উপমহাদেশ-টিভি লাইসেন্সই কাল হলো by পার্থ চট্টোপাধ্যায়
তামিলনাড়ূতে কংগ্রেস খুব দুর্বল। তখন ছিল করুণানিধির খুব রমরমা অবস্থা। সেই করুণানিধির যে এমন হবে তা কে জানত। বছরখানেক আগে ডিএমকে মন্ত্রী এ রাজার ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়ল। তিনি টেলিকমমন্ত্রী হিসেবে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টন করেছেন।
লোকসভায় বিরোধী সদস্যরা এ নিয়ে হইচই শুরু করলেন। সরকার বাধ্য হলো সিবিআইকে তদন্তের ভার দিতে। অতঃপর রাজার পদত্যাগ। গ্রেফতার ও তিহার জেল। কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ল
আজ রাজা কাল ফকির_ ২৩ মে দিলি্লর তিহার জেলের সামনে একটি অ্যামবাসাডর গাড়ি থেকে ৮৭ বছরের বৃদ্ধকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে তিহার জেলের ভেতর নিয়ে যাওয়া হলো। ওই বৃদ্ধকে দেখে কে বলবে, তিনি ১০ দিন আগেও তামিলনাড়ূর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার নাম করুণানিধি। পাঁচবার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ষষ্ঠবারে তার দল হেরে গেল। তিনি এখন রাজ্যহারা। তার পরিবারই ছিল তার দল। ছেলেমেয়ে, জামাই, আত্মীয়-বন্ধু_ এরাই তার রাজত্বের পাত্রমিত্র অমাত্য। রাজ্যপাট হারানোর দুঃখ হয়তো গায়ে লাগত না। কারণ তিনি জানেন, রাজনীতি হলো পতন-অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা। তিনি জানেন, ছেলেমেয়ে বা জামাই আবার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু তার দুঃখ হলো, তার শেষ বয়সের আদরের মেয়ে কানিমোঝি দুর্নীতির দায়ে তিহার জেলে বিচারাধীন বন্দি।
তিহার জেল কর্তৃপক্ষ এই ভিভিআইপি দর্শনার্থীকে ২০ মিনিট সময় দিয়েছে মেয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। এই ২০ মিনিট করুণানিধির জীবনে বোধহয় সবচেয়ে ভাবাবেগময় মুহূর্ত। তিনি তিহার জেল থেকে সোনিয়া গান্ধীর কাছে ছুটেছেন, যদি তারা তার কন্যার প্রতি সদয় হন। তিহার জেলেই রয়েছেন সাবেক টেলিকমমন্ত্রী এ রাজা। টু-জি স্ক্যান নামে পরিচিত এক বিরাট দুর্নীতির মামলায় হাবুডুবু খাচ্ছেন তামিলনাড়ূ ডিএমকে দলের মন্ত্রী এ রাজা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। রাজার মন্ত্রীর পদটি গেছে। এখন তিনি বিচারাধীন বন্দি। রাজা করুণানিধির আত্মীয় নন। কিন্তু কানিমোঝি করুণানিধির আত্মজা। সুশ্রী, শিক্ষিতা, পরিচিত তামিল কবি। অনেক সাধ করে তাকে রাজ্যসভার সদস্য করে দিয়েছেন করুণানিধি। টু-জি স্ক্যান নিয়ে দেশজুড়ে এত হইচই হলো যে, তার ঝাপটায় করুণানিধির সরকারই হেরে গেল এবারের নির্বাচনে।
পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাসী করুণানিধির তিন স্ত্রী। ছোট স্ত্রীর মেয়ে কানিমোঝি। তিনি এমপি। তার ছেলেদের মধ্যে এমকে আজহাগিরি কেন্দ্রীয় সারমন্ত্রী। আর এক ছেলে এমকে স্ট্যালিন ছিলেন উপমুখ্যমন্ত্রী_ বাবার সব কাজই তিনি দেখতেন। তার এক মেয়ে সেলভিও এমপি।
করুণানিধির পরিবারের সবাই নানা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাদের পরিবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক। দুর্নীতি তামিল রাজনীতির এখন একটা সংস্কৃতি। এআইডিএমকের নেত্রী জয়ললিতা এবার করুণানিধির ডিএমকে দলকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। এক পক্ষের দুর্নীতির অভিযোগ যখন চরমে ওঠে, তখন সেখানকার ভোটাররা ধ্যাত্তেরি বলে অন্য পক্ষকে ভোট দেয়। তামিলনাড়ূর ডিএমকে দলের সঙ্গে আবার কেন্দ্রের গাঁটছড়া বাঁধা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লোকসভার একক মেজরিটি নেই। তাই তৃণমূল আর ডিএমকে দলের সমর্থনের ওপর ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার টিকে আছে। শরিকদের হাতে রাখতে তাদের সঙ্গে অনেক সমঝোতা করতে হয়েছে। যেমন তৃণমূলকে রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতর ছেড়ে দিতে হয়েছে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেলেন, তবু রেল ছাড়লেন না তিনি। তার বিশ্বস্ত জাহাজ দফতরের প্রতিমন্ত্রী মুকুল রায়কে এখন রেলের প্রতিমন্ত্রীর অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে মমতা কদাচ রেলমন্ত্রকে বসতেন। কিন্তু সোনিয়া চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিপিএম শাসন হটানোর এবারই প্রকৃষ্ট সময়। তাই মমতাকে তারা আর্থিক মদদ দিয়ে সাহায্য করেছেন। মমতা যে এবার হেলিকপ্টারে করে নির্বাচন প্রচার করলেন, সেই হেলিকপ্টারের টাকা জুগিয়েছে ভারতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটি।
আর ডিএমকে? এখানে কংগ্রেসের সাপের ছুঁচো গলার মতো অবস্থা। তামিলনাড়ূতে কংগ্রেস খুব দুর্বল। তখন ছিল করুণানিধির খুব রমরমা অবস্থা। সেই করুণানিধির যে এমন হবে তা কে জানত। বছরখানেক আগে ডিএমকে মন্ত্রী এ রাজার ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়ল। তিনি টেলিকমমন্ত্রী হিসেবে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টন করেছেন। লোকসভায় বিরোধী সদস্যরা এ নিয়ে হইচই শুরু করলেন। সরকার বাধ্য হলো সিবিআইকে তদন্তের ভার দিতে। অতঃপর রাজার পদত্যাগ। গ্রেপ্তার ও তিহার জেল। কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ল। অবশেষে ডিএমকের আরও কিছু রাঘববোয়াল ধরা পড়ল। কংগ্রেস ভেবেছিল, করুণানিধির তামিলনাড়ূতে এত প্রতিপত্তি যে, দুর্নীতির প্রশ্নটাকে ভোটাররা আমল দেবেন না। কিন্তু হিসাবটা ভুল হয়ে গেল।
এবার কানিমোঝির কথা বলতে গেলে করুণানিধির পারিবারিক জীবনের কথা একটু বলতে হয়। করুণানিধির তিন সংসার। প্রথম পত্নীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। ২ নম্বর বউ দয়ালু আম্মাল ও ৩ নম্বর বউ রাজাথি আম্মালের সঙ্গে তিনি থাকেন। রাজাথি একজন চিত্রাভিনেত্রী ছিলেন। তারই মেয়ে কানিমোঝি। করুণানিধির প্রথম পক্ষের দুই ছেলে এ কে আলগিরি, এমকে মারান আর মেয়ে সেলভি। করুণানিধির এক ভাইয়ের নাতি দয়ানিধি মারান ও ভাইপো মুরাসোলি মারান (দয়ানিধির বাবা)। এই নিয়ে করুণানিধির পরিবারের গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স। তারাই সরকার চালাতেন। তারাই ডিএমকে চালান। এ তালিকায় এতদিন কানিমোঝির নাম ছিল না। কারণ করুণানিধি এতদিন মেয়েকে রাজনীতি থেকে আগলে রেখেছিলেন। বড় পয়মন্ত তার এই কনিষ্ঠতম সন্তান। তিনি যেবার জন্মান সেবারই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তামিলনাড়ূর মসনদে জেঁকে বসেছিলেন করুণানিধি। কিন্তু ওই যে কথায় আছে নিয়তিকে কে রুখতে পারে?
করুণানিধির এই বিশাল পরিবার কিন্তু সুখী পরিবার নয়। করুণানিধিকে বৃদ্ধ শাজাহান ভেবে ছেলে আর বউরা নিয়ত প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
করুণানিধির ভাইয়ের দুই নাতি মারান ব্রাদার্স বলে পরিচিত। তারা একটি বহুল প্রচারিত তামিল দৈনিকের (দিনাকরণ) মালিক। মারানদের সঙ্গে করুণানিধির পরিবারে সদ্ভাব নেই। গত ২০০৭ সালের মে মাসে দিনাকরণে একটি বিতর্কিত সমীক্ষা বেরোয় করুণানিধির পর কে? এই লেখা পড়ে করুণানিধির সমর্থকরা এমন ক্ষেপে যায় যে, তারা দিনাকরণের অফিসে চড়াও হয়ে ভাংচুর চালায়। বাধা দিতে গেলে অফিসের তিনজন স্টাফকে দুর্বৃত্তরা মেরে ফেলে। দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি আবার ব্যক্তিভিত্তিক। সেখানে একেকজন নেতার অনুগামীরা এত ফ্যানাটিক যে, নেতার জন্য অনুগামীরা গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দেয়।
বৃদ্ধ করুণানিধি দেখেন, তার দুই ছেলের মধ্যে সদ্ভাব নেই। তিনি চোখ বুজলে কী হবে! অন্যদিকে মারান যখন তার কাগজে করুণানিধির বিরুদ্ধেই লেখা ছাপতে শুরু করেন, তখন করুণানিধি ভাবলেন তার এখন একমাত্র বিশ্বস্ত আদরের মেয়েকেই তিনি উত্তরাধিকারী করে যাবেন। মেয়ে যোগ্যতায় কারও চেয়ে কম যায় না। অর্থনীতিতে এমএ। খুব ভালো মেয়ে। করুণানিধিও তামিল লেখক। তিনি বলেন, মেয়ে আমার গুণ পেয়েছে। মেয়ে বড় লেখিকা হবে_ এটাই তিনি চেয়েছিলেন। মেয়ে খবরের কাগজের সাব-এডিটর হিসেবে জীবন শুরু করেছিল। সিঙ্গাপুর থেকে একটি তামিল দৈনিক বের হয়। করুণাতনয়া কানি তার ফিচার এডিটর হয়েছিল। ২০০৭-এর পর কানি বলল, বাবা আমাদের একটা টিভি চ্যানেল খোলা দরকার। মারানরা দিনাকরণে যা-তা লেখে। তাছাড়া জয়ললিতার সান টিভি তো আমাদের শত্রু। আমাদের নিজস্ব চ্যানেল নেই। আমি সাংবাদিকতা করি। টিভিটা আমি ভালো বুঝি। ওটা আমিই দেখব। করুণানিধির কাছে এটা উত্তম প্রস্তাব বলে মনে হয়েছিল। মেয়েকেই তিনি উত্তরাধিকারী করে যাবেন_ এমন বাসনা হয়েছিল। তার আগে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য দিলি্লতে এমপি করে পাঠিয়েছিলেন তাকে। অন্য একটা উদ্দেশ্যও ছিল। মারান সেখানে ডিএমকে মন্ত্রী। তার ওপর নজর রাখার জন্য বিশ্বস্ত এমন কাউকে চাই।
ওই টিভির মালিক হওয়াটাই কাল হয়ে গেল করুণানিধির কবি-সাংবাদিক এবং সবসময় বই মুখে করে থাকা মেয়ের কাছে। কানি সবদিক থেকে সৎ ভাইদের চেয়ে আলাদা। প্রথম বিয়েটা ভেঙে গেলে বড় দুঃখ পেয়েছিল কানি। কিন্তু সিঙ্গাপুরের তামিল লেখক অরবিন্দের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েতে সুখীই হয়েছিল সে। করুণানিধির উদ্যোগে যে 'কালাইগনার' টিভি চ্যানেল তৈরি হয়েছিল তার ২০ শতাংশ শেয়ার ছিল কানির নামে। রাজাকে দ্বিতীয়বার টেলিকমমন্ত্রী করার ব্যাপারে কানি উদ্যোগ নেন। ক্রমে তিনি রাজার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। টু-জি স্পেকট্রামের লাইসেন্স কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদেরই একজন কানিমোঝির টিভি ২০০ কোটি টাকা দিয়ে তার 'শেয়ার' কিনেছিলেন_ এই লেনদেন অস্বাভাবিক ঠেকছে সিবিআইএর কাছে। আদালতের কাছেও এটা ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু তার কোনো চুক্তি নেই। কালাইগনার টিভির ইকুইটি ১০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০০৯ সালে এই কোম্পানির লেনদেন হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৪ কোটি টাকা। কোথা থেকে এলো এত টাকা? দেখা গেছে, কালাইগনার টিভি ঋণ হিসেবে নেওয়া ২০০ কোটি আর একটি কোম্পানিকে ফেরত দিয়েছে। এটাও এসেছে অঞ্জুগাম ফিল্ম থেকে। ওই ফিল্ম কোম্পানিও আবার 'কালাইগনার' টিভির সাবসিডিয়ারি।
মোট কথা, করুণানিধি পরিবার এখন গভীর জলে। তবে তারা সবাই গভীর জলের মাছ। কিন্তু আরও বড় মাছ শিকারি চেন্নাই সমুদ্রে বড় ছিপ নিয়ে বসে আছেন_ তিনি নতুন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতীয় সাংবাদিক
আজ রাজা কাল ফকির_ ২৩ মে দিলি্লর তিহার জেলের সামনে একটি অ্যামবাসাডর গাড়ি থেকে ৮৭ বছরের বৃদ্ধকে নামিয়ে হুইল চেয়ারে তিহার জেলের ভেতর নিয়ে যাওয়া হলো। ওই বৃদ্ধকে দেখে কে বলবে, তিনি ১০ দিন আগেও তামিলনাড়ূর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার নাম করুণানিধি। পাঁচবার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ষষ্ঠবারে তার দল হেরে গেল। তিনি এখন রাজ্যহারা। তার পরিবারই ছিল তার দল। ছেলেমেয়ে, জামাই, আত্মীয়-বন্ধু_ এরাই তার রাজত্বের পাত্রমিত্র অমাত্য। রাজ্যপাট হারানোর দুঃখ হয়তো গায়ে লাগত না। কারণ তিনি জানেন, রাজনীতি হলো পতন-অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা। তিনি জানেন, ছেলেমেয়ে বা জামাই আবার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু তার দুঃখ হলো, তার শেষ বয়সের আদরের মেয়ে কানিমোঝি দুর্নীতির দায়ে তিহার জেলে বিচারাধীন বন্দি।
তিহার জেল কর্তৃপক্ষ এই ভিভিআইপি দর্শনার্থীকে ২০ মিনিট সময় দিয়েছে মেয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। এই ২০ মিনিট করুণানিধির জীবনে বোধহয় সবচেয়ে ভাবাবেগময় মুহূর্ত। তিনি তিহার জেল থেকে সোনিয়া গান্ধীর কাছে ছুটেছেন, যদি তারা তার কন্যার প্রতি সদয় হন। তিহার জেলেই রয়েছেন সাবেক টেলিকমমন্ত্রী এ রাজা। টু-জি স্ক্যান নামে পরিচিত এক বিরাট দুর্নীতির মামলায় হাবুডুবু খাচ্ছেন তামিলনাড়ূ ডিএমকে দলের মন্ত্রী এ রাজা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। রাজার মন্ত্রীর পদটি গেছে। এখন তিনি বিচারাধীন বন্দি। রাজা করুণানিধির আত্মীয় নন। কিন্তু কানিমোঝি করুণানিধির আত্মজা। সুশ্রী, শিক্ষিতা, পরিচিত তামিল কবি। অনেক সাধ করে তাকে রাজ্যসভার সদস্য করে দিয়েছেন করুণানিধি। টু-জি স্ক্যান নিয়ে দেশজুড়ে এত হইচই হলো যে, তার ঝাপটায় করুণানিধির সরকারই হেরে গেল এবারের নির্বাচনে।
পরিবারতন্ত্রে বিশ্বাসী করুণানিধির তিন স্ত্রী। ছোট স্ত্রীর মেয়ে কানিমোঝি। তিনি এমপি। তার ছেলেদের মধ্যে এমকে আজহাগিরি কেন্দ্রীয় সারমন্ত্রী। আর এক ছেলে এমকে স্ট্যালিন ছিলেন উপমুখ্যমন্ত্রী_ বাবার সব কাজই তিনি দেখতেন। তার এক মেয়ে সেলভিও এমপি।
করুণানিধির পরিবারের সবাই নানা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাদের পরিবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক। দুর্নীতি তামিল রাজনীতির এখন একটা সংস্কৃতি। এআইডিএমকের নেত্রী জয়ললিতা এবার করুণানিধির ডিএমকে দলকে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। এক পক্ষের দুর্নীতির অভিযোগ যখন চরমে ওঠে, তখন সেখানকার ভোটাররা ধ্যাত্তেরি বলে অন্য পক্ষকে ভোট দেয়। তামিলনাড়ূর ডিএমকে দলের সঙ্গে আবার কেন্দ্রের গাঁটছড়া বাঁধা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের লোকসভার একক মেজরিটি নেই। তাই তৃণমূল আর ডিএমকে দলের সমর্থনের ওপর ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার টিকে আছে। শরিকদের হাতে রাখতে তাদের সঙ্গে অনেক সমঝোতা করতে হয়েছে। যেমন তৃণমূলকে রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতর ছেড়ে দিতে হয়েছে। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেলেন, তবু রেল ছাড়লেন না তিনি। তার বিশ্বস্ত জাহাজ দফতরের প্রতিমন্ত্রী মুকুল রায়কে এখন রেলের প্রতিমন্ত্রীর অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছেন। তবে মমতা কদাচ রেলমন্ত্রকে বসতেন। কিন্তু সোনিয়া চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে সিপিএম শাসন হটানোর এবারই প্রকৃষ্ট সময়। তাই মমতাকে তারা আর্থিক মদদ দিয়ে সাহায্য করেছেন। মমতা যে এবার হেলিকপ্টারে করে নির্বাচন প্রচার করলেন, সেই হেলিকপ্টারের টাকা জুগিয়েছে ভারতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটি।
আর ডিএমকে? এখানে কংগ্রেসের সাপের ছুঁচো গলার মতো অবস্থা। তামিলনাড়ূতে কংগ্রেস খুব দুর্বল। তখন ছিল করুণানিধির খুব রমরমা অবস্থা। সেই করুণানিধির যে এমন হবে তা কে জানত। বছরখানেক আগে ডিএমকে মন্ত্রী এ রাজার ব্যাপক দুর্নীতি ধরা পড়ল। তিনি টেলিকমমন্ত্রী হিসেবে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টন করেছেন। লোকসভায় বিরোধী সদস্যরা এ নিয়ে হইচই শুরু করলেন। সরকার বাধ্য হলো সিবিআইকে তদন্তের ভার দিতে। অতঃপর রাজার পদত্যাগ। গ্রেপ্তার ও তিহার জেল। কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ল। অবশেষে ডিএমকের আরও কিছু রাঘববোয়াল ধরা পড়ল। কংগ্রেস ভেবেছিল, করুণানিধির তামিলনাড়ূতে এত প্রতিপত্তি যে, দুর্নীতির প্রশ্নটাকে ভোটাররা আমল দেবেন না। কিন্তু হিসাবটা ভুল হয়ে গেল।
এবার কানিমোঝির কথা বলতে গেলে করুণানিধির পারিবারিক জীবনের কথা একটু বলতে হয়। করুণানিধির তিন সংসার। প্রথম পত্নীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। ২ নম্বর বউ দয়ালু আম্মাল ও ৩ নম্বর বউ রাজাথি আম্মালের সঙ্গে তিনি থাকেন। রাজাথি একজন চিত্রাভিনেত্রী ছিলেন। তারই মেয়ে কানিমোঝি। করুণানিধির প্রথম পক্ষের দুই ছেলে এ কে আলগিরি, এমকে মারান আর মেয়ে সেলভি। করুণানিধির এক ভাইয়ের নাতি দয়ানিধি মারান ও ভাইপো মুরাসোলি মারান (দয়ানিধির বাবা)। এই নিয়ে করুণানিধির পরিবারের গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স। তারাই সরকার চালাতেন। তারাই ডিএমকে চালান। এ তালিকায় এতদিন কানিমোঝির নাম ছিল না। কারণ করুণানিধি এতদিন মেয়েকে রাজনীতি থেকে আগলে রেখেছিলেন। বড় পয়মন্ত তার এই কনিষ্ঠতম সন্তান। তিনি যেবার জন্মান সেবারই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তামিলনাড়ূর মসনদে জেঁকে বসেছিলেন করুণানিধি। কিন্তু ওই যে কথায় আছে নিয়তিকে কে রুখতে পারে?
করুণানিধির এই বিশাল পরিবার কিন্তু সুখী পরিবার নয়। করুণানিধিকে বৃদ্ধ শাজাহান ভেবে ছেলে আর বউরা নিয়ত প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
করুণানিধির ভাইয়ের দুই নাতি মারান ব্রাদার্স বলে পরিচিত। তারা একটি বহুল প্রচারিত তামিল দৈনিকের (দিনাকরণ) মালিক। মারানদের সঙ্গে করুণানিধির পরিবারে সদ্ভাব নেই। গত ২০০৭ সালের মে মাসে দিনাকরণে একটি বিতর্কিত সমীক্ষা বেরোয় করুণানিধির পর কে? এই লেখা পড়ে করুণানিধির সমর্থকরা এমন ক্ষেপে যায় যে, তারা দিনাকরণের অফিসে চড়াও হয়ে ভাংচুর চালায়। বাধা দিতে গেলে অফিসের তিনজন স্টাফকে দুর্বৃত্তরা মেরে ফেলে। দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি আবার ব্যক্তিভিত্তিক। সেখানে একেকজন নেতার অনুগামীরা এত ফ্যানাটিক যে, নেতার জন্য অনুগামীরা গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি দেয়।
বৃদ্ধ করুণানিধি দেখেন, তার দুই ছেলের মধ্যে সদ্ভাব নেই। তিনি চোখ বুজলে কী হবে! অন্যদিকে মারান যখন তার কাগজে করুণানিধির বিরুদ্ধেই লেখা ছাপতে শুরু করেন, তখন করুণানিধি ভাবলেন তার এখন একমাত্র বিশ্বস্ত আদরের মেয়েকেই তিনি উত্তরাধিকারী করে যাবেন। মেয়ে যোগ্যতায় কারও চেয়ে কম যায় না। অর্থনীতিতে এমএ। খুব ভালো মেয়ে। করুণানিধিও তামিল লেখক। তিনি বলেন, মেয়ে আমার গুণ পেয়েছে। মেয়ে বড় লেখিকা হবে_ এটাই তিনি চেয়েছিলেন। মেয়ে খবরের কাগজের সাব-এডিটর হিসেবে জীবন শুরু করেছিল। সিঙ্গাপুর থেকে একটি তামিল দৈনিক বের হয়। করুণাতনয়া কানি তার ফিচার এডিটর হয়েছিল। ২০০৭-এর পর কানি বলল, বাবা আমাদের একটা টিভি চ্যানেল খোলা দরকার। মারানরা দিনাকরণে যা-তা লেখে। তাছাড়া জয়ললিতার সান টিভি তো আমাদের শত্রু। আমাদের নিজস্ব চ্যানেল নেই। আমি সাংবাদিকতা করি। টিভিটা আমি ভালো বুঝি। ওটা আমিই দেখব। করুণানিধির কাছে এটা উত্তম প্রস্তাব বলে মনে হয়েছিল। মেয়েকেই তিনি উত্তরাধিকারী করে যাবেন_ এমন বাসনা হয়েছিল। তার আগে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য দিলি্লতে এমপি করে পাঠিয়েছিলেন তাকে। অন্য একটা উদ্দেশ্যও ছিল। মারান সেখানে ডিএমকে মন্ত্রী। তার ওপর নজর রাখার জন্য বিশ্বস্ত এমন কাউকে চাই।
ওই টিভির মালিক হওয়াটাই কাল হয়ে গেল করুণানিধির কবি-সাংবাদিক এবং সবসময় বই মুখে করে থাকা মেয়ের কাছে। কানি সবদিক থেকে সৎ ভাইদের চেয়ে আলাদা। প্রথম বিয়েটা ভেঙে গেলে বড় দুঃখ পেয়েছিল কানি। কিন্তু সিঙ্গাপুরের তামিল লেখক অরবিন্দের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়েতে সুখীই হয়েছিল সে। করুণানিধির উদ্যোগে যে 'কালাইগনার' টিভি চ্যানেল তৈরি হয়েছিল তার ২০ শতাংশ শেয়ার ছিল কানির নামে। রাজাকে দ্বিতীয়বার টেলিকমমন্ত্রী করার ব্যাপারে কানি উদ্যোগ নেন। ক্রমে তিনি রাজার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। টু-জি স্পেকট্রামের লাইসেন্স কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদেরই একজন কানিমোঝির টিভি ২০০ কোটি টাকা দিয়ে তার 'শেয়ার' কিনেছিলেন_ এই লেনদেন অস্বাভাবিক ঠেকছে সিবিআইএর কাছে। আদালতের কাছেও এটা ঋণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু তার কোনো চুক্তি নেই। কালাইগনার টিভির ইকুইটি ১০ কোটি টাকা। কিন্তু ২০০৯ সালে এই কোম্পানির লেনদেন হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৪ কোটি টাকা। কোথা থেকে এলো এত টাকা? দেখা গেছে, কালাইগনার টিভি ঋণ হিসেবে নেওয়া ২০০ কোটি আর একটি কোম্পানিকে ফেরত দিয়েছে। এটাও এসেছে অঞ্জুগাম ফিল্ম থেকে। ওই ফিল্ম কোম্পানিও আবার 'কালাইগনার' টিভির সাবসিডিয়ারি।
মোট কথা, করুণানিধি পরিবার এখন গভীর জলে। তবে তারা সবাই গভীর জলের মাছ। কিন্তু আরও বড় মাছ শিকারি চেন্নাই সমুদ্রে বড় ছিপ নিয়ে বসে আছেন_ তিনি নতুন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা।
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় :ভারতীয় সাংবাদিক
No comments