সময়ের প্রতিধ্বনি-তাদের হাত কত লম্বা? by মোস্তফা কামাল

১০ এপ্রিল কালের কণ্ঠের একটি কাকতালীয় বিষয় নিশ্চয়ই পাঠকের নজরে পড়েছে। ওইদিন সম্পাদকীয় পাতায় রঙ্গব্যঙ্গ কলামে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির একটি কাল্পনিক প্রতিবেদন আমি লিখেছিলাম। ৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় সম্পাদকীয় পাতা ছাপাখানায় চলে গেছে। ঠিক তখনই খবর পেলাম, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদনটি আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি ফারুক মেহেদীর হাতে।


তিনি তখন প্রতিবেদন তৈরিতে ব্যস্ত। তার ফাঁকেই জেনে নিলাম শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়কদের নাম। মিলে গেল। কাল্পনিক প্রতিবেদনের সঙ্গে বাস্তব প্রতিবেদন এতটা মিলে যাবে ভাবতেও পারিনি।
যাহোক সরকার কিন্তু এখনো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। সরকার প্রকাশ করুক আর না করুক, কালের কণ্ঠের মাধ্যমে দেশবাসী ঠিকই জেনে গেছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত। তাঁরা সেই আলোচিত-সমালোচিত সালমান এফ রহমান, আ হ ম মোস্তফা কামাল, মোসাদ্দেক আলী ফালু, ডা. এইচ বি এম ইকবাল, নুর আলী, লুৎফর রহমান বাদল প্রমুখ। এ তালিকায় প্রায় ১০০ জন ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। তাঁরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের যক্ষের ধন লুট করেছেন। কারসাজির মাধ্যমে বাজার থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের মুখে মুখেও কিন্তু এসব নায়কের নাম শোনা গিয়েছিল। তাঁদের কাউকে কাউকে টিভিতে ডেকে নিয়ে সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছিল।
এখন সাধারণ মানুষের একটাই প্রশ্ন_শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির নায়কদের বিচার হবে তো? নাকি ১৯৯৬ সালের মতো এবারও তাঁরা পার পেয়ে যাবেন? বিচার হওয়া তো দূরের কথা, এখন তাঁরা তদন্ত প্রতিবেদনটিই বিতর্কিত করার অপতৎপরতা চালাচ্ছেন। তাঁরা ইব্রাহিম খালেদকেও বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করছেন। সরকার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে যতই দেরি করবে, ততই অপতৎপরতা বাড়তে থাকবে। সরকার কি এই অপতৎপরতায় হাওয়া দেবে, নাকি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে_সেটাই এখন দেখার বিষয়।
১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকারের সামগ্রিক ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে শেয়ার কেলেঙ্কারিও একটি কারণ বলে অনেকে মনে করেন। তখনো তদন্ত কমিটি হয়েছিল। সেই কমিটি প্রতিবেদনও দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেদনটি আর আলোর মুখ দেখেনি। তখনো সালমান রহমানের নামটি বারবার এসেছিল। কিন্তু প্রতিবেদনটি গোপন থাকায় হলফ করে কেউ বলতে পারেননি, কে জড়িত আর কে জড়িত নন। এবারও সেই একই কায়দায় শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। এবারও সেই সালমান রহমান গং।
দেশের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিরোধ থাকলেও অর্থ লুটপাটের ব্যাপারে উভয় দলের মধ্যে মধুর মিল। এবার বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে শেয়ারবাজারে ঢুকেছেন এবং হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এরা একসঙ্গে ব্যবসা করছেন। একসঙ্গে ওঠাবসা, খাওয়াদাওয়া, এমনকি আত্মীয়তাও করছেন। রাতে একই অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, একই গ্লাসে পানি পান করছেন। একই ধরনের পোশাক পরছেন। দিনের বেলায় তাঁদের কেবল পোশাক বদলায়। কেউ পরেন মুজিব কোট আর কেউ সাফারি। আর এর সঙ্গে কিছু কথাবার্তাও পাল্টায়। কোনো বিষয়ে একজন হ্যাঁ বললে আরেকজন না, একজন উত্তর বললে আরেকজন দক্ষিণ বলবেন। রাজনৈতিক মঞ্চে কথা বলার সময় বিপরীতধর্মী এসব কথা বলেন তারা। তবে তাঁরা জানেন, দুই নেত্রী কী ধরনের কথা পছন্দ করেন। ঠিক সেই কথাগুলো বলে নেত্রীদের তুষ্ট রাখেন। আর প্রয়োজন হলে মাঝেমধ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে লোক দেখানো বিষোদ্গার করেন। ব্যস, তাঁদের আর পায় কে? আমাদের আমজনতাকে তাঁরা বোকা বানিয়ে বেশ আমোদেই আছেন।
কেলেঙ্কারির প্রতিবেদন প্রকাশের পর নায়কদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ায় তাঁরা এখন নতুন কৌশলে অগ্রসর হচ্ছেন। তাঁরা তদন্ত প্রতিবেদনটি বিতর্কিত করতে নানা অপকৌশল কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। কয়েক দিন আগে তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদের একটি মন্তব্য ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে একটি ওয়েব পত্রিকা। আর সেই ভুল মন্তব্যের ওপর আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরো যুক্ত হন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ। কথায় বলে না, বাঙালি তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ! যাচাই-বাছাই না করেই একটি ভুল মন্তব্যের ওপর তাঁরা মতামত দিয়ে পুরো বিষয়কে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। অথচ তাঁরা মতামত দেওয়ার আগে একবার ইব্রাহিম খালেদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। তা না করে বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়কদের পাতা ফাঁদে পা দিলেন!
আমরা এ কথাও বলি না যে তদন্ত কমিটির প্রধানকে তাঁর প্রতিবেদন নিয়ে এখনই মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে হবে। এখনো এ বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় আসেনি। তাঁর চুপ থাকাটা বরং মঙ্গলজনক। তিনি কথা বলতে গেলে বেফাঁস কিছু বলে ফেলতে পারেন। আর কথার কথাকে আসল কথা ধরে সেটাকে তাল বানানোর প্রবণতা তো আছেই। বাংলাভিশনে তিনি কথার কথা হিসেবেই বলেছিলেন, আমাদের আইনি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সময় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। আবার আইনের ফাঁকফোকরেও তারা বেরিয়ে যায়। এ কারণে ১৯৯৬ সালের কেলেঙ্কারির নায়করা পার পেয়ে গিয়েছিল। মার্শাল লর সময় হয়তো সেটা সম্ভব হয় না। সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। তিনি নাকি বিচার বিভাগকে অবমাননা করেছেন! তিনি কোথায় কিভাবে বিচার বিভাগকে অবমাননা করলেন তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, ইব্রাহিম খালেদ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিবেদনটিতে শেয়ার কেলেঙ্কারির নায়কদের নাম উল্লেখ করে অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এ জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাতে হয়। তা ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে ইব্রাহিম খালেদকে আমরা সৎ ও দেশপ্রেমিক মানুষ বলে জানি। তিনি ব্যাংকিং পেশায় পুরো জীবন কাটিয়েছেন। তিনি চেনেন ও জানেন কারা অসৎভাবে বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। এর পরও তিনি এবং তাঁর কমিটির আরো তিন সদস্য তদন্ত প্রতিবেদনটি তৈরি করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। অসখ্য মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনুসন্ধান করেছেন। হয়তো সামগ্রিকভাবে তদন্তের জন্য তাঁর আরো সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিংবা এখনো সময় আছে, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে সরকার ব্যাপক তদন্ত করতে পারে।
তবে এটা তো ঠিক, ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া আইনে অনেক ফাঁকফোকর রয়েছে। আবার দীর্ঘসূত্রতাও আছে। এ জন্য অনেক সময় সরকারকে দ্রুত বিচার আদালত গঠন করতে হয়। বিভিন্ন সময় তার নজির আমরা দেখেছি। আমরা জানি, শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের হাত অনেক লম্বা। তাদের শিকড় অনেক শক্ত। তার পরও বলি, তাদের হাত নিশ্চয়ই সরকারের চেয়ে লম্বা নয়। সরকার আন্তরিক হলে তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কোনো সমস্যা নয়। সরকারের হৃদ ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্যই এখন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। মানুষের মনে এ রকম একটা ধারণা জন্ম নিয়েছে যে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। তদন্ত প্রতিবেদনও কোনো দিন আলোর মুখ দেখবে না। সরকার লোক দেখানো একটি তদন্ত কমিটি করেছে। অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতের ভূমিকা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন।
আমরা বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সততার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। তিনি ব্যক্তিগত বিত্তবৈভবের প্রতি আকৃষ্ট নন। তিনি ভোগবিলাস পছন্দ করেন না। তিনি পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। এখন আর তাঁর হারাবার কিছু নেই। তিনি পিতার মতোই দেশের সাধারণ মানুষকে ভালোবাসেন। তিনিই পারবেন এসব রাঘববোয়ালকে শাস্তি দিতে। তিনি নিশ্চয়ই অপরাধীদের কাছে মাথা বিকিয়ে দেবেন না। অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবেন না। তিনি অর্থমন্ত্রীর ভাষায়ও কথা বলবেন না। তিনি সাহসের সঙ্গে দুষ্টচক্রকে মোকাবিলা করবেন। তিনি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন। প্রয়োজনে আরো ব্যাপক তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবেন। আইনের ফাঁক গলে যাতে তারা বের হতে না পারে সে জন্য বিশেষ আদালত গঠন করতে হলেও তা করা উচিত বলে মনে করি।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.