শ্রম আইন-বাস্তবায়নে চাই উপযুক্ত তদারকি
পাঠকের দৃষ্টিবঞ্চিত গ্রন্থগত বিদ্যা যেমন বিদ্যা পদবাচ্য নয়, তেমনি প্রয়োগ সম্ভাবনাহীন বিধিবদ্ধ আইনও আইন বলে বিবেচিত হয় না। অথচ গভীর ও জটিল যে কোনো সমস্যা উপস্থিত হলে নাগরিকদের পক্ষ থেকে উপযুক্ত আইন প্রণয়নের দাবি অহরহ উত্থাপিত হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের দাবি যতটা জনপ্রিয় হয় আইন কতটা প্রযুক্ত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে তা তদারকির দাবি ততটা আমল পায় না।
ফলে অনেক বিষয়ে চমৎকার আইন থাকলেও সে আইন কারও কাজে আসে না। শ্রম আইন এ পরিস্থিতিতে যথার্থ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। দেশে ২০০৬ সালে গৃহীত শ্রম আইন কার্যকর। শ্রম আইন প্রয়োগ ও আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদফতর আছে। আইন লঙ্ঘনের ঘটনায় আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার ব্যবস্থাও আছে। ঢাকায় ৩টি, চট্টগ্রামে ২টি, খুলনায় ১টি, রাজশাহীতে ১টি শ্রম আদালত আছে। শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হলে আদালতের শরণাপন্ন যেমন হতে পারেন, তেমনি পরিদফতরের কর্মকর্তারা সরেজমিন পর্যবেক্ষণে গিয়ে কোনো কারখানা বা প্রতিষ্ঠান আইনের লঙ্ঘন করলে তার বিহিতও করতে পারেন। প্রশ্ন হলো, আইন লঙ্ঘনের বিহিত কি আসলেই হয়? বহু প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য কল্যাণ, প্রাপ্য ছুটি, উপযুক্ত মজুরি, সঠিক কর্মঘণ্টা বিষয়ে উদাসীন থেকে দিব্যি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিহিত করার কেউ নেই। শ্রমিকরা আদালতের শরণাপন্ন হতে পারছেন না। কারণ তাদের নিয়োগপত্র কিংবা পরিচয়পত্র না দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছে। আদালতের ভূমিকা সেখানে সীমিত হলেও পরিদফতর বিশেষ ভূমিকা নিতে পারত। কিন্তু পরিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তৎপরতা কেতাবেই সীমাবদ্ধ। আইন বাস্তবায়নের জন্য মাঠপর্যায়ে তদারকিতে তাদের বিশেষ আগ্রহ নেই। সঙ্গে আছে জনবল সংকটও। জনবল সংকট থাকার পরও যে কর্মকর্তারা মাঠপর্যায় পর্যন্ত পেঁৗছাতে পারেন, তাদের উৎকোচ দিয়ে ম্যানেজ করার বিশেষ সুযোগ আছে। বলা হচ্ছে, যদি উৎকোচের সুযোগ না থাকত তবে নাকি ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যেত। আইন মানলে দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই তালা পড়ত। নিয়ম অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দোকান ও প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে পরিদফতরে হাজির হওয়ার চিঠি দেওয়া হয় সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু সে কাজটি না করেই পার পেয়ে যান দোকান ও প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। পরিদফতরের পরিদর্শক বা উপ-পরিদর্শক এলে তাদের কিছু বখশিশ ধরিয়ে দিলেই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে, বখশিশ আদায়ের জন্য যদি সরেজমিন পরিদর্শনে যাওয়া সম্ভব হয় তবে আইন প্রয়োগের সময় লোকবল সংকটের অজুহাত কেন? পরিস্থিতি বলছে, আইন থাকলেও তা ভুক্তভোগীদের কাজে লাগছে না। শ্রম পরিবেশ উন্নয়নেও তা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারছে না। বরং উৎকোচভোগী ও আইন অমান্যকারীদের সুবিধা হচ্ছে এ পরিস্থিতিতে। বিভিন্ন সময় কারখানাগুলোতে দুর্ঘটনা, শ্রমিক স্বাস্থ্যহানি, শ্রমিক অসন্তোষের নানা খবর আমরা পাই। সেসবের মূলে যে আইনের লঙ্ঘন তা নিশ্চিত করে বলা যায়। আইনকে পাশে সরিয়ে রাখার এমন প্রবণতা চলতে থাকলে তা এ দেশের শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নের পথেই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। নিয়ম না মেনে সাময়িক লাভ হতে পারে, কিন্তু জাতির সামগ্রিক স্বার্থ তাতে বাধাগ্রস্ত হয়। তাই শ্রম আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ জন্য সচেতনতামূলক উদ্যোগ দরকার। প্রয়োজনে পরিদফতরের লোকবল বাড়ানো হোক। লোকবল বাড়ানোর সঙ্গে অসৎ উৎকোচভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও আসুক। নইলে উৎকোচের উন্নতি হবে_ আইন প্রয়োগে নয়।
No comments