সাক্ষাৎকার-মালদ্বীপে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবই by মোহাম্মদ নাশিদ
ভাষান্তর :সুভাষ সাহা মালদ্বীপের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের বিস্তৃত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায়। ধর্মীয় মৌলবাদবিরোধী ও গণতন্ত্রের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এই নেতা কীভাবে তাকে ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয় এবং কোন পথে দেশটির গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন সম্ভব তা বর্ণনা করেছেন
প্রশ্ন :ফেব্রুয়ারিতে আপনার ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার সময়ের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলবেন?
প্রশ্ন :ফেব্রুয়ারিতে আপনার ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার সময়ের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলবেন?
উত্তর :২০০৮ সালে প্রথম মালদ্বীপে বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আমি ওই নির্বাচনে জয়লাভ করি। গত তিন বছরে ক্ষমতায় থাকাকালে আমি গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য চেষ্টা করেছি। আমরা যখন ক্ষমতায় আসি তখন মালদ্বীপে ৩০ শতাংশেরও কম মানুষের নিরাপদ পানীয় জল ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা ছিল। এখন সেটা প্রায় ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আমরা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় স্বামী নেই এমন মা ও শারীরিকভাবে অক্ষমদের বিনা পয়সায় মেডিকেল সুবিধা প্রদানের ভিত্তি রচনা করি। আমরা চমৎকার একটা প্রতিষেধক কর্মসূচি ও জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি রূপায়ণ করেছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন আবার একনায়কতান্ত্রিক শাসন ফিরে এসেছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে তারা ক্যু এবং আমাকে পদত্যাগে বাধ্য করে। দেশকে পুনরায় পূর্বের অবস্থানে টেনে তোলা ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এখন নির্বাচন অনুষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নিচে এবং এই মানুষরাই আমাকে নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে দেশ শাসনের সুযোগ করে দিয়েছিল। এখন এই জনগণ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ বিক্ষোভে শামিল হচ্ছে। একনায়কতান্ত্রিক শাসনকে ঘাঁটি গেড়ে বসতে দিলে, সামরিক বাহিনী ও পুলিশকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিলে অদূর ভবিষ্যতে এখানে নির্বাচন হবে কি-না সন্দেহ।
র্যাডিক্যাল ইসলাম মালদ্বীপে পুনরায় মাথাচাড়া দিচ্ছে। গত ২০ বছর ধরেই এখানে এর উর্বর ক্ষেত্র রয়েছে। আমরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইসলামী পার্টিগুলোর বিরুদ্ধে জয়লাভ করি এবং এসব পার্টি সংসদে একটি আসনও লাভ করতে পারেনি তখন। স্থানীয় নির্বাচনেও তাদের প্রার্থী কোনো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি। কিন্তু ক্যু করে ক্ষমতা দখলের পর তারা এখন মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছে। আমরা যদি সত্বর নির্বাচন অনুষ্ঠান না করতে পারি তাহলে এই ইসলামী দলগুলো তাদের অবস্থানকে আরও সংহত করার সুযোগ পাবে। সাবেক একনায়ক মামুন আবদুল গাইয়ুম আবার মালদ্বীপের রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন এবং নানা বিষয়ে প্রভাবিত করছেন। আমাদের সংসদে বর্তমানে সবচেয়ে বড় গ্রুপ রয়েছে। মালদ্বীপের জনগণ অবশ্যই কারা দেশ শাসনের উপযুক্ত তাদের বাছাই করে নেওয়ার সামর্থ্য রাখে। আমরা ভারত সরকার ও জনগণকে আমাদের সত্যিকারের অবস্থাটা উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন :৭ ফেব্রুয়ারি কীভাবে আপনি পদত্যাগে বাধ্য হলেন সে সম্পর্কে বলুন।
উত্তর :৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশের দুটি ব্যাটালিয়ন ১শ' জনের মতো পুলিশ সদস্য পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে আমার সমর্থিত দল-মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এমডিপি) সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। তারা আমাদের অ্যাসেম্বলি হাউস তছনছ করে। এই পুলিশ সদস্যরা আমার ও পুলিশপ্রধানের পদত্যাগ দাবি করে। তখন রাত ১১টার মতো হবে। এরপর পুলিশপ্রধান আমাকে বিদ্রোহী এই দুই ব্যাটালিয়ন পুলিশকে গ্রেফতার করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন। আমি সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ প্রদান করি আর তখন দেখা যায়, এই নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য সেখানে সামরিক বাহিনীর মাত্র দুইশ' সদস্য রয়েছে। ভোর ৫টার দিকে আমি সামরিক সদর দফতরে যাই। সকাল ৭টা পর্যন্ত বিদ্রোহী পুলিশ সদস্যরা টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও মরিচের গুঁড়া স্প্রে নিয়ে সামরিক সদর দফতরের প্রধান গেটে সমবেত হয়। তখন দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে ভেতরের সেনাসদস্যরাও। এরপর জেনারেল আমাকে পদত্যাগের জন্য চাপ দেয় এবং বলে যে, আমি পদত্যাগ না করলে তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে। তখন আমি বলি যে, সামরিক সদর দফতরে আমার পদত্যাগ করাটা শোভন হবে না। তখন তারা আমাকে প্রেসিডেন্ট হাউসে নিয়ে যায়। আমার পদত্যাগ ঘোষণা করার পর তারা আমাকে সেখানেই যোগাযোগবিহীন অবস্থায় তিনদিন থাকতে হবে বলে জানায়। ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ আমি আমার কিছু বন্ধুভাবাপন্ন সামরিক কর্মকর্তার সহায়তায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে সরে পড়তে সক্ষম হই। সেখান থেকে আমি সরাসরি আমার নিজের বাড়িতে চলে আসি। দু'রাত আমি ঘুমোতে পারিনি এবং বাড়িতে আসার পর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠি। এরপর পার্টির লোকজনের সঙ্গে কথা বলি এবং তাদের সঙ্গে আগের দিনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করি। এটা যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ নয় সে ব্যাপারেও আমরা একমত পোষণ করি।
প্রশ্ন :একজন প্রেসিডেন্টের এভাবে সামরিক সদর দফতরে যাওয়া এবং পুলিশের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলাটা কি বিশেষ ঘটনা নয়?
উত্তর :আমি এটাকে বিশেষ কোনো ঘটনা বলে মনে করি না। কারণ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওটা আমার এখতিয়ারের মধ্যেই পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে এটা করা সঙ্গতও। আগে মালদ্বীপে ক্ষমতার রদবদলগুলো সহিংস হতো_ আগের প্রেসিডেন্টরা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলার শিকার হয়েছেন, হাওয়া হয়ে গেছেন, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন ও বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এমনকি কারও কারও সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম তখন এ ধরনের কোনো কাজ করা হয়নি। আমরা কাউকে নাজেহাল বা নির্যাতন করতে যাইনি। আমরা ভেতর থেকেই সংস্কার চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা তা করতে পারিনি। গত তিন বছরে একবারও আমরা দাঙ্গা পুলিশকে ব্যবহার করিনি। এই বিদ্রোহী দুই পুলিশ ব্যাটালিয়নকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আমার দলের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
প্রশ্ন :ওই সময় আপনার সঙ্গে নয়াদিলি্লর যাদের আলোচনা হয়েছিল তারা ঘটনার একদিন পরে এটাকে আপনার ক্যু আখ্যায়িত করে বক্তব্যকে পরে চিন্তা করে বলা হয়েছে বলে মনে করেন।
উত্তর :এটা একটা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ক্যু। কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তি নেই। এর পরের দিন পর্যন্ত আমি যোগাযোগবিহীন অবস্থায় ছিলাম।
প্রশ্ন :আপনি কি মনে করেন, ওই অচলাবস্থা দূর করার জন্য ভারত আরও বলিষ্ঠতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে পারত?
উত্তর : প্রতিবেশীদের সঙ্গে ডিলিংয়ের ক্ষেত্রে আমি ভারতের ডিফিকাল্টিটা বুঝি। কোনো দেশে গিয়ে সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা একটি সরকারের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না। আমি জানি না সে সময় ভারতের পক্ষে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব ছিল কি-না, আমি সে সম্পর্কে বলিওনি। তবে ভারত যেভাবে দ্রুত নতুন ক্ষমতাসীনকে স্বীকৃতি দিল তাতে অনেকেই হতাশ হয়েছেন।
প্রশ্ন :ভারত সরকারের কাছ থেকে আপনি কী প্রত্যাশা করেন?
উত্তর : মালদ্বীপের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা যাতে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয় তার জন্য তাদের বাধ্য করার মতো অনেক উপায় (সামরিক ছাড়া) ভারতের হাতে রয়েছে। আমরা ভারতের কাছ থেকে এ মুহূর্তে এটাই প্রত্যাশা করি।
প্রশ্ন :যারা ক্যু সংঘটন করেছিল তাদের সঙ্গে কি প্রতিবেশী কোনো দেশের সংশ্রব ছিল সে মুহূর্তে? মালদ্বীপে ইসলামী র্যাডিক্যালিজম বিস্তার সম্পর্কে বলুন।
উত্তর :অপরাধী চক্র দিলি্ল, কলম্বো ও শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়েছে যে, তারা ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছে এবং সেটা বাস্তবায়িতও হবে। ক্ষমতা পরিবর্তন সেখানে আসন্ন। তারা মালদ্বীপে ভারতীয় হাইকমিশনার ও কর্তৃপক্ষকেও এ ব্যাপারে অবহিত করে থাকবে।
র্যাডিক্যাল ইসলাম হলো একটা আন্দোলন, যেটা শিকড় গেড়েছিল একনায়কত্বের দীর্ঘ সময় ধরে। তখন এটা একনায়কত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর প্রধান মাধ্যম ছিল। এদের সংগঠন ছিল মসজিদকেন্দ্রিক। তারা গোপনে কাজ চালাত। তাই তখন যারাই কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইত তারাই এই সংগঠনে ভিড়ে যেত।
প্রশ্ন :মালদ্বীপের সাত তরুণ পড়তে গিয়ে পাকিস্তানে কিছুদিন আগে নিখোঁজ হয়ে যায়। তারা আল কায়দায় যোগ দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উত্তর :এসব তরুণকে রিত্রুক্রট করার সময় বলা হয়েছে, তারা ইচ্ছা করলে তাদের সন্তানকে পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করতে পারে। এরপর এসব তরুণ পাকিস্তান গমন করে। আফগান-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী মাদ্রাসায় তাদের রেখে নৃশংস করে তোলা হয়। এসব মাদ্রাসা থেকে তালেবান তৈরি করা হয়।
প্রশ্ন :মালদ্বীপের বর্তমান সরকার বলছে, তারা ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সেখানে নির্বাচন করবে। আপনি এর অনেক আগেই নির্বাচন চান। কীভাবে আপনার দাবি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে?
উত্তর :তারা একদিকে ২০১৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে, অন্যদিকে আগাম নির্বাচনের কথাও বলছে। আমি মনে করি, এটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। মানুষ মনে করতে পারে, আসলে সরকার আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছে। আসলে এগুলো নির্ধারিত নির্বাচন। আমরা যদি তাড়াতাড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠান করাতে ব্যর্থ হই তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং তখন সামরিক বাহিনী ও পুলিশ অনেক বিরোধী কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে পারবে।
প্রশ্ন :রাষ্ট্র এবং গোটা প্রশাসন যন্ত্র বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান কি সম্ভব?
উত্তর :নতুন সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্ট মনোনীত নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এই কমিশন পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ। এই কমিশনের ওপর আমার পুরোপুরি আস্থা রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকারকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময় দেওয়া হলে তারা নির্বাচন কমিশনে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে। নির্বাচনকে পর্যবেক্ষণ ও মনিটর করতে হবে।
র্যাডিক্যাল ইসলাম মালদ্বীপে পুনরায় মাথাচাড়া দিচ্ছে। গত ২০ বছর ধরেই এখানে এর উর্বর ক্ষেত্র রয়েছে। আমরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইসলামী পার্টিগুলোর বিরুদ্ধে জয়লাভ করি এবং এসব পার্টি সংসদে একটি আসনও লাভ করতে পারেনি তখন। স্থানীয় নির্বাচনেও তাদের প্রার্থী কোনো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি। কিন্তু ক্যু করে ক্ষমতা দখলের পর তারা এখন মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছে। আমরা যদি সত্বর নির্বাচন অনুষ্ঠান না করতে পারি তাহলে এই ইসলামী দলগুলো তাদের অবস্থানকে আরও সংহত করার সুযোগ পাবে। সাবেক একনায়ক মামুন আবদুল গাইয়ুম আবার মালদ্বীপের রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন এবং নানা বিষয়ে প্রভাবিত করছেন। আমাদের সংসদে বর্তমানে সবচেয়ে বড় গ্রুপ রয়েছে। মালদ্বীপের জনগণ অবশ্যই কারা দেশ শাসনের উপযুক্ত তাদের বাছাই করে নেওয়ার সামর্থ্য রাখে। আমরা ভারত সরকার ও জনগণকে আমাদের সত্যিকারের অবস্থাটা উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন :৭ ফেব্রুয়ারি কীভাবে আপনি পদত্যাগে বাধ্য হলেন সে সম্পর্কে বলুন।
উত্তর :৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশের দুটি ব্যাটালিয়ন ১শ' জনের মতো পুলিশ সদস্য পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে আমার সমর্থিত দল-মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টি (এমডিপি) সমর্থকদের ওপর হামলা চালায়। তারা আমাদের অ্যাসেম্বলি হাউস তছনছ করে। এই পুলিশ সদস্যরা আমার ও পুলিশপ্রধানের পদত্যাগ দাবি করে। তখন রাত ১১টার মতো হবে। এরপর পুলিশপ্রধান আমাকে বিদ্রোহী এই দুই ব্যাটালিয়ন পুলিশকে গ্রেফতার করার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ প্রদানের জন্য অনুরোধ করেন। আমি সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ প্রদান করি আর তখন দেখা যায়, এই নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য সেখানে সামরিক বাহিনীর মাত্র দুইশ' সদস্য রয়েছে। ভোর ৫টার দিকে আমি সামরিক সদর দফতরে যাই। সকাল ৭টা পর্যন্ত বিদ্রোহী পুলিশ সদস্যরা টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও মরিচের গুঁড়া স্প্রে নিয়ে সামরিক সদর দফতরের প্রধান গেটে সমবেত হয়। তখন দাঙ্গাকারীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে ভেতরের সেনাসদস্যরাও। এরপর জেনারেল আমাকে পদত্যাগের জন্য চাপ দেয় এবং বলে যে, আমি পদত্যাগ না করলে তারা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে। তখন আমি বলি যে, সামরিক সদর দফতরে আমার পদত্যাগ করাটা শোভন হবে না। তখন তারা আমাকে প্রেসিডেন্ট হাউসে নিয়ে যায়। আমার পদত্যাগ ঘোষণা করার পর তারা আমাকে সেখানেই যোগাযোগবিহীন অবস্থায় তিনদিন থাকতে হবে বলে জানায়। ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ আমি আমার কিছু বন্ধুভাবাপন্ন সামরিক কর্মকর্তার সহায়তায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে সরে পড়তে সক্ষম হই। সেখান থেকে আমি সরাসরি আমার নিজের বাড়িতে চলে আসি। দু'রাত আমি ঘুমোতে পারিনি এবং বাড়িতে আসার পর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। পরদিন সকালে আমি ঘুম থেকে উঠি। এরপর পার্টির লোকজনের সঙ্গে কথা বলি এবং তাদের সঙ্গে আগের দিনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করি। এটা যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ নয় সে ব্যাপারেও আমরা একমত পোষণ করি।
প্রশ্ন :একজন প্রেসিডেন্টের এভাবে সামরিক সদর দফতরে যাওয়া এবং পুলিশের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলাটা কি বিশেষ ঘটনা নয়?
উত্তর :আমি এটাকে বিশেষ কোনো ঘটনা বলে মনে করি না। কারণ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওটা আমার এখতিয়ারের মধ্যেই পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে এটা করা সঙ্গতও। আগে মালদ্বীপে ক্ষমতার রদবদলগুলো সহিংস হতো_ আগের প্রেসিডেন্টরা উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলার শিকার হয়েছেন, হাওয়া হয়ে গেছেন, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার শিকার হয়েছেন ও বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এমনকি কারও কারও সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম তখন এ ধরনের কোনো কাজ করা হয়নি। আমরা কাউকে নাজেহাল বা নির্যাতন করতে যাইনি। আমরা ভেতর থেকেই সংস্কার চেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা তা করতে পারিনি। গত তিন বছরে একবারও আমরা দাঙ্গা পুলিশকে ব্যবহার করিনি। এই বিদ্রোহী দুই পুলিশ ব্যাটালিয়নকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আমার দলের বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
প্রশ্ন :ওই সময় আপনার সঙ্গে নয়াদিলি্লর যাদের আলোচনা হয়েছিল তারা ঘটনার একদিন পরে এটাকে আপনার ক্যু আখ্যায়িত করে বক্তব্যকে পরে চিন্তা করে বলা হয়েছে বলে মনে করেন।
উত্তর :এটা একটা টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ক্যু। কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তি নেই। এর পরের দিন পর্যন্ত আমি যোগাযোগবিহীন অবস্থায় ছিলাম।
প্রশ্ন :আপনি কি মনে করেন, ওই অচলাবস্থা দূর করার জন্য ভারত আরও বলিষ্ঠতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে পারত?
উত্তর : প্রতিবেশীদের সঙ্গে ডিলিংয়ের ক্ষেত্রে আমি ভারতের ডিফিকাল্টিটা বুঝি। কোনো দেশে গিয়ে সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা একটি সরকারের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না। আমি জানি না সে সময় ভারতের পক্ষে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব ছিল কি-না, আমি সে সম্পর্কে বলিওনি। তবে ভারত যেভাবে দ্রুত নতুন ক্ষমতাসীনকে স্বীকৃতি দিল তাতে অনেকেই হতাশ হয়েছেন।
প্রশ্ন :ভারত সরকারের কাছ থেকে আপনি কী প্রত্যাশা করেন?
উত্তর : মালদ্বীপের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা যাতে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয় তার জন্য তাদের বাধ্য করার মতো অনেক উপায় (সামরিক ছাড়া) ভারতের হাতে রয়েছে। আমরা ভারতের কাছ থেকে এ মুহূর্তে এটাই প্রত্যাশা করি।
প্রশ্ন :যারা ক্যু সংঘটন করেছিল তাদের সঙ্গে কি প্রতিবেশী কোনো দেশের সংশ্রব ছিল সে মুহূর্তে? মালদ্বীপে ইসলামী র্যাডিক্যালিজম বিস্তার সম্পর্কে বলুন।
উত্তর :অপরাধী চক্র দিলি্ল, কলম্বো ও শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়েছে যে, তারা ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেছে এবং সেটা বাস্তবায়িতও হবে। ক্ষমতা পরিবর্তন সেখানে আসন্ন। তারা মালদ্বীপে ভারতীয় হাইকমিশনার ও কর্তৃপক্ষকেও এ ব্যাপারে অবহিত করে থাকবে।
র্যাডিক্যাল ইসলাম হলো একটা আন্দোলন, যেটা শিকড় গেড়েছিল একনায়কত্বের দীর্ঘ সময় ধরে। তখন এটা একনায়কত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর প্রধান মাধ্যম ছিল। এদের সংগঠন ছিল মসজিদকেন্দ্রিক। তারা গোপনে কাজ চালাত। তাই তখন যারাই কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইত তারাই এই সংগঠনে ভিড়ে যেত।
প্রশ্ন :মালদ্বীপের সাত তরুণ পড়তে গিয়ে পাকিস্তানে কিছুদিন আগে নিখোঁজ হয়ে যায়। তারা আল কায়দায় যোগ দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উত্তর :এসব তরুণকে রিত্রুক্রট করার সময় বলা হয়েছে, তারা ইচ্ছা করলে তাদের সন্তানকে পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করতে পারে। এরপর এসব তরুণ পাকিস্তান গমন করে। আফগান-পাকিস্তান সীমান্তবর্তী মাদ্রাসায় তাদের রেখে নৃশংস করে তোলা হয়। এসব মাদ্রাসা থেকে তালেবান তৈরি করা হয়।
প্রশ্ন :মালদ্বীপের বর্তমান সরকার বলছে, তারা ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সেখানে নির্বাচন করবে। আপনি এর অনেক আগেই নির্বাচন চান। কীভাবে আপনার দাবি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে?
উত্তর :তারা একদিকে ২০১৩ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে, অন্যদিকে আগাম নির্বাচনের কথাও বলছে। আমি মনে করি, এটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। মানুষ মনে করতে পারে, আসলে সরকার আগাম নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছে। আসলে এগুলো নির্ধারিত নির্বাচন। আমরা যদি তাড়াতাড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠান করাতে ব্যর্থ হই তাহলে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে এবং তখন সামরিক বাহিনী ও পুলিশ অনেক বিরোধী কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে পারবে।
প্রশ্ন :রাষ্ট্র এবং গোটা প্রশাসন যন্ত্র বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠান কি সম্ভব?
উত্তর :নতুন সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্ট মনোনীত নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এই কমিশন পার্লামেন্টের কাছে দায়বদ্ধ। এই কমিশনের ওপর আমার পুরোপুরি আস্থা রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকারকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময় দেওয়া হলে তারা নির্বাচন কমিশনে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে। নির্বাচনকে পর্যবেক্ষণ ও মনিটর করতে হবে।
No comments