অর্থকরী খনিজ-কাচবালু হিসেবে চরের বালুর সম্ভাবনা by মোহাম্মদ রাজীব
নদীমাতৃক বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে নদীর দিকে তাকালে কষ্টই লাগে। নদীর বুক চিরে জেগে থাকা বিশাল চরগুলোকে অভিশাপ মনে হয়। হিমালয়বিধৌত এই নদীগুলো স্বাভাবিক নিয়মে লাখ-কোটি টন পলি সঙ্গে নিয়ে সমতল বাংলাদেশের বুকে জমা হয়ে নদীর স্বাভাবিক গতিধারা ব্যাহত করে।
ফলে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ড্রেজিং খরচের প্রয়োজন হয় শুধু নদীপথ ঠিক রাখার জন্য। পলি সরিয়ে নদীর নাব্যতা বাড়িয়ে পানি প্রবাহের পথ প্রশস্ত করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা অনেক কঠিন। এ রকম একটা অবস্থায় ওইসব চরের বালিকে যদি অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তাহলে একই সঙ্গে দুটি উদ্দেশ্য সফল হবে—বালু আহরণের মাধ্যমে অর্থোপার্জন, একই সঙ্গে ড্রেজিংয়ের খরচ বাঁচানো।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, নদী অববাহিকায় যেসব বালু জমা হয়, তার মধ্যে প্রধানত হালকা খনিজের আধিক্য থাকে, যার আপেক্ষিক ঘনত্ব তুলনামূলক কম। প্রধানত, কোয়ার্টজ বা সিলিকা, ফেল্ডস্পার ও কিছু মাইকাসিয়াস খনিজ। এদের মধ্যে কোয়ার্টজ ও ফেল্ডস্পার একই শ্রেণীভুক্ত সিলিকেট মিনারেল, যাদের মধ্যে Si ও O থাকবেই। পার্থক্য হলো ফেল্ডস্পারের মধ্যে অন্য আরও উপাদান থাকে। অন্যান্য ভৌত বৈশিষ্ট্য বেশ কাছাকাছি হলেও রাসায়নিকভাবে ফেল্ডস্পার অনেক নমনীয়। অপর পক্ষে কোয়ার্টজ সবচেয়ে stable mineral। হালকা খনিজ ছাড়া নদীর বালুতে ভারী খনিজের পরিমাণ স্থানভেদে এক শতাংশের কম থেকে ছয়-আট শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে ইলমেনাইট, গারনেট, জিরকন, পাইরক্সিন, ম্যাগনেটাইট, রুটাইল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সৈকতের বালুতে উপস্থিত ভারী খনিজগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এসব খনিজের বহুল ব্যবহার সম্পর্ক কমবেশি আমরা অনেকেই অবগত। অথচ পরিমাণে অনেক গুণ বেশি, অবহেলায় পড়ে থাকা বা নদীর অভিশাপ বলে আখ্যায়িত চরের বালুতে হালকা খনিজ হিসেবে সিলিকাসমৃদ্ধ বালি অর্থনৈতিকভাবে কতটা কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে গবেষণা খুব কমই হয়েছে।
বর্তমানে চরের বালু সাধারণত দুটি কারণে ব্যবহূত হয়—খালি জায়গা ভরাট করার কাজে ও নির্মাণশিল্পে। বাংলাদেশের কাচ তৈরির কারখানাগুলোতে কোনো কোনো এলাকার বালু ব্যবহার হয় বলে জানা যায়। তবে সবচেয়ে ভালো মানের কাচ তৈরিতে ওই বালু ব্যবহার করা না যাওয়ার কারণ এর সিলিকার পরিমাণ। গ্লাসস্যান্ড বা কাচবালুতে সিলিকার পরিমাণ অবশ্যই ৯৫ শতাংশের বেশি থাকতে হয় এবং সবচেয়ে ভালো মানের কাচ তৈরিতে যার পরিমাণ হতে হয় ৯৯ শতাংশের অধিক। কিন্তু নদীর বালুতে সাধারণত সিলিকার পরিমাণ এলাকাভেদে ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে কাচবালু মজুদ আছে এমন এলাকা খুবই অল্প এবং মজুদের পরিমানও খুব কম। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বালিজুরী (শেরপুর), নয়াপাড়া-শাহজীবাজার (হবিগঞ্জ), চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা), লালঘাট-লাকমা (সুনামগঞ্জ) এবং বড়পুকুরিয়া ও মধ্যপাড়ায় (দিনাজপুর) অবস্থিত ছয়টি ডিপোজিটে কাচবালুর মোট মজুত নির্ণিত আছে ১১১ দশমিক ৩৮৫ মিলিয়ন টন, যার অনেকটাই ব্যবহূত হয়ে গেছে বা আহরণ উপযোগী নয় (ইমাম, ১৯৯৬)। ভূপৃষ্ঠের বেশ কাছে জমা থাকা এসব কাচবালুতে সিলিকার পরিমাণ ৮৯ থেকে ৯৯ শতাংশ, আয়রনের পরিমাণ শূন্য দশমিক শূন্য ১ থেকে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ পর্যন্তসহ অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের কিছুটা উপস্থিতি থাকে। কাচবালুতে সাধারণত ক্রোমিয়াম ও টাইটেনিয়ামের উপস্থিতি কাম্য নয়। এমতাবস্থায় নদীর সিলিকাসমৃদ্ধ বালু থেকে যদি কোনোভাবে ফেল্ডস্পার, মাইকাসিয়াস ও অন্যান্য ভারী খনিজ পৃথক করা যায়, তাহলে খুব সহজেই নদীর বালুকেও কাচবালু হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কক্সবাজার সৈকত খনিজ বালু আহরণকেন্দ্রের (সৈখবাআকে) বিভিন্ন গবেষণাগারে গড়াই, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীর কয়েকটি এলাকার বালু নিয়ে এ রকম একটি সম্ভাব্যতা যাচাই-সংক্রান্ত প্রকল্প পরিচালনা করা হয়। ওই প্রকল্পের ফলাফলে দেখা যায়, সৈখবাআকে-এ যে পদ্ধতিতে সৈকত বালু থেকে ভারী খনিজ পৃথক করা হয়, সেই একই পদ্ধতিতে নদীর বালুর সিলিকার ভৌত মানোন্নয়ন সম্ভব। একই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে নদীর সিলিকাসমৃদ্ধ বালু প্রক্রিয়াজাত করে সিলিকার ভৌত মানোন্নয়ন সম্ভব, যা গবেষণায় দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সিলিকাসমৃদ্ধ গড়াই নদীর বালুতে কোয়ার্টজ বা সিলিকার উপস্থিতি খুব সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৯৪ শতাংশের অধিক করা সম্ভব হয়েছে। এর সঙ্গে Fe, Al, Mg-এর সামান্য উপস্থিতি এবং Cr ও Ti-এর অনুপস্থিতির কথা বিবেচনায় নিলে এই ভৌত মানোন্নয়নকৃত বালুকে সহজেই গ্লাসস্যান্ড বা কাচবালুর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আমেরিকান সিরামিক সোসাইটি এবং ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যান্ডার্ড অনুমোদিত কাচের গঠনের সঙ্গে গড়াই নদীর মানোন্নয়নকৃত সিলিকা বালুর তুলনায় দেখা গেছে, তা ফ্লিন্ট গ্লাস, সিট ও প্লেট গ্লাস, গ্রিন গ্লাস এবং আম্বার গ্লাসের সঙ্গে প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বালিজুরী (শেরপুর) ও চৌদ্দগ্রামের (কুমিল্লা) কাচবালুর সঙ্গে তুলনায় তা অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ (সারণি-১)। তবে সৈখবাআকে-এর যন্ত্রপাতিগুলো বেশ পুরোনো হওয়ায় সিলিকার মানোন্নয়নে আরও আধুনিক যন্ত্র দ্বারা বালু পৃথকীকরণ সম্ভব হলে সিলিকার উপস্থিতি সহজেই ৯৫ শতাংশের অধিক করা সম্ভব বলে গবেষণায় দেখা গেছে। সে ক্ষেত্রে খুব সহজ কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নদীর বালুকে কাচবালুতে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
তবে প্রাথমিক গবেষণাগার বিশ্লেষণে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে সিলিকার মানোন্নয়নের পাশাপাশি বালুতে উপস্থিত ভারী খনিজও পৃথক করা সম্ভব হবে, যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে ইতিমধ্যে প্রমাণিত। তবে বাণিজ্যিক ফল পাওয়া সম্ভব কি না তার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।
তবে এসব কিছুর পাশাপাশি আরও বড় প্রাপ্তি হবে নদী খনন। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যদি নদীর চরের বালু সংগ্রহ করা যায়, তাহলে বছরে কোটি কোটি টাকার ড্রেজিং খরচ বাঁচবে। বালু আহরণের প্রয়োজনে নদী এমনিতেই খনন হবে। নদী নাব্যতা ফিরে পাবে। নদীর নাব্যতা ফিরে পেলে ভয়ংকর বন্যার কবল থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে দেশ। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে এই বালু কোনো দিন শেষ হবে না। প্রতিবছর বন্যার সঙ্গে বালু আসবে। সঠিক পরিকল্পনামতো বালুউত্তোলন করা গেলে প্রতিবছরই তা অল্প অল্প করে পুনর্ভরণ হয়ে যাবে।
উল্লিখিত পদ্ধতিতে হয়তো সবচেয়ে ভালো মানের সিলিকা পাওয়া সম্ভব নয়, তবু এর অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবহার, সম্ভাব্য ভারী খনিজের উৎপাদন, কাচামালের সহজপ্রাপ্যতা, ড্রেজিং খরচ, নদীর নাব্যতা তথা পরিবেশের ভারসাম্য ইত্যাদি বিবেচনা করলে কিছুটা নিম্নমানের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি ও স্থানীয়ভাবে কমমূল্যে বাজারজাত করা যদি সম্ভব হয়, তবুও সামষ্টিক বিচারে একেবারেই ক্ষতি নেই। এ ব্যাপারে শিল্পভিত্তিক গবেষণা জরুরি।
মোহাম্মদ রাজীব: ভূতত্ত্ববিদ, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
mohammad_rajib@yahoo.com
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, নদী অববাহিকায় যেসব বালু জমা হয়, তার মধ্যে প্রধানত হালকা খনিজের আধিক্য থাকে, যার আপেক্ষিক ঘনত্ব তুলনামূলক কম। প্রধানত, কোয়ার্টজ বা সিলিকা, ফেল্ডস্পার ও কিছু মাইকাসিয়াস খনিজ। এদের মধ্যে কোয়ার্টজ ও ফেল্ডস্পার একই শ্রেণীভুক্ত সিলিকেট মিনারেল, যাদের মধ্যে Si ও O থাকবেই। পার্থক্য হলো ফেল্ডস্পারের মধ্যে অন্য আরও উপাদান থাকে। অন্যান্য ভৌত বৈশিষ্ট্য বেশ কাছাকাছি হলেও রাসায়নিকভাবে ফেল্ডস্পার অনেক নমনীয়। অপর পক্ষে কোয়ার্টজ সবচেয়ে stable mineral। হালকা খনিজ ছাড়া নদীর বালুতে ভারী খনিজের পরিমাণ স্থানভেদে এক শতাংশের কম থেকে ছয়-আট শতাংশ পর্যন্ত পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে ইলমেনাইট, গারনেট, জিরকন, পাইরক্সিন, ম্যাগনেটাইট, রুটাইল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সৈকতের বালুতে উপস্থিত ভারী খনিজগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এসব খনিজের বহুল ব্যবহার সম্পর্ক কমবেশি আমরা অনেকেই অবগত। অথচ পরিমাণে অনেক গুণ বেশি, অবহেলায় পড়ে থাকা বা নদীর অভিশাপ বলে আখ্যায়িত চরের বালুতে হালকা খনিজ হিসেবে সিলিকাসমৃদ্ধ বালি অর্থনৈতিকভাবে কতটা কাজে লাগানো যায় তা নিয়ে গবেষণা খুব কমই হয়েছে।
বর্তমানে চরের বালু সাধারণত দুটি কারণে ব্যবহূত হয়—খালি জায়গা ভরাট করার কাজে ও নির্মাণশিল্পে। বাংলাদেশের কাচ তৈরির কারখানাগুলোতে কোনো কোনো এলাকার বালু ব্যবহার হয় বলে জানা যায়। তবে সবচেয়ে ভালো মানের কাচ তৈরিতে ওই বালু ব্যবহার করা না যাওয়ার কারণ এর সিলিকার পরিমাণ। গ্লাসস্যান্ড বা কাচবালুতে সিলিকার পরিমাণ অবশ্যই ৯৫ শতাংশের বেশি থাকতে হয় এবং সবচেয়ে ভালো মানের কাচ তৈরিতে যার পরিমাণ হতে হয় ৯৯ শতাংশের অধিক। কিন্তু নদীর বালুতে সাধারণত সিলিকার পরিমাণ এলাকাভেদে ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে কাচবালু মজুদ আছে এমন এলাকা খুবই অল্প এবং মজুদের পরিমানও খুব কম। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বালিজুরী (শেরপুর), নয়াপাড়া-শাহজীবাজার (হবিগঞ্জ), চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা), লালঘাট-লাকমা (সুনামগঞ্জ) এবং বড়পুকুরিয়া ও মধ্যপাড়ায় (দিনাজপুর) অবস্থিত ছয়টি ডিপোজিটে কাচবালুর মোট মজুত নির্ণিত আছে ১১১ দশমিক ৩৮৫ মিলিয়ন টন, যার অনেকটাই ব্যবহূত হয়ে গেছে বা আহরণ উপযোগী নয় (ইমাম, ১৯৯৬)। ভূপৃষ্ঠের বেশ কাছে জমা থাকা এসব কাচবালুতে সিলিকার পরিমাণ ৮৯ থেকে ৯৯ শতাংশ, আয়রনের পরিমাণ শূন্য দশমিক শূন্য ১ থেকে ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ পর্যন্তসহ অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের কিছুটা উপস্থিতি থাকে। কাচবালুতে সাধারণত ক্রোমিয়াম ও টাইটেনিয়ামের উপস্থিতি কাম্য নয়। এমতাবস্থায় নদীর সিলিকাসমৃদ্ধ বালু থেকে যদি কোনোভাবে ফেল্ডস্পার, মাইকাসিয়াস ও অন্যান্য ভারী খনিজ পৃথক করা যায়, তাহলে খুব সহজেই নদীর বালুকেও কাচবালু হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের কক্সবাজার সৈকত খনিজ বালু আহরণকেন্দ্রের (সৈখবাআকে) বিভিন্ন গবেষণাগারে গড়াই, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীর কয়েকটি এলাকার বালু নিয়ে এ রকম একটি সম্ভাব্যতা যাচাই-সংক্রান্ত প্রকল্প পরিচালনা করা হয়। ওই প্রকল্পের ফলাফলে দেখা যায়, সৈখবাআকে-এ যে পদ্ধতিতে সৈকত বালু থেকে ভারী খনিজ পৃথক করা হয়, সেই একই পদ্ধতিতে নদীর বালুর সিলিকার ভৌত মানোন্নয়ন সম্ভব। একই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে নদীর সিলিকাসমৃদ্ধ বালু প্রক্রিয়াজাত করে সিলিকার ভৌত মানোন্নয়ন সম্ভব, যা গবেষণায় দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সিলিকাসমৃদ্ধ গড়াই নদীর বালুতে কোয়ার্টজ বা সিলিকার উপস্থিতি খুব সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ৯৪ শতাংশের অধিক করা সম্ভব হয়েছে। এর সঙ্গে Fe, Al, Mg-এর সামান্য উপস্থিতি এবং Cr ও Ti-এর অনুপস্থিতির কথা বিবেচনায় নিলে এই ভৌত মানোন্নয়নকৃত বালুকে সহজেই গ্লাসস্যান্ড বা কাচবালুর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। আমেরিকান সিরামিক সোসাইটি এবং ন্যাশনাল ব্যুরো অব স্ট্যান্ডার্ড অনুমোদিত কাচের গঠনের সঙ্গে গড়াই নদীর মানোন্নয়নকৃত সিলিকা বালুর তুলনায় দেখা গেছে, তা ফ্লিন্ট গ্লাস, সিট ও প্লেট গ্লাস, গ্রিন গ্লাস এবং আম্বার গ্লাসের সঙ্গে প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বালিজুরী (শেরপুর) ও চৌদ্দগ্রামের (কুমিল্লা) কাচবালুর সঙ্গে তুলনায় তা অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ (সারণি-১)। তবে সৈখবাআকে-এর যন্ত্রপাতিগুলো বেশ পুরোনো হওয়ায় সিলিকার মানোন্নয়নে আরও আধুনিক যন্ত্র দ্বারা বালু পৃথকীকরণ সম্ভব হলে সিলিকার উপস্থিতি সহজেই ৯৫ শতাংশের অধিক করা সম্ভব বলে গবেষণায় দেখা গেছে। সে ক্ষেত্রে খুব সহজ কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নদীর বালুকে কাচবালুতে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
তবে প্রাথমিক গবেষণাগার বিশ্লেষণে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। বিশেষ করে সিলিকার মানোন্নয়নের পাশাপাশি বালুতে উপস্থিত ভারী খনিজও পৃথক করা সম্ভব হবে, যা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে ইতিমধ্যে প্রমাণিত। তবে বাণিজ্যিক ফল পাওয়া সম্ভব কি না তার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন।
তবে এসব কিছুর পাশাপাশি আরও বড় প্রাপ্তি হবে নদী খনন। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যদি নদীর চরের বালু সংগ্রহ করা যায়, তাহলে বছরে কোটি কোটি টাকার ড্রেজিং খরচ বাঁচবে। বালু আহরণের প্রয়োজনে নদী এমনিতেই খনন হবে। নদী নাব্যতা ফিরে পাবে। নদীর নাব্যতা ফিরে পেলে ভয়ংকর বন্যার কবল থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে দেশ। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে এই বালু কোনো দিন শেষ হবে না। প্রতিবছর বন্যার সঙ্গে বালু আসবে। সঠিক পরিকল্পনামতো বালুউত্তোলন করা গেলে প্রতিবছরই তা অল্প অল্প করে পুনর্ভরণ হয়ে যাবে।
উল্লিখিত পদ্ধতিতে হয়তো সবচেয়ে ভালো মানের সিলিকা পাওয়া সম্ভব নয়, তবু এর অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবহার, সম্ভাব্য ভারী খনিজের উৎপাদন, কাচামালের সহজপ্রাপ্যতা, ড্রেজিং খরচ, নদীর নাব্যতা তথা পরিবেশের ভারসাম্য ইত্যাদি বিবেচনা করলে কিছুটা নিম্নমানের দ্রব্যসামগ্রী তৈরি ও স্থানীয়ভাবে কমমূল্যে বাজারজাত করা যদি সম্ভব হয়, তবুও সামষ্টিক বিচারে একেবারেই ক্ষতি নেই। এ ব্যাপারে শিল্পভিত্তিক গবেষণা জরুরি।
মোহাম্মদ রাজীব: ভূতত্ত্ববিদ, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
mohammad_rajib@yahoo.com
No comments