পরিসর বাড়ছে দেশীয় জাহাজ নির্মাণশিল্পের by শুভংকর কর্মকার
দেশের জাহাজ নির্মাণশিল্পটির পরিসর ক্রমেই বাড়ছে। দেশের নদ-নদীতে চলাচলের জন্য বিভিন্ন ধরনের নৌযান তৈরি করছে জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। একই সঙ্গে শিল্পটি রপ্তানি খাতের তালিকায় যুক্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্তত ২৫টি জাহাজ রপ্তানি হয়েছে। সরকারের সহায়তা পেলে ১০ বছরের ব্যবধানে এই খাত থেকে এক হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি আয় সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
জাহাজ নির্মাণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইউরোপে বাংলাদেশি জাহাজের ব্যাপক চাহিদা আছে। মূলত স্বল্পমূল্যে মানসম্মত জাহাজ তৈরিতে পারদর্শী হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ঝুঁকছেন বিদেশি ক্রেতারা। বিশেষত বাংলাদেশ ১০ হাজার টনের কম ওজনের বা হালকা জাহাজ তৈরি করে, যা অন্য নির্মাতা দেশগুলো করে না।
দেশীয় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো যাত্রী ভ্যাসেল, এমপিসি ভ্যাসেল, পাইলট ভ্যাসেল, ফেরি, ট্যাংকার, পন্টুন, কার্গো ইত্যাদি নৌযান তৈরি করছে। তবে এসব নৌযান নির্মাণের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ যন্ত্রাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে বর্তমানে ছোট-বড় প্রায় ২০০ জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান পাঁচ-ছয়টি। তবে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের জাহাজ রপ্তানি করছে দুটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হচ্ছে: ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড এবং আনন্দ শিপইয়ার্ডস অ্যান্ড শিপওয়েজ লিমিটেড। তবে শিগগিরই খান ব্রাদার্স, খুলনা ও কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড জাহাজ রপ্তানি করবে বলে জানা গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বরে জাহাজ রপ্তানি করে দুই কোটি ২৪ লাখ ডলার রপ্তানি আয় করছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১০-১১ অর্থবছরের এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল প্রায় চার কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি।
দেশের অন্যতম জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন মেরিন ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬২টি জাহাজ তৈরি করেছে। এর মধ্যে জার্মানিতে ছয়টি, পাকিস্তানে দুটি ও ফিনল্যান্ডে একটি জাহাজ রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। রপ্তানি হওয়া সবগুলোই বিশেষায়িত জাহাজ।
প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি তিন মাসে গড়ে দু-তিনটি জাহাজ তৈরি করছে ওয়েস্টার্ন মেরিন। বর্তমানে প্রায় ৫০টি জাহাজ নির্মাণের পর্যায়ে আছে। এর মধ্যে ১৫টিই জার্মানি, ফিনল্যান্ড, হল্যান্ড ও ডেনমার্কে রপ্তানি করা হবে। বাকিগুলো দেশীয় ক্রেতাদের জন্য।
নির্মাণাধীন জাহাজগুলোর মধ্যে প্যাসেঞ্জার ভ্যাসেল, এমপিসি ভ্যাসেল, মাল্টিপারপাস কার্গো, পাইলট ভ্যাসেল, রো রো ফেরি, ট্যাংকার অন্যতম। আগামী বছরের মধ্যে এগুলোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, ইউরোপের বেশির ভাগ জাহাজের বয়স ২৯ বছর পার হয়েছে। ২৬-২৭ বছর হলেই তাঁরা জাহাজ ভেঙে নতুন করে তৈরি করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এখনো সেভাবে কার্যাদেশ (অর্ডার) আসছে না। মন্দা কেটে গেলেই প্রচুর কার্যাদেশ আসবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
দেশের আরেক বড় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আনন্দ শিপইয়ার্ড ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত ছোট-বড় চার শতাধিক জাহাজ তৈরি করেছে। ২০০৮ সাল থেকে রপ্তানিতে যায় প্রতিষ্ঠানটি। ফেরি, কনটেইনার ভ্যাসেলসহ ১১টি জাহাজ ডেনমার্ক, মোজাম্বিক, মালদ্বীপে রপ্তানি করেছে আনন্দ শিডইয়ার্ড।
এদিকে জাহাজ নির্মাণশিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জাহাজ নকশাকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা। বর্তমানে ১১টি নকশাকারী প্রতিষ্ঠানই দেশে ব্যবহূত সব ধরনের জাহাজের নকশা তৈরি করছে। এ ছাড়া রপ্তানিযোগ্য জাহাজের মূল নকশা না করলেও নকশার জন্য কাজ করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
নকশা প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান মেরিন হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুল আলম বলেন, ‘তিন-চার বছর আগেও সব ধরনের জাহাজের নকশা বিদেশ থেকে করানো হতো। এখন দেশেই হচ্ছে। বিদেশি ক্রেতাদের শর্ত না থাকলে রপ্তানি করা জাহাজের নকশাও দেশের নকশাবিদেরাই করতে পারতেন।’ মেরিন হাউস বর্তমানে ৩৮টি অয়েল ট্যাংকারের নকশা তৈরি করছে বলে জানান তিনি।
ওয়েস্টার্ন মেরিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপের বিশাল বাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এই মুহূর্তে খাতটির জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন।
জাহাজ নির্মাণের জন্য বিশেষ অঞ্চল করার ওপর জোর দিয়ে শাখাওয়াত বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানেরই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রেনের মতো বৃহৎ যন্ত্রাংশ কেনার সামর্থ্য নেই। সে ক্ষেত্রে একেকটি অঞ্চলে একই যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে সাত-আটটি প্রতিষ্ঠান সহজেই জাহাজ নির্মাণ করতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দরে এসব সুযোগ-সুবিধা আছে উল্লেখ করে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মেঘনাঘাট, মংলা ও পটুয়াখালীতে জাহাজ নির্মাণ অঞ্চল করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সরকারকে শিল্পটির জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দিতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকে আনুষঙ্গিক সহযোগিতাও করতে হবে।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরোজা বারী প্রথম আলোকে বলেন, ৩০ বছর ধরে তিলে তিলে জাহাজের নির্মাণশিল্পে আজকের এই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এখন খাতটিতে বড় বিনিয়োগকারী আসতে হবে। এ জন্য ব্যাংক সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে রাখতে হবে।
খান ব্রাদার্স শিপ বিল্ডিংয়ের নির্বাহী পরিচালক আবদুর রহিম বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রবেশ সীমিত আকারে। তবে যে কয়টি জাহাজ রপ্তানি হয়েছে, তা উন্নতমানের। বিদেশি ক্রেতারাও সন্তুষ্ট। বিশ্ববাজার ধরতে হলে দেশে এখন আন্তর্জাতিক মানের শিপইয়ার্ড নির্মাণ করতে হবে। এ জন্য নদীর পারের ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সরকারকে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, জাহাজ নির্মাণশিল্পের মূল্য সংযোজন তৈরি পোশাক খাতের চেয়েও বেশি। সরকার ইতিমধ্যে এটিকে ‘থ্রাস্ট সেক্টর’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
No comments