রক্ত ও তরবারির গান-‘তুমি কি জানো না, তোমার বাবা গুলিবিদ্ধ?’ by ফাতিমা ভুট্টো

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতনি ফাতিমা ভুট্টোর আত্মজীবনীমূলক বই সংস অব ব্লাড অ্যান্ড সোর্ড (রক্ত ও তরবারির গান) সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এতে ভুট্টো পরিবারের দ্বন্দ্ব-কলহ ও ক্ষমতার লড়াইয়ের পাশাপাশি পাকিস্তানি রাজনীতির চরিত্র উদঘাটনের চেষ্টা রয়েছে। বইটির কিছু নির্বাচিত ও পরিমার্জিত অংশ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে।


ফোনের অপর প্রান্তে আসিফ আলী জারদারি।
তিনি স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি কি জানো না, তোমার বাবা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন?’
আমি ফোন রেখে দিলাম। আমার শরীর নিসাড় ও ঠান্ডা হয়ে গেল এবং হূদযন্ত্রও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আমার চারপাশে সবকিছু অন্ধকার দেখলাম।
মা ফোনটি তুলে নিলেন। তিনি আমার চেহারা দেখলেন। আমি ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছি। তিনি বুঝতে পারলেন যে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে, যা আমি বলতে পারছি না। তিনি চিৎকার করে উঠলেন। তিনি কী বলেছিলেন, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। আমি চেয়ারে বসে পড়লাম।
সেটা (গুলি) নিশ্চয়ই হাতে। আমি বিড়বিড় করতে লাগলাম। নিশ্চয়ই তাঁর হাতে গুলি লেগেছে। পায়ে লাগলেও গুরুতর নয়। কেন জারদারি আমাকে গুলির কথা বললেন? আমার বাবার গুলি যদি গুরুতর হয়ে থাকে, তিনি ১৪ বছরের এক কিশোরীকে কি তা বলতেন? আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না।
ফাতি—এটা ভয়ংকর। মা চিৎকার করে উঠলেন।
‘কিন্তু আমি তাঁকে একা যেতে দেব না’। মা বললেন।
মাকে এখনই গাড়ি ডাকতে হবে। দেখলাম, তিনি দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ালাম। তিনি বললেন, এখানে থাক। আমি বললাম, না, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। শাফি আয়ার কাছে বারান্দায়। আমাদের চিৎকার যাতে না শুনতে পারে, সে জন্য আয়া শাফিকে আরও কাছে টেনে নিলেন।
আমি কাঁদতে লাগলাম। তিনি আমার বাবা।
মায়ের বাহু আঁকড়ে ধরে টানতে টানতে আমিও গাড়িতে উঠলাম। তিনি আমাকে বাধা দিতে পারলেন না।
রাস্তা ছিল পরিষ্কার, ফাঁকা। অন্ধকার রাস্তায় কোনো চিহ্ন আছে কি না, দেখতে চেষ্টা করলাম। কিছুই পেলাম না। তখন ভাবলাম, গুরুতর কিছু ঘটেনি।
রাত তিনটার মতো হবে। মা তখনো হাসপাতালে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও বাবার লাশের ছাড়পত্রের জন্য অপেক্ষা করছেন, প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ইসলামাবাদ থেকে করাচি এসে পৌঁছালেন। প্রথমে তিনি তাঁর বাড়িতে গেলেন। সেখান থেকে খালি পায়ে হাসপাতালে এলেন, শোকের চিহ্ন বয়ে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা ওয়াজিদ দুররানি ও সোয়াইল সুদল, যাঁরা সেই রাতে মুর্তজাকে গুলি করেছেন। আরও ছিলেন সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী আবদুল্লাহ শাহ।
বেনজির আমার প্রিয় ওয়াদি, বহু বছর পর তাঁর মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিজের ভুলের জন্যই মুর্তজাকে জীবন দিতে হয়েছে। তিনি ঘটনাকে ভিন্নভাবে উত্থাপন করে বলেছেন, পেছন থেকে মুর্তজার শরীরে গুলি লেগেছে। তাঁর দেহরক্ষীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল, যা তাঁর পিঠে লেগেছে। বাবার দাফনের পর আমি আর বেনজিরকে দেখিনি। প্রতিবার তিনি আল মুর্তজা ভবনে আসার চেষ্টা করতেন এবং লারকানার বাসিন্দারা গাড়ির প্রতি পাথর ও জুতা ছুড়ে মারত।
গারহি খোদা বক্সে বাবাকে চিরনিদ্রায় রেখে আসার পর বেনজির মায়ের বিরুদ্ধে মামলা করলেন যে তিনি ইদ্দত (স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য) পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। (তিনি নিজে মামলা করেননি, তাঁর সমর্থকদের দিয়ে করিয়েছেন) তাঁদের অভিযোগ, মা ইসলামি রীতিনীতি ভঙ্গ করেছেন।
মাত্র ৩৪ বছর বয়সী মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাকে বললেন, তোমার বাবাকে যারা খুন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার কেউ নেই। তিনি চলে গেছেন, সেই সঙ্গে তার ঘাতকেরাও অন্তর্ধান হয়ে গেছেন। আদালত মামলা নাকচ করে দেন।
বহু বছর পর মামলা দায়েরকারী অন্তত পাঁচজন মায়ের কাছে এসে সে জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার মায়ের এবং বাবার স্মৃতির বিরুদ্ধে বেনজিরের যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। নতুন বছরের শুরুতে বাবার দলে মা যোগ দিলেন। ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে ভোটাররা বেনজিরকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং মুসলিম লিগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হয়।
সে সময় বেনজির ভুট্টো প্রখ্যাত লেবাননি সাংবাদিক গিসেলি খোরি মাকে এক বেলি ড্যান্সার হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, সে এসেছে পশ্চাৎপদ লেবাননি সমাজ থেকে। এরপর যে নোংরা কথা উচ্চারণ করেন তা হলো মুর্তজা তাঁর সঙ্গে রাত যাপন করতেন না এবং চাকরানি হিসেবেই তাঁকে বিয়ে করেছেন। মা অত্যন্ত ভদ্রভাবে তার জবাব দিয়েছিলেন এবং অবশ্যই ঘরোয়া আলোচনায়। তিনি বলেছিলেন, মুর্তজার শয়নকক্ষে কী ঘটেছে বেনজির যদি জেনে থাকেন তাহলে কীভাবে তিনি দাবি করেন, ২০ সেপ্টেম্বর তাঁর ঘরের বাইরে কী ঘটেছে তা জানেন না।
সেই রাতের গোলাগুলির মধ্যেও যাঁরা বেঁচে ছিলেন এবং যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁদের এক থানা থেকে অন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা জানতে পারিনি তাঁরা কোথায় আছেন। নাগরিক হিসেবে প্রতিকার পাওয়ার যে মৌলিক অধিকার থানায় এফআইআর দায়ের, বেনজির সরকার তাও করতে দেয়নি। থানায় মামলা করতেও আমাদের সিন্ধু হাইকোর্টের আশ্রয় নিতে হয়েছে।
এদিকে পুলিশ নিহত ও বেঁচে যাওয়া সবার বিরুদ্ধে এই বলে মামলা দায়ের করেছে যে তারা প্রথমে গুলি ছুড়েছে এবং পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। এটাই ছিল অপারেশন ক্লিন আপ-এর ধরন। জেলখানায়ও বেঁচে যাওয়া সঙ্গীরা লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কায়াসার নামে গ্রেপ্তার হওয়া এক যুবক আমাকে বলেছেন, ‘সে রাতে পুলিশ আমাদের পিটিয়েছে এবং বলেছে, আমরা তোমাদের নেতাকে হত্যা করেছি। এখন আমরাই তোমাদের সাহেব, তোমাদের ওপরওয়ালা।’
বাবার মৃত্যুর তিন মাস পর বেনজির সরকারের পতন না ঘটা পর্যন্ত কোনো আসামি ছাড়া পাননি।
ফুফু বেনজিরকে একদিন ফোন করে বললাম, সরকার কেন সবাইকে গ্রেপ্তার করেছে, যেখানে সেদিন বন্দুকযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুলিশ সদস্যরা মুক্ত, ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য তাঁদের কাউকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়নি বা এক দিনের বেতনও কাটা হয়নি।
ফুফু আমাকে কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘ফাতি, তুমি খুবই তরুণ। এটি চলচ্চিত্র নয়, সরকার এবং আমাদের পথেই আমাদের চলতে হবে।’ তিনি আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি।

আগামীকাল জারদারির হাতে মুর্তজার রক্ত

No comments

Powered by Blogger.