কালের পুরাণ-নেতা-নেত্রীগণ, দয়া করে আমাদের মুক্তি দিন by সোহরাব হাসান

‘এই অবস্থা চলবে আর কত কাল? আমাদের মুক্তি দিন।’ উক্তিটি যদু-মধু, রাম-রহিমের নয়। খোদ মহামান্য হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারক নজরুল ইসলাম চৌধুরী সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদকে উদ্দেশ করে এ কথা বলেছেন। মঙ্গলবার ছিল বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের জামিনের আবেদনের শুনানি।

আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন মওদুদ আহমদ। আগের দিন শুনানিকালে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছিলেন, পুলিশ জয়নুল আবদিন ফারুককে জামিনের শুনানিতে হাজির হতে বাধা দিয়েছে। জবাবে আদালত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে পরদিন (মঙ্গলবার) তাঁকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন।
মঙ্গলবার জয়নুল আবদিন ফারুককে অ্যাম্বুলেন্সে করে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে স্ট্রেচারে করে এজলাসে। চোর-ডাকাত নন, একজন নির্বাচিত সাংসদের জামিন নিয়ে এ ধরনের নির্দয় আচরণ বাংলাদেশের পুলিশের পক্ষেই সম্ভব; সম্ভব রাস্তায় পিটিয়ে তাঁকে গুরুতর আহত করা। আবার আমাদের মান্যবর জনপ্রতিনিধিদেরও পুলিশকে তুই-তোকারি করতে আটকায় না। রুচি ও সংস্কৃতি কত নিচে নেমে গেছে!
মার খেয়ে জয়নুল আবদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকলেও পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দিতে কার্পণ্য করেনি। এতে কি পুলিশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে? আবার বিএনপির নেতারা পুলিশের বিরুদ্ধে একেবারে হত্যাচেষ্টার মামলা করে বসলেন! পুলিশ জয়নুল আবদিন ফারুককে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে, তাঁর গায়ের টি-শার্ট খুলে নিয়েছে, এ কথা সত্য। কিন্তু তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশ্যেই যে এসব করা হয়েছে, তা তাঁরা প্রমাণ করতে পারবেন কি? মানুষকে বিশ্বাস করানোর জন্য প্রমাণযোগ্য মামলাই করা উচিত। না হলে পুলিশ ও জনপ্রতিনিধি এক কাতারে চলে আসেন। উভয়কেই মিথ্যাচারের জন্য দায়ী হতে হয়।
মঙ্গলবার জয়নুল আবদিন ফারুকের জামিনের শুনানিকালে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী আসামিপক্ষের আইনজীবী মওদুদ আহমদকে উদ্দেশ করে আরও বলেন, ‘আপনারা এখন সাফারার (ভুগছেন)। যখন আপনারা ক্ষমতায় ছিলেন, তখন ওনারা (সরকারি দল) সাফার করেছেন। আবার আপনারা ক্ষমতায় গেলে ওনারা সাফার করবেন। আমরা এটাই দেখে আসছি। এ অবস্থা আমরা আর দেখতে চাই না।’ (ইত্তেফাক, ১৩ জুলাই ২০১১)
আরেকটি পত্রিকায় দেখলাম, এই অবস্থায় আদালত দুজনকে (বর্তমান আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ও সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ) একসঙ্গে বসে সমস্যার সমাধান করতে বলেছেন। প্রস্তাবটি উত্তম। আওয়ামী লীগ ছাড়া সব সরকারের মন্ত্রী মওদুদ আহমদ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী শফিক আহমেদ বসলে একটি সমাধান বেরিয়েও আসতে পারে। দুজনই বিলেতি ডিগ্রিপ্রাপ্ত। তাঁদের দুজনের প্রতি দুই শীর্ষ নেত্রী আস্থাশীল বলেই আমরা ধারণা করি।
আদালতে বিচারকের বক্তব্যের জবাবে মওদুদ আহমদ যা বলেছেন, তাতে তিনি তাঁর সরকারের দোষ অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, তাঁদের আমলে অ্যানালগ মার হতো, এখন ডিজিটাল মার হচ্ছে। মওদুদ আহমদের এই উপলব্ধি ক্ষমতায় থাকতে হলে সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনী পাস করতেন না, আর চতুর্দশ সংশোধনী পাস না হলে তাঁদের ভাষায় ‘ফখরুদ্দীন-মইনকে হয়তো ক্ষমতাও দখল করতে হতো না। বিএনপির অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সাংবিধানকে ঝাড়াই-মোছাই করে নির্বাচনে জয়ী হতে চাইছে। ক্ষমতায় থাকতে কি তারাও একই কাজ করেনি? ইয়াজউদ্দিন-এম এ আজিজ কাদের আবিষ্কার?

২.
এত দিন এই নিরীহ কলাম লিখিয়ে থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ দুই বড় দলের জাঁদরেল নেতা-নেত্রীদের কাছে নানা কায়দায়, নানা ভাষায় অনুনয়-বিনয় করে এ কথাগুলোই বলার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আপনারা রাজনীতি করুন, আপনারা দেশ চালান, আপনারা সরকারে থাকুন, আপনারা বিরোধী দলে থাকুন। কিন্তু সাধারণ মানুষকে পুলিশের লাঠিপেটা থেকে, হরতালের নামে রুটি-রুজি বন্ধ করা থেকে, গাড়ি পুড়িয়ে, ট্রাক জ্বালিয়ে মানুষ মারা থেকে রেহাই দিন। মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে রাস্তায় চলাচল করতে পারে, জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, সেই ব্যবস্থাটুকু করুন। আপনারা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিশাল ভবনটিতে বসে যত খুশি বাহাস করুন, যুক্তিতর্ক করুন। কিন্তু আন্দোলন দমন কিংবা আন্দোলন বেগবান করার নামে দেশের মানুষকে আর কষ্ট দেবেন না। রোগীর হাসপাতালে যাওয়া, অসুস্থ পিতাকে দেখতে পুত্রের বাড়ি যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করবেন না। ইটের বদলে পাটকেল ছুড়ে মারার রাজনীতি করবেন না।
দুই দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক অনাচার থেকে দেশকে, মানুষকে মুক্তি দেওয়ার কথাই বলেছেন মাননীয় আদালত। মওদুদ আহমদ এই আদালতকে কী বলবেন? সরকারের আজ্ঞাবহ? তাহলে তো তাঁরা বিরোধী দলের চিফ হুইপকে তিন মাসের জন্য জামিন দিতে পারতেন না। বিদেশে তাঁর চিকিৎসায় সরকারকে বাধা না দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারতেন না। ইতিমধ্যে জয়নুল আবদিন ফারুক উন্নত চিকিৎসার জন্য সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু বিএনপির নেতাদের গরম বক্তৃতায় উজ্জীবিত হয়ে যেসব মাঠকর্মী পিকেটিং করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, আহত হয়েছেন, তাঁদের খোঁজ কি নেতারা নিয়েছেন?
ইসলামি দলগুলোর আহ্বানে এবং বিএনপির সমর্থনে ৩০ ঘণ্টার হরতালে দেখলাম, লাঠিসোঁটাধারী রাস্তা অবরোধকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি ছুড়েছে এবং সেই গুলিতে একজন নিরীহ দোকানদার আহত হয়ে কাতরাচ্ছেন। এই দোকানদার কোনো পক্ষে ছিলেন না। তিনি সরকারের কথায় আশ্বস্ত হয়ে দোকান খুলে বসেছিলেন। এ রকম কত নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষ হরতালে আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার হিসাব কি সরকার বা বিরোধী দল রাখে? এক পক্ষ হরতাল ‘সফল’ এবং অপর পক্ষ ‘ব্যর্থ’ বলে আহ্লাদিত হয়, কিন্তু তাতে জনগণের ক্ষতি ও দুঃখ-দুর্দশা বিন্দুমাত্র কমে না। হরতাল রাজনীতিকদের ক্ষমতায় আনে, ক্ষমতা থেকে নামায় আর সাধারণ মানুষকে করে সর্বস্বান্ত।
কেবল জয়নুল আবদিন ফারুকের জামিন নয়, আরও অনেক ক্ষেত্রে আদালত উচিত কথা বলেছেন। কয়েক দিন আগে এই বিচারকই সাংসদদের জ্ঞানের বহর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যাতে ক্ষুব্ধ এক প্রতিমন্ত্রী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে তাঁর বিচারের কথাও বলেছিলেন। আদালতের রায় সরকারের বিরুদ্ধে গেলে সরকার ক্ষুব্ধ হয়। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে গেলে বিরোধী দল ক্ষুব্ধ হয়। আর পক্ষে গেলে আনন্দে ডুগডুগি বাজায়।

৩.
বিএনপির নেতারা সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের ওপর মহা খাপ্পা। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছেন, এটাই একমাত্র কারণ নয়। তিনি সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীও বাতিল করেছেন। একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে মওদুদ সাহেব বলবেন কি, পৃথিবীর কোথাও সামরিক শাসন বৈধতা পেয়েছে? সামরিক শাসকেরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছে? সামরিক শাসকেরা যদি গণতন্ত্রের চর্চা করবেন, তাহলে তো তাঁর মতো ঝানু ঝানু রাজনীতিকের প্রয়োজন হতো না। সেই সামরিক শাসকের জবরদস্তি আইন যদি বিচারপতি খায়রুল হক বাতিল করে থাকেন, তাহলে তিনি অন্যায়টা কী করেছেন? আর তিনি এ রায় তো প্রথম দিয়েছেন বিএনপির আমলে, হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালে। সরকার তাঁর সেই রায়ের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো যুক্তি খাড়া করতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই মামলার অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে যাঁদের ডাকা হয়েছিল, তাঁরাও কিন্তু কেউ একে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ প্রমাণ করতে পারেননি। তাঁরা বাস্তবতার দোহাই দিয়েছেন। বলেছেন, তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা না থাকলে দেশে আবার নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সবার মনে থাকার কথা, ২০০৭ সালে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেই ধ্বংস ও নৈরাজ্য ঠেকাতে পারেনি।
গণতন্ত্র হলো জনপ্রতিনিধিত্বকারী একটি শাসনব্যবস্থা। একে কে কীভাবে ব্যবহার করেন, তার ওপরই জনগণের কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ভর করে। জার্মানির অ্যাডল্ফ হিটলারের দল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টিও নির্বাচিত ছিল। গণতন্ত্রকে নিছক দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার করুণ পরিণাম দেশবাসী একাধিকবার প্রত্যক্ষ করেছে। সেই অভিজ্ঞতা যদি রাজনীতিকদের বোধোদয় ঘটাতে না পারে, তাহলে বুঝতে হবে, আমরা গণতন্ত্রের উপযুক্ত নই।
আমরা বুঝি না, একটি দেশের রাজনীতি আর কত দিন রাস্তায় থাকবে। এভাবে পরস্পর মারামারি-কাটাকাটি করে নিজেরা শেষ হবে, দেশকেও শেষ করবে।
এ কারণেই বিচারক নজরুল ইসলাম চৌধুরী প্রশ্ন করেছেন, ‘আর কত কাল চলবে এই অবস্থা? আমাদের মুক্তি দিন।’ বিচারক কেবল তাঁর বা বিচারালয়ের মুক্তির কথা বলেননি, বলেছেন দেশবাসীর মুক্তির কথা। গণতন্ত্রে তো মানুষের শান্তি দেওয়ার কথা, অধিকার দেওয়ার কথা। কিন্তু সেই গণতন্ত্র কেন তাদের শান্তি কেড়ে নেবে? কেন তারা প্রতিবার ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুল্লিতে পড়বে?

৪.
বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া অনেক বেশি সৌভাগ্যবান। তিন দশক ধরে তাঁরা কেবল দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন না, পালা করে গত দুই দশক দেশও চালাচ্ছেন। খালেদা জিয়া ১০ বছর প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। শেখ হাসিনাও সেই মেয়াদ পূরণ করবেন, আশা করি। এই যে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় আপনারা দেশ ও জনগণের অভিভাবকের দায়িত্বে সমাসীন, একবারও কি ভেবেছেন, দেশকে আপনারা কী দিয়েছেন? কী দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মকে? দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট ঘোচাতে কতটুকু করেছেন? এই দেওয়া শুধু আর্থিক সহায়তা দেওয়া নয়, অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, ভাষা, রুচি, সংস্কৃতিও দেওয়া। কে কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন বা আছেন, সেটি বড় কথা নয়। ক্ষমতায় থেকে, বিরোধী দলে থেকে, দলের নেতৃত্বে থেকে জনগণের জন্য কী করেছেন? শেখ হাসিনা কেন শুধুই আওয়ামী লীগের নেত্রী হবেন? খালেদা জিয়া কেন শুধুই বিএনপির নেত্রী হবেন?
আপনারা জনগণের মনের চাওয়া-পাওয়ার কথা চিন্তা করুন। তারা ক্ষমতার হিস্যা চায় না, ঠিকাদারি-ব্যবসা চায় না; চায় একটু স্বস্তি, একটু শান্তি। তারা চায় রাজনীতিতে ঘৃণার বদলে ভালোবাসার চাষ হোক। নেতা-নেত্রীরা একে অপরকে বিষবাণে ঘায়েল না করে সম্প্রীতির আহ্বান জানাক। তারা চায়, রাজনীতিকেরা পরস্পরকে সম্মান করুন। তাতে দেশবাসীও সম্মানিত হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.