সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থী-৬১ জেলায় প্রশাসক নিয়োগ

স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণের কফিনে আরেকটি পেরেক ঠুকল আমাদের বাহাদুর সরকার। জনমত যাচাইয়ের কোনো তোয়াক্কাই তারা করল না। ঢাকা ভাগের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের মতোই বিনামেঘে তারা আরেকটি বজ্রপাত ঘটাল। কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা না করেই দেশের ৬১ জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগের দলীয় ব্যক্তিদের প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট জেলাবাসী জানতে পারল যে তাদের ওপর নতুন প্রশাসক নাজেল হয়ে গেছেন।


অবশ্য এর ফলে তাদের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। কারণ তোপখানা রোডের সচিবালয়সর্বস্ব যে জনপ্রশাসন জনগণকে অক্টোপাসের মতো আটকে রেখেছে তা থেকে মুক্তি নেই। বরং নবনিযুক্ত প্রশাসকেরা জনজীবনের নতুন উপদ্রব হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে জেলা পরিষদকে কখনোই জনপ্রশাসন পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করা হয়নি। সামরিক শাসকদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে স্থানীয় সরকারে নিজেদের লোক বসানোর চেষ্টা করা। আইয়ুব-জিয়া ও এরশাদ সবাই অভিন্ন প্রবণতা দেখিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা দিয়ে সাংসদদের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করার মূলে ছিল হালুয়ারুটি বিলানোর রাজনৈতিক ধারায় জলসিঞ্চন। এসব চেয়ারম্যানের ক্ষমতায়ন করা হয়েছিল ডেপুটি কমিশনারদের সর্বময় ক্ষমতা বজায় রেখেই। ওই একই ধারাবাহিকতায় উপজেলা চেয়ারম্যানদের বিরোধিতা সত্ত্বেও উপজেলা পরিষদে সাংসদদের মাতব্বরি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে এবার জেলা পরিষদকে ঘিরে একপ্রকার মৌলিক গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ঘটতে চলেছে বলে প্রতীয়মান। নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধি ও বর্ধিত সেবার দোহাই দিয়ে ঢাকাকে দুটি সিটি করপোরেশনে বিভক্ত করা হয়েছে। এর পেছনে যে সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে এই মুহূর্তে জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা দুটি। একটি সাংবিধানিক এবং অন্যটি সুপ্রিম কোর্টের রায়। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ ১৫২ অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রতিটি জেলাই ‘প্রশাসনিক একাংশ’। জেলা পরিষদগুলোও প্রশাসনের অংশ। সে কারণে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রশাসক নিয়োগ করায় সংবিধানের লঙ্ঘন ঘটেছে।
অন্যদিকে কুদরত-ই ইলাহি বনাম বাংলাদেশ মামলায় ১৯৯২ সালের জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দিয়েছিলেন যে ছয় মাসের মধ্যে জেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের সকল স্তর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠন সম্পন্ন করতে হবে। প্রায় ২০ বছর পর ক্ষমতাসীন দল ওই রায় উপেক্ষা করে ৬১ জেলায় প্রশাসক নিয়োগ দিল। সে কারণে এই সিদ্ধান্তের বৈধতা আদালতে যাচাইযোগ্য।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে যদি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ মডেলে পরোক্ষ নির্বাচন করা হয়, তাহলে এখন কেন চুপিসারে ৬১ জেলায় প্রশাসক নিয়োগের প্রয়োজন পড়ল তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
সরকারি দল ক্রমশ হঠকারিতাপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দিকে ঝুঁকছে, যা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়।

No comments

Powered by Blogger.