বাঘা তেঁতুল-চৌর্যোন্মাদনা by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কলিকালে নাকি এমন সব ঘটনা ঘটার কথা, যা আগের কালে অর্থাৎ সত্য বা দ্বাপর যুগে মানুষ কল্পনাও করত না। তবে কলিকালে পৃথিবীর সব দেশেই যে আজব ব্যাপার ঘটবে তা নয়। ঘটবে শুধু বাংলাদেশে। অন্য দেশের লোকেরা কলিকালই মানে না। আর মানলেও তাদের কলিকাল অন্য রকম।
অন্য দেশের কলিকালে হয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা। এসব দেশ কোনো আজব কারখানা নয়। আমাদের বাউলসাধকদের ভাষায় তো বাঙালির জীবন এক আজব কারখানা।
বঙ্গীয় সমাজে আগে ছাল তোলার কথা শুনেছি মানুষের। এক বাঙালি তুলতে চায় আরেক বাঙালির পিঠের ছাল। সেই ছাল দিয়ে জুতা অথবা ডুগডুগি বানানোর বাসনাও আছে। এখন দেখছি বাঙালি গাছেরও ছাল তোলায় ব্যস্ত। বাঙালি তার শত্রুর পিঠের বা পাছার ছাল তুলে লবণ মাখাতে চায়।
‘অমুকের চামড়া তুলে নেব আমরা’ বলে রাজপথ প্রকম্পিত করে। বোবা বৃক্ষও আজ বাঙালির শত্রু। তাই বাঙালি অথবা বাংলাদেশি বৃক্ষের ছাল তুলে তুঁতে ও লবণ মাখানো হচ্ছে। আগে গোড়ায় কুড়াল মেরে গাছকে হত্যা করা হতো। এখন গাছের পিঠের ছাল তুলে তুঁতে-লবণ মাখিয়ে গাছ মারা হচ্ছে। মরা গাছ কেটে নিলে দোষ কী?
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা গেল, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মেধাকচ্চপিয়া জাতীয় উদ্যানের শতবর্ষী গর্জন গাছগুলোতে ছাল তুলে লবণ ও তুঁতে মারা হচ্ছে। তাতে মাস দেড়েকের মধ্যে গাছটি মারা যায়। মরা গাছটির ডালপালা কেটে ফেলার পর কাঠচোরেরা সুযোগ বুঝে তা পাচার করে। গাছ মরে শুকিয়ে গেলে হালকা হয়। কাঠচোরেরা বিশাল গাছগুলো বহনের সুবিধার্থে এই কাজ করছে।
প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে, বন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই গাছ চুরির সঙ্গে জড়িত। তা-ই যদি না থাকবে, তাহলে এক বন সাহেবের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে তাঁর বিছানার বালিশের মধ্যে ও তোশকের ভেতর ৫০০ টাকার কচকচে নোট পাবে কীভাবে? সে নোটও দু-চারখানা নয়—লাখ লাখ টাকার।
দখলদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্তা বঙ্গীয় সমাজ সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, বাঙালি বিচিত্র পদ্ধতিতে চুরিতে অতি পাকা। তাঁর বক্তব্যে আমরা রাগ করেছিলাম। এখন তো দেখছি, মনোবিজ্ঞানের ক্লেপটোমেনিয়া বা চৌর্যোন্মাদনা বাঙালির প্রধান প্রবৃত্তি।
জগদীশ বসু এত দিন বেঁচে থাকলে লেডি অবলা বসু বিষ খেয়ে মারা গেলেও যতটা চোখের পানি ফেলতেন, মেধাকচ্চপিয়ায় গাছের ছাল তুলে তুঁতে-লবণ মারায় এর চেয়ে বেশি কাঁদতেন। বাঙালির শুধু অপহরণস্পৃহা প্রবল নয়, নির্যাতনস্পৃহাও প্রচণ্ড।
যাদের চুরি করা অভ্যাস, তারা চোখের সামনে যা দেখবে তা-ই চুরি করবে। অতি তুচ্ছ দ্রব্যও যদি হয়, তাও। সাগরপারের কক্সবাজারের একেবারে উল্টো দিকে পদ্মাপারে রাজশাহীর বাঘা উপজেলা। সেখানে পদ্মা নদীর মাঝখানে এক স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন জেগে উঠেছে। খবর হওয়া মাত্র স্থানীয় লোকজন ঝাঁপ দিয়েছে পদ্মায়। দালানটির গম্বুজ থেকে ইট খুলে মাথায় করে লোকজন সোজা বাড়ি যাচ্ছে, সেই ছবি কাগজে দেখলাম। কার ইট, কে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ি।
কোনো রকম কাগজপত্র না ঘেঁটে, গবেষণা না করে, ধাঁ করে বলে দেওয়া হলো: ওই বাড়ির মালিক লস্কর খাঁ। তিনি ষোলো শতকের পাঠান জায়গিরদার। এখন নদীর মধ্যে পাতালপুরিতে বাস করেন।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও টেন্ডার জমা দেওয়ার অফিস উত্তাল করে তুলেছে ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা অথবা শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়। ওসবে গ্রামের গরিবদের ছেলেমেয়েরা কোনো ভাগ পায় না। পদ্মার তলদেশের প্রাসাদের ইটের ভাগ তারা ছাড়বে কেন?
প্রাচীন নিদর্শন, যা হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষণার অমূল্য উপাদান। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তা ভেঙেচুরে ইট-কাঠ-লোহা-লক্কড় খুলে তছনছ করে দেওয়া হলো। বর্তমান সরকার ইতিহাস শব্দটি দিয়ে দিন শুরু করে, রাতে শুতে যাওয়ার আগে ইতিহাস নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে। তবে বাঙালির তিন হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই—নয় মাসের ইতিহাসই তাদের রাজনীতি করার জন্য যথেষ্ট।
বাঘার পাতালপুরীতে স্থানীয় সাংসদও সৃষ্টি করলেন ইতিহাস। জনসেবার বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি জনসেবক থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদে পরিণত হলেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্তার সঙ্গে তিনিও লুঙ্গিতে মালকোঁচা মেরে ঝাঁপ দিলেন পদ্মায় অরূপ রতন পাওয়ার আশায়। যদি ধরে নিই যে পদ্মার তলদেশে একটি দ্বিতীয় তাজমহল জেগে উঠেছে, তাহলেও সেখানে সংসদ সদস্যের ঝাঁপ দেওয়ার যুক্তি কোথায়? নীল নদে, টেমস নদীতে, রাইন অথবা মেকং নদীতে ৫০০ বছরের পুরোনো স্থাপত্য পাওয়া গেলে সেসব দেশের এমপিরা কি নদীতে ঝাঁপ দিতেন?
আগে ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকারা ঝাঁপ দিত যমুনায়। এখন বাঙালি জনগণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ঝাঁপ দিচ্ছেন পদ্মায়। আগে প্রিয় ও প্রিয়াকে না পেয়ে দুঃখে নদীতে ঝাঁপ দিত, এখন কলিকালে কিছু পাওয়ার আশায় ঝাঁপ দিচ্ছে। আর কিছু পাওয়া না গেলেও পাবলিসিটি তো পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্নসামগ্রী রক্ষার চেয়ে পাবলিসিটি বেশি প্রয়োজন। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, লস্কর খাঁর অধস্তন ১৮ পুরুষ তাদের বংশগৌরব সম্পর্কে নীরব ছিলেন। এবার ১৯তম বংশধর উত্তরাধিকারী হলেন পাতালপুরীর রাজপ্রাসাদের।
নানা রকম চেতনায় বাঙালি জাতির দম নেওয়ার ফুরসত নেই। তবে যত দিন বাঙালির চৌর্যোন্মাদনার স্বভাব দূর না হবে, তত দিন কোনো কিছুর চেতনাতেই কোনো কাজ হবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
বঙ্গীয় সমাজে আগে ছাল তোলার কথা শুনেছি মানুষের। এক বাঙালি তুলতে চায় আরেক বাঙালির পিঠের ছাল। সেই ছাল দিয়ে জুতা অথবা ডুগডুগি বানানোর বাসনাও আছে। এখন দেখছি বাঙালি গাছেরও ছাল তোলায় ব্যস্ত। বাঙালি তার শত্রুর পিঠের বা পাছার ছাল তুলে লবণ মাখাতে চায়।
‘অমুকের চামড়া তুলে নেব আমরা’ বলে রাজপথ প্রকম্পিত করে। বোবা বৃক্ষও আজ বাঙালির শত্রু। তাই বাঙালি অথবা বাংলাদেশি বৃক্ষের ছাল তুলে তুঁতে ও লবণ মাখানো হচ্ছে। আগে গোড়ায় কুড়াল মেরে গাছকে হত্যা করা হতো। এখন গাছের পিঠের ছাল তুলে তুঁতে-লবণ মাখিয়ে গাছ মারা হচ্ছে। মরা গাছ কেটে নিলে দোষ কী?
প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা গেল, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মেধাকচ্চপিয়া জাতীয় উদ্যানের শতবর্ষী গর্জন গাছগুলোতে ছাল তুলে লবণ ও তুঁতে মারা হচ্ছে। তাতে মাস দেড়েকের মধ্যে গাছটি মারা যায়। মরা গাছটির ডালপালা কেটে ফেলার পর কাঠচোরেরা সুযোগ বুঝে তা পাচার করে। গাছ মরে শুকিয়ে গেলে হালকা হয়। কাঠচোরেরা বিশাল গাছগুলো বহনের সুবিধার্থে এই কাজ করছে।
প্রতিবেদনে আরও জানা গেছে, বন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী এই গাছ চুরির সঙ্গে জড়িত। তা-ই যদি না থাকবে, তাহলে এক বন সাহেবের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে তাঁর বিছানার বালিশের মধ্যে ও তোশকের ভেতর ৫০০ টাকার কচকচে নোট পাবে কীভাবে? সে নোটও দু-চারখানা নয়—লাখ লাখ টাকার।
দখলদার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্তা বঙ্গীয় সমাজ সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, বাঙালি বিচিত্র পদ্ধতিতে চুরিতে অতি পাকা। তাঁর বক্তব্যে আমরা রাগ করেছিলাম। এখন তো দেখছি, মনোবিজ্ঞানের ক্লেপটোমেনিয়া বা চৌর্যোন্মাদনা বাঙালির প্রধান প্রবৃত্তি।
জগদীশ বসু এত দিন বেঁচে থাকলে লেডি অবলা বসু বিষ খেয়ে মারা গেলেও যতটা চোখের পানি ফেলতেন, মেধাকচ্চপিয়ায় গাছের ছাল তুলে তুঁতে-লবণ মারায় এর চেয়ে বেশি কাঁদতেন। বাঙালির শুধু অপহরণস্পৃহা প্রবল নয়, নির্যাতনস্পৃহাও প্রচণ্ড।
যাদের চুরি করা অভ্যাস, তারা চোখের সামনে যা দেখবে তা-ই চুরি করবে। অতি তুচ্ছ দ্রব্যও যদি হয়, তাও। সাগরপারের কক্সবাজারের একেবারে উল্টো দিকে পদ্মাপারে রাজশাহীর বাঘা উপজেলা। সেখানে পদ্মা নদীর মাঝখানে এক স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন জেগে উঠেছে। খবর হওয়া মাত্র স্থানীয় লোকজন ঝাঁপ দিয়েছে পদ্মায়। দালানটির গম্বুজ থেকে ইট খুলে মাথায় করে লোকজন সোজা বাড়ি যাচ্ছে, সেই ছবি কাগজে দেখলাম। কার ইট, কে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ি।
কোনো রকম কাগজপত্র না ঘেঁটে, গবেষণা না করে, ধাঁ করে বলে দেওয়া হলো: ওই বাড়ির মালিক লস্কর খাঁ। তিনি ষোলো শতকের পাঠান জায়গিরদার। এখন নদীর মধ্যে পাতালপুরিতে বাস করেন।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও টেন্ডার জমা দেওয়ার অফিস উত্তাল করে তুলেছে ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা অথবা শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়। ওসবে গ্রামের গরিবদের ছেলেমেয়েরা কোনো ভাগ পায় না। পদ্মার তলদেশের প্রাসাদের ইটের ভাগ তারা ছাড়বে কেন?
প্রাচীন নিদর্শন, যা হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষণার অমূল্য উপাদান। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তা ভেঙেচুরে ইট-কাঠ-লোহা-লক্কড় খুলে তছনছ করে দেওয়া হলো। বর্তমান সরকার ইতিহাস শব্দটি দিয়ে দিন শুরু করে, রাতে শুতে যাওয়ার আগে ইতিহাস নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ে। তবে বাঙালির তিন হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই—নয় মাসের ইতিহাসই তাদের রাজনীতি করার জন্য যথেষ্ট।
বাঘার পাতালপুরীতে স্থানীয় সাংসদও সৃষ্টি করলেন ইতিহাস। জনসেবার বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি জনসেবক থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদে পরিণত হলেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্তার সঙ্গে তিনিও লুঙ্গিতে মালকোঁচা মেরে ঝাঁপ দিলেন পদ্মায় অরূপ রতন পাওয়ার আশায়। যদি ধরে নিই যে পদ্মার তলদেশে একটি দ্বিতীয় তাজমহল জেগে উঠেছে, তাহলেও সেখানে সংসদ সদস্যের ঝাঁপ দেওয়ার যুক্তি কোথায়? নীল নদে, টেমস নদীতে, রাইন অথবা মেকং নদীতে ৫০০ বছরের পুরোনো স্থাপত্য পাওয়া গেলে সেসব দেশের এমপিরা কি নদীতে ঝাঁপ দিতেন?
আগে ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকারা ঝাঁপ দিত যমুনায়। এখন বাঙালি জনগণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ঝাঁপ দিচ্ছেন পদ্মায়। আগে প্রিয় ও প্রিয়াকে না পেয়ে দুঃখে নদীতে ঝাঁপ দিত, এখন কলিকালে কিছু পাওয়ার আশায় ঝাঁপ দিচ্ছে। আর কিছু পাওয়া না গেলেও পাবলিসিটি তো পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্নসামগ্রী রক্ষার চেয়ে পাবলিসিটি বেশি প্রয়োজন। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, লস্কর খাঁর অধস্তন ১৮ পুরুষ তাদের বংশগৌরব সম্পর্কে নীরব ছিলেন। এবার ১৯তম বংশধর উত্তরাধিকারী হলেন পাতালপুরীর রাজপ্রাসাদের।
নানা রকম চেতনায় বাঙালি জাতির দম নেওয়ার ফুরসত নেই। তবে যত দিন বাঙালির চৌর্যোন্মাদনার স্বভাব দূর না হবে, তত দিন কোনো কিছুর চেতনাতেই কোনো কাজ হবে না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments