সমৃদ্ধি-মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে কেমন অর্থনীতি চাই by এম এ সাত্তার মণ্ডল
সেই শিশুকালে যখন থেকে গৃহশিক্ষক মৌলভি শুখাই মিনার কাছে কালির দোয়াতে বাঁশের কঞ্চির কলম ডুবিয়ে কলার পাতায় বর্ণমালার গায়ে হাত ঘোরানো শুরু করি, বলা যায় তখন থেকেই শুরু অর্থনীতি শেখা। কলাপাতা জোগানের কোনো অভাব ছিল না; কিন্তু গাছ থেকে প্রতিদিন পাতা কেটে এনে লেখার জন্য ফালি প্রস্থ তৈরি করতে যে সময় ও শ্রমের প্রয়োজন হয়, তা তো ছিল দুষ্প্রাপ্য।
তাই একই পাতা ধুয়েমুছে একাধিকবার ব্যবহার করলে গাছ থেকে পাতা সংগ্রহের শ্রম ও সময় দুই-ই বাঁচে, সম্পদের কাম্য ব্যবহারের এই মৌলিক ধারণাটি হয়তো শিশুমনে তখনই ঢুকে গিয়েছিল।
তারপর সনাতন গ্রামীণ অর্থনীতির অনুষঙ্গগুলো অবলম্বন করে বড় হয়েছি খোরপোশি কৃষির আবহে। এক বছর খরা, তো পরের বছর বন্যা, বানের ঘোলা জলে আউশ, আমন ধান ডুবে যাওয়া, ফসলহানি, খাদ্যাভাব, রেশনের দোকানে লম্বা সারি, বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পলি পড়া জমিতে রবিশস্য ও চৈতালি ফসলের বেশি বেশি আবাদ, জমি বন্ধক রেখে ঘর-গৃহস্থালির পুঁজি জোগাড় করা—সবই তো স্পর্শ করেছে আমাদের পারিবারিক অর্থনীতি ও জীবিকায়ন। ডান্ডি ম্যানচেস্টারে পাটের দাম পড়ে গেল তো ভৈরব বাজার ও নারায়ণগঞ্জের আড়তেও মন্দাভাব, পাটের রপ্তানি-আয় হ্রাস। পরে বুঝেছি, এটা ছিল সামষ্টিক অর্থনীতি। কিন্তু এর ঢেউ লাগতে দেরি হয়নি ফরিদপুরের কানাইপুর বাজারে, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও সৈয়দপুরে। এটা ভেজা পাট, ওটার রং ভালো না, এটার গোড়া শক্ত কাঠি—নানা ছলছুতোয় গ্রামের হাটবাজারে ফড়িয়া-বেপারিরা পানির দামে কিনে নিয়েছেন কৃষকের সোনালি আঁশ। কালেভদ্রে দুই পয়সা লাভের মুখ দেখলেও প্রায়ই কৃষকদের হতো লোকসান। কামলা-কৃষাণের খরচ ওঠানো ছিল দায়। অথচ তা দিয়েই চালাতে হয়েছে আমাদের সংসার, মেটাতে হয়েছে আমার পড়ার খরচ। এটাই তো ব্যষ্টিক অর্থনীতি।
না, ভুলব কেন বোরো ধানের অর্থনীতি ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা? পাওয়ারপাম্প দিয়ে খাল-বিল সেচে ইরি ধানের আবাদ, তারপর ডিপ-টিউবওয়েল, শ্যালো মেশিন, ডংফেং-সাইফেং পাওয়ারটিলার—এসবই তো কৃষকের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, ভাগ্যনিয়ন্তা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ৮০ লাখ থেকে দুই কোটি ৮০ লাখ টন চাল উত্পাদন। কী অসাধারণ উত্তরণ। তাও আবার ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি থেকে। চাট্টিখানা কথা নয়। কে বলে, আমরা অর্থনীতি বুঝি না? শুধু লাভটা দেখিয়ে দিন, প্রযুক্তিটা শিখিয়ে দিন, পণ্যের বাজারটা ঠিক রাখুন। দেখুন, কী করে উত্পাদন দ্রুততম সময়ে উচ্চতর স্তরে পৌঁছে যায়। রফিক আজাদের কবিতা: ‘ভালবাসা পেলে কোন বোকা পড়ে থাকে নষ্ট জলে।’ আর সহজে কৃষিঋণটা চাই, যাতে মাসিক শতকরা ১০ টাকা গুনতে না হয় কৃষককে।
১৯৭৭ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে প্রথমবারের মতো সদস্য হই। সেই থেকে জ্ঞানী-গুণী পথিকৃত্ অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে পরিচিতি, জানাশোনা, কাজ করা। পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুসংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও প্রভাবশালী হচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। এ সংগঠনের সমাজসচেতনতা, কর্মতত্পরতা ও পেশাদার ভূমিকাকে সব মহল অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে এবং সমীহ করে। কি পাটনীতি বা ভূমিনীতি, গ্যাস-তেল কয়লানীতি, কৃষি, শিল্প বা মুদ্রানীতি, দারিদ্র্য বিমোচন বা খাদ্যনীতি, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ননীতি—সমসাময়িক সব বিষয়েই অর্থনীতি সমিতি কথা বলে, সমাজের মূলসুরটির প্রতিধ্বনি করে।
অর্থনীতিবিদদের সম্পর্কে বলা হয়, অনেক সময় তাঁরা নাকি গাড়ির চাবি হারিয়ে তা লাইটপোস্টের কাছে আলোতে খুঁজতে পছন্দ করেন, কিন্তু চাবিটি হয়তো পড়ে আছে লাইটপোস্ট থেকে দূরে রাস্তার ধারে ঈষত্ অন্ধকারে চোখের একটু আড়ালে। আমাদের উন্নয়নের মূল চাবিটিও লুকানো আছে অনেকটা দৃষ্টির আড়ালে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের মধ্যে। সুখের কথা, সম্প্র্রতি বিশ্বব্যাংকসহ বনেদি ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা অপেক্ষাকৃত ঝলমলে নাগরীয় বা মুদ্রা অর্থনীতি চর্চার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ফেলে আসা কৃষি, গ্রামোন্নয়ন ও পরিবেশ অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছেন। আমাদের অর্থনীতিবিদদের দায়িত্ব হচ্ছে এই পুনর্জাগরিত ধারাটিকে সযত্নে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া।
‘মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর অর্থনীতি: কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’—এটা বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ১৭তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এখন থেকে এক দশক পর ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীকালে আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই, চাই সবার জন্য শুধু খাদ্যনিরাপত্তা নয়, পুষ্টিনিরাপত্তা, রোগ-ব্যাধিতে সুচিকিত্সাসেবা। এই সঙ্গে আরও চাই নিরাপদ আবাসন, জননিরাপত্তা ও দূষণমুক্ত পরিবেশ। এসব বিষয়ে অর্থনীতিবিদেরা আরও যত্নবান, অনুসন্ধিত্সু ও ক্রিয়াশীল হবেন, এবারের সম্মেলনে এই হোক শুভকামনা।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
তারপর সনাতন গ্রামীণ অর্থনীতির অনুষঙ্গগুলো অবলম্বন করে বড় হয়েছি খোরপোশি কৃষির আবহে। এক বছর খরা, তো পরের বছর বন্যা, বানের ঘোলা জলে আউশ, আমন ধান ডুবে যাওয়া, ফসলহানি, খাদ্যাভাব, রেশনের দোকানে লম্বা সারি, বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পলি পড়া জমিতে রবিশস্য ও চৈতালি ফসলের বেশি বেশি আবাদ, জমি বন্ধক রেখে ঘর-গৃহস্থালির পুঁজি জোগাড় করা—সবই তো স্পর্শ করেছে আমাদের পারিবারিক অর্থনীতি ও জীবিকায়ন। ডান্ডি ম্যানচেস্টারে পাটের দাম পড়ে গেল তো ভৈরব বাজার ও নারায়ণগঞ্জের আড়তেও মন্দাভাব, পাটের রপ্তানি-আয় হ্রাস। পরে বুঝেছি, এটা ছিল সামষ্টিক অর্থনীতি। কিন্তু এর ঢেউ লাগতে দেরি হয়নি ফরিদপুরের কানাইপুর বাজারে, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও সৈয়দপুরে। এটা ভেজা পাট, ওটার রং ভালো না, এটার গোড়া শক্ত কাঠি—নানা ছলছুতোয় গ্রামের হাটবাজারে ফড়িয়া-বেপারিরা পানির দামে কিনে নিয়েছেন কৃষকের সোনালি আঁশ। কালেভদ্রে দুই পয়সা লাভের মুখ দেখলেও প্রায়ই কৃষকদের হতো লোকসান। কামলা-কৃষাণের খরচ ওঠানো ছিল দায়। অথচ তা দিয়েই চালাতে হয়েছে আমাদের সংসার, মেটাতে হয়েছে আমার পড়ার খরচ। এটাই তো ব্যষ্টিক অর্থনীতি।
না, ভুলব কেন বোরো ধানের অর্থনীতি ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা? পাওয়ারপাম্প দিয়ে খাল-বিল সেচে ইরি ধানের আবাদ, তারপর ডিপ-টিউবওয়েল, শ্যালো মেশিন, ডংফেং-সাইফেং পাওয়ারটিলার—এসবই তো কৃষকের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, ভাগ্যনিয়ন্তা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ৮০ লাখ থেকে দুই কোটি ৮০ লাখ টন চাল উত্পাদন। কী অসাধারণ উত্তরণ। তাও আবার ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি থেকে। চাট্টিখানা কথা নয়। কে বলে, আমরা অর্থনীতি বুঝি না? শুধু লাভটা দেখিয়ে দিন, প্রযুক্তিটা শিখিয়ে দিন, পণ্যের বাজারটা ঠিক রাখুন। দেখুন, কী করে উত্পাদন দ্রুততম সময়ে উচ্চতর স্তরে পৌঁছে যায়। রফিক আজাদের কবিতা: ‘ভালবাসা পেলে কোন বোকা পড়ে থাকে নষ্ট জলে।’ আর সহজে কৃষিঋণটা চাই, যাতে মাসিক শতকরা ১০ টাকা গুনতে না হয় কৃষককে।
১৯৭৭ সালে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে প্রথমবারের মতো সদস্য হই। সেই থেকে জ্ঞানী-গুণী পথিকৃত্ অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে পরিচিতি, জানাশোনা, কাজ করা। পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুসংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ ও প্রভাবশালী হচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। এ সংগঠনের সমাজসচেতনতা, কর্মতত্পরতা ও পেশাদার ভূমিকাকে সব মহল অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখে এবং সমীহ করে। কি পাটনীতি বা ভূমিনীতি, গ্যাস-তেল কয়লানীতি, কৃষি, শিল্প বা মুদ্রানীতি, দারিদ্র্য বিমোচন বা খাদ্যনীতি, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ননীতি—সমসাময়িক সব বিষয়েই অর্থনীতি সমিতি কথা বলে, সমাজের মূলসুরটির প্রতিধ্বনি করে।
অর্থনীতিবিদদের সম্পর্কে বলা হয়, অনেক সময় তাঁরা নাকি গাড়ির চাবি হারিয়ে তা লাইটপোস্টের কাছে আলোতে খুঁজতে পছন্দ করেন, কিন্তু চাবিটি হয়তো পড়ে আছে লাইটপোস্ট থেকে দূরে রাস্তার ধারে ঈষত্ অন্ধকারে চোখের একটু আড়ালে। আমাদের উন্নয়নের মূল চাবিটিও লুকানো আছে অনেকটা দৃষ্টির আড়ালে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের মধ্যে। সুখের কথা, সম্প্র্রতি বিশ্বব্যাংকসহ বনেদি ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা অপেক্ষাকৃত ঝলমলে নাগরীয় বা মুদ্রা অর্থনীতি চর্চার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ফেলে আসা কৃষি, গ্রামোন্নয়ন ও পরিবেশ অর্থনীতির দিকে ঝুঁকছেন। আমাদের অর্থনীতিবিদদের দায়িত্ব হচ্ছে এই পুনর্জাগরিত ধারাটিকে সযত্নে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া।
‘মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর অর্থনীতি: কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’—এটা বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ১৭তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এখন থেকে এক দশক পর ২০২১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীকালে আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই, চাই সবার জন্য শুধু খাদ্যনিরাপত্তা নয়, পুষ্টিনিরাপত্তা, রোগ-ব্যাধিতে সুচিকিত্সাসেবা। এই সঙ্গে আরও চাই নিরাপদ আবাসন, জননিরাপত্তা ও দূষণমুক্ত পরিবেশ। এসব বিষয়ে অর্থনীতিবিদেরা আরও যত্নবান, অনুসন্ধিত্সু ও ক্রিয়াশীল হবেন, এবারের সম্মেলনে এই হোক শুভকামনা।
এম এ সাত্তার মণ্ডল: উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
No comments