দেশহীন মানুষের কথা-সারী নদী আমার বোন, পাহাড় আমার ভাই by সঞ্জীব দ্রং
একজন আদিবাসী মানুষের কাছে নদী তার বোনের মতো, আর পাহাড় হলো তার ভাই। প্রকৃতি ও ধরিত্রী সম্পর্কে এ রকম জীবনদর্শন থাকলে আজ পৃথিবীতে এত পরিবেশ বিপর্যয় হতো না, মানুষ নদীর ওপর নগদ লাভের জন্য বাঁধ দিত না, নদী খুঁড়ে পানি দূষিত করত না। নদী যদি আমাদের বোন হয়, তবে আমরা তো তার ওপর অত্যাচার করতে পারি না, তাকে ধ্বংস করতে পারি না।
টিপাইমুখ বাঁধ বা জাফলংয়ে পিয়াইন নদীর ওপর পাথর উত্তোলন মেশিনের অত্যাচার রাষ্ট্র ও মানুষের আধুনিক উন্নয়নচিন্তার ফসল, যা সুদূরপ্রসারী ক্ষতি ডেকে আনবে ভবিষ্যর্যা প্রজন্মের জন্য। আজকের উন্নয়নভাবনা ও রাজনীতি নগদ হিসাবের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যর্যা প্রজন্মের কী হবে, এই ভাবনা এখানে মূল্যহীন। হাওর অঞ্চল থেকে একজন লোক এসে বললেন, যে নদীর পাথর আমরা এত দিন উত্তোলন করেছি, আরও হয়তো ২০০ বছর এই নদী আমাদের জীবন বাঁচিয়ে রাখত, মেশিনযন্ত্র দিয়ে আমরা তা দুই বছরে সব শেষ করে দিচ্ছি।
ধরিত্রী আমার নয়, আমিই ধরিত্রীর; নদী তো আমার নয়, আমিই নদীর; এই পাহাড় ও বন আমার নয়, আমিই বনের—এই ছিল জীবনভাবনা আদিবাসী মানুষের। আজকের করপোরেট সমাজ ও নগদ বাজারে এই ভাবনা, এই মূল্যবোধ অর্থহীন। আদিবাসীদের কাছে বন ও অরণ্য ছিল মায়ের মতো, অরণ্য জননী। অরণ্য যদি জননী হয়, তাকে বিক্রি বা উজাড় করার তো প্রশ্নই আসে না। সেই বন থেকে মুনাফা করার চিন্তাও তো আদিবাসীদের ছিল না। জননীকে কি বিক্রি করা যায়? আর আজকের রাষ্ট্র, উন্নয়নধারা ও মানুষের কাছে বন হলো সম্পদ, এখানে জীবনের কোনো বিষয় নেই। এখানেই অসহায় আদিবাসী মানুষ, তাদের ভাবনা-চিন্তা আজ মূল্যহীন। প্রকৃতি যখন উজাড় করে আমাদের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা নদী দিয়েছে, আমরা কেন এসব নদী দখল করি? সিডর, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস হলে অনেকে বলেন, মানুষ এখনো প্রকৃতিকে জয় করতে পারেনি, প্রকৃতির কাছে মানুষ অসহায়। আর আমরা আদিবাসীরা বলি, প্রকৃতিকে জয় করার বা তাকে পরাস্ত করার কিছু নেই। মানুষ যেন প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করার চিন্তা ভুলে যায়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের মাধ্যমে উভয়ে যেন পরিপূরক হয়। একজন খাসি বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘বনে একটি বড় গাছ দেখলে আধুনিক মানুষ গাছের কাঠের মূল্য টাকা দিয়ে বিচার করে আর গাছ কেটে বিক্রির কথা চিন্তা করে।’ আর আদিবাসী মানুষের কাছে বৃক্ষ হলো দেবতা। শুধু মানুষের জন্য তার চিন্তা নয়, বনের পশুপাখি, কীটপতঙ্গের কথাও আদিবাসী মানুষ ভাবে, তাদের জন্য বৃক্ষ সংরক্ষণ প্রয়োজন। আদিবাসী মানুষের কাছে ভূমি, পাহাড় ও বনের সবকিছু পবিত্র। সেখানে তাদের পূর্বপুরুষের রক্ত মিশে আছে, তাদের সমাধিক্ষেত্র আছে।
বাঙালি প্রেমিক ভালোবেসে তার প্রেমিকাকে বলে, তুমি আমার। ‘তুমি আমার’ বলেই ছেলেটি মেয়েটির স্বাধীনতা হরণ করে। আদিবাসী জীবনদর্শনে ছেলেটি মেয়েটিকে ‘তুমি আমার’ না বলে বলবে, ‘আমি তোমার।’ বিষয়টি পুরো উল্টো।
গত ১৩ জানুয়ারি সিলেটের জাফলংয়ের কাছে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা সারী নদী দেখতে গেলাম। এই নদীর জল এখনো নীল। সঙ্গে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। আমরা একটি নৌকায় করে যেখানে সারী নদী মেঘালয়ের খাসি পাহাড় থেকে নেমেছে, তার শেষ মাথায় গেলাম। ওপাশে বিএসএফ ক্যাম্প। হাবিবুর রহমান স্যার আমাকে বললেন, ‘এই নীল পানির ফটো তোলো।’ তিনি বললেন, ‘বহু দিন পর এই রকম নীল পানি দেখলাম।’ আমি ফটো তুললাম। সারী নদীর দুই ধার এখনো অপূর্ব সুন্দর। স্বচ্ছ, পরিষ্কার তার নীল জল। তবে শুনলাম, জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর মতো এখানেও পাথর ও বালুলোভী মানুষের চোখ পড়েছে। যন্ত্রদানব ও ব্যবসায়ী লোভী মানুষের অত্যাচারে পিয়াইন নদী ও জাফলং এখন লন্ডভন্ড, মৃতপ্রায়। আমরা স্বস্তি পেলাম দেখে, সারী নদী এখনো বেঁচে আছে, সুন্দর আছে। তবে বিপদের কথাও জানলাম, এই নদীতেও বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আর এপারেও পাথর ও বালু ব্যবসায়ীরা মাঝেমধ্যে নদী খোঁড়ার চেষ্টা করছে। প্রথম আলো এ বিষয়ে ১৭ জানুয়ারি একটি খবর ছেপেছে।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাপা আয়োজিত সম্মেলনে কয়েকজন শিক্ষক বললেন, ‘আদিবাসী মানুষের কাছে বনের দায়িত্ব দিলে তারাই বন, গাছ, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি রক্ষা করত। অন্যদের কাছে এই দায়িত্ব দিলে কী হয়, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। অন্যের কাছে গাছ ও বন হলো মুনাফার হাতিয়ার, আর আদিবাসীদের কাছে বন ও অরণ্য হলো জীবনের প্রতীক।’
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় আমি একটি আদিবাসী ঘোষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, ‘সকল মানুষের আগমন ঘটেছে বন থেকে, ভূমি থেকে। বন মরে গেলে মানুষ মরে যায়। আমাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার, একে মায়া-মমতা দিয়ে লালন করার। যখন এ প্রকৃতির কোনো একটি অংশকে ধ্বংস করা হয়, তখন সব ভারসাম্য লন্ডভন্ড হয়ে যায়। যখন বনের শেষ বৃক্ষ কেটে ফেলা হয়, শেষ নদীটি শুকিয়ে যায়, তখন মানুষ শিখবে যে সোনা-রুপা-টাকা খেয়ে জীবন বাঁচে না। সঠিকভাবে, পরম যত্নে, নির্লোভভাবে প্রকৃতিকে, বন ও ভূমিকে ব্যবহার করার ভার আমরা পেয়েছি পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে, যারা ভবিষ্যর্যা প্রজন্মের জন্য একে রক্ষার ভার আমাদের দিয়ে গেছেন।’ বহুদিন ধরে আধুনিক সভ্যতা, ক্ষমতাধর লোভী নিষ্ঠুর মানুষ এবং অপরিণামদর্শী রাষ্ট্র কথাগুলো কানে শোনেনি। তাই আজ প্রকৃতি ও আদিবাসী মানুষ উভয়ে বিপন্ন।
এই অনুষ্ঠানেই বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, আদিবাসীদের সংজ্ঞায়ন নয়, শনাক্তকরণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কথাটা আমাদের সরকার ও রাষ্ট্র যেন কানে শোনে ও মানে।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
sanjeebdrong@gmail.com
ধরিত্রী আমার নয়, আমিই ধরিত্রীর; নদী তো আমার নয়, আমিই নদীর; এই পাহাড় ও বন আমার নয়, আমিই বনের—এই ছিল জীবনভাবনা আদিবাসী মানুষের। আজকের করপোরেট সমাজ ও নগদ বাজারে এই ভাবনা, এই মূল্যবোধ অর্থহীন। আদিবাসীদের কাছে বন ও অরণ্য ছিল মায়ের মতো, অরণ্য জননী। অরণ্য যদি জননী হয়, তাকে বিক্রি বা উজাড় করার তো প্রশ্নই আসে না। সেই বন থেকে মুনাফা করার চিন্তাও তো আদিবাসীদের ছিল না। জননীকে কি বিক্রি করা যায়? আর আজকের রাষ্ট্র, উন্নয়নধারা ও মানুষের কাছে বন হলো সম্পদ, এখানে জীবনের কোনো বিষয় নেই। এখানেই অসহায় আদিবাসী মানুষ, তাদের ভাবনা-চিন্তা আজ মূল্যহীন। প্রকৃতি যখন উজাড় করে আমাদের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা নদী দিয়েছে, আমরা কেন এসব নদী দখল করি? সিডর, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস হলে অনেকে বলেন, মানুষ এখনো প্রকৃতিকে জয় করতে পারেনি, প্রকৃতির কাছে মানুষ অসহায়। আর আমরা আদিবাসীরা বলি, প্রকৃতিকে জয় করার বা তাকে পরাস্ত করার কিছু নেই। মানুষ যেন প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করার চিন্তা ভুলে যায়, বরং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের মাধ্যমে উভয়ে যেন পরিপূরক হয়। একজন খাসি বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘বনে একটি বড় গাছ দেখলে আধুনিক মানুষ গাছের কাঠের মূল্য টাকা দিয়ে বিচার করে আর গাছ কেটে বিক্রির কথা চিন্তা করে।’ আর আদিবাসী মানুষের কাছে বৃক্ষ হলো দেবতা। শুধু মানুষের জন্য তার চিন্তা নয়, বনের পশুপাখি, কীটপতঙ্গের কথাও আদিবাসী মানুষ ভাবে, তাদের জন্য বৃক্ষ সংরক্ষণ প্রয়োজন। আদিবাসী মানুষের কাছে ভূমি, পাহাড় ও বনের সবকিছু পবিত্র। সেখানে তাদের পূর্বপুরুষের রক্ত মিশে আছে, তাদের সমাধিক্ষেত্র আছে।
বাঙালি প্রেমিক ভালোবেসে তার প্রেমিকাকে বলে, তুমি আমার। ‘তুমি আমার’ বলেই ছেলেটি মেয়েটির স্বাধীনতা হরণ করে। আদিবাসী জীবনদর্শনে ছেলেটি মেয়েটিকে ‘তুমি আমার’ না বলে বলবে, ‘আমি তোমার।’ বিষয়টি পুরো উল্টো।
গত ১৩ জানুয়ারি সিলেটের জাফলংয়ের কাছে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা সারী নদী দেখতে গেলাম। এই নদীর জল এখনো নীল। সঙ্গে ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। আমরা একটি নৌকায় করে যেখানে সারী নদী মেঘালয়ের খাসি পাহাড় থেকে নেমেছে, তার শেষ মাথায় গেলাম। ওপাশে বিএসএফ ক্যাম্প। হাবিবুর রহমান স্যার আমাকে বললেন, ‘এই নীল পানির ফটো তোলো।’ তিনি বললেন, ‘বহু দিন পর এই রকম নীল পানি দেখলাম।’ আমি ফটো তুললাম। সারী নদীর দুই ধার এখনো অপূর্ব সুন্দর। স্বচ্ছ, পরিষ্কার তার নীল জল। তবে শুনলাম, জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর মতো এখানেও পাথর ও বালুলোভী মানুষের চোখ পড়েছে। যন্ত্রদানব ও ব্যবসায়ী লোভী মানুষের অত্যাচারে পিয়াইন নদী ও জাফলং এখন লন্ডভন্ড, মৃতপ্রায়। আমরা স্বস্তি পেলাম দেখে, সারী নদী এখনো বেঁচে আছে, সুন্দর আছে। তবে বিপদের কথাও জানলাম, এই নদীতেও বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আর এপারেও পাথর ও বালু ব্যবসায়ীরা মাঝেমধ্যে নদী খোঁড়ার চেষ্টা করছে। প্রথম আলো এ বিষয়ে ১৭ জানুয়ারি একটি খবর ছেপেছে।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাপা আয়োজিত সম্মেলনে কয়েকজন শিক্ষক বললেন, ‘আদিবাসী মানুষের কাছে বনের দায়িত্ব দিলে তারাই বন, গাছ, জীববৈচিত্র্য ইত্যাদি রক্ষা করত। অন্যদের কাছে এই দায়িত্ব দিলে কী হয়, তা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। অন্যের কাছে গাছ ও বন হলো মুনাফার হাতিয়ার, আর আদিবাসীদের কাছে বন ও অরণ্য হলো জীবনের প্রতীক।’
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় আমি একটি আদিবাসী ঘোষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, ‘সকল মানুষের আগমন ঘটেছে বন থেকে, ভূমি থেকে। বন মরে গেলে মানুষ মরে যায়। আমাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার, একে মায়া-মমতা দিয়ে লালন করার। যখন এ প্রকৃতির কোনো একটি অংশকে ধ্বংস করা হয়, তখন সব ভারসাম্য লন্ডভন্ড হয়ে যায়। যখন বনের শেষ বৃক্ষ কেটে ফেলা হয়, শেষ নদীটি শুকিয়ে যায়, তখন মানুষ শিখবে যে সোনা-রুপা-টাকা খেয়ে জীবন বাঁচে না। সঠিকভাবে, পরম যত্নে, নির্লোভভাবে প্রকৃতিকে, বন ও ভূমিকে ব্যবহার করার ভার আমরা পেয়েছি পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে, যারা ভবিষ্যর্যা প্রজন্মের জন্য একে রক্ষার ভার আমাদের দিয়ে গেছেন।’ বহুদিন ধরে আধুনিক সভ্যতা, ক্ষমতাধর লোভী নিষ্ঠুর মানুষ এবং অপরিণামদর্শী রাষ্ট্র কথাগুলো কানে শোনেনি। তাই আজ প্রকৃতি ও আদিবাসী মানুষ উভয়ে বিপন্ন।
এই অনুষ্ঠানেই বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, আদিবাসীদের সংজ্ঞায়ন নয়, শনাক্তকরণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কথাটা আমাদের সরকার ও রাষ্ট্র যেন কানে শোনে ও মানে।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
sanjeebdrong@gmail.com
No comments