সময়ের প্রতিবিম্ব-কত দিন মা গো, আ-র কত দিন! by এবিএম মূসা
কয়েকটি দেওয়া-নেওয়ার মহামূল্যবান উদ্ধৃতি দিয়ে আজকের প্রতিবেদনের সূচনা করছি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইংরেজবিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধে ভারতবাসীকে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ অনুষ্ঠানে কেনেডির বিখ্যাত উদ্বোধনী ভাষণ, ‘আস্ক নট হোয়াট আমেরিকা ক্যান গিভ ইউ, আস্ক হোয়াট ইউ ক্যান গিভ আমেরিকা।’
বাংলা মানে হলো, ‘রাষ্ট্র তোমাকে কী দিতে পারে জিজ্ঞেস কোরো না, তোমরা রাষ্ট্রকে কী দেবে বলো।’ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৩০ লাখ বাঙালি রক্ত দিয়েছিল। তিনি তাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। দেওয়া-নেওয়ার এমনি হাজারো উদাহরণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আছে।
এসব আদান-প্রদানের ভাবনার আলোকে প্রশ্ন করতে পারি, ‘আমরা সরকারকে বিদ্যুত্ দিয়ে যাচ্ছি কবে নাগাদ ফেরত পাব?’ তবে এটি হবে ব্যতিক্রমী প্রশ্ন। কারণ আমরা ‘দিচ্ছি না’, আসলে সরকারই নিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে এখনো পেয়ে যাচ্ছি শুধু প্রতিশ্রুতি। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী সংসদে চার বছর ধাপে ধাপে বিদ্যুত্ পাব বলে মেগাওয়াটের হিসাবে আশ্বস্ত করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে ‘কিছুক্ষণের জন্য’ লোডশেডিং করেছেন, অর্থাত্ বিদ্যুত্ প্রদান স্থগিত করেছেন। এই ‘কিছুক্ষণ’ ক্রমান্বয়ে হলো কিছু ঘণ্টা, অতঃপর দিনরাতের আপাতত অর্ধেক সময়। এমনি চলতে থাকলে সরকারের নেওয়ার বা জনগণের দেওয়ার আর কিছুই থাকবে কি না জানি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ধীরে ধীরে দেবেন।’ মেগাওয়াটের অঙ্ক কষে তিনি সংসদে আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁর উপদেষ্টা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এত দিন এটুকুও দেননি। গত সোমবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি শুনে ১৪ মাস পর জনগণ জানতে পেরেছেন, ‘দেবে, সরকার অবশ্যই দেবে। তবে সময় লাগবে, কারণ এর আগের সরকারগুলো কিছু দিয়ে যায়নি, এখন দিতে নানা প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হচ্ছে। কিন্তু নিজেরা ১৪ মাসে কেন দেয়নি তা ব্যাখ্যা করেনি।
প্রধানমন্ত্রী কিছু দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিবরণ দিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছেন। তাঁর ভাষণের আশ্বাসের চেয়েও উল্লেখযোগ্য ও ব্যতিক্রমী দিকটি হলো ‘তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’ তিন দিন আগে ‘প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুত্-সংকট নিরসনে বিরোধী দলসহ সব সাংসদের সহযোগিতা কামনা করেছেন। তিনি জনগণকে ধৈর্য ধারণ করতে ও শান্ত থাকতে বলেছেন। অতীতে কোনো সরকারপ্রধান অথবা রাষ্ট্রনায়ক তাঁদের কোনো সাময়িক অথবা সামগ্রিক ব্যর্থতা বা অপারগতার জন্য একটুখানি হলেও দুঃখিত হয়েছেন অথবা সর্বসাধারণের সহযোগিতা চেয়েছেন—এমন উদাহরণ নেই। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারপ্রধান যে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও যন্ত্রণা অনুভব করে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তা যে আন্তরিক, তা আমরা বিশ্বাস করি। তিনি জনদরদি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, জনগণের দুর্দশা ও দুর্ভোগ অবশ্যই তাঁর হূদয়কে স্পর্শ করেছে। আমি মনে করি, তাঁর এই সহমর্মিতা প্রকাশ জনগণের জন্য অনেকখানি পাওনা। তবে সেই পাওনাটুকু যথেষ্ট নয়। আসল পাওনা বিদ্যুত্, পানি ও গ্যাস। সেটি কবে পাব তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ধাপে ধাপে দেওয়ার আশ্বাসে জনগণের দুর্ভাবনা আর ক্ষোভ খুব বেশি প্রশমিত হয়েছে কি?
প্রধানমন্ত্রীর সংসদে প্রদত্ত বক্তব্যে ও তাঁর বরাতে পাঠানো চিঠির বক্তব্যে অতীতে সাতটি বছর যে কোনো বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়নি, গ্যাস উত্তোলনের কোনো প্রচেষ্টা ক্ষমতাসীন সরকারগুলো নেননি, এসব উদাহরণ টেনে এনে সেই পুরোনো অভিযোগটির পুনরাবৃত্তি তিনি না করলেও পারতেন। কারণ বর্তমান বিদ্যুত্-সংকট যে তাঁর সরকারের সৃষ্ট নয়, অতীতের লিগেসি বা উত্তরাধিকার, পূর্ববর্তী সরকারের ব্যর্থতার দায় বহন করতে হচ্ছে, এই সত্যটি জনগণের জানা আছে। বিএনপি সরকার শুধু বিদ্যুত্-গ্যাস নয়, অনেক ক্ষেত্রেই যা কিছু করার ছিল তা করেনি। এই না-করায় জনগণ শেষ পর্যন্ত অশান্ত হয়ে সেই সরকারের অপারগতা অথবা অযোগ্যতার জন্য শাস্তিস্বরূপ গত নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি ঘটিয়েছে। বর্তমান চরম বিদ্যুত্-সংকট ও গ্যাস সরবরাহ বিপর্যয়ের সূচনা থেকেই হিসাব-নিকাশ চলছে, কোন সরকার কত দূর দিয়েছিল অথবা দেয়নি। সাধারণ মানুষ এখন আর সেসব শুনতে চায় না। মেগাওয়াটের জটিল হিসাব, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে বিশেষজ্ঞদের বাগাড়ম্বর তাদের কাছে অবোধ্য ও একঘেয়ে মনে হয়। তারা হিসাব চায় না, তারা বাতির সুইচ টিপে দেখতে চায় বিদ্যুত্ আছে কি না। কল খুলে পানি খোঁজে, বার্নারের চাবি ঘুরিয়ে অপেক্ষা করে কখন দপ করে আগুন জ্বলে উঠবে। এ সবই হবে, তবে কবে হবে এত দিন কেউ বলতে পারেনি অথবা বলেনি। অবশেষে সংসদে যা-ই হোক, প্রধানমন্ত্রী একটি সময়সীমা উল্লেখ করেছেন। বছরওয়ারি হিসাবটিতে দিন গণনা করলে হিমশিম খেতে হবে। তাই এত দিন কেন দিতে পারেননি সেই ব্যাখ্যাটিও ভাষণে থাকলে জনগণ অধিকতর আশ্বস্ত হতো।
গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে রয়েছে, সরকারের জ্বালানিমন্ত্রী এবং বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা বলেছেন, ‘সরকার ও বিরোধী দলের ৩৪৫ জন সাংসদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বর্তমান বিদ্যুত্-পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে জনগণকে বোঝানোর অনুরোধ করা হয়েছে।’ আমি এই ৩৪৫ জনের যে কেউ একজনকে প্রশ্ন করতে পারি, তাঁরা কী ব্যাখ্যা করবেন নিজেরা কি তা জানেন? কী আশার স্তোকবাক্যে জনগণকে শান্ত থাকতে বলবেন? বরং জনগণকে বিদ্যুতের মেগাওয়াট আর গ্যাসের ঘনফুট কাকে বলে সেই সবক দিতে গেলে ৩৪৫ জন সাংসদের অনেককেই যে বিএনপির সালাউদ্দিনের প্রদর্শিত পন্থায় ‘যঃ পলায়তিং সঃ জীবতি’ বেদবাক্য অনুসরণে দৌড় দিতে হবে। শুনেছি, অনেক সাংসদ নাকি এই আশঙ্কায় এলাকায়ই যান না।
বিদ্যুত্ ও গ্যাস-সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ৩৪৫ জনকে যে পত্র দেওয়া হয়েছে তাতে সংকট নিরসনে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কবে নাগাদ বিদ্যুত্-পানি ভোগান্তির অবসান হবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে কি না জানি না। গত ১৪ মাস প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে বলেছেন, ‘গতবার মানে ১৯৯৬—২০০১ মেয়াদের অবসানে তাঁর সরকার বিদ্যুত্-গ্যাস যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানেই আছে।’ তাঁর এই অভিযোগ বা বিদ্যুত্, গ্যাস, পানিসংকট বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এমন প্রশ্নও করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় দেড় বছর পরও কি ‘সেখানেই আছে’, নাকি আরোহণ অথবা অবতরণ ঘটেছে? এই ১৪ মাসে বিদ্যুত্-গ্যাস উত্পাদন বৃদ্ধির উদ্যোগের উদাহরণ বেশি নেই। এই কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে, অমুক যন্ত্র রাখতে হবে, অমুক এলাকায় এতক্ষণ অন্ধকার থাকবে, নিত্যনতুন নির্দেশই শুনেছি। তদুপরি নীতি-নির্ধারকেরা সরকারি ‘এধারকা মাল উধার করছেন।’ সার উত্পাদনের গ্যাস বিদ্যুেকন্দ্রে দিচ্ছেন। বিদ্যুত্ বাসাবাড়িতে দেবেন বলে দোকানপাট আর কলকারখানা আধা-বন্ধ ও আধা-খোলা রাখতে বলছেন। কিন্তু কত দিন এসব নির্দেশনা কার্যকর থাকবে তা নির্দিষ্টভাবে বললে জনগণ আশ্বস্ত হতো এবং প্রধানমন্ত্রীকে ‘অশান্ত’ না হওয়ার জন্য আবেদন করতে হতো না।
কথায় কথায় অনেক কথা বলেছি, আসল প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর সংসদে প্রদত্ত ভাষণ, জ্বালানি-খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর পাঠানো পত্রটি জনমনে কি প্রভাব ফেলবে? উল্লিখিত চিঠিতে জনগণকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। আগেই বলেছি, জনগণের ব্যথায় ব্যথিত প্রধানমন্ত্রীর আবেদনটি জনগণ ইতিবাচক মনে করে আপাতত শান্ত থাকবে। সত্যি কথা বলতে হয়, তারা তো এমনিতেই শান্ত রয়েছে। চরম সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে, যা বাঙালির ধাতে নেই। তার পরও বলছে, কিন্তু ‘কত দিন, মা গো, আ-র কত দিন?’ প্রথম আলোয় সোমবার প্রকাশিত কতিপয় নাগরিক মন্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার এই প্রতিবেদনের প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। অনেকের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের লিটনের প্রশ্নটি উদ্ধৃত করছি, ‘কত দিনে, কত সময়ে, কত অর্থে’ বিদ্যুত্-গ্যাস-পানির সমস্যার সমাধান হবে? আমাদের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন (প্রথম আলো, সোমবার, পৃষ্ঠা-২)। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সদস্যদের বলেছেন, দেশবাসী বিদ্যুত্ না পেলেও শিগগিরই একটি বিবৃতি পাবে। সেই বিবৃতিতে ‘বিদ্যুত্ পরিস্থিতির সঠিক অবস্থার বিবরণ থাকবে, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা থাকবে, আর অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। উত্পাদনের পরিকল্পনা আছে, কী সব চুক্তি হবে সবই নাকি জানা যাবে। সেই বিবৃতিটি সংসদে ভাষণ আকারে প্রধানমন্ত্রী গত সোমবার দিয়ে দিয়েছেন।
এখন অপেক্ষা করতে হবে সেই ভাষণ শুনে বা পড়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সময়সূচি জনগণকে কত দিন শান্ত রাখবে? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবে না, প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন না। কারণ এই দেশে গত ৫৪ বছরের না পাওয়ার ইতিহাস বলে, জনগণ যখন ‘অশান্ত’ হয়ে তাণ্ডব শুরু করে তখন আবেদন-নিবেদন আর চিঠি দিয়ে তাদের শান্ত রাখা যায় না। আইয়ুব খানের ‘উন্নয়নের দশকের’ ঢাকঢোল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঠেকাতে পারেনি। তাই প্রথম আলোর পাঠকদের জিজ্ঞাসার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলব, ‘প্রধানমন্ত্রী, জনগণের আপনার ওপর এখনো অগাধ আস্থা রয়েছে। আপনার ভাষণ শুনে জনগণ আপাতত শান্ত থেকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে। গিন্নিরা চুলোর কাছে বসে থাকবে কখন ভাত চড়াবেন, পরীক্ষার্থীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে মায়ের হাতের পাখার বাতাস খাবে আর মাঝেমধ্যে বিদ্যুত্বাতিটির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করবে। পাড়ার মা-বোনেরা রাস্তার অপর প্রান্তের দিকে চেয়ে থাকেন ওয়াসার গাড়ি আসছে কি না।
আপনার দেওয়া সময়সূচিতে তাদের যে আস্থা আছে তা কি চার বছর বজায় থাকবে? প্রশ্নটি করার কারণ, গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী যে জাঁকজমকের সঙ্গে ফেঞ্চুগঞ্জে দুটি বিদ্যুেকন্দ্র উদ্বোধন করেছেন, এই খবরটি তাদের একটুখানি আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু পত্রিকাটির ছিদ্রান্বেষী বিশেষ প্রতিনিধির প্রতিবেদনটিতে কুমিরের বাচ্চা দেখে তারা বরং হতাশ হতে পারে। প্রতিবেদনটি হলো, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ফেঞ্চুগঞ্জে ৫১ মেগাওয়াট ও গত মাসে সিদ্ধিরগঞ্জে ১২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার যে বিদ্যুেকন্দ্র উদ্বোধন করেছেন, সেগুলোতে উত্পাদন আরম্ভ হয়েছে অনেক আগে। জাতীয় গ্রিডে আগে থেকেই এসব কেন্দ্রের বিদ্যুত্ সঞ্চালিত হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।’ অতঃপর অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুত্-গ্যাস-পানি সরবরাহের পরিকল্পনার বিবরণী নিয়ে ‘মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।’
তার পরও একজনের রসাল মন্তব্য শুনলাম গুলশানে দুই দিন আগে এক খোশগল্পের আসরে। প্রধানমন্ত্রীর বছর বছর বিদ্যুত্ প্রদানের হিসাবসংবলিত ভাষণটি সম্পর্কে বললেন, ‘বিএনপি পাঁচ বছর খাম্বা দিয়েছে। এই সরকার সাড়ে চার বছর সেই সব খাম্বায় বিদ্যুতের তার টানাবে। দিনপঞ্জির পাতা উল্টিয়ে দেখলাম, সেই সময়ের মধ্যেই বর্তমান সরকারের শাসন সময়কালের পরিসমাপ্তি ঘটবে। তাহলে সেই তারে বিদ্যুত্ সঞ্চালন করবে নতুন বা পুরোনো অথবা অন্য কোনো সরকার?’ তাই তো বলছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার প্রতিশ্রুত বিদ্যুত্ সরবরাহের দিনকাল আরও সংক্ষিপ্ত করুন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
এসব আদান-প্রদানের ভাবনার আলোকে প্রশ্ন করতে পারি, ‘আমরা সরকারকে বিদ্যুত্ দিয়ে যাচ্ছি কবে নাগাদ ফেরত পাব?’ তবে এটি হবে ব্যতিক্রমী প্রশ্ন। কারণ আমরা ‘দিচ্ছি না’, আসলে সরকারই নিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে এখনো পেয়ে যাচ্ছি শুধু প্রতিশ্রুতি। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী সংসদে চার বছর ধাপে ধাপে বিদ্যুত্ পাব বলে মেগাওয়াটের হিসাবে আশ্বস্ত করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে ‘কিছুক্ষণের জন্য’ লোডশেডিং করেছেন, অর্থাত্ বিদ্যুত্ প্রদান স্থগিত করেছেন। এই ‘কিছুক্ষণ’ ক্রমান্বয়ে হলো কিছু ঘণ্টা, অতঃপর দিনরাতের আপাতত অর্ধেক সময়। এমনি চলতে থাকলে সরকারের নেওয়ার বা জনগণের দেওয়ার আর কিছুই থাকবে কি না জানি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ধীরে ধীরে দেবেন।’ মেগাওয়াটের অঙ্ক কষে তিনি সংসদে আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁর উপদেষ্টা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এত দিন এটুকুও দেননি। গত সোমবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি শুনে ১৪ মাস পর জনগণ জানতে পেরেছেন, ‘দেবে, সরকার অবশ্যই দেবে। তবে সময় লাগবে, কারণ এর আগের সরকারগুলো কিছু দিয়ে যায়নি, এখন দিতে নানা প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হচ্ছে। কিন্তু নিজেরা ১৪ মাসে কেন দেয়নি তা ব্যাখ্যা করেনি।
প্রধানমন্ত্রী কিছু দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বিবরণ দিয়ে আশার বাণী শুনিয়েছেন। তাঁর ভাষণের আশ্বাসের চেয়েও উল্লেখযোগ্য ও ব্যতিক্রমী দিকটি হলো ‘তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’ তিন দিন আগে ‘প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুত্-সংকট নিরসনে বিরোধী দলসহ সব সাংসদের সহযোগিতা কামনা করেছেন। তিনি জনগণকে ধৈর্য ধারণ করতে ও শান্ত থাকতে বলেছেন। অতীতে কোনো সরকারপ্রধান অথবা রাষ্ট্রনায়ক তাঁদের কোনো সাময়িক অথবা সামগ্রিক ব্যর্থতা বা অপারগতার জন্য একটুখানি হলেও দুঃখিত হয়েছেন অথবা সর্বসাধারণের সহযোগিতা চেয়েছেন—এমন উদাহরণ নেই। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারপ্রধান যে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও যন্ত্রণা অনুভব করে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন তা যে আন্তরিক, তা আমরা বিশ্বাস করি। তিনি জনদরদি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, জনগণের দুর্দশা ও দুর্ভোগ অবশ্যই তাঁর হূদয়কে স্পর্শ করেছে। আমি মনে করি, তাঁর এই সহমর্মিতা প্রকাশ জনগণের জন্য অনেকখানি পাওনা। তবে সেই পাওনাটুকু যথেষ্ট নয়। আসল পাওনা বিদ্যুত্, পানি ও গ্যাস। সেটি কবে পাব তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ধাপে ধাপে দেওয়ার আশ্বাসে জনগণের দুর্ভাবনা আর ক্ষোভ খুব বেশি প্রশমিত হয়েছে কি?
প্রধানমন্ত্রীর সংসদে প্রদত্ত বক্তব্যে ও তাঁর বরাতে পাঠানো চিঠির বক্তব্যে অতীতে সাতটি বছর যে কোনো বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়নি, গ্যাস উত্তোলনের কোনো প্রচেষ্টা ক্ষমতাসীন সরকারগুলো নেননি, এসব উদাহরণ টেনে এনে সেই পুরোনো অভিযোগটির পুনরাবৃত্তি তিনি না করলেও পারতেন। কারণ বর্তমান বিদ্যুত্-সংকট যে তাঁর সরকারের সৃষ্ট নয়, অতীতের লিগেসি বা উত্তরাধিকার, পূর্ববর্তী সরকারের ব্যর্থতার দায় বহন করতে হচ্ছে, এই সত্যটি জনগণের জানা আছে। বিএনপি সরকার শুধু বিদ্যুত্-গ্যাস নয়, অনেক ক্ষেত্রেই যা কিছু করার ছিল তা করেনি। এই না-করায় জনগণ শেষ পর্যন্ত অশান্ত হয়ে সেই সরকারের অপারগতা অথবা অযোগ্যতার জন্য শাস্তিস্বরূপ গত নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি ঘটিয়েছে। বর্তমান চরম বিদ্যুত্-সংকট ও গ্যাস সরবরাহ বিপর্যয়ের সূচনা থেকেই হিসাব-নিকাশ চলছে, কোন সরকার কত দূর দিয়েছিল অথবা দেয়নি। সাধারণ মানুষ এখন আর সেসব শুনতে চায় না। মেগাওয়াটের জটিল হিসাব, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে বিশেষজ্ঞদের বাগাড়ম্বর তাদের কাছে অবোধ্য ও একঘেয়ে মনে হয়। তারা হিসাব চায় না, তারা বাতির সুইচ টিপে দেখতে চায় বিদ্যুত্ আছে কি না। কল খুলে পানি খোঁজে, বার্নারের চাবি ঘুরিয়ে অপেক্ষা করে কখন দপ করে আগুন জ্বলে উঠবে। এ সবই হবে, তবে কবে হবে এত দিন কেউ বলতে পারেনি অথবা বলেনি। অবশেষে সংসদে যা-ই হোক, প্রধানমন্ত্রী একটি সময়সীমা উল্লেখ করেছেন। বছরওয়ারি হিসাবটিতে দিন গণনা করলে হিমশিম খেতে হবে। তাই এত দিন কেন দিতে পারেননি সেই ব্যাখ্যাটিও ভাষণে থাকলে জনগণ অধিকতর আশ্বস্ত হতো।
গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে রয়েছে, সরকারের জ্বালানিমন্ত্রী এবং বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা বলেছেন, ‘সরকার ও বিরোধী দলের ৩৪৫ জন সাংসদের কাছে পাঠানো চিঠিতে বর্তমান বিদ্যুত্-পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে জনগণকে বোঝানোর অনুরোধ করা হয়েছে।’ আমি এই ৩৪৫ জনের যে কেউ একজনকে প্রশ্ন করতে পারি, তাঁরা কী ব্যাখ্যা করবেন নিজেরা কি তা জানেন? কী আশার স্তোকবাক্যে জনগণকে শান্ত থাকতে বলবেন? বরং জনগণকে বিদ্যুতের মেগাওয়াট আর গ্যাসের ঘনফুট কাকে বলে সেই সবক দিতে গেলে ৩৪৫ জন সাংসদের অনেককেই যে বিএনপির সালাউদ্দিনের প্রদর্শিত পন্থায় ‘যঃ পলায়তিং সঃ জীবতি’ বেদবাক্য অনুসরণে দৌড় দিতে হবে। শুনেছি, অনেক সাংসদ নাকি এই আশঙ্কায় এলাকায়ই যান না।
বিদ্যুত্ ও গ্যাস-সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ৩৪৫ জনকে যে পত্র দেওয়া হয়েছে তাতে সংকট নিরসনে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, কবে নাগাদ বিদ্যুত্-পানি ভোগান্তির অবসান হবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে কি না জানি না। গত ১৪ মাস প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে বলেছেন, ‘গতবার মানে ১৯৯৬—২০০১ মেয়াদের অবসানে তাঁর সরকার বিদ্যুত্-গ্যাস যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানেই আছে।’ তাঁর এই অভিযোগ বা বিদ্যুত্, গ্যাস, পানিসংকট বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এমন প্রশ্নও করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় দেড় বছর পরও কি ‘সেখানেই আছে’, নাকি আরোহণ অথবা অবতরণ ঘটেছে? এই ১৪ মাসে বিদ্যুত্-গ্যাস উত্পাদন বৃদ্ধির উদ্যোগের উদাহরণ বেশি নেই। এই কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে, অমুক যন্ত্র রাখতে হবে, অমুক এলাকায় এতক্ষণ অন্ধকার থাকবে, নিত্যনতুন নির্দেশই শুনেছি। তদুপরি নীতি-নির্ধারকেরা সরকারি ‘এধারকা মাল উধার করছেন।’ সার উত্পাদনের গ্যাস বিদ্যুেকন্দ্রে দিচ্ছেন। বিদ্যুত্ বাসাবাড়িতে দেবেন বলে দোকানপাট আর কলকারখানা আধা-বন্ধ ও আধা-খোলা রাখতে বলছেন। কিন্তু কত দিন এসব নির্দেশনা কার্যকর থাকবে তা নির্দিষ্টভাবে বললে জনগণ আশ্বস্ত হতো এবং প্রধানমন্ত্রীকে ‘অশান্ত’ না হওয়ার জন্য আবেদন করতে হতো না।
কথায় কথায় অনেক কথা বলেছি, আসল প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর সংসদে প্রদত্ত ভাষণ, জ্বালানি-খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর পাঠানো পত্রটি জনমনে কি প্রভাব ফেলবে? উল্লিখিত চিঠিতে জনগণকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। আগেই বলেছি, জনগণের ব্যথায় ব্যথিত প্রধানমন্ত্রীর আবেদনটি জনগণ ইতিবাচক মনে করে আপাতত শান্ত থাকবে। সত্যি কথা বলতে হয়, তারা তো এমনিতেই শান্ত রয়েছে। চরম সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে, যা বাঙালির ধাতে নেই। তার পরও বলছে, কিন্তু ‘কত দিন, মা গো, আ-র কত দিন?’ প্রথম আলোয় সোমবার প্রকাশিত কতিপয় নাগরিক মন্তব্য বিশ্লেষণ করে আমার এই প্রতিবেদনের প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। অনেকের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের লিটনের প্রশ্নটি উদ্ধৃত করছি, ‘কত দিনে, কত সময়ে, কত অর্থে’ বিদ্যুত্-গ্যাস-পানির সমস্যার সমাধান হবে? আমাদের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন (প্রথম আলো, সোমবার, পৃষ্ঠা-২)। ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সদস্যদের বলেছেন, দেশবাসী বিদ্যুত্ না পেলেও শিগগিরই একটি বিবৃতি পাবে। সেই বিবৃতিতে ‘বিদ্যুত্ পরিস্থিতির সঠিক অবস্থার বিবরণ থাকবে, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা থাকবে, আর অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। উত্পাদনের পরিকল্পনা আছে, কী সব চুক্তি হবে সবই নাকি জানা যাবে। সেই বিবৃতিটি সংসদে ভাষণ আকারে প্রধানমন্ত্রী গত সোমবার দিয়ে দিয়েছেন।
এখন অপেক্ষা করতে হবে সেই ভাষণ শুনে বা পড়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সময়সূচি জনগণকে কত দিন শান্ত রাখবে? এই প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারবে না, প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন না। কারণ এই দেশে গত ৫৪ বছরের না পাওয়ার ইতিহাস বলে, জনগণ যখন ‘অশান্ত’ হয়ে তাণ্ডব শুরু করে তখন আবেদন-নিবেদন আর চিঠি দিয়ে তাদের শান্ত রাখা যায় না। আইয়ুব খানের ‘উন্নয়নের দশকের’ ঢাকঢোল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঠেকাতে পারেনি। তাই প্রথম আলোর পাঠকদের জিজ্ঞাসার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলব, ‘প্রধানমন্ত্রী, জনগণের আপনার ওপর এখনো অগাধ আস্থা রয়েছে। আপনার ভাষণ শুনে জনগণ আপাতত শান্ত থেকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে। গিন্নিরা চুলোর কাছে বসে থাকবে কখন ভাত চড়াবেন, পরীক্ষার্থীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে মায়ের হাতের পাখার বাতাস খাবে আর মাঝেমধ্যে বিদ্যুত্বাতিটির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করবে। পাড়ার মা-বোনেরা রাস্তার অপর প্রান্তের দিকে চেয়ে থাকেন ওয়াসার গাড়ি আসছে কি না।
আপনার দেওয়া সময়সূচিতে তাদের যে আস্থা আছে তা কি চার বছর বজায় থাকবে? প্রশ্নটি করার কারণ, গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী যে জাঁকজমকের সঙ্গে ফেঞ্চুগঞ্জে দুটি বিদ্যুেকন্দ্র উদ্বোধন করেছেন, এই খবরটি তাদের একটুখানি আশ্বস্ত করেছিল। কিন্তু পত্রিকাটির ছিদ্রান্বেষী বিশেষ প্রতিনিধির প্রতিবেদনটিতে কুমিরের বাচ্চা দেখে তারা বরং হতাশ হতে পারে। প্রতিবেদনটি হলো, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ফেঞ্চুগঞ্জে ৫১ মেগাওয়াট ও গত মাসে সিদ্ধিরগঞ্জে ১২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার যে বিদ্যুেকন্দ্র উদ্বোধন করেছেন, সেগুলোতে উত্পাদন আরম্ভ হয়েছে অনেক আগে। জাতীয় গ্রিডে আগে থেকেই এসব কেন্দ্রের বিদ্যুত্ সঞ্চালিত হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।’ অতঃপর অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুত্-গ্যাস-পানি সরবরাহের পরিকল্পনার বিবরণী নিয়ে ‘মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।’
তার পরও একজনের রসাল মন্তব্য শুনলাম গুলশানে দুই দিন আগে এক খোশগল্পের আসরে। প্রধানমন্ত্রীর বছর বছর বিদ্যুত্ প্রদানের হিসাবসংবলিত ভাষণটি সম্পর্কে বললেন, ‘বিএনপি পাঁচ বছর খাম্বা দিয়েছে। এই সরকার সাড়ে চার বছর সেই সব খাম্বায় বিদ্যুতের তার টানাবে। দিনপঞ্জির পাতা উল্টিয়ে দেখলাম, সেই সময়ের মধ্যেই বর্তমান সরকারের শাসন সময়কালের পরিসমাপ্তি ঘটবে। তাহলে সেই তারে বিদ্যুত্ সঞ্চালন করবে নতুন বা পুরোনো অথবা অন্য কোনো সরকার?’ তাই তো বলছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার প্রতিশ্রুত বিদ্যুত্ সরবরাহের দিনকাল আরও সংক্ষিপ্ত করুন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
No comments