মায়ের জন্য যুদ্ধ by শাকিল আবদুল্লাহ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন, ‘ফার্স্ট ইয়ার ডোন্ট কেয়ার’ করে ঘুরে বেড়াই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় পার করি। দিব্যি মজার জীবন। একদিন হঠাৎ করে খবর এল, আমার মা অসুস্থ। বুক কেঁপে ওঠে অজানা আতঙ্কে। সর্বংসহা মা আমার দুনিয়ার সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা থেকে আগলে রাখে আমাকে।
আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান কিনা! নিজের ব্যথাবেদনার কথা মুখ ফুটে বলে না কোনো দিন। মা অসুস্থ হওয়ার খবরটা তাই আশঙ্কার শেল হয়ে বুকে বিঁধে বসে। মনে মনে খুব করে বলি, আমার মায়ের যেন খারাপ কিছু না হয়, খারাপ কিছু না হয়। কিন্তু মানুষের চাওয়ার সঙ্গে বাস্তবের কী অমিল! আমার মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ল। রোগ যত বড়, তার চেয়ে ভয়ংকর তার চেহারা। আমাদের মতো সাধারণ মধ্যবিত্তদের জ্বর হলে চিকিৎসা প্যারাসিটামলেই আটকে যায়। সেখানে ক্যানসারের মতো কঠিন অসুখ বোঝার ওপর শাকের আঁটি নয়, হিমালয় পর্বত। মাকে ভালোবাসে না এমন মানুষ কি কোনো জগতে খুঁজে পাওয়া যাবে? আমার জীবনের সব স্বপ্ন, সব ইচ্ছা কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গেল। কী করব কিংবা কী করা উচিত—কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। সেই সময় আমার বড় মামা আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি জানতাম, আমার মা বাঁচবেই, আমার মাকে আমি মরতে দেব না। তবে সে জন্য যুদ্ধ করতে হবে, মামা শিখিয়ে দিলেন সেটাই। কিন্তু আমি তো মায়ের ছোট্ট ছেলে, কী করে লড়ব অমন একটা মরণব্যাধির সঙ্গে? লড়ে জিততে পারব তো? ভয় হতো সব সময়। মনে হতো, এই বুঝি মাকে হারিয়ে ফেললাম মৃত্যুর অতল অন্ধকারে। সেই আঁধারে বুঝি মাকে আর খুঁজে পাব না, ভয় হতো আমার। এমন আঁধারের দিনে আমার আর আমার মায়ের জীবনে আলো হয়ে ধরা দিল প্রথম আলো। প্রথম আলো বন্ধুসভার আর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা সবাই মিলে ঠিক করলাম, একটা কনসার্ট করব। আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এল মাত্রা। ২০০৮ সালের ৯ আগস্ট ঠিক করা হলো কনসার্টের দিন। নাম দেওয়া হলো ‘মায়ের জন্য গান’। সেই কনসার্টে গান গাইতে এলেন সুবীর নন্দী, সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবী, রিংকু, ব্যান্ডদল আর্টসেল আর প্রমিথিউস। সেই কনসার্টে টিএসসির অডিটোরিয়াম ভরে গেল কানায় কানায়। আমার মায়ের জীবন বাঁচাতে তার কত কত সন্তান যে সেদিন ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসেছিল, আমি বলতেও পারব না। শুধু জানি, সেই কনসার্টের টিকিট বিক্রির টাকায় আমার মায়ের চিকিৎসা হলো। ভারতের চিকিৎসকেরা বললেন, আমার মা ভালো হয়ে গেছে। অবশেষে আমার মা বেঁচে ফিরে এল আমার কাছে। মরণব্যাধি ক্যানসারকে হারিয়ে দিলাম আমরা সবাই মিলে। আজ আমার মা খুব ভালো আছে। এখনো আগের মতোই শিক্ষকতা করছে, জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছে কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকার ঘরে ঘরে। তাতেই নাকি তার সবচেয়ে বেশি আনন্দ। আর আমি আমার মায়ের সততা আর উৎসর্গের দৃষ্টান্ত বুকে নিয়ে বেড়ে উঠছি দিন দিন। জানি, জীবনে যত বড়ই সফলতা অর্জন করি না কেন, আমার মাকে বাঁচানোর লড়াইতে জয়ী হওয়ার যে গৌরব, তার তুলনায় সেসব ধুলোর সমান। মাঝেমধ্যে যখন হুট করে বাড়ি ফিরি, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি, মা আমার একমনে ঘর সামলে যাচ্ছে। চৌকাঠে হেলান দিয়ে আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি একদৃষ্টে, চোখে পানি চলে আসে। মনে মনে বলি, মা, তুমি কোনো দিন আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, কেমন?
লেখক: একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কর্মরত
লেখক: একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কর্মরত
No comments