মিডিয়া ভাবনা-আলোকচিত্রের স্বাধীনতা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
সম্প্রতি ঢাকার দৃক গ্যালারিতে ‘ক্রসফায়ার’ বিষয়ক একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী সরকার অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি। পরে রিট আবেদন করা হলে আদালতের নির্দেশে সেই প্রদর্শনী আবার শুরু হয়। পাঠশালা-সাউথ এশিয়ান ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট এই প্রদর্শনীর আয়োজন করে।
খবরে প্রকাশ, পুলিশ দৃক গ্যালারি ঘেরাও করে রেখেছিল এবং আগ্রহী দর্শককে প্রদর্শনীকক্ষে ঢুকতে দেয়নি।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ হলেও মাঝেমধ্যে এ ধরনের হামলা বা সরকারি পদক্ষেপ আমাদের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করে। সরকারের কোন মহলের কার পরামর্শে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের পদক্ষেপ নেয় তা কখনো জানা যায় না। তবে যারাই পরামর্শ দিক না কেন, তারা মিত্রের ছদ্মবেশে সরকারের ক্ষতিই যে বেশি করছে তা বুঝতে সরকারি মহলের অনেক সময় লেগে যায়। তখন যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে।
প্রথমত দেখা দরকার বিষয়টা কী। একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী। কী ছবি? ক্রসফায়ার। ক্রসফায়ার নিয়ে দেশে নানা সমালোচনা রয়েছে। ক্রসফায়ারের বিপক্ষে যেমন জনমত রয়েছে তেমনি পক্ষেও রয়েছে জনমত। কাজেই একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী ক্রসফায়ার সম্পর্কে দেশের জনমত ১০০ ভাগ বিপক্ষে নিয়ে যাবে, তা কেউ দাবি করতে পারে না। এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী হওয়ার পরও ক্রসফায়ারের অবস্থান তেমন নড়চড় হতো বলে মনে হয় না। যেসব যুক্তিতে র্যাব ‘ক্রসফায়ার’-এর মতো অমানবিক কৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছে, সেই যুক্তি আলোকচিত্র প্রদর্শনী হলেও বলবত্ থাকবে। তা ছাড়া র্যাব বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কখনো স্বীকার করে না, তারা ক্রসফায়ার অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশে ক্রসফায়ারই মনে হয় একমাত্র কর্মসূচি বা কৌশল যা বিএনপি-জামায়াত আমল, তত্ত্বাবধায়ক আমল ও মহাজোট আমল বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছে। এটা একটা বড় বৈশিষ্ট্য। ক্রসফায়ার সম্পর্কে মানবাধিকার সংগঠনগুলো নানা কথা বলেছে। তাদের সমালোচনার উপযুক্ত জবাব এখনো র্যাব দিতে পারেনি। আমার ধারণা, ক্রসফায়ার একটা ‘ওপেন সিক্রেট’ হিসেবে আমাদের সমাজে আরও কিছু কাল টিকে থাকবে। ক্রসফায়ারের ভালো-মন্দ নিয়ে পর্যালোচনা করা এই নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। আমি প্রধানত আলোচনা করতে চাইছি আলোকচিত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে।
এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে মনে হয় এটাই প্রথম। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, কলাম, সম্পাদকীয়, কার্টুন, প্রবন্ধ, কবিতাসহ নানা কিছুর ওপর গত চার দশকে বিভিন্ন সরকারের সময় বাধানিষেধ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ, নিষিদ্ধ করা, প্রত্যাহার করা, মামলা দেওয়া, গ্রেপ্তার করা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এ রকম নানা কাণ্ড ঘটেছে। পাকিস্তান আমলেও এ রকম বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল।
‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র ওপর সরকারি হামলা বা হস্তক্ষেপ এ দেশে মোটেও নতুন নয়। তবে বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া এর আগে কখনো ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। আলোকচিত্র তো মত প্রকাশের কিছু নয়। আলোকচিত্র ঘটনার প্রতিফলন মাত্র। যা ঘটেছে তাই তুলে ধরা আলোকচিত্রের ধর্ম। যা দৃশ্যমান তা তুলে ধরে আলোকচিত্র। এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণ কী? আলোকচিত্রগুলো কি কৃত্রিম ছিল? গ্রাফিকস কারসাজিতে তৈরি হয়েছিল? অভিযোগটা কী তা জনগণের কাছে জানানো হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যদি যুক্তিসংগত কারণ থাকত এবং তা যদি সমর্থনযোগ্য হতো তাহলে আমরা কলাম লিখে সরকারকে সমর্থন দিতাম। দৃকের নিন্দা করতাম। কিন্তু সরকার সে রকম কোনো কারণ জনগণকে জানায়নি। এটাও গণতান্ত্রিক সরকারের মতো কাজ হয়নি। সরকার একটি দায়িত্বশীল শক্তি। তারা যখন ক্ষমতার জোরে একটা কাজ করবে, যে কাজে জনগণ আহত হতে পারে, তখন সরকারকে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। কারণ গণতন্ত্রে সরকার জনগণের প্রতিনিধি। একমাত্র অনির্বাচিত সরকারই এ ধরনের একতরফা আচরণ করতে পারে। কারণ কারও কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না।
রিট আবেদনে আদালতের নির্দেশে প্রদর্শনী আবার শুরু করা সম্ভব হয়েছে বটে, কিন্তু দেশের ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। কীভাবে? পাঠশালা-সাউথ এশিয়ান ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। সারা বিশ্বের ফটোগ্রাফি ঘরানার সঙ্গে তাদের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। প্রতি দুই বছর অন্তর তাদের উদ্যোগে ঢাকায় আয়োজিত হয় আন্তর্জাতিক প্রেস ফটোগ্রাফির প্রদর্শনী। ক্রসফায়ার প্রদর্শনী বন্ধ করার খবর নিমিষেই চলে গেছে সারা দুনিয়ায়। অনুমান করি, বিশ্বের বহু পত্রিকায় খবরটি ছাপাও হয়েছে। এই ‘খবর’ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথে এ দেশে কী রকম বাধা কাজ করছে তা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে একটি ছোট্ট খবরের মাধ্যমে। এর জন্য ‘কৃতিত্ব’ দাবি করতে পারে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এসব কারণে অবশ্য কারও কোনো শাস্তি হয় না।
এ ধরনের কাজ এটাই শেষ, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। ভবিষ্যতে সরকারের কোনো অতি উৎসাহী সুহূদ বা দলবাজ আমলা অন্য কোনো ক্ষেত্রেও হয়তো অকারণে বাধানিষেধের দেয়াল তুলে ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আগে স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করলে জাতি, সমাজ বা জনগণ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো তা জনগণকে জানানো দরকার।
দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরীন
বাংলাদেশের দুজন লেখক দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরীন দীর্ঘদিন ধরে বাধ্যতামূলকভাবে বিদেশে। শুধু ‘মত প্রকাশের’ ‘অপরাধে’ তাঁরা আজ বাধ্যতামূলকভাবে মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত। বিদেশে নানা রকম বৃত্তি ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর মাতৃভূমি, মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য না পাওয়া যে কত কষ্টকর ও অমানবিক, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ তেমন অনুভব করতে পারে না। দীর্ঘদিন এই দুজন সাহিত্যশিল্পী এই নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে প্রবাসজীবন যাপন করছেন। যখন তাঁদের রচনা প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার বাংলাদেশের সমাজ ও এখনকার সমাজের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেক কিছু বাংলাদেশের সমাজ গ্রহণ করতে পারছে। এখন আমাদের সমাজ অনেক আন্তর্জাতিক আবহে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এখনো প্রায় আগের মতো দৃঢ় থাকলেও মানুষ এখন অনেক বেশি সহনশীল, গণতান্ত্রিক ও পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরীনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো কি পর্যালোচনা করা যায় না? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে একটা সুপারিশ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না?
বাংলাদেশের এই দুজন বিশিষ্ট লেখকের বিদেশে নির্বাসনে থাকা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির জন্য সহায়ক নয়। ‘ধর্মান্ধ শক্তিই বাংলাদেশে ক্ষমতাশালী’—এ রকম একটি ধারণা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। অথচ সবাই জানে, তা সত্য নয়। বাংলাদেশে উগ্র ধর্মান্ধ শক্তি বিএনপি-জামায়াত আমলে যতটা প্রশ্রয় পেয়েছিল, মহাজোট আমলে সে রকম পায়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন হলে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর প্রভাব অনেকটাই হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরীনের বিষয়টি আবার বিবেচনা করার সুযোগ আছে বৈকি।
আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পীগোষ্ঠী এই বিষয়ে সব সময় নীরবতা অবলম্বন করেন। এই দুই সাহিত্যশিল্পী কোনো খুনের মামলায় বিদেশে পালিয়ে যাননি। নিছক মত প্রকাশের কারণে তাঁদের আজ প্রবাসজীবন বেছে নিতে হয়েছে। তাঁদের মতের সঙ্গে বা তাঁদের মত প্রকাশের ভঙ্গির সঙ্গে আমি বা অনেকেই একমত নই। সবাই সবার সঙ্গে একমত হবেন, এমন আশা করাও যায় না। কিন্তু তাই বলে একটা লেখার কারণে একজনকে ২০-৩০ বছর নির্বাসনে কাটাতে হবে, এটা সমর্থন করা যায় না। এই দুজন লেখক তাঁদের কোনো বিশেষ রচনার জন্য যদি মানুষের মনে আঘাত দিয়ে থাকেন, তাহলে এত বছরের নির্বাসিত জীবন কি তার জন্য যথেষ্ট শাস্তি নয়?
বিষয়টি নিয়ে ভাবার জন্য ও সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আমি প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, নারী নেত্রীসহ সবাইকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ হলেও মাঝেমধ্যে এ ধরনের হামলা বা সরকারি পদক্ষেপ আমাদের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করে। সরকারের কোন মহলের কার পরামর্শে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের পদক্ষেপ নেয় তা কখনো জানা যায় না। তবে যারাই পরামর্শ দিক না কেন, তারা মিত্রের ছদ্মবেশে সরকারের ক্ষতিই যে বেশি করছে তা বুঝতে সরকারি মহলের অনেক সময় লেগে যায়। তখন যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে।
প্রথমত দেখা দরকার বিষয়টা কী। একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী। কী ছবি? ক্রসফায়ার। ক্রসফায়ার নিয়ে দেশে নানা সমালোচনা রয়েছে। ক্রসফায়ারের বিপক্ষে যেমন জনমত রয়েছে তেমনি পক্ষেও রয়েছে জনমত। কাজেই একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী ক্রসফায়ার সম্পর্কে দেশের জনমত ১০০ ভাগ বিপক্ষে নিয়ে যাবে, তা কেউ দাবি করতে পারে না। এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী হওয়ার পরও ক্রসফায়ারের অবস্থান তেমন নড়চড় হতো বলে মনে হয় না। যেসব যুক্তিতে র্যাব ‘ক্রসফায়ার’-এর মতো অমানবিক কৌশল অবলম্বন করে যাচ্ছে, সেই যুক্তি আলোকচিত্র প্রদর্শনী হলেও বলবত্ থাকবে। তা ছাড়া র্যাব বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কখনো স্বীকার করে না, তারা ক্রসফায়ার অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশে ক্রসফায়ারই মনে হয় একমাত্র কর্মসূচি বা কৌশল যা বিএনপি-জামায়াত আমল, তত্ত্বাবধায়ক আমল ও মহাজোট আমল বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছে। এটা একটা বড় বৈশিষ্ট্য। ক্রসফায়ার সম্পর্কে মানবাধিকার সংগঠনগুলো নানা কথা বলেছে। তাদের সমালোচনার উপযুক্ত জবাব এখনো র্যাব দিতে পারেনি। আমার ধারণা, ক্রসফায়ার একটা ‘ওপেন সিক্রেট’ হিসেবে আমাদের সমাজে আরও কিছু কাল টিকে থাকবে। ক্রসফায়ারের ভালো-মন্দ নিয়ে পর্যালোচনা করা এই নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। আমি প্রধানত আলোচনা করতে চাইছি আলোকচিত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে।
এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে মনে হয় এটাই প্রথম। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, কলাম, সম্পাদকীয়, কার্টুন, প্রবন্ধ, কবিতাসহ নানা কিছুর ওপর গত চার দশকে বিভিন্ন সরকারের সময় বাধানিষেধ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ, নিষিদ্ধ করা, প্রত্যাহার করা, মামলা দেওয়া, গ্রেপ্তার করা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি এ রকম নানা কাণ্ড ঘটেছে। পাকিস্তান আমলেও এ রকম বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল।
‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’র ওপর সরকারি হামলা বা হস্তক্ষেপ এ দেশে মোটেও নতুন নয়। তবে বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়া এর আগে কখনো ঘটেছে বলে মনে পড়ে না। আলোকচিত্র তো মত প্রকাশের কিছু নয়। আলোকচিত্র ঘটনার প্রতিফলন মাত্র। যা ঘটেছে তাই তুলে ধরা আলোকচিত্রের ধর্ম। যা দৃশ্যমান তা তুলে ধরে আলোকচিত্র। এ ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষের আপত্তির কারণ কী? আলোকচিত্রগুলো কি কৃত্রিম ছিল? গ্রাফিকস কারসাজিতে তৈরি হয়েছিল? অভিযোগটা কী তা জনগণের কাছে জানানো হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যদি যুক্তিসংগত কারণ থাকত এবং তা যদি সমর্থনযোগ্য হতো তাহলে আমরা কলাম লিখে সরকারকে সমর্থন দিতাম। দৃকের নিন্দা করতাম। কিন্তু সরকার সে রকম কোনো কারণ জনগণকে জানায়নি। এটাও গণতান্ত্রিক সরকারের মতো কাজ হয়নি। সরকার একটি দায়িত্বশীল শক্তি। তারা যখন ক্ষমতার জোরে একটা কাজ করবে, যে কাজে জনগণ আহত হতে পারে, তখন সরকারকে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। কারণ গণতন্ত্রে সরকার জনগণের প্রতিনিধি। একমাত্র অনির্বাচিত সরকারই এ ধরনের একতরফা আচরণ করতে পারে। কারণ কারও কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না।
রিট আবেদনে আদালতের নির্দেশে প্রদর্শনী আবার শুরু করা সম্ভব হয়েছে বটে, কিন্তু দেশের ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। কীভাবে? পাঠশালা-সাউথ এশিয়ান ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। সারা বিশ্বের ফটোগ্রাফি ঘরানার সঙ্গে তাদের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। প্রতি দুই বছর অন্তর তাদের উদ্যোগে ঢাকায় আয়োজিত হয় আন্তর্জাতিক প্রেস ফটোগ্রাফির প্রদর্শনী। ক্রসফায়ার প্রদর্শনী বন্ধ করার খবর নিমিষেই চলে গেছে সারা দুনিয়ায়। অনুমান করি, বিশ্বের বহু পত্রিকায় খবরটি ছাপাও হয়েছে। এই ‘খবর’ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথে এ দেশে কী রকম বাধা কাজ করছে তা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছে একটি ছোট্ট খবরের মাধ্যমে। এর জন্য ‘কৃতিত্ব’ দাবি করতে পারে আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এসব কারণে অবশ্য কারও কোনো শাস্তি হয় না।
এ ধরনের কাজ এটাই শেষ, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। ভবিষ্যতে সরকারের কোনো অতি উৎসাহী সুহূদ বা দলবাজ আমলা অন্য কোনো ক্ষেত্রেও হয়তো অকারণে বাধানিষেধের দেয়াল তুলে ধরে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার আগে স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও ভাবনাচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করলে জাতি, সমাজ বা জনগণ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো তা জনগণকে জানানো দরকার।
দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরীন
বাংলাদেশের দুজন লেখক দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরীন দীর্ঘদিন ধরে বাধ্যতামূলকভাবে বিদেশে। শুধু ‘মত প্রকাশের’ ‘অপরাধে’ তাঁরা আজ বাধ্যতামূলকভাবে মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত। বিদেশে নানা রকম বৃত্তি ও সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর মাতৃভূমি, মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য না পাওয়া যে কত কষ্টকর ও অমানবিক, তা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ তেমন অনুভব করতে পারে না। দীর্ঘদিন এই দুজন সাহিত্যশিল্পী এই নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে প্রবাসজীবন যাপন করছেন। যখন তাঁদের রচনা প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার বাংলাদেশের সমাজ ও এখনকার সমাজের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেক কিছু বাংলাদেশের সমাজ গ্রহণ করতে পারছে। এখন আমাদের সমাজ অনেক আন্তর্জাতিক আবহে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এখনো প্রায় আগের মতো দৃঢ় থাকলেও মানুষ এখন অনেক বেশি সহনশীল, গণতান্ত্রিক ও পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরীনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো কি পর্যালোচনা করা যায় না? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে একটা সুপারিশ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না?
বাংলাদেশের এই দুজন বিশিষ্ট লেখকের বিদেশে নির্বাসনে থাকা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির জন্য সহায়ক নয়। ‘ধর্মান্ধ শক্তিই বাংলাদেশে ক্ষমতাশালী’—এ রকম একটি ধারণা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। অথচ সবাই জানে, তা সত্য নয়। বাংলাদেশে উগ্র ধর্মান্ধ শক্তি বিএনপি-জামায়াত আমলে যতটা প্রশ্রয় পেয়েছিল, মহাজোট আমলে সে রকম পায়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন হলে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর প্রভাব অনেকটাই হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা যায়। এ রকম পরিস্থিতিতে দাউদ হায়দার ও তসলিমা নাসরীনের বিষয়টি আবার বিবেচনা করার সুযোগ আছে বৈকি।
আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পীগোষ্ঠী এই বিষয়ে সব সময় নীরবতা অবলম্বন করেন। এই দুই সাহিত্যশিল্পী কোনো খুনের মামলায় বিদেশে পালিয়ে যাননি। নিছক মত প্রকাশের কারণে তাঁদের আজ প্রবাসজীবন বেছে নিতে হয়েছে। তাঁদের মতের সঙ্গে বা তাঁদের মত প্রকাশের ভঙ্গির সঙ্গে আমি বা অনেকেই একমত নই। সবাই সবার সঙ্গে একমত হবেন, এমন আশা করাও যায় না। কিন্তু তাই বলে একটা লেখার কারণে একজনকে ২০-৩০ বছর নির্বাসনে কাটাতে হবে, এটা সমর্থন করা যায় না। এই দুজন লেখক তাঁদের কোনো বিশেষ রচনার জন্য যদি মানুষের মনে আঘাত দিয়ে থাকেন, তাহলে এত বছরের নির্বাসিত জীবন কি তার জন্য যথেষ্ট শাস্তি নয়?
বিষয়টি নিয়ে ভাবার জন্য ও সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আমি প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, কলামিস্ট, নারী নেত্রীসহ সবাইকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
No comments