বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৯৬ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। এ জে এম আমিনুল হক, বীর উত্তম সাহসী এক অধিনায়ক ঘণ্টা খানেক আগে সংঘটিত হয়েছে ভয়াবহ যুদ্ধ। যুদ্ধের দামামা থেমে গেলেও দুই পক্ষ থেকেই বিক্ষিপ্তভাবে গোলা বর্ষিত হচ্ছে।


গোটা যুদ্ধক্ষেত্র মহাশ্মশান। চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে মৃতদেহ। কোনো জ্যান্ত মানুষ নেই। পাখিরাও পালিয়েছে।
এ জে এম আমিনুল হক মুক্তিবাহিনীর কমান্ডো প্লাটুনের কয়েকজনকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন যুদ্ধক্ষেত্রে। তাঁর অধীন মুক্তিযোদ্ধা দলের বেশির ভাগ আহত ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর দলের একটি উপ-দলের দলনেতা (আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম) নিখোঁজ। তিনি জীবিত না মৃত, কেউ জানেন না। মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করার পর চারদিকে পাকিস্তানি সেনারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা খুঁজছে জীবিত ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। মাথার ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে গুলি। মাঝেমধ্যে এসে পড়ছে বোমা। এ জে এম আমিনুল হক এতে বিচলিত হলেন না। খুঁজতে থাকলেন উপ-দলনেতাকে।
তখন আনুমানিক সকাল সোয়া আটটা। এমন সময় এ জে এম আমিনুল হক শালবনের ভেতর থেকে দেখতে পেলেন তাঁকে। একটা গর্তের ভেতরে চিত হয়ে। তাঁর গোটা শরীর কর্দমাক্ত। দেখামাত্র তিনি তাঁকে বললেন, তাঁর কাছে আস্তে আস্তে আসার জন্য। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কোনো সাড়া এল না। তিনি বুঝতে পারলেন উপ-দলনেতা আহত। নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন।
এ জে এম আমিনুল হক সহযোদ্ধাদের বললেন, উদ্ধার করে আনতে। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ইতস্তত ভাব। কারণ, সেদিক দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি একাই ক্রল করে রওনা হলেন উপ-দলনেতার উদ্দেশে। তখন তাঁর অনুগামী হলেন কয়েকজন সহযোদ্ধা।
কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তখন ২৫/৩০ গজ দূরে। তারা আহত এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে এগিয়ে আসছিল সেখানে। কাভারিংয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করল। এই সুযোগে এ জে এম আমিনুল হক উদ্ধার করলেন উপ-দলনেতাকে।
এ ঘটনা নকশী বিওপিতে। ১৯৭১ সালের ৩ আগস্ট। সেদিন মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নকশী বিওপির পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানে আক্রমণ করে। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন এ জে এম আমিনুল হক। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মূল আক্রমণকারী দল ছিল ব্রাভো (বি) ও ডেলটা কোম্পানি। যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী। নকশী বিওপির অবস্থান শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি উপজেলায়। সেখানে প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের একটি দল। আরও ছিল বিপুলসংখ্যক অন্যান্য সহযোগী।
সেদিন বিয়োগান্তুক ঘটনার মধ্য দিয়ে ওই যুদ্ধ শেষ হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রায় ২৬ জন শহীদ এবং অনেকে আহত হন। নকশী বিওপির যুদ্ধে এ জে এম আমিনুল হকের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা সফল না হলেও পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বেশ সফলতা অর্জন করেন। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চা-বাগানে আক্রমণ করেন। ওই সব এলাকা শত্রুমুক্ত করে তাঁরা অগ্রসর হন সিলেট অভিমুখে।
এ জে এম আমিনুল হক চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের অধীনে কর্মরত ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। পরে তাঁকে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এ জে এম আমিনুল হককে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৩।
এ জে এম আমিনুল হক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হিসেবে অবসর নেন। ২০১১ সালে তিনি মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বাঁশবাড়িয়া গ্রামে। তবে বাস করতেন ঢাকার মহাখালী নতুন ডিওএইচএসে। তাঁর বাবার নাম নূরুল হক, মা ফাতেমা জোহরা। স্ত্রী মরিয়ম হক। তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে।
সূত্র: রাফিয়া চৌধুরী এবং মেজর জেনারেল (অব.) আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীর বিক্রম।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.