স্মরণ-নন্দনকাননের নিভৃত নিলয়ের মানুষটি

গেল শতকের ষাট কিংবা সত্তরের দশকের কথা। চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়ি এলাকা নন্দনকাননের ঘুম ভাঙত বাঁশির সুরে। ভোরের আলো-আঁধারে সেই সুর যখন হাওয়ায় ভাসত, তখন রথের পুকুরের জল আর ডিসি পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে গাছের পাতা তিরতির করে কাঁপত। নন্দনকাননে পাহাড়ের শীর্ষে প্রাচীন মন্দির তুলসী ধাম। সেই পাহাড়ের পাদদেশে একটি একতলা বাড়ি থেকে সেই সুর ছড়িয়ে পড়ছে।


ফুল কুড়ানোর ছলে বাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখতাম, এক সৌম্যকান্তি গৌর বর্ণের মানুষ পদ্মাসনে বসা, চোখ দুটো বন্ধ, বিশেষ মুদ্রার ভঙ্গিতে দুই হাতে ধরে রেখেছেন বাঁশি আর হূদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত আবেগে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছেন সেই বাঁশিতে। মনে হতো যেন সুরের মায়াজাল ছড়িয়ে নিবিড় সাধনায় মগ্ন এক সাধক। তাঁর নাম সুচরিত চৌধুরী। বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে যিনি কথাসাহিত্যিক হিসেবেই বেশি পরিচিত। আজ ২১ জানুয়ারি তাঁর ৮৩তম জন্মদিন।
১৯২৯ সালে এই দিনে বোয়ালখালী থানার কদুরখিল গ্রামে সুচরিতের জন্ম হলেও শৈশব থেকে জীবনের শেষ দিন অবধি তাঁর এই বাড়িতেই কেটেছে। বাড়িটির নাম ‘নিভৃত নিলয়’। কিন্তু খুব বেশি যে নিভৃত ছিল, তা নয়। নানা গুণী মানুষ ও কৃতিমানের কোলাহলে ভরা থাকত বাড়িটি। বাবা আশুতোষ চৌধুরী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালাগান সংগ্রাহক। চাকরি শেষে এই বাড়িতে বসবাস শুরুর পর থেকেই আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে আড্ডা দিতে আসতেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদাশংকর রায়, মনীশ ঘটক, মাহবুব-উল-আলম, আবুল ফজলের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা। এই বাড়ি নিয়ে চালু হয়েছে নানা কিংবদন্তি।
সুচরিত চৌধুরীর বাড়ির সামনে একটি নরসুন্দরের দোকান আছে। একদিন এক অচেনা লোক ক্ষৌরকর্ম সারতে এলেন সেখানে। লোকটি এসেছেন সুচরিত চৌধুরীর বাবা আশুতোষ চৌধুরীর কাছে। কথায় কথায় পরিচয় হলো। লোকটির নাম জসীম উদ্দীন। পল্লীকবি নামে তাঁকে সবাই চেনেন। এই পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে আরেক লোক ছুটে এসে যিনি কবির দাড়ি কামাচ্ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে ক্ষুরটি কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘কবির দাড়ি তুই কেন কাটবি? আমিই কাটব।’ তারপর খুব যত্নে কবির মুখটা মসৃণ করে দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আমার নাম রমেশ শীল’। দুই কবির এ রকম মহামিলনের মতো অনেক মজার গল্প আছে এই বাড়িটি ঘিরে। কিন্তু সবচেয়ে বড় গল্প সে বাড়ির ছেলেটির সাহিত্যিক ও শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প।
প্রচারবিমুখ, বিশুদ্ধবাদী এই মানুষ শিল্প-সাহিত্য চর্চাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে দূরে রেখে বেছে নিয়েছিলেন ধ্যানমগ্ন জীবন। বেতারে বাঁশি বাজিয়ে, আর সাহিত্য রচনা করে জীবিকা নির্বাহের সাহস করেছিলেন তিনি।
লেখার মানের প্রশ্নে কখনো আপস করেননি তিনি। তাই বছর বছর বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর কথা ভাবেননি। লিখেছেন কম কিন্তু যা লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের জন্য তা সম্পদ হয়ে থাকবে। তাঁর জীবদ্দশায় একটি উপন্যাস (নদী নির্জন নীল), পাঁচটি গল্পগ্রন্থ, (সুরাইয়া চৌধুরীর সেরা গল্প, আকাশে অনেক ঘুড়ি, একদিন একরাত, নির্বাচিত গল্প, কিংবদন্তির গল্প) একটি কাব্যগ্রন্থসহ (শুধু চৌধুরী শুধু কবিতা) সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তবে অগ্রন্থিত আছে ছয়টি উপন্যাস, ৩৩টি গল্পসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পেলেও তাঁর লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়ে। প্রথমে ‘শুধু চৌধুরী’ নামেই কবিতা লিখতেন। প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ছিল ‘শুধু চৌধুরীর শুধু কবিতা’। এরপর গল্প লিখলেন সুরাইয়া চৌধুরী নামে। সুরাইয়া চৌধুরীর সেরা গল্প নামে বইও প্রকাশিত হয়েছে। শুরুর দিকে নিজের নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশের এই দ্বিধা কেন যে তাঁর ভেতরে কাজ করেছে, তা এক রহস্য সবার কাছে। এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো জবাব দিতেন না। তিনি বলতেন, ‘নাম নিয়ে এত গবেষণার দরকার কী। যে নামেই হোক—যা লিখেছি, তার শিল্পমানই আসল বিচারের বিষয়।’
নিজের বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করতেই শিল্প সৃষ্টি করেছেন সুচরিত চৌধুরী। কখনো ছোটেননি খ্যাতির পেছনে। আড্ডা, গান, কবিতা কিংবা সংগীতচর্চা এই সবকিছুর মধ্যে জীবনের রস খুঁজতেন তিনি। তাই কবিতা, গল্প আর উপন্যাস লেখার পাশাপাশি প্রায় নিভৃতেই রচনা করেছেন তিন হাজার গান।
শিল্প-সাহিত্য নিয়ে তাঁর তেমন কিছু উচ্চাশা ছিল না। তবু পেয়েছেন বহু পাঠকের ভালোবাসা। ১৯৭৬ সালে ছোটগল্পের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কারসহ বিভিন্ন সম্মাননা ও পদকে ভূষিত হয়েছেন।
সুচরিত চৌধুরীর ‘ছায়ামৃগ’ নামে একটি কবিতায় শেষ চার লাইন ছিল এ রকম—
‘সেখানে যেয়ো না মেয়ে, ফিরে এসো
এইখানে সূর্যঝরা নন্দনকাননে এই নিভৃত নিলয়ে
ছায়ামৃগ আমার হূদয়ে।’
সেই সূর্যঝরা নন্দনকাননের নিভৃত নিলয় থেকে একদিন মানুষটি নিজেই হারিয়ে গেলেন (মৃত্যু ১৯৯৪ সাল ৫ জানুয়ারি)। তবু শিল্পীর মৃত্যু নেই। সুচরিত তাই আজও আলোচিত ও প্রাসঙ্গিক চট্টগ্রামের মানুষের কাছে।
 ওমর কায়সার।

No comments

Powered by Blogger.