রাজনীতি ও এনজিও-সাময়িক প্রসঙ্গ by ইশা মোহাম্মদ

বিরোধী দল তুমুল আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে আর একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে এনজিওওয়ালাদের অপতৎপরতা। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিদেশেও তারা অপতৎপরতায় লিপ্ত। অবশ্য বিদেশের মাটিতে তাদের অপতৎপরতার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। অনেক দিন আগে থেকেই তারা নিজেদের পিঠের ছাল বাঁচাতে বিদেশ বিভুঁইয়ে 'প্রভুসন্ধান' করছে।


নিত্যদিন যাদের তেল-সিঁদুর দিয়ে পূজা-অর্চনা করেছে, সেসব প্রভু কি বিপদের সময় ত্রাতার ভূমিকায় নামবে না? তাদের সঙ্গে দেখা করা, পদতলে আভূমি নত হয়ে 'বর' প্রার্থনায় রত এনজিওয়ালারা এবার কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি করেছে। আমেরিকাতেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মান ভূলুণ্ঠিত করে শেখ হাসিনার বিশেষ সভার অনতিদূরে তারা নিন্দাসভার আয়োজন করেছে। সেখানে অনেক কথার সঙ্গে 'বাংলাদেশ সরকারকে' অঙ্গুলিসংকেতও করা হয়েছে, যা চূড়ান্ত বিচারে এক ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কিন্তু তাদের এ অসদাচরণকে বাংলাদেশের কর্ণধাররা অসদাচরণ হিসেবে দেখছেন না। কেন নয়, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভয় পাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অন্তত ওই কারণে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মার্কিন স্বার্থ বাংলাদেশে এখন অন্য খাতে প্রবাহিত হচ্ছে। নিছক এনজিওওয়ালাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ দেখার জন্য তারা বৃহৎ স্বার্থ জলাঞ্জলি দেবে না। তাই রাষ্ট্র পক্ষের এনজিওওয়ালাদের ভয় করারও প্রয়োজন নেই মার্কিন ঘনিষ্ঠতার কারণে। কিন্তু এটি কর্ণধাররা বুঝতে পারছেন বিধায় ভয় পেয়ে চুপসে গিয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন না। এ ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব খুবই নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। যেমন বিরোধী দলের লাগাতার আন্দোলন ও সমাবেশকে তারা গোপন পথে মদদ দিতে পারে।
সম্প্রতি ফাঁসকৃত উইকিলিকসের তথ্য অনেক কথাই সাধারণ মানুষকে জানিয়েছে। এসব তথ্যের মধ্যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতার খবরাখবরও আছে। যেমন কোনো কোনো আমলা (সামরিক কিংবা বেসামরিক) রাজনীতিতে অবৈধভাবে নাক গলিয়েছিল তাও এখন জানা হয়ে গেছে। কোনো কোনো পতিত রাজনীতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে দেশছাড়া করতে চেয়েছিল সে খবরও জানা গেছে। কোনো কোনো এনজিওওয়ালা দুই নেত্রীকে বিদায় করে দিয়ে নিজেরাই দেশের হর্তাকর্তা-বিধাতা হতে চেয়েছিলেন, তাও এখন ফাঁস হয়ে গেছে। বাংলাদেশের পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক। তারা মৌলবাদীর সঙ্গে এনজিওওয়ালাদের সম্পর্ক বিষয়ে একেবারেই নীরব। কেন? পুলিশের পক্ষেই সম্ভব তাদের গোপন এবং প্রকাশ্য সম্পর্ক জনগণকে জানানো; কিন্তু তারা কোনো এক বিশেষ কারণে চুপ মেরে আছে।
বাংলাদেশের জাতশত্রুরা দেশে অরাজক পরিস্থিতিই চায়। সাম্রাজ্যবাদী এবং সম্প্রসারণবাদীরা অরাজক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশে শোষণ-নিষ্পেষণ চালাতে চায়। বহুদিন ধরে মার্কিনিরা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে নজর দিচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের দিকেও কালো চোখে চেয়ে আছে। একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিবেশী ভারতেরও। তারাও বাংলাদেশকে নিজেদের কব্জায় নিতে চায়।
এনজিওওয়ালাদের ব্যাপারে সরকারের ভীতসন্ত্রস্ত ভাব যায় না। বহুদিন ধরে এনজিও ব্যাংকিং কার্যক্রম নিয়ে নানা কিসিমের কথাবার্তা বাজারে চলছে। বিশেষ কোনো অজ্ঞাত কারণে এদের ব্যাংকিং কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করা হচ্ছে না। কয়েকদিন আগে পত্রিকায় খবর হয়ে এসেছে যে, টাঙ্গাইলের কয়েকটি এনজিও ব্যাংকিং কার্যক্রমের লোকজন কোটি কোটি টাকা লোপাট করে ভেগেছে। খবরটা এবারই প্রথম নয়? অন্তত হাজারবার হাজার দিন অজস্র পত্রিকাতেই এ রকম খবর বেরিয়েছে। কিন্তু তারপরও কর্তাব্যক্তিদের নজরে কিছুই পড়েনি। হাইকোর্ট মাঝে মধ্যেই বিশেষ নজরকাড়া খবরে কান দেন এবং আদালত মাত্রিক ব্যবস্থা নেন। এনজিও ব্যাংকিংয়ের নামে প্রতারণার ব্যাপারে আজ পর্যন্ত তারাও কোনো আদালতিক ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ অজ্ঞাত। এমন পরিস্থিতিতে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। রাস্তাঘাটে যাকে যেখানে পাবে তাকে সেখানেই পেটাতে হবে। একই সঙ্গে কোনো এনজিও ব্যাংকিং কার্যক্রমের শোষণ, নির্যাতন এবং প্রতারণার জন্য সরকারকেই পেটাতে হবে। সরকার পিটুনি না খেলে এনজিওওয়ালাদের সরকার নিজে থেকে কোনো শিক্ষা দেবে না। তার নমুনাও দেখা গেছে। কয়েকদিন আগে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার একজন বিশিষ্ট রাখাল চালক বলেছেন, বিশিষ্ট কোনো এক এনজিওওয়ালাকে নাকি রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। দুর্নীতির সরকারি অনুসন্ধান ব্যবস্থাকে তিনি কী করে রাজনৈতিক হয়রানি বললেন? তিনি কি প্রকারান্তরে শেখ হাসিনাকেই তার তির্যক নয়নে বার্তা পাঠালেন না? এত সাহস তার হয় কী করে। সরকার তাকে নিয়ে আহ্লাদ করতেই পারে। কিন্তু জনগণ এনজিওওয়ালার ব্যাপারে সরকারি পদক্ষেপ সমর্থন করেছে। তাই যদি কোনো আমলা জাতীয় লোকজন সরকারকে ওই ব্যাপারে সমালোচনা করে তবে সরকারের উচিত হবে, জনসমর্থন ধরে রাখার জন্য ওইসব এনজিওয়ালার শাস্তি আরও কঠোর করা। যাতে সরকারের ন্যায়ানুগ পদক্ষেপ সম্পর্কে জনগণ ভালোভাবে জানতে পারে, বুঝতে পারে এবং একই সঙ্গে সরকারকে যে সমর্থন দিচ্ছে, তা অব্যাহত রাখতে পারে।
আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। একই সঙ্গে বিদেশের মাটিতে দেশবৈরী কর্মকাণ্ডকে তাচ্ছিল্যভরে দেখার সুযোগ নেই। সরকারে উচিত হবে, এক এক করে ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটন করা। মৌলবাদীর সঙ্গে এনজিও সম্পর্কে ছিন্ন করা। যারা দেশবৈরী কর্মকাণ্ড করছে, অবৈধ ব্যাংকিং করছে, চড়া সুদে ঋণের ব্যবসা করছে তাদের আইনের আওতায় আনা এবং এনজিও ব্যাংকিং চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া। সব অবৈধ এনজিওর অর্থ-সম্পদ এবং মৌলবাদীদের অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং মৌলবাদী সংশ্লিষ্ট জমায়েতে এনজিও কর্মী ও কর্মকর্তার উপস্থিতি এবং আস্ফালন পুলিশি তদন্তে নিয়ে আসা। আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা।
সবচেয়ে ভালো হয়, যে জন্য মৌলবাদীরা এতসব করছে, সেই যুদ্ধাপরাধীদের মাথা-মোথা গোছের কয়েকজনকে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে ভাইটাল পানিশমেন্ট দেওয়া এদের যথোপযুক্ত শাস্তি দিলে এবং দেশের লোকজন তা স্বচক্ষে দেখলেই কেবল সমাজে যতটুকু সমর্থন আছে মৌলবাদী ও জামায়াতিদের তা চিরতরে গায়েব হয়ে যাবে। যেসব এনজিও অর্থায়ন করছে তারাও খামোশ হয়ে যাবে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। সময় পেকেছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও শাস্তির এখনই সঠিক সময়। বিরোধী দল ও মৌলবাদীরা বড় ধরনের আন্দোলনে যাওয়ার আগেই বিচারের রায় কার্যকর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে বিদেশে যে অর্থ পাচার করা হয়েছে, তা যে কর্মেই হোক ফিরিয়ে আনতে হবে। তা সে বিল ক্লিনটনই হোক কিংবা হিলারি ক্লিনটন। বিদেশের নাবিকদের যে টাকা দেওয়া হয়েছে, গোপনে সেগুলোও দাবি করতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলে 'তোলপাড়' সৃষ্টি করা দরকার। তাতেও কিছুটা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় অর্জন হবে। সরকারের উচিত সাহস রাখা এবং কিছু দুঃসাহসিক কাজ করা। আশা করি, সরকার সব ষড়যন্ত্র সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারবে এবং নৈরাজ্য প্রতিহত করবে।

ইশা মোহাম্মদ : কলেজশিক্ষক
 

No comments

Powered by Blogger.