বিজয় দিবস-স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি by মাহবুবুর রহমান

শ্মশ্রুশোভিত তরুণ কণ্ঠশিল্পী হায়দারের একটা গান আমার খুব ভালো লাগে। বারবার শুনি। কিছু কথা হূদয়ের গভীরে আঘাত হানে। দলিত-মথিত করে। ‘কী বলার ছিল কী বলছি। কী শোনার ছিল কী শুনছি। কী দেখার ছিল কী দেখছি। তিরিশটি বছর আমি স্বাধীনটাকে খুঁজছি...।’ হায়দার গানটা হয়তো ২০০১ সালে রচনা করেছেন। আজ ২০১১ সালের মহান বিজয় দিবসে গানটা আমার কাছে আরও অর্থবহ, আরও বেদনাদায়ক মনে হয়।


দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ ঘোর অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তন্ন তন্ন করে স্বাধীনতাটাকে খুঁজছে। কোথায় তুমি, হে আমার স্বাধীনতা? কোথায় তুমি, আমার মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত ফসল? বাংলার মানুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা-কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র আপামর জনতা অস্ত্র হাতে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। বাংলার শ্যামল প্রান্তর লাখো নিযুত শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। গোটা দক্ষিণ এশিয়ার এই বিস্তৃত ভূখণ্ডে, এই বিশাল উপমহাদেশের আর কোনো দেশে এমন তো আর হয়নি।
বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। স্বাধীনতার এক অদম্য স্পৃহা তাদের ঠেলে দিয়েছিল যুদ্ধে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও সংখ্যালঘিষ্ঠ এক দুর্বৃত্ত শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা শাসিত ও শোষিত। মুক্তিযুদ্ধ বাংলার মানুষের স্বাধীনতার প্রশ্নে দীর্ঘ সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্ব।
১৯৪৭-পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস পূর্ব বাংলার মানুষের চরম বঞ্চনার ইতিহাস, পদানত মানবাধিকারের পদে পদে লাঞ্ছনার ইতিহাস; চরম বৈষম্য, অপমান আর অবজ্ঞার ইতিহাস—আমাদের মনে করিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার চরম বর্ণবাদী ইতিহাসের কথা। এ যেন তারই এক এশীয় সংস্করণ।
শাসকশ্রেণী বন্দুকের নল আর শক্তি দিয়ে দুঃশাসন চালিয়ে যাচ্ছিল। ভাষার অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে বাংলার মানুষকে ভিন্ন ভাষা রাষ্ট্রভাষা বলে জোর করে মুখে পুরে দিচ্ছিল। বাঙালি গর্জে উঠল। ঢাকার রাস্তায় মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে বুকের রক্ত ঢেলে দিল।
১৯৫২ থেকে ১৯৭১। দীর্ঘ ১৯ বছরে বৈষম্য আর শোষণের পরিধি বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর হয়। জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে তা তীব্রভাবে প্রতিফলিত হতে থাকে। ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে জনগণের পর্বতপ্রমাণ রায়কে পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তা শাসক দল পায়ে ঠেলে দেয় তাচ্ছিল্য ভরে। বাংলার মানুষ, গোটা বাঙালি জাতি স্বাধীনতার অদম্য স্পৃহায় ঐক্যবদ্ধ হয়। হাতে হাতিয়ার তুলে নেয়, সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এটা অবিসংবাদিত সত্য যে, এই কঠিন মুক্তিযুদ্ধের মূলে যে চালিকাশক্তি ছিল, তা ছিল সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য গণমানুষের অদম্য স্পৃহা আর তার ওপর প্রতিষ্ঠিত এক বঞ্চনাহীন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন।
আজ চার দশক সময় অতিবাহিত। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেনি। শেকড় প্রোথিত হয়নি।
বারবার শুধু আছাড় খেয়েছে। কখনো স্বৈরতন্ত্র কখনো বা সামরিক শাসন, কখনো বা নৈরাজ্য-নৈরাশ্য পথ রুদ্ধ করেছে। বিচারপতি হাবিবুর রহমান এই সেদিনও বাংলাদেশে bastardization of democracy—গণতন্ত্রের জারজীকরণের কথা বলেছেন। বাজিগরদের শাসন বলেছেন। সকল জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও সংসদ আজ অকার্যকর। বিরোধী দল (সে যে দলই হোক না কেন) দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সংসদে অনুপস্থিত থেকেছে। সংসদে জাতীয় বড় বড় ইস্যু অনালোচিত থেকেছে। খাদ্য নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ নিরাপত্তা, সীমান্ত নিরাপত্তা, জাতীয় নিরাপত্তা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক অভিঘাত, সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্বসহ তালপট্টি দ্বীপের অধিকার, তেল, গ্যাস, কয়লা উত্তোলনে বৈদেশিক অসম চুক্তি ইত্যাদি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংসদে আলোচিত হয়নি। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, একটা সাংঘর্ষিক বিকৃত সংস্কৃতি জগদ্বল পাথরের মতো বাংলাদেশের রাজনীতিতে চেপে বসেছে। এ থেকে কোনো নিষ্কৃতি নেই, মুক্তি নেই। সরকার বদল হয়, শাসনযন্ত্রে পরিবর্তন আসে, দিনবদলের অঙ্গীকার হয়, কিন্তু সাংঘর্ষিক রাজনীতির রীতি-আচারের কখনো কোনো পরিবর্তন হয় না। সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে।
অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। অপার সম্ভাবনার দেশ আমার এই মাতৃভূমি, আমার এই বাংলাদেশ, তার আছে সবচেয়ে উর্বরা মাটি, যাতে সোনা ফলে। আছে বিশাল সুপেয় পানির অপার বিস্তার, আছে মাটির নিচে তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি বহু খনিজ সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার। বাংলার মানচিত্রের দক্ষিণাংশজুড়ে সুদীর্ঘ উপকূল ঘিরে আছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত বঙ্গোপসাগরের সীমাহীন বিস্তৃতি। আছে সুদূরপ্রসারিত মহিসোপানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃত বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিকার। আর আছে ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি সৃজনশীল হাতের এক বিশাল মানবসম্পদ।
আর আছে জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার গর্বিত সেনাবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগৃহে প্রসবিত এক দেশপ্রেমিক জাতীয় সেনাবাহিনী যার উত্থান, যার বিকাশ মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে। এই সেই সেনাবাহিনী যে শত্রুকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। দেশকে স্বাধীন করেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশ বির্নিমাণে অবদান রেখেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে জাতীয় সংকটে এই সেনাবাহিনীর সাহসী সদস্যরাই জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সিডরে, আইলায়, প্লাবনে, জলোচ্ছ্বাসের মহাদুর্যোগে মানুষ সেনাবাহিনীর সস্যদেরই ত্রাণকর্তা হিসেবে কাছে পেয়েছে। এই বাহিনীই জাতীয় নিরাপত্তা, জাতীয় অখণ্ডতা নিশ্চিত করেছে। বিশ্বশান্তি আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ যেন সমার্থক শব্দ।
এত সব সম্পদ আর এত সম্ভাবনা নিয়েও কেন বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতে পারছে না? সে কেন এখনো শুধুই হামাগুড়ি খাচ্ছে ? আজ আশপাশের দেশগুলোর দিকে যখন তাকাই, দেখি তারা কী শনৈঃ শনৈঃ করে এগিয়ে চলছে। একবিংশ শতাব্দরি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তারা সকলে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। অর্জন আর সাফল্য তাদের কদম ছুঁয়েছে। তারা সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির পথ ধরে আগুয়ান তারা, নব নব দিগন্ত উন্মোচন করছে। বিশ্বসভায় নিজেদের গৌরব আর সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করছে। চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া—যেদিকে তাকাই, শুধু জয়ধ্বনী শুনি। দেখি সকলেই তো আমাদের পেছনে ফেলে দূর থেকে আরও দূরে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এই তো কয়েক দশক আগেও তারা আমাদেরই গোত্রীভূত ছিল।
দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের। পরাধীনতার গ্লানি মোচন হয়েও স্বশাসিত স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বিশ্বে এক দারিদ্র্যপ্রপীড়িত দুর্নীতিগ্রস্ত ও গণতন্ত্রের অবক্ষয়িত এক দেশ। কিন্তু কেন? কারা আমার দেশের মহামানব, আমার মঞ্চের মহানায়ককে হত্যা করে আমার জাতিকে অতলান্তের অতলতলায় ডুবিয়ে দিতে চায়? কারা পিলখানার মর্মন্তুদ লোমহর্ষক মহা হত্যাকাণ্ড ঘটায়? কারা আমার মাতৃভূমি যাদের অস্থির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যাদের রক্তে অবগাহিত আমার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, সেই সেনাবাহিনীর মূল ভিত্তিতে বারবার আঘাত হানে? কারা জাতিকে দিকভ্রান্ত করে, দিশাহারা করে? কিন্তু কী বিচিত্র বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারা!
আজ ষোলোই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বিজয় দিবসের প্রভাত সূর্যকে স্বাগত জানাই। তার আলোচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ুক সারা বাংলার মাটিতে। মুক্ত হোক, নির্মল হোক বাংলার অবরুদ্ধ বায়ু। স্রোত হারানো বাংলার সকল স্রোতস্বিনী—তিস্তা, করোতোয়া, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কুশিয়ারা, বরাক, সুরমা ফিরে পাক তাদের স্রোতধারা। বাঁধ ভেঙে কুল ছাপিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাক সব নদ-নদী। বাংলার সাগর তাই তো সে বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর হোক সীমাহীন, দিগন্ত বিস্তৃত, সুরক্ষিত, একচ্ছত্র শুধু বাংলার। বাংলার আকাশ দিনের আলোয় হোক নীলিমায় নীল, আর রাতে লাখো কোটি তারার আলোয় হোক ঝলমলে। উত্তর আকাশের জ্বলজ্বল করা ধ্রুবতারাটিকে বাংলার দিশাহীন মানুষ প্রত্যক্ষ করুক, সহজেই চিনে নিক, দিশা পাক। নব উদ্যমে, নব প্রত্যয়ে, নব প্রত্যাশায় আমরা সকলে হাত ধরাধরি করে একসঙ্গে বিজয় দিবসের আজকের এই দিনে স্বাধীনতাটাকে আবিষ্কার করি, সোনার বাংলা গড়ি।
লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান (অব.): সাবেক সেনাপ্রধান।

No comments

Powered by Blogger.