গণতান্ত্রিক লিবিয়ার স্বপ্ন কি বাস্তবে ধরা দেবে এবার?-গাদ্দাফির মৃত্যু by আবু সাঈদ খান
এ শহর থেকে ও শহর ঘুরেফিরে অবশেষে নিজ শহর সিরতে এসেও এতটুকু স্বস্তিতে থাকতে পারেননি কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি। বিদ্রোহী সেনাদের উপর্যুপরি হামলায় তটস্থ; তবে তার চেয়ে বড় আতঙ্ক_ ন্যাটো বাহিনীর শ্যেনদৃষ্টি তাকে খুঁজে ফিরছিল। তিনি সিরতে আছেন জেনে সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে উপর্যুপরি হামলা চালাচ্ছিল তারা। কিন্তু মাথা নোয়াবার মতো যোদ্ধা নন এই দুর্ধর্ষ আরব। তার শিরায় শিরায় ছিল বেদুইনের রক্ত।
শৈশব থেকে বেদুইনের শৌর্য-বীর্যের নানা গল্প শুনে আসছি। কবিগুরু একদা বেদুইনের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, 'ইহার চেয়ে হতেম যদি/আরব বেদুয়িন।/চরণতলে বিশাল মরু/দিগন্তে বিলীন।/ছুটছে ঘোরা, উড়ছে বালি,/জীবনস্রোত আকাশে ঢালি/হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি/চলেছি নিশিদিন।' বিদ্রোহী কবি নজরুলের কাছেও বেদুইন বীরত্বের প্রতীক। তাই তার বিদ্রোহী কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে আছে, 'আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিশ/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।'
গত ২০ অক্টোবর বেদুইন সন্তান গাদ্দাফি স্বদেশী বিদ্রোহী ও গণতন্ত্রের ত্রাতা (!) ন্যাটো বাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণে সব হারিয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় প্রাণ দিলেন। অবশ্য আত্মসমর্পণ করার পর নিরস্ত্র ও আহত গাদ্দাফিকে গ্রেফতার ও বিচার না করে নির্মমভাবে হত্যা করার ব্যাপারে বিদ্রোহীদের গড়া এনটিসি (ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল) এবং এর সমর্থক পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর কোনো অনুতাপ নেই। তারা ভালো করেই জানেন, এ প্রশ্ন অচিরেই শূন্যে মিলে যাবে। তবে যে প্রশ্নের উত্তর সহজে মিলবে না, তা হলো গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় কি শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে? যে বিদ্রোহের বীজ ছড়িয়ে পড়েছে তা কি থামবে, নাকি ক্ষমতার নির্মম খেলায় পর্যবসিত হবে? পশ্চিমা দুনিয়া কি লিবিয়াবাসীর কাছে গণতন্ত্রের মেওয়া তুলে দিয়ে স্বগৃহে ফিরে যাবে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, তেলের ওপর লিবিয়াবাসীর অধিকার নিরুপদ্রব থাকবে কি-না। এসবের উত্তর খোঁজার আগে এই বেপরোয়া শাসক গাদ্দাফির উত্থান ও ৪২ বছরের শাসনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।
১৯৬৯ সালে বিদ্রোহী সেনা অফিসার মুয়াম্মার গাদ্দাফি যখন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সম্রাট ইদ্রিসকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসীন হলেন, তখন লিবিয়া ছিল গোত্রে গোত্রে বিভক্ত, ক্ষত-বিক্ষত; হতদরিদ্র এক দেশ। তেল আবিষ্কৃত হলেও ওই তরল সোনার ওপর লিবিয়াবাসীর কোনো অধিকার ছিল না, তেলকূপগুলো ছিল বিদেশি কোম্পানির করতলগত। তিনি পশ্চিমা দুনিয়ার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। এর আগে ১৯৫২ সালে আরেক সেনা অফিসার জামাল আবদেল নাসের মিসরে ক্ষমতাসীন হন। সুয়েজখাল জাতীয়করণ করে মিসরের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন। একইভাবে তেল জাতীয়করণ করার মধ্য দিয়ে গাদ্দাফি বদলে দিলেন লিবিয়ার ভাগ্য।
গাদ্দাফি ছিলেন নাসেরের ভাবশিষ্য। নাসেরের লক্ষ্য ছিল_ এক. ঔপনিবেশিক আধিপত্য থেকে মুক্তি; দুই. বিদেশিদের কারসাজিতে বহুধা বিভক্ত আরবের ঐক্য; তিন. আরবদের মর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করা। ষাটের দশকে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বোমেদিন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট নুরুদ্দিন মুহম্মাদ আলী আল আতাসি, সুদানের প্রেসিডেন্ট ইসমাইল আল আজহারি প্রমুখকে নিয়ে নাসের আরব সংহতির বাতাবরণ রচনায় উদ্যোগী হন। এটি ছিল প্যান আরব ন্যাশনালিজমের উত্থানপর্ব। সে সময় বিভিন্ন আরব দেশে সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সৃষ্ট বাথ পার্টিও আরব জাতীয়তাবাদী ধারাকে উজ্জীবিত করে। মানবব্রতে বিশ্বাসী নাসেরও সমাজতন্ত্রের মর্মবাণীতে প্রভাবিত হয়েছিলেন। একইভাবে আলজেরিয়ার বোমেদিন, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার গাদ্দাফি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রভাবমুক্ত ছিলেন না। ইরানের জাতীয়তাবাদী শাসক ড. মোসাদ্দেক সাম্রাজ্যবাদী হামলায় নিহত ও ক্ষমতাচ্যুত হলেও তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
সব ছাপিয়ে ওই সময়ের আরব নেতাদের লক্ষ্য ছিল_ আরবের ঐক্য ও সংহতির বন্ধন সুদৃঢ় করা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-উত্তর প্রতিষ্ঠিত আরব লীগ, ১৯৫৮ সালে ইরাক ও জর্ডানের সমন্বয়ে আরব ফেডারেশন, সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র, আরব আমিরাত, মাগরেব ইউনিয়ন, ফিলিস্তিনের পক্ষাবলম্বন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আরব সংহতির ধারা এগিয়ে যায়। নাসেরের মৃত্যুর পর আরব জাতীয়তাবাদী ধারায় ভাটা পড়ে। তবে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদ ও গাদ্দাফি আরব জাতির সংহতির ধারা ধরে রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। ঐক্যের এই ধারা এগিয়ে নিতে গাদ্দাফি কখনও আরব জাতীয়তাবাদ, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বা প্যান ইসলামিজমের বক্তব্য সামনে এনেছেন। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলামের মিশেল মতবাদ দিয়ে নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করেছেন। লিখেছেন গ্রিন বুক। এসব কিছুর মূলে ছিল পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত আরব।
গাদ্দাফির ভাষা ছিল চাঁছাছোলা। পশ্চিমাদের উদ্দেশে হরহামেশা নিক্ষেপ করতেন বিষাক্ত শরবাণ। কূটনৈতিক বুদ্ধিবর্জিত গাদ্দাফি হয়ে উঠেছিলেন পশ্চিমা বিশ্বের চক্ষুশূল। সর্বশেষ অবরোধের মুখে তিনি যথার্থই কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো কোনো মহলের সুদৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হয়নি। পশ্চিমাদের টার্গেট অপরিবর্তিত। সাদ্দামের পর গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদের শেষ ব্যক্তিটিও চলে গেলেন।
এ যাওয়া পূর্বনির্ধারিত। মহাকবি বাল্মীকি রামের জন্মের ৫ হাজার বছর আগে রামায়ণ লিখেছিলেন। পশ্চিমা রাজনীতির কবিরা এত শক্তিশালী নন। তবে দু'চার দশক আগেই তারা লিখে রেখেছেন যে, সাদ্দামের পর গাদ্দাফির ট্র্যাজেডি, এরপর কে, সিরিয়া না ইরানের ওপর ন্যাটোর বোমারু বিমান উড়তে থাকবে; তা হয়তো নির্ধারিত।
গাদ্দাফির পতনের জন্য লিবিয়ার গৃহদাহ দায়ী। তিনি আরব ঐক্য, আফ্রিকান ঐক্য, পশ্চিমা দুনিয়াকে তুলাধোনায় ব্যস্ত থেকেছেন। কিন্তু নিজের ঘরের দিকে তাকাননি। এর অর্থ এই নয় যে, গাদ্দাফি তার দেশের কল্যাণের কথা ভাবেননি। আধুনিক শহর, সুরম্য অট্টালিকা গড়েছেন। মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটিয়েছেন। যেখানে ১৯৫৪ সালে গড় আয়ু ছিল ৫১, এখন তা ৭৪-এ উন্নীত। যেখানে শিক্ষার হার এখন ৮৮ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলার। কিন্তু সবকিছুর পরও মানুষের মধ্যে যে অভাববোধ কাজ করেছে, সেটি বাক্-স্বাধীনতা, স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা। এ ক্ষেত্রে তার নিষ্ঠুরতা সীমাহীন। রাজনৈতিক দল, গণসংগঠন কোনো কিছুরই শিকড় গজাতে দেননি তিনি। তিনি ব্রাদার লিডার হয়েও সবার মঙ্গল চেয়েছেন, যা তাকে দিয়েছে স্বৈরশাসকের তকমা। স্বেচ্ছাচারী গাদ্দাফি যদি যুগের হাওয়া বুঝে গণতন্ত্রের জন্য দুয়ার খুলে দিতেন, তাহলে ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবর্তন হতে পারত লিবিয়ার। প্রশ্ন হচ্ছে, এ কি গাদ্দাফির একার অদূরদর্শিতা? শুধু গাদ্দাফির লিবিয়াই নয়, আরব জাহানের কোথাও গণতন্ত্রের আবাদ হয়নি। গণতন্ত্রের মর্মবাণী প্রবেশ করেনি কোনো আরব শাসকের অন্তরে। তাই আরবের শাসকরা হয়ে আছেন রাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী, কিংবা স্বেচ্ছাচারী একনায়ক। তবে সব আরব শাসকের জন্য পশ্চিমা দুনিয়ার গণতন্ত্র দরদি শাসকরা অভিন্ন প্রেসক্রিপশন লিখছেন না। তাদের অনুগত রাজা-বাদশাদের বিরুদ্ধে রা শব্দও করছেন না।
সে যাই হোক, আরব জাহানের স্বৈরশাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষিত তরুণদের ক্ষোভ ধূমায়িত। এরই প্রকাশ ঘটেছে মিসর ও তিউনিসিয়ায়। বিদায় নিতে হয়েছে হোসনি মোবারক ও জিনে এল আবেদিন বেন গালিকে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সিরিয়া ও ইয়েমেনে। এই আন্দোলন নিজ নিজ দেশের জনগণের অভিব্যক্তি। জনগণ স্বৈরশাসনের অবসান চায়, তারা চায় দেশ শাসনে অংশীদারিত্ব। তবে গণতন্ত্রের প্রতি দরদ দেখিয়ে যেন আন্দোলনের প্রতিভূ হয়ে উঠেছে পশ্চিমা শক্তি।
আরব বিশ্ব গণতান্ত্রিক চেতনায় শানিত হচ্ছে_ এটি ইতিবাচক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দীর্ঘ কয়েক দশকজুড়ে প্যান আরব ন্যাশনালিজমের প্রবক্তাদের কেউ কেউ স্বৈরশাসকের কাঠগড়ায় দাঁড়ালেও আরববাসীর মানসভূমিতে দেশপ্রেমের যে শিখা তারা জ্বেলেছেন_ সেই আলোতে থেকেই কি তারুণ্যের আন্দোলন এগিয়ে যাবে, না পাশ্চাত্য হুকুমদারিতে তার স্বকীয়তা পরিত্যক্ত হবে_ সেটি আজ দেখার বিষয়।
তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আরব জাতিগুলোকে আরও অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হবে। এ সত্য উপলব্ধি না করে আন্দোলনকারীরা বিদেশি আধিপত্যবাদীদের বাহুলগ্ন হয়ে ত্বরিত ফল আশা করছে, যা হয়ে উঠতে পারে সমূহ বিপদের কারণ। আমরা জানি_ ইরাক, লিবিয়ায় কেবল ন্যাটোর সৈন্যরা মার্চ করেনি, সেখানে ছড়ানো হয়েছে বিভ্রান্তির বীজ। তার ফল যে কী বিষময় হবে তা কি ভাবা যায়!
স্বৈরশাসনের পতনের পর এনটিসি যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে, তবে তা হয়ে দাঁড়াবে গাদ্দাফির ট্র্যাজেডির চেয়ে অধিকতর বিয়োগান্ত নাটক।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
গত ২০ অক্টোবর বেদুইন সন্তান গাদ্দাফি স্বদেশী বিদ্রোহী ও গণতন্ত্রের ত্রাতা (!) ন্যাটো বাহিনীর উপর্যুপরি আক্রমণে সব হারিয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় প্রাণ দিলেন। অবশ্য আত্মসমর্পণ করার পর নিরস্ত্র ও আহত গাদ্দাফিকে গ্রেফতার ও বিচার না করে নির্মমভাবে হত্যা করার ব্যাপারে বিদ্রোহীদের গড়া এনটিসি (ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল) এবং এর সমর্থক পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর কোনো অনুতাপ নেই। তারা ভালো করেই জানেন, এ প্রশ্ন অচিরেই শূন্যে মিলে যাবে। তবে যে প্রশ্নের উত্তর সহজে মিলবে না, তা হলো গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় কি শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসবে? যে বিদ্রোহের বীজ ছড়িয়ে পড়েছে তা কি থামবে, নাকি ক্ষমতার নির্মম খেলায় পর্যবসিত হবে? পশ্চিমা দুনিয়া কি লিবিয়াবাসীর কাছে গণতন্ত্রের মেওয়া তুলে দিয়ে স্বগৃহে ফিরে যাবে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, তেলের ওপর লিবিয়াবাসীর অধিকার নিরুপদ্রব থাকবে কি-না। এসবের উত্তর খোঁজার আগে এই বেপরোয়া শাসক গাদ্দাফির উত্থান ও ৪২ বছরের শাসনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।
১৯৬৯ সালে বিদ্রোহী সেনা অফিসার মুয়াম্মার গাদ্দাফি যখন অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সম্রাট ইদ্রিসকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসীন হলেন, তখন লিবিয়া ছিল গোত্রে গোত্রে বিভক্ত, ক্ষত-বিক্ষত; হতদরিদ্র এক দেশ। তেল আবিষ্কৃত হলেও ওই তরল সোনার ওপর লিবিয়াবাসীর কোনো অধিকার ছিল না, তেলকূপগুলো ছিল বিদেশি কোম্পানির করতলগত। তিনি পশ্চিমা দুনিয়ার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। এর আগে ১৯৫২ সালে আরেক সেনা অফিসার জামাল আবদেল নাসের মিসরে ক্ষমতাসীন হন। সুয়েজখাল জাতীয়করণ করে মিসরের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন। একইভাবে তেল জাতীয়করণ করার মধ্য দিয়ে গাদ্দাফি বদলে দিলেন লিবিয়ার ভাগ্য।
গাদ্দাফি ছিলেন নাসেরের ভাবশিষ্য। নাসেরের লক্ষ্য ছিল_ এক. ঔপনিবেশিক আধিপত্য থেকে মুক্তি; দুই. বিদেশিদের কারসাজিতে বহুধা বিভক্ত আরবের ঐক্য; তিন. আরবদের মর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করা। ষাটের দশকে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বোমেদিন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট নুরুদ্দিন মুহম্মাদ আলী আল আতাসি, সুদানের প্রেসিডেন্ট ইসমাইল আল আজহারি প্রমুখকে নিয়ে নাসের আরব সংহতির বাতাবরণ রচনায় উদ্যোগী হন। এটি ছিল প্যান আরব ন্যাশনালিজমের উত্থানপর্ব। সে সময় বিভিন্ন আরব দেশে সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সৃষ্ট বাথ পার্টিও আরব জাতীয়তাবাদী ধারাকে উজ্জীবিত করে। মানবব্রতে বিশ্বাসী নাসেরও সমাজতন্ত্রের মর্মবাণীতে প্রভাবিত হয়েছিলেন। একইভাবে আলজেরিয়ার বোমেদিন, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার গাদ্দাফি সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রভাবমুক্ত ছিলেন না। ইরানের জাতীয়তাবাদী শাসক ড. মোসাদ্দেক সাম্রাজ্যবাদী হামলায় নিহত ও ক্ষমতাচ্যুত হলেও তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রেরণা জুগিয়েছিল।
সব ছাপিয়ে ওই সময়ের আরব নেতাদের লক্ষ্য ছিল_ আরবের ঐক্য ও সংহতির বন্ধন সুদৃঢ় করা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-উত্তর প্রতিষ্ঠিত আরব লীগ, ১৯৫৮ সালে ইরাক ও জর্ডানের সমন্বয়ে আরব ফেডারেশন, সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র, আরব আমিরাত, মাগরেব ইউনিয়ন, ফিলিস্তিনের পক্ষাবলম্বন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আরব সংহতির ধারা এগিয়ে যায়। নাসেরের মৃত্যুর পর আরব জাতীয়তাবাদী ধারায় ভাটা পড়ে। তবে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদ ও গাদ্দাফি আরব জাতির সংহতির ধারা ধরে রাখতে সচেষ্ট থেকেছেন। ঐক্যের এই ধারা এগিয়ে নিতে গাদ্দাফি কখনও আরব জাতীয়তাবাদ, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ বা প্যান ইসলামিজমের বক্তব্য সামনে এনেছেন। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলামের মিশেল মতবাদ দিয়ে নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করেছেন। লিখেছেন গ্রিন বুক। এসব কিছুর মূলে ছিল পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত আরব।
গাদ্দাফির ভাষা ছিল চাঁছাছোলা। পশ্চিমাদের উদ্দেশে হরহামেশা নিক্ষেপ করতেন বিষাক্ত শরবাণ। কূটনৈতিক বুদ্ধিবর্জিত গাদ্দাফি হয়ে উঠেছিলেন পশ্চিমা বিশ্বের চক্ষুশূল। সর্বশেষ অবরোধের মুখে তিনি যথার্থই কূটনৈতিক কৌশল নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো কোনো মহলের সুদৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হয়নি। পশ্চিমাদের টার্গেট অপরিবর্তিত। সাদ্দামের পর গাদ্দাফির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদের শেষ ব্যক্তিটিও চলে গেলেন।
এ যাওয়া পূর্বনির্ধারিত। মহাকবি বাল্মীকি রামের জন্মের ৫ হাজার বছর আগে রামায়ণ লিখেছিলেন। পশ্চিমা রাজনীতির কবিরা এত শক্তিশালী নন। তবে দু'চার দশক আগেই তারা লিখে রেখেছেন যে, সাদ্দামের পর গাদ্দাফির ট্র্যাজেডি, এরপর কে, সিরিয়া না ইরানের ওপর ন্যাটোর বোমারু বিমান উড়তে থাকবে; তা হয়তো নির্ধারিত।
গাদ্দাফির পতনের জন্য লিবিয়ার গৃহদাহ দায়ী। তিনি আরব ঐক্য, আফ্রিকান ঐক্য, পশ্চিমা দুনিয়াকে তুলাধোনায় ব্যস্ত থেকেছেন। কিন্তু নিজের ঘরের দিকে তাকাননি। এর অর্থ এই নয় যে, গাদ্দাফি তার দেশের কল্যাণের কথা ভাবেননি। আধুনিক শহর, সুরম্য অট্টালিকা গড়েছেন। মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটিয়েছেন। যেখানে ১৯৫৪ সালে গড় আয়ু ছিল ৫১, এখন তা ৭৪-এ উন্নীত। যেখানে শিক্ষার হার এখন ৮৮ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলার। কিন্তু সবকিছুর পরও মানুষের মধ্যে যে অভাববোধ কাজ করেছে, সেটি বাক্-স্বাধীনতা, স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা। এ ক্ষেত্রে তার নিষ্ঠুরতা সীমাহীন। রাজনৈতিক দল, গণসংগঠন কোনো কিছুরই শিকড় গজাতে দেননি তিনি। তিনি ব্রাদার লিডার হয়েও সবার মঙ্গল চেয়েছেন, যা তাকে দিয়েছে স্বৈরশাসকের তকমা। স্বেচ্ছাচারী গাদ্দাফি যদি যুগের হাওয়া বুঝে গণতন্ত্রের জন্য দুয়ার খুলে দিতেন, তাহলে ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবর্তন হতে পারত লিবিয়ার। প্রশ্ন হচ্ছে, এ কি গাদ্দাফির একার অদূরদর্শিতা? শুধু গাদ্দাফির লিবিয়াই নয়, আরব জাহানের কোথাও গণতন্ত্রের আবাদ হয়নি। গণতন্ত্রের মর্মবাণী প্রবেশ করেনি কোনো আরব শাসকের অন্তরে। তাই আরবের শাসকরা হয়ে আছেন রাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী, কিংবা স্বেচ্ছাচারী একনায়ক। তবে সব আরব শাসকের জন্য পশ্চিমা দুনিয়ার গণতন্ত্র দরদি শাসকরা অভিন্ন প্রেসক্রিপশন লিখছেন না। তাদের অনুগত রাজা-বাদশাদের বিরুদ্ধে রা শব্দও করছেন না।
সে যাই হোক, আরব জাহানের স্বৈরশাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষিত তরুণদের ক্ষোভ ধূমায়িত। এরই প্রকাশ ঘটেছে মিসর ও তিউনিসিয়ায়। বিদায় নিতে হয়েছে হোসনি মোবারক ও জিনে এল আবেদিন বেন গালিকে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সিরিয়া ও ইয়েমেনে। এই আন্দোলন নিজ নিজ দেশের জনগণের অভিব্যক্তি। জনগণ স্বৈরশাসনের অবসান চায়, তারা চায় দেশ শাসনে অংশীদারিত্ব। তবে গণতন্ত্রের প্রতি দরদ দেখিয়ে যেন আন্দোলনের প্রতিভূ হয়ে উঠেছে পশ্চিমা শক্তি।
আরব বিশ্ব গণতান্ত্রিক চেতনায় শানিত হচ্ছে_ এটি ইতিবাচক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দীর্ঘ কয়েক দশকজুড়ে প্যান আরব ন্যাশনালিজমের প্রবক্তাদের কেউ কেউ স্বৈরশাসকের কাঠগড়ায় দাঁড়ালেও আরববাসীর মানসভূমিতে দেশপ্রেমের যে শিখা তারা জ্বেলেছেন_ সেই আলোতে থেকেই কি তারুণ্যের আন্দোলন এগিয়ে যাবে, না পাশ্চাত্য হুকুমদারিতে তার স্বকীয়তা পরিত্যক্ত হবে_ সেটি আজ দেখার বিষয়।
তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আরব জাতিগুলোকে আরও অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হবে। এ সত্য উপলব্ধি না করে আন্দোলনকারীরা বিদেশি আধিপত্যবাদীদের বাহুলগ্ন হয়ে ত্বরিত ফল আশা করছে, যা হয়ে উঠতে পারে সমূহ বিপদের কারণ। আমরা জানি_ ইরাক, লিবিয়ায় কেবল ন্যাটোর সৈন্যরা মার্চ করেনি, সেখানে ছড়ানো হয়েছে বিভ্রান্তির বীজ। তার ফল যে কী বিষময় হবে তা কি ভাবা যায়!
স্বৈরশাসনের পতনের পর এনটিসি যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারে, তবে তা হয়ে দাঁড়াবে গাদ্দাফির ট্র্যাজেডির চেয়ে অধিকতর বিয়োগান্ত নাটক।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments