শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে নথি উদ্ধার-শিক্ষক-কর্মকর্তারা নিয়মিত চাঁদা দেন শিবিরকে by শরিফুল হাসান ও মিসবাহ উদ্দিন
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জয়নাল ইসলাম চৌধুরী নভেম্বরে পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন নজরুল ইসলাম দিয়েছেন ১০ হাজার টাকা, গণিত বিভাগের প্রধান ও শিক্ষক সমিতির সদস্য সাজেদুল করিম পাঁচ হাজার টাকা এবং রেজিস্ট্রার ভবনের কর্মকর্তা নাজমুল হক দিয়েছেন দুই হাজার টাকা।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশত শিক্ষক ও কর্মকর্তার কাছ থেকে এভাবেই নিয়মিত চাঁদা আদায় করে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন শিবির। কারও কাছ থেকে প্রতি মাসে, কারও কাছ থেকে এককালীন বড় অঙ্কের চাঁদা নেয় তারা। শিক্ষক ও কর্মকর্তারা প্রায় সবাই চাঁদা দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে রসিদ দেখালে প্রথম আলোকে তাঁরা বলেছেন, কেউ কেউ স্বেচ্ছায় আর অনেকে চক্ষুলজ্জায় বা বাধ্য হয়ে শিবিরকে চাঁদা দেন। কেবল বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকেরাই নন, বর্তমানে আওয়ামী লীগ দাবিদার অনেক শিক্ষকও শিবিরকে চাঁদা দেন। শিবির এই চাঁদাবাজিকে ‘এয়ানত’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের নেতা-কর্মীদের কক্ষ থেকে উদ্ধার করা গোপন কাগজপত্র, বার্ষিক প্রতিবেদন ও চাঁদা আদায়ের রসিদ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ১১ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে অতর্কিত সংঘর্ষের পর হল ও ক্যাম্পাসছাড়া হয়ে পড়ে শিবির। পরে শাহ পরান ও বঙ্গবন্ধু হলের (শিবির এই হলের নাম ব্যবহার করে গাজী বুরহানউদ্দিন হল) শীর্ষস্থানীয় শিবির নেতাদের আলমারি ভেঙে এসব কাগজপত্র উদ্ধার করেন সাধারণ ছাত্ররা।
প্রথম আলো এসব তথ্য অনুসন্ধান করে শিবিরের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কখনোই শিবিরকে হল ত্যাগ করতে হয়নি। এবারই প্রথম হল ছাড়তে হওয়ায় তাঁরা এসব কাগজপত্র সরাতে পারেননি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. সালেহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমরাও অনেক দিন ধরে শুনে আসছি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা জানি না কীভাবে এটি বন্ধ করা হবে। কেউ যদি স্বেচ্ছায় শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন, তাহলে আমরা কী করতে পারি। তার পরও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ঘেঁটে দেখব, কিছু করা যায় কি না।’
যাঁরা চাঁদা দেন: ছাত্রশিবির তাদের ছাপানো প্যাডে চাঁদা আদায় করে। শাহ পরান হলের ১০১, ১০২, ২০১, ২০২ ও ২০৮ এবং বঙ্গবন্ধু হলের ২০১১, ৩০১১ ও ৪০১১ নম্বর কক্ষ থেকে চাঁদা আদায়ের রশিদের অসংখ্য মুড়ি পাওয়া গেছে।
এসব মুড়ি অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান কামাল আহমেদ চৌধুরী নভেম্বর মাসে ১০ হাজার টাকা রসিদে (ছাপানো রসিদ নম্বর ৩২০২) ও ৩ নভেম্বর পাঁচ হাজার টাকা, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ ফ ম জাকারিয়া (রসিদ-৩২০৩) পাঁচ হাজার, গণিত বিভাগের প্রধান সাজেদুল করিম (রসিদ-৩২০৫) পাঁচ হাজার, লোকপ্রশাসন বিভাগের আশরাফ সিদ্দিকী (রসিদ-২০১৭০) পাঁচ হাজার, অর্থনীতি বিভাগের (রসিদ ৩১৮৭৮) রফিকুল ইসলাম তিন হাজার, খাদ্য প্রকৌশল ও চা-প্রযুক্তি বিভাগের বেলাল হোসেন শিকদার তিন হাজার (রসিদ-৩১৮৭৯), জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের জাহাঙ্গীর আলম (রসিদ-৫১৬০১) দুই হাজার, সমাজকর্ম বিভাগের ঈসমাইল হোসেন (রসিদ-২০১৭৩) পাঁচ হাজার এবং একই বিভাগের আশরাফ জাহান (রসিদ ১০৭৬০১) এক হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছেন।
এ ছাড়া পুর ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আকতারুল ইসলাম চৌধুরী, একই বিভাগের সাইফুল ইসলাম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাযহারুল ইসলাম, পরিসংখ্যান বিভাগের মোহাম্মদ তাজউদ্দিন ও একই বিভাগের অধ্যাপক রহমত আলীর কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেয় শিবির।
শিক্ষক ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার নাজিমউদ্দিন, প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবদুল করিমসহ প্রশাসনের আরও অনেক কর্মকর্তার কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে শিবির। এ ছাড়া নাম উল্লেখ না করে কোড নম্বর দিয়েও টাকা নেয় তারা।
শিক্ষক ও কর্মকর্তারা যা বলছেন: শিবিরকে চাঁদা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কোনো চাঁদা দিইনি। ওরা হয়তো এমনিই লিখেছে।’ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান কামাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমার কাছে অনেক সংগঠনই তো আসে। তবে শিবিরকে কোনো টাকা দিয়েছি বলে মনে পড়ে না।’
নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ ফ ম জাকারিয়া বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সম্মেলনের কথা বলে শিবির আমার কাছে চাঁদা চাইতে এসেছিল। ওরা একটি কুপনে লিখেই নিয়ে এসেছিল যে আপনাকে টাকা দিতে হবে। আরও অনেকেই তো আসে। চক্ষুলজ্জার কারণে দিতে হয়।’
গণিত বিভাগের প্রধান সাজেদুল করিম বলেন, ‘আমি জীবনে একবারই শিবিরকে টাকা দিয়েছি। আর নভেম্বর মাসে কুপন নিয়ে আমার ছাত্ররা এসে আমার কাছে টাকা চাইলে আমি ৫০০ টাকা দিয়েছি।’
লোকপ্রশাসন বিভাগের আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি মনেপ্রাণে শিবিরকে ঘৃণা করি। টাকা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ সমাজকর্ম বিভাগের ঈসমাইল হোসেন বলেন, ‘টাকা দিলে স্বেচ্ছায়ই দিয়েছি। তবে নভেম্বর মাসে কোনো টাকা দিয়েছি বলে মনে হয় না।’ খাদ্য প্রকৌশল ও চা-প্রযুক্তি বিভাগের বেলাল হোসেন শিকদার বলেন, ‘আমি জানি না। অন্য কেউ লিখে রাখতে পারে।’ জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের আশরাফ জাহান বলেন, ‘আমার তো মনে হয় না আমি কোনো টাকা দিয়েছি।’
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জয়নাল আবদীন চৌধুরী বলেন, ‘আমার কাছে শিবির চাঁদার জন্য আসছিল। আমি ১০০ না ২০০ টাকা দিয়েছিলাম মনে নেই।’ সহকারী রেজিস্ট্রার নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘একটি অনুষ্ঠানের কথা বলে শিবির আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল। আর আমার কাছে তো সবাই আসে। সবাইকে কিছু না কিছু দেই।’
শিবিরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, মূল ক্যাম্পাস, শাহ পরান হল, বঙ্গবন্ধু হল, ‘বেলাল অঞ্চল’ (নয়াবাজার), আখালিয়া অঞ্চলসহ ক্যাম্পাসের অনেকগুলো শাখা আছে। একেকটি শাখা গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি করে। সব মিলিয়ে বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা কেবল চাঁদাবাজি করেই আয় করা হয়।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সভাপতি মুজাহিদ রুমী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক সম্পর্ক আছে, আমরা তাদের কাছ থেকে টাকা নিই। অনেকে শিবিরকে পছন্দ না করলেও আমাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে টাকা দেন।’
শুভাকাঙ্ক্ষীর তালিকা: বিভিন্ন বিপদে শিবিরকে যাঁরা সাহায্য করেন, শিবির সেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে বিভিন্ন প্রতিবেদনে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এই তালিকায় আছেন: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার সলিম মো. আবদুল কাদির, রসায়ন বিভাগের শিক্ষক শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের কর্মচারী আবদুল হামিদ, একই দপ্তরের বিল্লাল হোসেন, শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল (আইপিই) বিভাগের পিয়ন ওমর সানী, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের কর্মকর্তা সোহেলি তামান্না, রসায়ন বিভাগের ল্যাব সহকারী সিরাজুল ইসলামসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ছাড়া বিভিন্ন বিভাগের ৩৮ জন শিক্ষককে শিবির তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে উল্লেখ করেছে।
অন্য ছাত্রসংগঠন সম্পর্কে মূল্যায়ন: ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন সম্পর্কে মূল্যায়নও করেছে শিবিরের তথ্য ও প্রচার বিভাগ। এই বিভাগের কাজকে অত্যন্ত গোপনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকের মোট ১৬ জন সাংবাদিক যাঁরা শিবিরের ‘সাথী’ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ), তাঁরা এই কাজটি করেছেন।
ছাত্রলীগ সম্পর্কে মূল্যায়ন হচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের ঘটনার পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিবিরকে হটিয়ে দেওয়ার শপথ নিয়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু সিলেট আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে। ছাত্রলীগে অনেকগুলো পক্ষ আছে। তাদের মধ্যে কোন্দল বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রক্টর ফারুকউদ্দিন বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে কোন্দল বাড়িয়ে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন।
ছাত্রদল সম্পর্কে বলা হয়েছে, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্যাম্পাসে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অস্তিত্ব-সংকটে ভুগছে। তারা এখন ক্যাম্পাসেই আসছে না। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন উপলক্ষে সাংবাদিকদের কেবল প্রেস রিলিজ দেয়।
হিযবুত তাহ্রীর সম্পর্কে বলা হয়েছে, মহাজোট সরকার এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার পর অত্যন্ত গোপনে তারা ক্যাম্পাসের বদলে মেসভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ক্যাম্পাসের বাইরের ছাত্রদের নিয়ে তারা প্রতি সপ্তাহে বৈঠক করে। ভ্রমণের নামে সিলেটের দূরবর্তী জায়গায় দুটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। নামে-বেনামে তারা শহরে বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করে।
আরও যা আছে: শিবিরের এসব নথি বিশ্লেষণ করে সংগঠনটির বর্তমান-অতীত পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ আরও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। চাঁদার বাইরে সংগঠনটির অর্থের উৎস হিসেবে রেডিয়াম, রেটিনা ও নিউক্লিয়াস কোচিং সেন্টার, আল হামরা শপিং সেন্টার, হলি সিলেট সিন্ডিকেট লিমিটেডের বিভিন্ন প্রকল্প, সেল্ফ ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স ও কম্পিউটার কোর্সের কথা বলা হয়েছে।
শিবিরের এসব চাঁদা ব্যবহূত হয় সাপ্তাহিক ও মাসিক প্রশিক্ষণ, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে বিচার বিঘ্নিত করতে নানা পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ, নেতা-কর্মীদের মৃত্যুবার্ষিকী, সংগঠনের প্রচারের জন্য বিভিন্ন ধরনের স্টিকার, কার্ড-ডায়েরি তৈরি, সাহিত্য প্রকাশ, রুটিন তৈরি ও বিভিন্ন কর্মশালায়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে অঙ্গীকার সাংস্কৃতিক সংসদ, স্টুডেন্ট এইড সাস্ট ও সাস্ট ক্রিকেট ক্লাব শিবিরের নিজস্ব সংগঠন।
নথিগুলো ঘেঁটে দেখা গেছে, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের তিন শতাধিক সাথি আছে। আর কর্মী ও সমর্থকের সংখ্যা এর তিন গুণ। এ ছাড়া সিলেটের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও আছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের তালিকায়। এমনকি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর অনেক শিক্ষার্থীর কথাও বলা আছে।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের নেতা-কর্মীদের কক্ষ থেকে উদ্ধার করা গোপন কাগজপত্র, বার্ষিক প্রতিবেদন ও চাঁদা আদায়ের রসিদ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ১১ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে অতর্কিত সংঘর্ষের পর হল ও ক্যাম্পাসছাড়া হয়ে পড়ে শিবির। পরে শাহ পরান ও বঙ্গবন্ধু হলের (শিবির এই হলের নাম ব্যবহার করে গাজী বুরহানউদ্দিন হল) শীর্ষস্থানীয় শিবির নেতাদের আলমারি ভেঙে এসব কাগজপত্র উদ্ধার করেন সাধারণ ছাত্ররা।
প্রথম আলো এসব তথ্য অনুসন্ধান করে শিবিরের কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেয়েছে। দীর্ঘ ২০ বছরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কখনোই শিবিরকে হল ত্যাগ করতে হয়নি। এবারই প্রথম হল ছাড়তে হওয়ায় তাঁরা এসব কাগজপত্র সরাতে পারেননি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. সালেহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমরাও অনেক দিন ধরে শুনে আসছি। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা জানি না কীভাবে এটি বন্ধ করা হবে। কেউ যদি স্বেচ্ছায় শিবিরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন, তাহলে আমরা কী করতে পারি। তার পরও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ঘেঁটে দেখব, কিছু করা যায় কি না।’
যাঁরা চাঁদা দেন: ছাত্রশিবির তাদের ছাপানো প্যাডে চাঁদা আদায় করে। শাহ পরান হলের ১০১, ১০২, ২০১, ২০২ ও ২০৮ এবং বঙ্গবন্ধু হলের ২০১১, ৩০১১ ও ৪০১১ নম্বর কক্ষ থেকে চাঁদা আদায়ের রশিদের অসংখ্য মুড়ি পাওয়া গেছে।
এসব মুড়ি অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান কামাল আহমেদ চৌধুরী নভেম্বর মাসে ১০ হাজার টাকা রসিদে (ছাপানো রসিদ নম্বর ৩২০২) ও ৩ নভেম্বর পাঁচ হাজার টাকা, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ ফ ম জাকারিয়া (রসিদ-৩২০৩) পাঁচ হাজার, গণিত বিভাগের প্রধান সাজেদুল করিম (রসিদ-৩২০৫) পাঁচ হাজার, লোকপ্রশাসন বিভাগের আশরাফ সিদ্দিকী (রসিদ-২০১৭০) পাঁচ হাজার, অর্থনীতি বিভাগের (রসিদ ৩১৮৭৮) রফিকুল ইসলাম তিন হাজার, খাদ্য প্রকৌশল ও চা-প্রযুক্তি বিভাগের বেলাল হোসেন শিকদার তিন হাজার (রসিদ-৩১৮৭৯), জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের জাহাঙ্গীর আলম (রসিদ-৫১৬০১) দুই হাজার, সমাজকর্ম বিভাগের ঈসমাইল হোসেন (রসিদ-২০১৭৩) পাঁচ হাজার এবং একই বিভাগের আশরাফ জাহান (রসিদ ১০৭৬০১) এক হাজার টাকা চাঁদা দিয়েছেন।
এ ছাড়া পুর ও পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আকতারুল ইসলাম চৌধুরী, একই বিভাগের সাইফুল ইসলাম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাযহারুল ইসলাম, পরিসংখ্যান বিভাগের মোহাম্মদ তাজউদ্দিন ও একই বিভাগের অধ্যাপক রহমত আলীর কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নেয় শিবির।
শিক্ষক ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার নাজিমউদ্দিন, প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবদুল করিমসহ প্রশাসনের আরও অনেক কর্মকর্তার কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে শিবির। এ ছাড়া নাম উল্লেখ না করে কোড নম্বর দিয়েও টাকা নেয় তারা।
শিক্ষক ও কর্মকর্তারা যা বলছেন: শিবিরকে চাঁদা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কোনো চাঁদা দিইনি। ওরা হয়তো এমনিই লিখেছে।’ সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান কামাল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমার কাছে অনেক সংগঠনই তো আসে। তবে শিবিরকে কোনো টাকা দিয়েছি বলে মনে পড়ে না।’
নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ ফ ম জাকারিয়া বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সম্মেলনের কথা বলে শিবির আমার কাছে চাঁদা চাইতে এসেছিল। ওরা একটি কুপনে লিখেই নিয়ে এসেছিল যে আপনাকে টাকা দিতে হবে। আরও অনেকেই তো আসে। চক্ষুলজ্জার কারণে দিতে হয়।’
গণিত বিভাগের প্রধান সাজেদুল করিম বলেন, ‘আমি জীবনে একবারই শিবিরকে টাকা দিয়েছি। আর নভেম্বর মাসে কুপন নিয়ে আমার ছাত্ররা এসে আমার কাছে টাকা চাইলে আমি ৫০০ টাকা দিয়েছি।’
লোকপ্রশাসন বিভাগের আশরাফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি মনেপ্রাণে শিবিরকে ঘৃণা করি। টাকা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ সমাজকর্ম বিভাগের ঈসমাইল হোসেন বলেন, ‘টাকা দিলে স্বেচ্ছায়ই দিয়েছি। তবে নভেম্বর মাসে কোনো টাকা দিয়েছি বলে মনে হয় না।’ খাদ্য প্রকৌশল ও চা-প্রযুক্তি বিভাগের বেলাল হোসেন শিকদার বলেন, ‘আমি জানি না। অন্য কেউ লিখে রাখতে পারে।’ জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগের আশরাফ জাহান বলেন, ‘আমার তো মনে হয় না আমি কোনো টাকা দিয়েছি।’
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জয়নাল আবদীন চৌধুরী বলেন, ‘আমার কাছে শিবির চাঁদার জন্য আসছিল। আমি ১০০ না ২০০ টাকা দিয়েছিলাম মনে নেই।’ সহকারী রেজিস্ট্রার নাজিমউদ্দিন বলেন, ‘একটি অনুষ্ঠানের কথা বলে শিবির আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল। আর আমার কাছে তো সবাই আসে। সবাইকে কিছু না কিছু দেই।’
শিবিরের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, মূল ক্যাম্পাস, শাহ পরান হল, বঙ্গবন্ধু হল, ‘বেলাল অঞ্চল’ (নয়াবাজার), আখালিয়া অঞ্চলসহ ক্যাম্পাসের অনেকগুলো শাখা আছে। একেকটি শাখা গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি করে। সব মিলিয়ে বছরে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা কেবল চাঁদাবাজি করেই আয় করা হয়।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সভাপতি মুজাহিদ রুমী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক সম্পর্ক আছে, আমরা তাদের কাছ থেকে টাকা নিই। অনেকে শিবিরকে পছন্দ না করলেও আমাদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে টাকা দেন।’
শুভাকাঙ্ক্ষীর তালিকা: বিভিন্ন বিপদে শিবিরকে যাঁরা সাহায্য করেন, শিবির সেসব শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে বিভিন্ন প্রতিবেদনে শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এই তালিকায় আছেন: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার সলিম মো. আবদুল কাদির, রসায়ন বিভাগের শিক্ষক শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের কর্মচারী আবদুল হামিদ, একই দপ্তরের বিল্লাল হোসেন, শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল (আইপিই) বিভাগের পিয়ন ওমর সানী, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের কর্মকর্তা সোহেলি তামান্না, রসায়ন বিভাগের ল্যাব সহকারী সিরাজুল ইসলামসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ছাড়া বিভিন্ন বিভাগের ৩৮ জন শিক্ষককে শিবির তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষী বলে উল্লেখ করেছে।
অন্য ছাত্রসংগঠন সম্পর্কে মূল্যায়ন: ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন সম্পর্কে মূল্যায়নও করেছে শিবিরের তথ্য ও প্রচার বিভাগ। এই বিভাগের কাজকে অত্যন্ত গোপনীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকের মোট ১৬ জন সাংবাদিক যাঁরা শিবিরের ‘সাথী’ (দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ), তাঁরা এই কাজটি করেছেন।
ছাত্রলীগ সম্পর্কে মূল্যায়ন হচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের ঘটনার পর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শিবিরকে হটিয়ে দেওয়ার শপথ নিয়েছিল ছাত্রলীগ। কিন্তু সিলেট আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের কাছ থেকে সাড়া না পাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে। ছাত্রলীগে অনেকগুলো পক্ষ আছে। তাদের মধ্যে কোন্দল বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী প্রক্টর ফারুকউদ্দিন বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে কোন্দল বাড়িয়ে ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন।
ছাত্রদল সম্পর্কে বলা হয়েছে, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্যাম্পাসে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল অস্তিত্ব-সংকটে ভুগছে। তারা এখন ক্যাম্পাসেই আসছে না। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন উপলক্ষে সাংবাদিকদের কেবল প্রেস রিলিজ দেয়।
হিযবুত তাহ্রীর সম্পর্কে বলা হয়েছে, মহাজোট সরকার এই সংগঠনটি নিষিদ্ধ করার পর অত্যন্ত গোপনে তারা ক্যাম্পাসের বদলে মেসভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ক্যাম্পাসের বাইরের ছাত্রদের নিয়ে তারা প্রতি সপ্তাহে বৈঠক করে। ভ্রমণের নামে সিলেটের দূরবর্তী জায়গায় দুটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। নামে-বেনামে তারা শহরে বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করে।
আরও যা আছে: শিবিরের এসব নথি বিশ্লেষণ করে সংগঠনটির বর্তমান-অতীত পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ আরও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। চাঁদার বাইরে সংগঠনটির অর্থের উৎস হিসেবে রেডিয়াম, রেটিনা ও নিউক্লিয়াস কোচিং সেন্টার, আল হামরা শপিং সেন্টার, হলি সিলেট সিন্ডিকেট লিমিটেডের বিভিন্ন প্রকল্প, সেল্ফ ডেভেলপমেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স ও কম্পিউটার কোর্সের কথা বলা হয়েছে।
শিবিরের এসব চাঁদা ব্যবহূত হয় সাপ্তাহিক ও মাসিক প্রশিক্ষণ, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে বিচার বিঘ্নিত করতে নানা পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ, নেতা-কর্মীদের মৃত্যুবার্ষিকী, সংগঠনের প্রচারের জন্য বিভিন্ন ধরনের স্টিকার, কার্ড-ডায়েরি তৈরি, সাহিত্য প্রকাশ, রুটিন তৈরি ও বিভিন্ন কর্মশালায়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্যাম্পাসে অঙ্গীকার সাংস্কৃতিক সংসদ, স্টুডেন্ট এইড সাস্ট ও সাস্ট ক্রিকেট ক্লাব শিবিরের নিজস্ব সংগঠন।
নথিগুলো ঘেঁটে দেখা গেছে, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের তিন শতাধিক সাথি আছে। আর কর্মী ও সমর্থকের সংখ্যা এর তিন গুণ। এ ছাড়া সিলেটের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরাও আছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের তালিকায়। এমনকি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর অনেক শিক্ষার্থীর কথাও বলা আছে।
No comments