ফিরে দেখা ’৭১-একাত্তরে বিপ্লব-তীর্থ চট্টগ্রাম by আবদুল মান্নান

বাংলাদেশের তো বটেই, ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে চট্টগ্রাম সব সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই উপমহাদেশে গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই যুব বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, লোকনাথ বল প্রমুখ। এখানে জন্ম হয়েছে কাজেম আলী মাস্টার, যতীন্দ্র মোহন সেনের মতো উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কদের।


১৮৫৭ সালে এই চট্টগ্রাম থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন সিপাহি রজব আলী। মহাত্মা গান্ধী চট্টগ্রামের বিপ্লবী চরিত্র দেখে ১৯২১ সালে এই জেলা সম্পর্কে বলেছিলেন: ‘Chittagong to the fore.’ (সবার আগে চট্টগ্রাম)। কবি সুকান্ত তো ‘চট্টগ্রাম বীর চট্টগ্রাম’ বলে একটি কবিতাই লিখে ফেলেছিলেন। এসব কারণে এই উপমহাদেশে বিপ্লব-তীর্থ হিসেবেই চট্টগ্রামের পরিচয়। ১৯৭১ সালেও বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সময় চট্টগ্রাম তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পিছপা হয়নি।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের পর এটি স্বাভাবিক ছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবে। কিন্তু পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার কখনো চায়নি, বাঙালিরা পাকিস্তানের কেন্দ্রে সরকার গঠন করুক। একাত্তরের পয়লা মার্চ যখন এক বেতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণের আশ্রয় নিলেন, তখন বাঙালির কাছে এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কখনো আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে দেবে না। গর্জে উঠল বাংলাদেশ। আওয়াজ উঠল ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। এক ঐতিহাসিক উত্তাল সময়ের শুরু, যার ঢেউ মুহূর্তেই বিপ্লব-তীর্থ চট্টগ্রামে এসে লেগেছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাড়ায়-মহল্লায় গঠিত হয়েছিল সংগ্রাম পরিষদ। এ সময় এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল চট্টগ্রামের বুদ্ধিজীবী সমাজ, যার নেতৃত্বে ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি; আর চট্টগ্রামের বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করেছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ডা. কামাল এ খান। সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ড. শামসুল হক (পরে উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) আর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। বুদ্ধিজীবীদের সব কর্মকাণ্ড সমন্বয় করার দায়িত্ব পড়েছিল তাঁর ওপর। তাঁকে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিলেন অধ্যাপক আবু জাফর, অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিক, অধ্যাপক মোমতাজ উদ্দিন আহম্মদ, অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, অধ্যাপক রশিদুল হক প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল চট্টগ্রামের ছাত্র ও যুবসমাজ। নানাভাবে পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক, সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আবুল ফজল, অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ আরও অনেকে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় লালদীঘি ময়দানে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ নামে তাঁরা বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করেন।
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি-নিধন কর্মসূচি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে চট্টগ্রামে প্রথম বড় আক্রমণটা হয় ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে বন্দরে নোঙর করা পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ থেকে, যদিও এর আগে প্রথম হত্যাযজ্ঞটা পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অভ্যন্তরে। ২৭ মার্চ থেকে ধীরে ধীরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহর দখল করতে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের সহায়তা করে পাকিস্তানি নৌবাহিনী। পথে পথে তারা বাঙালি সেনা, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ছাত্র-যুবক আর রাজনৈতিক কর্মীবাহিনীর কাছে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালিদের যে কটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল, তার মধ্যে কুমিরা, কালুরঘাট, কোর্ট বিল্ডিং ও পুলিশ লাইনের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। একাত্তরের পুরো সময় চট্টগ্রাম ছিল এক বিভীষিকার নগর। একদিকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর মারমুখী আচরণের কারণে শহরজুড়ে চরম আতঙ্ক আর অন্যদিকে পাকিস্তান সামরিক জান্তাকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, ইসলামী ছাত্র সংঘ (বর্তমানে ছাত্রশিবির), পিডিপি আর পাহাড়তলী শেরশাহ কলোনির বিহারিরা। গঠিত হয় শান্তি কমিটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন কাট্টলির নবী চৌধুরী। মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী। চন্দনপুরায় তাঁর গুডস হিলের বাসভবনে স্থাপিত নির্যাতনকেন্দ্রের কথা মনে করলে এখনো চট্টগ্রামের মানুষের গায়ে কাঁটা দেয়। সেই নির্যাতনকেন্দ্রে নির্যাতনের দায়িত্ব পালন করতেন তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে খোকা, সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম (পরবর্তী সময়ে বিএনপির চিফ হুইপ) প্রমুখ। মুসলিম লীগ বিহারি আর দলীয় ক্যাডার নিয়ে গঠন করেছিল আলশামস বাহিনী। এই বাহিনী শহরে তো বটেই, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। জামায়াত নন্দনকানন ডালিম হোটেলে প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের নিজস্ব নির্যাতনকেন্দ্র। এখানে তারা ছাত্রশিবিরের সহায়তায় বাঙালি আর মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়ে পরে হত্যা করত। এসব নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন জামায়াতের আবদুল খালেক, ওসমান রমজ, মাওলানা শামসুল আলম, ইয়াহিয়া খালেদ, ছাত্র সংঘের মীর কাসেম আলী, আফসারউদ্দিন, আবু তাহের, মো. ইউসুফ প্রমুখ। পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সৃষ্টি হয়েছিল রাজাকার বাহিনী। এরা এসেছিল সাধারণত খুব নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে, অনেকটা পেটের দায়ে। তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে। বিহারিরা পুরো পাহাড়তলী এলাকায় সৃষ্টি করেছিল ভয়াবহ এক মৃত্যুর উপত্যকা। নভেম্বর মাসে তারা ঝাওতলা আর টাইগারপাস এলাকার মাঝামাঝি জায়গায় দুটি ট্রেন দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে কয়েক শ যাত্রীকে হত্যা করে এবং টাইগারপাস রেলওয়ে বালিকা বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে ও রেল কলোনির সেপটিক ট্যাংকের ভেতর তা ফেলে রেখেছিল। ফয়’স লেক এলাকা থেকে চট্টগ্রাম টিভি স্টেশনের সামনে পর্যন্ত তারা প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম বধ্যভূমি (বর্তমানে এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে)।
এপ্রিল-জুলাইয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের মতো চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষও কিছুটা হতাশাগ্রস্ত ছিল। কারণ, এ সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হচ্ছিল এবং এ কারণে সামগ্রিকভাবে তাঁদের কর্মকাণ্ড কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। মাঝেমধ্যে কিছু চোরাগোপ্তা আক্রমণ ছাড়া এ সময় উল্লেখ করার মতো তাঁদের তেমন কোনো বড় অপারেশন চোখে পড়েনি। আগস্ট থেকে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়। এবার মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণে। দিনের বেলায় শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর তাদের দোসরদের দেখা গেলেও রাতে তারা ভয়ে প্রকাশ্যে বের হতো না। রাতে তাদের জন্য চট্টগ্রাম ছিল এক আতঙ্কের নগর। সারা রাত গুলি ছুড়ে মুক্তিযোদ্ধারা জানান দিত: আমরা আছি এই নগরে, তোমাদের পাশে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৫ আগস্ট আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী নৌ-কমান্ডোরা কর্ণফুলী নদীর অন্য পাড় থেকে সাঁতরে এসে মাইন লাগিয়ে বেশ কয়েকটি পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করেন।
৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর প্রথমে নবগঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনী নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল ও চট্টগ্রামের পতেঙ্গা তেলের ডিপোতে বিমান হামলা চালায়। এরপর উপর্যুপরি বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমানবাহিনী। এসব বিমান আসত বঙ্গোপসাগরে নোঙর করা যুদ্ধবিমান বহনকারী জাহাজ ‘বিক্রান্ত’ থেকে। প্রথম হামলা হয় রাত দুইটায়। পরেরটা সকাল সাড়ে সাতটা ও বিকেল চারটায় (৪ তারিখ)। বস্তুতপক্ষে যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিন থেকেই পাকিস্তানি বিমানবাহিনী বাংলাদেশের আকাশের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। একই সঙ্গে ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে নিয়মিত গোলা বর্ষণ করা হচ্ছিল পতেঙ্গা এলাকায়। ৩ তারিখ রাতেই সামরিক কর্তৃপক্ষ শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে, কিন্তু সেটি ছিল অনেকটা অকার্যকর। যখন বাংলাদেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, তখন শহরের উপকণ্ঠ, যেমন—সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, হাটহাজারী প্রভৃতি অঞ্চল থেকে রাতের অন্ধকার ভেদ করে আসতে লাগল প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ।
ষোলো ডিসেম্বর পড়ন্ত বেলায় ঢাকায় নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেন। সে খবর সন্ধ্যা সাতটায় প্রথম অল ইন্ডিয়া রেডিও প্রচার করে। তখন চট্টগ্রামজুড়ে একটাই স্লোগান—‘জয় বাংলা’। চট্টগ্রামে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি হয় ১৭ ডিসেম্বর। সকাল সাতটা নাগাদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস—যা সামরিক প্রশাসকের সদর দপ্তর ছিল—থেকে নতুনপাড়া সেনানিবাসে চলে যায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সার্কিট হাউস থেকে চলে যাওয়ার পর সকাল আটটা নাগাদ আমি, খালেদুজ্জামান দাদুল (বন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে অবসর নিয়েছেন), মাসুদসহ (শিল্পী) আরও কয়েকজন সার্কিট হাউসে প্রবেশ করি। সামনের পতাকাদণ্ডে লাগানো পাকিস্তানি পতাকাটি নামিয়ে আনি আর দাদুল নামায় সার্কিট হাউসের চূড়ার উড়ন্ত পতাকাটি। দুপুর ১২টা নাগাদ মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সেনারা শহরে প্রবেশ করা শুরু করে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.