তিউনিসিয়ার নির্বাচন ও রাজনীতি- by আবু এন এম ওয়াহিদ
প্রায় ১০ মাস আগে তিউনিসিয়ায় ঘটে যায় তথাকথিত জেসমিন বিপ্লব। বিপ্লবের শেষদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে স্বৈরাচারী শাসক জাইন এল আবেদিন বেন আলী জানুয়ারির ১৪ তারিখ সৌদি আরব পালিয়ে যান। তারপর মাত্র ৯ মাসের মধ্যে দেশটিতে হয়ে গেল প্রথম সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে দেশে এবং বিদেশে অবস্থানরত তিউনিসিয়ার চার লাখের বেশি ভোটার অংশ নেয়। নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ২১৭ সদস্যের একটি পার্লামেন্ট গঠন করছে।
নবনির্বাচিত এই সংসদের দায়িত্ব প্রথমে দেশের জন্য একজন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ ও একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা এবং পরে তিউনিসিয়ার জন্য স্থায়ী সংবিধান তৈরি করা। নির্বাচনে ছোট-বড় ৮০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। তবে এই নিবন্ধ লেখার সময় পর্যন্ত প্রকাশিত ফলাফলে দেখা যায়, বড় পাঁচটি দল ৮০ শতাংশের অধিক সিট পেয়েছে। পাঠক-পাঠিকারা যখন লেখাটি পড়বেন তখন হয়তোবা পূর্ণ ফল বেরিয়ে যাবে এবং এতে ফলাফলের দলীয় অবস্থানে দেখা দিতে পারে সামান্য হেরফের।
নির্বাচনে যে পাঁচটি দল বেশি আসন পেয়ে অন্য সব দলের চেয়ে এগিয়ে আছে, তাদের মধ্যে প্রথম হলো আন্ নাহ্দা (অর্থাৎ পুনর্জাগরণ বা জেগে ওঠা)। আন্ নাহ্দা একটি মধ্যপন্থী ইসলামী দল। বেন আলির স্বৈরাচারী আমলে এই দল বেআইনি ছিল। নির্বাচনে এ পর্যন্ত তারা পেয়েছে সবচেয়ে বেশি সিট অর্থাৎ ৯০টি আসন। এই দলের মূল নেতা রশিদ ঘানুচি এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি হামদি জেবেলি। জেবেলি এখন প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার। আন্ নাহ্দার জয়লাভে অনেকে আশঙ্কা করছেন, দেশে আগামীতে সিভিল রাইটস এবং নারী অধিকার খর্ব হতে পারে, যদিও আন্ নাহ্দা এ রকম কোনো কথা নির্বাচনী প্রচারে ঘুণাক্ষরেও বলেনি। নির্বাচনী প্রচারে তারা শরিয়াহ আইনের কথাও কিছু বলেনি। বরং বলেছে, নির্বাচনে জিতলে তারা সব ধর্মের প্রতি সমান মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করবে। দেশের শিক্ষা, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমানাধিকার সমুন্নত রাখবে। দেশে এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদের পক্ষে তাদের অবস্থানও তারা পরিষ্কার করেছে। আন্ নাহ্দার প্রস্তাব_জাতীয় সংসদ পাঁচ বছর মেয়াদের একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে, যে কি না দুই টার্মের বেশি নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না। তারা সামাজিক গৃহায়ণ, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং নূ্যনতম মজুরি বাড়ানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আন্ নাহ্দা পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থের খাতিরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার পক্ষে। তারা ২০১৬ সালের মধ্যে তিউনিসিয়ায় পাঁচ লাখ ৯০ হাজার যুবকের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকার সমস্যা ১৬ থেকে ৮.৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। তারা তিউনিসিয়ার জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে চায়। আন্ নাহ্দার নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী দল সেক্যুলারিস্ট সংগঠন কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক পেয়েছে ৩০টি আসন। আন্ নাহ্দার মতো এই দলও বেন আলীর যুগে নিষিদ্ধ ছিল। কংগ্রেস ফর দ্য রিপাবলিক একটি জাতীয়তাবাদী বামপন্থী দল। তাদের নির্বাচনী এজেন্ডা ছিল ব্যাংকগুলোর ওপর রাষ্ট্রের অধিক নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করা, মানুষে মানুষে আয়বৈষম্য দূর করা, সারা দেশে কৃষি সমবায় চালু করা এবং ভ্যাটের হার কমানো। সমাজবাদী দল হিসেবে তারা অর্থনীতির ওপর রাষ্ট্রের কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। তারা সিভিল রাইটস, নারী-পুরুষের সমতা এবং স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থার পক্ষপাতী। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সপক্ষে জোরালো তাদের অবস্থান। তারা শ্যাভেজ বিশ্বায়নের কড়া সমালোচক এবং সুষম আন্তর্জাতিক উন্নয়নের সপক্ষে। তারা চায় তিউনিসিয়ার জাতীয় পার্লামেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে।
নির্বাচনে তৃতীয় শক্তিশালী দল হিসেবে উঠে আসে এত্তোকাতল। এটাও একটি মধ্য-বামপন্থী সেক্যুলার দল। এর নেতা হলেন মুস্তাফা বেন জাফর। তিনি ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন। বেন আলীর সময়ে তাঁর দলও আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল। কিন্তু অন্য আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির চেয়ে জাফরের একটা বাড়তি সুবিধা ছিল। তাঁর মালিকানায় ছিল একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য জনগণের মধ্যে সহজে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। এই দল নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা পাবলিক ওয়ার্কসের মাধ্যমে এক বছরে কম করে হলেও এক লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টি করবে। তাদের এজেন্ডার অংশ হলো_আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ, শহর এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্যে দূরত্ব দূর করা। তারা পেয়েছে মাত্র ২১টি আসন। বিগত নির্বাচনে পপুলার পিটিশন ফর জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি চতুর্থ বড় দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দলের নেতার নাম হেকমি হামদি। তিনি একজন বিত্তবান লন্ডন প্রবাসী ব্যবসায়ী। অনেকে মনে করেন, বেন আলীর সঙ্গে রয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। এই দল ১৯টি সিট পেয়ে চতুর্থ স্থান দখল করেছে। আর্থিক অনিয়মের কারণে হামদি ছয়টি নির্বাচনী ডিস্ট্রিক্ট থেকে তাঁর প্রার্থীদের প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। তথাপি নির্বাচনে তাঁর দলের সাফল্য অনেকের কাছেই চমকপ্রদ লাগছে। এই দল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এবং রুটির দামে ব্যাপক হারে সরকারি সাবসিডি দেবে। সমাজসেবার বিনিময়ে চালু করবে বেকারভাতা। হামদি লন্ডনে বসে তাঁর দলের কাজকর্ম এবং প্রচার-প্রপাগান্ডা চালান তাঁরই মালিকানাধীন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল আল্ মুস্তালিকা থেকে। তার পরের দল প্রগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টি। তারা ১৭টি সিট পেয়ে হয়েছে পঞ্চম। এর নেত্রী একজন মহিলা। তাঁর নাম মায়া জিবরি। তাদের মূল এজেন্ডা ছিল শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া। তারা আধুনিক ইসলামে বিশ্বাসী। ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত তিউনিসিয়ার জাতীয় নির্বাচনে আন্ নাহ্দার জয়লাভ আগামীতে মিসর এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের জাতীয় নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর পক্ষে প্রভাব ফেলতে পারে বলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেইট ইউনিভার্সিটি এবং এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
awahid@tnstate.edu
No comments