চারদিক-শ্যামের বাঁশরীতে ধামাইল নাচ by আকমল হোসেন নিপু
বড় কোনো আলোকমঞ্চ নয়, নয় ঢাকঢোল পেটানো আয়োজন। গ্রামের বুকে এক দল মানুষের এ যেন সুখপাখি খোঁজা। তাঁরা এসেছেন গাইতে, তাঁরা এসেছেন নাচতে। প্রাণভরা তাঁদের সুরের দোলা, রক্তে থইথই নাচ। হারানো নাচ, হারানো কথা ও সুরকে প্রাণ দিতেই তাঁদের যত হইচই।
এখানে না আছে বৈষয়িকতার অঙ্ক কষা, না আছে বিত্তবৈভবের ঝলক। তাঁদের মন ভর্তি অন্য এক মরমী কাতরতা, যেখানে সবকিছুকে তুচ্ছ করে বেজে ওঠে শ্যাম কালিয়ার আনন্দ বাঁশি।
‘সখি আমার নামটি প্রেয়সী/ নাম ধরিয়া বাজায় বন্ধে বাঁশরি’ কিংবা ‘আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়/তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয়।’... গানগুলো রাধারমণের। কিন্তু এগুলো সাধারণ মানুষের প্রাণের ভেতর দোলা দেওয়া লোক-আত্মার গান। এ রকম শাহ আবদুল করিমের ‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী/আমারে কেউ ছুঁইও নাগো সজনী’ বা ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে/পিরিতি শিখাইছে’ অথবা প্রভাতরঞ্জন তালুকদারের ‘একবার বাজাও বাজাওরে বন্ধু বাজাও বাঁশিখান/তোমারও বাঁশির সুরে উইড়া যায় পরান।’... এ রকম গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত গান। এ গানগুলো শুধুই কি গান! হ্যাঁ, গান তো বটেই। কিন্তু তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নৃত্য, যাকে সবাই ‘ধামাইল নৃত্য’ নামে চেনে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতির বিশাল আত্মার এই সম্পদ ধামাইল নৃত্য ও গান মরমী সাধক কবি রাধারমণ দত্তের হাতেই সৃষ্টি হয়েছে, বিকাশও হয়েছে তাঁর হাতেই।
একটা সময় ছিল, কি হিন্দু, কি মুসলিম—বিয়ের অনুষ্ঠান ধামাইল নৃত্য ছাড়া ভাবা যেত না। বিয়ের আগের রাতে নানা বয়সের নারীরা দল বেঁধে এই ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করতেন। কিছু নারী ছিলেন, যেকোনো বিয়ের আসরে তাঁদের ডাক পড়ত। এই ধামাইল নৃত্য না হলে যেন বিয়ের আনন্দ পূর্ণ হতো না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবখানে ধামাইল নৃত্যের ছিল সমান কদর। এই নৃত্যগীত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীকণ্ঠে গাওয়া হয় বলে একে অনেকে নারীসংগীতও বলে থাকেন। এই নৃত্যগীতের মাধ্যমে ফুটে ওঠে নারীমনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা ও সামাজিক বাস্তবতার ছবি। সাংস্কৃতিক কর্মী অজয় দেবরায় বলেন, ‘ধামাইল নৃত্য শুধু যে নারীরাই পরিবেশন করতেন, এমন নয়। পুরুষেরাও বিভিন্ন উৎসবে দল বেঁধে ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করতেন। ধামাইল নৃত্য করা ছিল আনন্দ ও শখের বিষয়। এখন হিন্দুদের বিয়েতে অধিবাসের দিন ভাড়াটে নারী এনে ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে।’
শুধু কি বিয়ের আসর, পূজা-পার্বণ, কিংবা অন্নপ্রাশনের মতো সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব ধামাইল নৃত্য ছাড়া জমতো না। কিন্তু সময় এখানেও ছোবল দিয়েছে। লোকজ প্রাণশক্তির এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বিয়ের আসরে এখন সেই জলভেজা, প্রাণের মমতাশ্রয়ী কথা বা সুরের নৃত্যগীত প্রায় শোনা বা দেখা যায় না।
তবে কি এই ধামাইল নৃত্য হারিয়ে গেছে! না, এখনও গ্রামাঞ্চলে, কিছু পার্বণের আনুষ্ঠানিকতায় যুক্ত আছে ধামাইল নৃত্য। লোকসংস্কৃতির এই নৃত্যটিকে বাঁচিয়ে রাখতেই সম্প্রতি একটি ধামাইল নৃত্য উৎসব হয়ে গেল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও ইউনিয়নের রুস্তুমপুর গ্রামে। আয়োজকদের মতে, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে শুধু ধামাইল নৃত্য নিয়ে এ রকম উৎসব এই প্রথম।
‘চল ফিরে যাই প্রাণের টানে, মাটির গানে’— এই প্রতিপাদ্যকে বিষয় করে আঞ্চলিক ধামাইল নৃত্যগীতের একটি সংগঠন ‘নবনাগরী ধামাইল সংঘ’ ধামাইল উৎসব ২০১০-এর আয়োজন করে। এতে সমবেত হয়েছিল বিভিন্ন এলাকা থেকে আটটি ধামাইল নাচের দল। তারা গাইল, নাচাল—লুপ্তপ্রায় লোকজ আত্মাটিকে পুনরুদ্ধার করতে, জনলোকে ছড়িয়ে দিতেই। কোনো অর্থ-যশ বা বড় কোনো প্রাপ্তির টানাপোড়েন নয়, প্রাণের স্রোতে ভেসে যেতে, সবাইকে মেলাতেই যেন ছিল এই উৎসব। আয়োজকদের কথা, ধামাইল গান ও সুরের আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও দেশজুড়ে এখনও সেভাবে প্রচার পায়নি। কিছু গান গাওয়া হয়, কিন্তু সেটা ধামাইল না কি স্রেফ লোকগান হিসেবে গাওয়া হয়, বিষয়টি স্পষ্ট নয়। নবনাগরী ধামাইল সংঘের প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ সরকার বলেন, ‘ধামাইল নৃত্য বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী বিষয় হলেও তা এখন অনেকটা লুপ্তপ্রায়। ধামাইল নৃত্য অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে। এ জন্যই ধামাইল নৃত্য উৎসবের আয়োজন। এই উৎসবের উদ্দেশ্য হচ্ছে ধামাইল গীত সংরক্ষণ করা। ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা। আবারও লোকসমাজে তাকে ছড়িয়ে দেওয়া। অনেক জায়গায় ধামাইল নৃত্য করা হয়। কিন্তু গানের কথা ও সুর এবং নাচের তাল ঠিক থাকে না।’
ঐতিহ্য ধরে রাখা বা সংরক্ষণ, যা-ই করা হোক, রাধারমণ দত্তের এই গানটি যখন ধামাইল নৃত্যের তালে তালে গৃহবাসী মানুষজন গাইতে থাকেন, ‘আসবে শ্যাম কালিয়া কুঞ্জ সাজাও গিয়া/এগো মনরঙ্গে সাজাও কুঞ্জ সব সখি মিলিয়া’... তখন কার না মনপ্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। এই ধূসর, ক্লেদাক্ত, ক্লিশে সময়ের কাছে সমর্পিত যে জীবন, তাকে কিছুটা রঙ্গ দিতে ধামাইল নৃত্য ও গান হয়তো এভাবেই আনন্দরসে সিক্ত হয়ে বেঁচে থাকবে যুগ যুগ।
‘সখি আমার নামটি প্রেয়সী/ নাম ধরিয়া বাজায় বন্ধে বাঁশরি’ কিংবা ‘আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয়/তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয়।’... গানগুলো রাধারমণের। কিন্তু এগুলো সাধারণ মানুষের প্রাণের ভেতর দোলা দেওয়া লোক-আত্মার গান। এ রকম শাহ আবদুল করিমের ‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী/আমারে কেউ ছুঁইও নাগো সজনী’ বা ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে/পিরিতি শিখাইছে’ অথবা প্রভাতরঞ্জন তালুকদারের ‘একবার বাজাও বাজাওরে বন্ধু বাজাও বাঁশিখান/তোমারও বাঁশির সুরে উইড়া যায় পরান।’... এ রকম গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত গান। এ গানগুলো শুধুই কি গান! হ্যাঁ, গান তো বটেই। কিন্তু তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নৃত্য, যাকে সবাই ‘ধামাইল নৃত্য’ নামে চেনে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের লোকজ সংস্কৃতির বিশাল আত্মার এই সম্পদ ধামাইল নৃত্য ও গান মরমী সাধক কবি রাধারমণ দত্তের হাতেই সৃষ্টি হয়েছে, বিকাশও হয়েছে তাঁর হাতেই।
একটা সময় ছিল, কি হিন্দু, কি মুসলিম—বিয়ের অনুষ্ঠান ধামাইল নৃত্য ছাড়া ভাবা যেত না। বিয়ের আগের রাতে নানা বয়সের নারীরা দল বেঁধে এই ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করতেন। কিছু নারী ছিলেন, যেকোনো বিয়ের আসরে তাঁদের ডাক পড়ত। এই ধামাইল নৃত্য না হলে যেন বিয়ের আনন্দ পূর্ণ হতো না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবখানে ধামাইল নৃত্যের ছিল সমান কদর। এই নৃত্যগীত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীকণ্ঠে গাওয়া হয় বলে একে অনেকে নারীসংগীতও বলে থাকেন। এই নৃত্যগীতের মাধ্যমে ফুটে ওঠে নারীমনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা ও সামাজিক বাস্তবতার ছবি। সাংস্কৃতিক কর্মী অজয় দেবরায় বলেন, ‘ধামাইল নৃত্য শুধু যে নারীরাই পরিবেশন করতেন, এমন নয়। পুরুষেরাও বিভিন্ন উৎসবে দল বেঁধে ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করতেন। ধামাইল নৃত্য করা ছিল আনন্দ ও শখের বিষয়। এখন হিন্দুদের বিয়েতে অধিবাসের দিন ভাড়াটে নারী এনে ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করা হয়ে থাকে।’
শুধু কি বিয়ের আসর, পূজা-পার্বণ, কিংবা অন্নপ্রাশনের মতো সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব ধামাইল নৃত্য ছাড়া জমতো না। কিন্তু সময় এখানেও ছোবল দিয়েছে। লোকজ প্রাণশক্তির এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। বিয়ের আসরে এখন সেই জলভেজা, প্রাণের মমতাশ্রয়ী কথা বা সুরের নৃত্যগীত প্রায় শোনা বা দেখা যায় না।
তবে কি এই ধামাইল নৃত্য হারিয়ে গেছে! না, এখনও গ্রামাঞ্চলে, কিছু পার্বণের আনুষ্ঠানিকতায় যুক্ত আছে ধামাইল নৃত্য। লোকসংস্কৃতির এই নৃত্যটিকে বাঁচিয়ে রাখতেই সম্প্রতি একটি ধামাইল নৃত্য উৎসব হয়ে গেল মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও ইউনিয়নের রুস্তুমপুর গ্রামে। আয়োজকদের মতে, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে শুধু ধামাইল নৃত্য নিয়ে এ রকম উৎসব এই প্রথম।
‘চল ফিরে যাই প্রাণের টানে, মাটির গানে’— এই প্রতিপাদ্যকে বিষয় করে আঞ্চলিক ধামাইল নৃত্যগীতের একটি সংগঠন ‘নবনাগরী ধামাইল সংঘ’ ধামাইল উৎসব ২০১০-এর আয়োজন করে। এতে সমবেত হয়েছিল বিভিন্ন এলাকা থেকে আটটি ধামাইল নাচের দল। তারা গাইল, নাচাল—লুপ্তপ্রায় লোকজ আত্মাটিকে পুনরুদ্ধার করতে, জনলোকে ছড়িয়ে দিতেই। কোনো অর্থ-যশ বা বড় কোনো প্রাপ্তির টানাপোড়েন নয়, প্রাণের স্রোতে ভেসে যেতে, সবাইকে মেলাতেই যেন ছিল এই উৎসব। আয়োজকদের কথা, ধামাইল গান ও সুরের আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও দেশজুড়ে এখনও সেভাবে প্রচার পায়নি। কিছু গান গাওয়া হয়, কিন্তু সেটা ধামাইল না কি স্রেফ লোকগান হিসেবে গাওয়া হয়, বিষয়টি স্পষ্ট নয়। নবনাগরী ধামাইল সংঘের প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ সরকার বলেন, ‘ধামাইল নৃত্য বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী বিষয় হলেও তা এখন অনেকটা লুপ্তপ্রায়। ধামাইল নৃত্য অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছে। এ জন্যই ধামাইল নৃত্য উৎসবের আয়োজন। এই উৎসবের উদ্দেশ্য হচ্ছে ধামাইল গীত সংরক্ষণ করা। ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা। আবারও লোকসমাজে তাকে ছড়িয়ে দেওয়া। অনেক জায়গায় ধামাইল নৃত্য করা হয়। কিন্তু গানের কথা ও সুর এবং নাচের তাল ঠিক থাকে না।’
ঐতিহ্য ধরে রাখা বা সংরক্ষণ, যা-ই করা হোক, রাধারমণ দত্তের এই গানটি যখন ধামাইল নৃত্যের তালে তালে গৃহবাসী মানুষজন গাইতে থাকেন, ‘আসবে শ্যাম কালিয়া কুঞ্জ সাজাও গিয়া/এগো মনরঙ্গে সাজাও কুঞ্জ সব সখি মিলিয়া’... তখন কার না মনপ্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। এই ধূসর, ক্লেদাক্ত, ক্লিশে সময়ের কাছে সমর্পিত যে জীবন, তাকে কিছুটা রঙ্গ দিতে ধামাইল নৃত্য ও গান হয়তো এভাবেই আনন্দরসে সিক্ত হয়ে বেঁচে থাকবে যুগ যুগ।
No comments