ আপনারা সবাইকে বিনিয়োগকারী বানাতে চান! এটা সম্ভবও নয়, প্রয়োজনও নেই। বরং বাজারটাকে আপন পথে চলতে দিন। দেখবেন, সবই ঠিক হয়ে যাবে। আর আপনারা সব বিনিয়োগকারী তথা শেয়ার ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন না। এটা হতেই পারে না। যাঁরা খেলতে গিয়ে হারবেন, তাঁরা তো অর্থ হারাবেনই। কাউকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না, এমন শেয়ারবাজার বিশ্বে একটাও নেই। তাহলে তো শেয়ারবাজারকেই বাদ দিতে হয়। এতক্ষণে তপনের চা এসে গেছে। তপন থেকে বেশি শুনতে চাইলাম। কারণ, তিনি অনেক বিনিয়োগকারীর ভাবনাকেই আমার সামনে তুলে ধরতে চাইছেন। তপন একজন ব্রোকারও বটে। ব্রোকার হিসেবে তাঁকেও বিনিয়োগকারীদের কিছু মতামত দিতে হয়। তপনের কথা হলো, গত দুই বছরে এই বাজারে জুয়াড়িরাই ভালো করেছে এবং সামনেও তা-ই হবে। তপনের দুঃখ বোধ হয় ওই সব বুদ্ধিহীন বিনিয়োগকারীর জন্য, যাঁরা শুধু কোম্পানির মৌল অর্জন দেখে শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন।
তপন এও বললেন, তিনি আগে একটা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন এবং ওই সব জায়গায় আরও বড় জালিয়াতি সংঘটিত হচ্ছে। অথচ কেউ কিছু বলছে না। তপন তাঁর এক আত্মীয়কে নিয়ে একটা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। মাত্র তিন দিনে ওই আত্মীয়ের ব্যয় হয়েছে এক লাখ টাকা। তিনি রাগের সঙ্গে বললেন, ওইটা কোন নৈতিকতা! শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে তো রেগুলেটর, এসইসি আছে। চিকিৎসক এবং হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে কোনো রেগুলেটর বা কমিশন আছে? তাহলে যাঁরা বড় এবং প্রভাবশালী, তাঁরা তো অন্যত্র অন্যায় কাজগুলো ঠিকই করে যাচ্ছে। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর ডাক্তার এবং ল্যাবের মালিকেরা লোকদের সর্বনাশ করছে। আপনার সরকার সেটা নিয়ে চিন্তা করে না। কিন্তু শেয়াবাজারে একটু মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে অমনি ম্যানুপুলেশন আর সিন্ডিকেট ট্রেডিংয়ের গন্ধ পান!
করপোরেট গভর্নেসের কোনো খবর নেই। অথচ আমরা ব্রোকারেরা একটু অন্যায় করলে দরজায় যমদূত এসে হাজির হয়। আপনি এবং সংবাদমাধ্যমের তো আরও এক শ গুণ বেশি বলা উচিত ছিল রেগুলেটরের অদক্ষতা নিয়ে এবং করপোরেট গভর্নেসের উন্নয়নের জন্য। আজতক কয়টা অডিটর কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে? অথচ তাদের তো নিয়োগ দেওয়া হয় কোম্পানির আদ্যোপান্ত এবং সবই দেখার জন্য। আপনাদের এসইসিই বা কয়টা অডিট রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেছে? আপনারা বললেন, ডাইরেক্ট লিস্টিং হবে না, তাহলে পরে কীভাবে দুটো কোম্পানি ডাইরেক্ট লিস্টিং পেল? আর ডাইরেক্ট লিস্টিংয়ের ক্ষেত্রে তো অনেকগুলো তথ্য শেয়ার ক্রেতাদের জানানোর কথা, কিন্তু কী পরিমাণ তথ্য আপনারা দেখতে পেয়েছেন এসব ক্ষেত্রে? আসলে ডাইরেক্ট লিস্টিংয়ের ক্ষেত্রে যারা পারভ্যালুর ৩০ গুণে শেয়ারগুলো কিনছেন, তাঁরা আপনাদের ব্যাখ্যাকৃত মূল্যায়ন পদ্ধতির ধারে কাছেও যাননি। বলতে পারেন অনেকটা জুয়া খেলছেন। তাহলে জুয়া খেলার সুযোগটা তো এসইসি দিচ্ছে, এটাকে নিয়ে আপনাদের এত আফসোস কেন?
আমারও চা খাওয়া শেষ। তপনের হুল ফুটানো কথাগুলোর সব উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমিও তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছি। উঠতে উঠতে ভাবলাম, তপন তো সত্য কথা বলেছে। কিন্তু এই সত্যতা সবাই সমভাবে বোঝে না বলে একশ্রেণীর বিনিয়োগকারী শুধু অর্থই হারাবেন। আমি এও বুঝি যে একেবারে জুয়ার আমেজ থাকবে না যে বাজারে, সেখানে অন্য কিছু হলেও অন্তত শেয়ারবাজার হবে না। কিন্তু এই বাজারে যে সবার সমান দক্ষতা ও শক্তি নেই। রেগুলেটরের কাজ তো হলো সবাইকে সমান ময়দান তৈরি করে দেওয়া। রেগুলেটর কি সেই কাজটি করছে? তদুপরি রেগুলেটরের বড় কাজ হলো অতি দুর্বলদের রক্ষা করা। কিন্তু রেগুলেটর যদি নিজেই ম্যানুপুলেটেড হয়, তাহলে তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না। কেউ কি কোনো দিন শুনেছে, আর্থিক বাজারে বড় খেলোয়াড়েরা মার খায়!
তপন আরও একটা কথা বলেছিলেন, সেটা হলো সরকারি শেয়ারের বিক্রয় নিয়ে। তপন বলেছিলেন, আপনারা তো সরকারি শেয়ারগুলো বিক্রির জন্য অনেকই বললেন। কিন্তু শেয়ারগুলো বেচা হয়েছে কি? হয়ওনি, হবেও না। অর্থমন্ত্রী নির্দেশনা দিলে কী হবে, তাঁর নির্দেশনাকে থামিয়ে দেওয়ার অনেক লোক আছে। যাঁরা সরকারি শেয়ার বিক্রয়ে বাধা দিচ্ছেন, তাঁদের হাত অনেক শক্তিশালী। এবং তাঁরা অর্থমন্ত্রী যেথায় পৌঁছাতে পারেন না, সেথায় পৌঁছতে পারেন। অর্থমন্ত্রী তো শেয়ারগুলো বিক্রয়ের জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। আপনি এর মধ্যে কোনো অগ্রগতি লক্ষ করেছেন? সুতরাং বেশি আশা করে লাভ নেই। অর্থনীতি তো অন্যত্র স্থবির আছে, এখন শেয়ারবাজারকেও যদি স্থবিরতায় ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না।
তপনের আর এক অভিযোগ হলো, তাঁকে এসইসি নতুন শাখা খুলতে দিচ্ছে না। তিনি বললেন, ‘আগে যাঁরা বিনা অনুমতিতে ব্রোকারেজ ফার্মসের শাখা খুলে পরে অনুমতি নিয়েছেন, তাঁরা ভালো আছেন। আমরা এখন পূর্বানুমতি নিয়ে শাখা খুলতে গিয়ে আটকে গেছি।’ এখানে আমি তপনকে থামালাম। বললাম, এত শাখার বাজার কি আমাদের শেয়ারবাজারে আছে? এমনিতেই আমরা বলছি, শেয়াবাজারে অর্থ ও বিনিয়োগকারী বেশি এসে গেছে। সে অবস্থায় আরও শাখা খোলা মানে তো আরও অর্থ ও আরও বিনিয়োগকারী। তাতে তো শেয়ারের মূল্য শুধু বাড়তেই থাকবে। তপন আমার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক যুক্তির ওপর শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কথা হলো, মানুষ অযৌক্তিক মূল্যে শেয়ার কিনবে না, আর কিনলেই বা কী! এক অযৌক্তিক লোক আরেক অযৌক্তিক লোকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে, তাতে কার কী ক্ষতি আছে।
আমি বললাম, বিশ্বের কোথাও এ ধরনের প্রতিযোগিতা রেগুলেটর অনুমোদন দেয় না। আমাদের এই বাজারেও দেওয়া ঠিক হবে না। যা হওয়া উচিত, বাজারের সম্প্রসারণটা শেয়ার সরবরাহের সঙ্গে সংগতি রেখে হওয়া উচিত। আর আমাদের মতো দেশে রেগুলেটরের ওপর চাপ থাকে। চাপ দেয় উদ্যোক্তারা, ব্রোকারেরা এবং ফান্ড ম্যানেজাররা, এই চাপকে মোকাবিলা করেই রেগুলেটরকে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। তবে রেগুলেটর দুর্বল হলে চাপটা বেশি আসে। এবং তখন অনেক সিদ্ধান্ত বাজারের তথা বিনিয়োগকারীদের বিপক্ষে যায়। এই যে এতগুলো মিউচুয়াল ফান্ডের দরখাস্ত এসইসিতে জমা আছে, তার পেছনে কারণ কী? আমাদের বাজার এতগুলো মিউচুয়াল ফান্ড ধারণ করার জন্য কি উপযুক্ত? আর মিউচুয়াল ফান্ড তো শেয়ার নয়, এটা কি বিনিয়োগকারীকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে? এত মিউচুয়াল ফান্ডকে ঘিরে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য হচ্ছে, এটাও কি রেগুলেটর দেখছে না? ভবিষ্যতে তো কেলেঙ্কারি হলে এসব ফান্ডকে ঘিরেই তা হবে।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
লাখ লাখ লোকের মধ্যে কেউ ঝুঁকি নেবেন, জুয়া খেলবেন, কেউ শেয়ার ব্যবসায়ী হবেন, আর কেউ শেয়ার বিনিয়োগকারী হবেন। অথচ আপনারা সবাইকে বিনিয়োগকারী বানাতে চান! এটা সম্ভবও নয়, প্রয়োজনও নেই। বরং বাজারটাকে আপন পথে চলতে দিন। দেখবেন, সবই ঠিক হয়ে যাবে। আর আপনারা সব বিনিয়োগকারী তথা শেয়ার ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন না। এটা হতেই পারে না। যাঁরা খেলতে গিয়ে হারবেন, তাঁরা তো অর্থ হারাবেনই। কাউকেই ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না, এমন শেয়ারবাজার বিশ্বে একটাও নেই। তাহলে তো শেয়ারবাজারকেই বাদ দিতে হয়। এতক্ষণে তপনের চা এসে গেছে। তপন থেকে বেশি শুনতে চাইলাম। কারণ, তিনি অনেক বিনিয়োগকারীর ভাবনাকেই আমার সামনে তুলে ধরতে চাইছেন। তপন একজন ব্রোকারও বটে। ব্রোকার হিসেবে তাঁকেও বিনিয়োগকারীদের কিছু মতামত দিতে হয়। তপনের কথা হলো, গত দুই বছরে এই বাজারে জুয়াড়িরাই ভালো করেছে এবং সামনেও তা-ই হবে। তপনের দুঃখ বোধ হয় ওই সব বুদ্ধিহীন বিনিয়োগকারীর জন্য, যাঁরা শুধু কোম্পানির মৌল অর্জন দেখে শেয়ারে বিনিয়োগ করেছেন।
তপন এও বললেন, তিনি আগে একটা ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন এবং ওই সব জায়গায় আরও বড় জালিয়াতি সংঘটিত হচ্ছে। অথচ কেউ কিছু বলছে না। তপন তাঁর এক আত্মীয়কে নিয়ে একটা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। মাত্র তিন দিনে ওই আত্মীয়ের ব্যয় হয়েছে এক লাখ টাকা। তিনি রাগের সঙ্গে বললেন, ওইটা কোন নৈতিকতা! শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে তো রেগুলেটর, এসইসি আছে। চিকিৎসক এবং হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্রে কোনো রেগুলেটর বা কমিশন আছে? তাহলে যাঁরা বড় এবং প্রভাবশালী, তাঁরা তো অন্যত্র অন্যায় কাজগুলো ঠিকই করে যাচ্ছে। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর ডাক্তার এবং ল্যাবের মালিকেরা লোকদের সর্বনাশ করছে। আপনার সরকার সেটা নিয়ে চিন্তা করে না। কিন্তু শেয়াবাজারে একটু মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে অমনি ম্যানুপুলেশন আর সিন্ডিকেট ট্রেডিংয়ের গন্ধ পান!
করপোরেট গভর্নেসের কোনো খবর নেই। অথচ আমরা ব্রোকারেরা একটু অন্যায় করলে দরজায় যমদূত এসে হাজির হয়। আপনি এবং সংবাদমাধ্যমের তো আরও এক শ গুণ বেশি বলা উচিত ছিল রেগুলেটরের অদক্ষতা নিয়ে এবং করপোরেট গভর্নেসের উন্নয়নের জন্য। আজতক কয়টা অডিটর কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে? অথচ তাদের তো নিয়োগ দেওয়া হয় কোম্পানির আদ্যোপান্ত এবং সবই দেখার জন্য। আপনাদের এসইসিই বা কয়টা অডিট রিপোর্টকে প্রত্যাখ্যান করেছে? আপনারা বললেন, ডাইরেক্ট লিস্টিং হবে না, তাহলে পরে কীভাবে দুটো কোম্পানি ডাইরেক্ট লিস্টিং পেল? আর ডাইরেক্ট লিস্টিংয়ের ক্ষেত্রে তো অনেকগুলো তথ্য শেয়ার ক্রেতাদের জানানোর কথা, কিন্তু কী পরিমাণ তথ্য আপনারা দেখতে পেয়েছেন এসব ক্ষেত্রে? আসলে ডাইরেক্ট লিস্টিংয়ের ক্ষেত্রে যারা পারভ্যালুর ৩০ গুণে শেয়ারগুলো কিনছেন, তাঁরা আপনাদের ব্যাখ্যাকৃত মূল্যায়ন পদ্ধতির ধারে কাছেও যাননি। বলতে পারেন অনেকটা জুয়া খেলছেন। তাহলে জুয়া খেলার সুযোগটা তো এসইসি দিচ্ছে, এটাকে নিয়ে আপনাদের এত আফসোস কেন?
আমারও চা খাওয়া শেষ। তপনের হুল ফুটানো কথাগুলোর সব উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমিও তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছি। উঠতে উঠতে ভাবলাম, তপন তো সত্য কথা বলেছে। কিন্তু এই সত্যতা সবাই সমভাবে বোঝে না বলে একশ্রেণীর বিনিয়োগকারী শুধু অর্থই হারাবেন। আমি এও বুঝি যে একেবারে জুয়ার আমেজ থাকবে না যে বাজারে, সেখানে অন্য কিছু হলেও অন্তত শেয়ারবাজার হবে না। কিন্তু এই বাজারে যে সবার সমান দক্ষতা ও শক্তি নেই। রেগুলেটরের কাজ তো হলো সবাইকে সমান ময়দান তৈরি করে দেওয়া। রেগুলেটর কি সেই কাজটি করছে? তদুপরি রেগুলেটরের বড় কাজ হলো অতি দুর্বলদের রক্ষা করা। কিন্তু রেগুলেটর যদি নিজেই ম্যানুপুলেটেড হয়, তাহলে তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না। কেউ কি কোনো দিন শুনেছে, আর্থিক বাজারে বড় খেলোয়াড়েরা মার খায়!
তপন আরও একটা কথা বলেছিলেন, সেটা হলো সরকারি শেয়ারের বিক্রয় নিয়ে। তপন বলেছিলেন, আপনারা তো সরকারি শেয়ারগুলো বিক্রির জন্য অনেকই বললেন। কিন্তু শেয়ারগুলো বেচা হয়েছে কি? হয়ওনি, হবেও না। অর্থমন্ত্রী নির্দেশনা দিলে কী হবে, তাঁর নির্দেশনাকে থামিয়ে দেওয়ার অনেক লোক আছে। যাঁরা সরকারি শেয়ার বিক্রয়ে বাধা দিচ্ছেন, তাঁদের হাত অনেক শক্তিশালী। এবং তাঁরা অর্থমন্ত্রী যেথায় পৌঁছাতে পারেন না, সেথায় পৌঁছতে পারেন। অর্থমন্ত্রী তো শেয়ারগুলো বিক্রয়ের জন্য ছয় মাস সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। আপনি এর মধ্যে কোনো অগ্রগতি লক্ষ করেছেন? সুতরাং বেশি আশা করে লাভ নেই। অর্থনীতি তো অন্যত্র স্থবির আছে, এখন শেয়ারবাজারকেও যদি স্থবিরতায় ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না।
তপনের আর এক অভিযোগ হলো, তাঁকে এসইসি নতুন শাখা খুলতে দিচ্ছে না। তিনি বললেন, ‘আগে যাঁরা বিনা অনুমতিতে ব্রোকারেজ ফার্মসের শাখা খুলে পরে অনুমতি নিয়েছেন, তাঁরা ভালো আছেন। আমরা এখন পূর্বানুমতি নিয়ে শাখা খুলতে গিয়ে আটকে গেছি।’ এখানে আমি তপনকে থামালাম। বললাম, এত শাখার বাজার কি আমাদের শেয়ারবাজারে আছে? এমনিতেই আমরা বলছি, শেয়াবাজারে অর্থ ও বিনিয়োগকারী বেশি এসে গেছে। সে অবস্থায় আরও শাখা খোলা মানে তো আরও অর্থ ও আরও বিনিয়োগকারী। তাতে তো শেয়ারের মূল্য শুধু বাড়তেই থাকবে। তপন আমার এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। তিনি তাঁর ব্যবসায়িক যুক্তির ওপর শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কথা হলো, মানুষ অযৌক্তিক মূল্যে শেয়ার কিনবে না, আর কিনলেই বা কী! এক অযৌক্তিক লোক আরেক অযৌক্তিক লোকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে, তাতে কার কী ক্ষতি আছে।
আমি বললাম, বিশ্বের কোথাও এ ধরনের প্রতিযোগিতা রেগুলেটর অনুমোদন দেয় না। আমাদের এই বাজারেও দেওয়া ঠিক হবে না। যা হওয়া উচিত, বাজারের সম্প্রসারণটা শেয়ার সরবরাহের সঙ্গে সংগতি রেখে হওয়া উচিত। আর আমাদের মতো দেশে রেগুলেটরের ওপর চাপ থাকে। চাপ দেয় উদ্যোক্তারা, ব্রোকারেরা এবং ফান্ড ম্যানেজাররা, এই চাপকে মোকাবিলা করেই রেগুলেটরকে সিদ্ধান্ত দিতে হয়। তবে রেগুলেটর দুর্বল হলে চাপটা বেশি আসে। এবং তখন অনেক সিদ্ধান্ত বাজারের তথা বিনিয়োগকারীদের বিপক্ষে যায়। এই যে এতগুলো মিউচুয়াল ফান্ডের দরখাস্ত এসইসিতে জমা আছে, তার পেছনে কারণ কী? আমাদের বাজার এতগুলো মিউচুয়াল ফান্ড ধারণ করার জন্য কি উপযুক্ত? আর মিউচুয়াল ফান্ড তো শেয়ার নয়, এটা কি বিনিয়োগকারীকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে? এত মিউচুয়াল ফান্ডকে ঘিরে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য হচ্ছে, এটাও কি রেগুলেটর দেখছে না? ভবিষ্যতে তো কেলেঙ্কারি হলে এসব ফান্ডকে ঘিরেই তা হবে।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments