বিবিসির আলোচনায় বিশেষজ্ঞদের অভিমত-অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল সমর্থনযোগ্য হবে না
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সরকার উৎখাতের এক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার বিবিসির ঢাকা স্টুডিওর আলোচনায় অংশ নেন রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রব খান। আলোচনার বিবরণ সমকাল পাঠকদের জন্য তুলে দেওয়া হলো।
বিবিসি : শুরুতেই যাচ্ছি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের অনেক ইতিহাস আগে হয়েছে, এখন বলা হচ্ছে আবারও এরকম একটা চেষ্টা হচ্ছে। এটা কতটা উদ্বেগজনক বাংলাদেশের রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতার জন্য?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :আমার কাছে এটি খুব বড় উদ্বেগের ঘটনা বলে মনে হয়নি। কারণ সেনা সদরে যখন ব্রিগেডিয়ার মাসুদ রাজ্জাক প্রেস ব্রিফিং করছিলেন_ তার কথা শুনে মনে হলো মাত্র কয়েকজন সেনাসদস্য এর সঙ্গে জড়িত, যারা আবার অবসরে আছেন। ফলে তাদের এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর মতো অস্ত্র বা সুযোগ-সুবিধা ছিল বলে মনে হয় না। উদ্বেগ অন্য কারণে, উগ্রবাদী অনুপ্রবেশ আমাদের একটি শক্তিশালী বাহিনীর মধ্যে, একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর মধ্যে_ এটি উদ্বেগের বিষয়। এই উগ্রবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দেখেছি, বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যে দেখেছি। এই ধরনের প্রয়াস হলে, যদি বড় কিছু একটা হয়ে যায়, তবে তা আমাদের জন্য একটা দুঃখের বিষয় হবে।
বিবিসি : আবদুর রব খান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যেটা বলছিলেন, সেনাবাহিনীর ভেতরে এই উগ্রপন্থিদের অনুপ্রবেশের একটা প্রচেষ্টা চলছে। আমরা জানি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এই ধরনের অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। তাদের ভেতরে এই ধরনের প্রবণতা রয়েছে। তো বাংলাদেশেও কি এই ধরনের কিছু ঘটতে যাচ্ছে? আপনার কী মনে হয়?
আবদুর রব খান : এখন যেভাবে যে পর্যায়ে এটা দেখা গেছে, মনে হয় না যে পাকিস্তানের মতো ওই ধরনের সমস্যা ও পরিস্থিতি আমরা অদূর ভবিষ্যতে ফেইস করতে যাব। তবে যেটা ড. মনজুরুল ইসলাম বলছিলেন, যে উগ্র আদর্শবাদ সেটা যদি অনুপ্রবেশ করে, তার সঙ্গে যদি আরেকটা জিনিস যোগ করতে চাই_ একজন প্রবাসী বাংলাদেশি এবং আর কতজন আছে তা আমরা জানি না। প্রবাসী বাংলাদেশির সংযোগ, এর সঙ্গে বিদেশি টাকা, বিদেশি ভাবধারা এবং টেকনোলজির সংযোগে এটা ঘটতে পারে। সেটাও কিন্তু একটা ডাইমেনশন যোগ করে। তারা অল্প কয়েকজন কিন্তু যদি এটা সফল প্রচেষ্টা হতো এবং ভবিষ্যতে তাদের কর্মকাণ্ডকে আরও এগিয়ে নিত তাহলে অবশ্যই উদ্বেগের কারণ বলে বিবেচিত হতো।
বিবিসি : কিন্তু এই ধরনের বাহিনীগুলো যদি সেনাবাহিনীর মতো একটা ডিসিপ্লিনড ফোর্স, তার মধ্যে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে, তবে সেটা প্রতিরোধ করার জন্য কী করা যেতে পারে, বাংলাদেশের জন্য কী করা সম্ভব?
আবদুর রব খান : এটার জন্য ডেফিনিটলি ইন্টেলিজেন্সকে আরও অ্যাকটিভেট করা এবং সমন্বিত ইন্টেলিজেন্স ব্যবস্থা। এ ছাড়াও আমার মনে হয় যে, সজাগ মিডিয়া এবং সজাগ সিভিল সোসাইটি, এগুলোও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা জানি, হিযবুত তাহ্রীরের নাম এসেছে, ইদানীং আমাদের মিডিয়ায় প্রচুর খবর দেখছি, তাদের অ্যাকটিভিটিজ এবং মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি বেশ সজাগ ভূমিকা পালন করছে। ইন্টেলিজেন্স যেভাবে কার সঙ্গে কার যোগাযোগ, কোথা থেকে কী ঘটছে, যেভাবে লিঙ্ক করতে পেরেছে, এতে বোঝা যায় তারাও বেশ ইফেক্টিভলি কাজ করেছে।
বিবিসি :সেনাবাহিনী আজ যে বক্তব্য দিয়েছে, তারা বলেছে, যখন এসব ঘটনা ঘটছে তখন বাংলাদেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলও এদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভিযোগ করেছে_ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারকে গুম করা হয়েছে। আপনার কী মনে হয়? এই যে অভিযোগ এর
কী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :প্রভাব খুব বড় হবে বলে মনে হয় না। তবে আমার মনে হয় যে, বিরোধদলীয় নেত্রী আরও একটু খোঁজখবর নিয়ে মন্তব্য করলে ভালো হতো। তবে আমি বিশ্বাস করি এবং আজকের প্রেস ব্রিফিং যেটা প্রমাণ করেছে, সবগুলো যদি স্বচ্ছভাবে মোকাবেলা করা যায়, যদি দেশবাসীকে আস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিষয়গুলো নিয়ে যদি খোলামেলা আলোচনা হয়, তাহলে ড. রব খান যে কথাগুলো বললেন তা আরও শক্তিশালী হবে। শুধু ইন্টেলিজেন্সকে শক্তিশালী করে এ বিষয়গুলো আমরা মোকাবেলা করতে পারব না। সে জন্য দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে নামতে হবে। মিডিয়াকে আস্থায় নিতে হবে, সুশীল সমাজকে আস্থায় নিতে হবে। আজকের প্রেস ব্রিফিং প্রমাণ করে যে, আসলেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের মনে রাখতে হবে, এ ধরনের উগ্রবাদ দেশের খুব কমসংখ্যক মানুষই সমর্থন করে। বৃহৎ সংখ্যক মানুষ গণতান্ত্রিক ও প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারী এবং এ বিষয়গুলো এভাবেই নিষ্পত্তি
হতে পারে।
বিবিসি :সেনাবাহিনীর ভেতরে অতীতে যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে আড়াল করা বা চেপে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আজকে আমরা দেখছি একেবারে উল্টো। সেনাবাহিনী আগ বাড়িয়ে জানাচ্ছে এবং সবিস্তারে গণমাধ্যমকে অবহিত করছে। পরিবর্তনটা আসলে কী হয়েছে যাতে সেনাবাহিনীকে এ বিষয়ে এতটা খোলামেলা আলোচনা করতে হয়েছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :আমার মনে হয়েছে, পরিবর্তনটা খুব আস্তে আস্তে হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের যে বিশ্বাস ও আস্থা সে বিষয়ে দেশবাসী ঐকমত্য হয়েছে। আর কয়েক বছর আগে বিডিআরে যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল, তারপর থেকেই সেনাবাহিনী উপলব্ধি করেছে, এ বিষয়গুলো দেশবাসীকে জানানো উচিত। এ স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত। আর মাঝখানে ওয়ান-ইলেভেনে যে ঘটনা ঘটল সেখানে দেখা যায় যে, কিছু উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তার জন্য সামরিক বাহিনীকে বদনামের ভাগীদার হতে হয়েছে। এ বিষয়গুলো তাদেরও সতর্ক করেছে। সাধারণ মানুষকে আস্থায় নিয়ে, দেশবাসীকে আস্থায় নিয়ে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে হবে। আমার মনে হয়, এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি বিজয়।
বিবিসি : আবদুর রব খান, এই ঘটনার কী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে? বাংলাদেশে বিভক্তি যেখানে, বড় রাজনৈতিক দলগুলো কোনো বিষয়ে একমত হতে পারে না, সেখানে সেনাবাহিনীরও একটা ইঙ্গিত আছে যে, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এ ধরনের সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। এমন একটা অবস্থায় রাজনীতিতে এর কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
আবদুর রব খান : প্রথমত আমরা যদি সরকারের প্রেক্ষিতও দেখি, রাজনীতিতে যে বিভাজন এবং সরকার ওভারঅল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে চাপের মুখে আছে, কাজেই এই পরিস্থিতিতে যে ঘটনা ঘটছে বা সেখানে সরকার যে পজিশন নিল এবং এটা প্রকাশ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বা স্বচ্ছতার মাধ্যমে জনসমক্ষে আনল, তাতে সরকারের ক্রেডিবিলিটি আরও বেড়ে যাবে। এখন এটার রিঅ্যাকশন অর্থাৎ বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া নিয়ে, যেটা নিয়ে কিছুক্ষণ আগে আলোচনা হচ্ছিল, অন্য ইস্যুতে শত বিভাজন সত্ত্বেও এই ইস্যুতে যদি বিরোধী দল এই ঘটনায় নিন্দা জানাত বা সরকারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করত, তবে বিষয়টা রাজনীতিতে সামান্য হলেও মোড় নিয়ে আনতে পারত। আরেকটা জিনিস আমি বলব যে, এই মুহূর্তে ঘটনা যা ঘটল, ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, কিছু কিছু জঙ্গিবাদ যেমন হুজি, হিযবুত তাহ্রীর এরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, কাজেই সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনাটা_ জঙ্গিবাদ সম্পর্কে আমাদের আরও অ্যাকটিভ হতে হবে, সেই সতর্কতা আমাদের মধ্যে জাগাতে হবে আর গণতন্ত্রের যে স্বচ্ছতা, বিশ্বাসযোগ্যতা তা ভালোভাবেই ভূমিকা রেখেছে। সরকার জনগণকে আরও আস্থায় নেওয়ার জন্য জনগণকে আরও ডিটেল জানিয়েছে, সেটা ভালো কাজ হয়েছে বলে আমি মনে করি। আর সামগ্রিকভাবে বলতে হবে, আমরা দুই কিস্তিতে সামরিক শাসনের মধ্যে ছিলাম, ২০০৭ সালেও আমরা প্রায় সামরিক সরকারের কাছে গিয়ে ফিরে এসেছি। সেখানে এমন একটা ঘটনা আমাদের গণতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করতে পারত, যত ছোটই হোক না কেন এবং উন্নয়ন ও নিরাপত্তাও বিঘি্নত হতে পারত। কাজেই সেদিক দিয়ে অনেকটা স্বস্তির কারণও বলা যায়।
বিবিসি : অধ্যাপক মনজুর, আপনারও কি তাই মনে হয় যে, বাংলাদেশে উগ্রবাদের যে ঝুঁকি পরাস্ত করা গেছে সেই ঝুঁকি আবারও কি ফিরে আসছে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমার বিশ্বাস, আমরা ধর্মীয় উগ্রবাদকে মোটামুটি ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছি। আর যেটুকু ঘটেছে তাকে আমরা উগ্রবাদীদের শেষ প্রচেষ্টা বলতে পারি, যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, বিরোধী দলকে সেই যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের এখন এই বিরোধী দলকে বলতে হবে, এই ইস্যুতে অন্তত সরকারের প্রতি তারা যেন সহমর্মিতা দেখায়।
বিবিসি : আপনার কী মনে হয়, বিরোধী দলের সভানেত্রী যে কথা বলেছেন অর্থাৎ সেনাবাহিনীর অফিসারদের গুম করা হচ্ছে, পুরো বিষয়টি না জেনে মন্তব্য করা কি সমীচীন হয়নি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :না, সমীচীন হয়নি। তবে তিনি হয়তো সরকারের অধীনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে সেটাকে একটু নাটকীয়ভাবে বলার উদ্দেশ্য ছিল তার। যেভাবেই তিনি বলে থাকেন না কেন, সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিং ও তদন্তের বিষয় থেকে উভয় দলকেই জ্ঞান নিতে হবে। এই বার্তাটি হচ্ছে সব ক্ষেত্রে যাতে দেশের স্বার্থ নিশ্চিত হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে এবং গণতন্ত্রের প্রতি যত ধরনের হুমকিই আসুক না কেন তা মোকাবেলা করতে হবে। ফলে আমাদের দেখাতে হবে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করার কোনো উপায় যাতে বাংলাদেশে না থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকার ভালো হতে পারে, মন্দ হতে পারে; কিন্তু সরকার বদলের একমাত্র বৈধ পথ হচ্ছে নির্বাচন। বিষয়গুলো যদি আমাদের সকলের ভেতর ঐকমত্য তৈরি করে, তাহলেও হয়তো এ ধরনের প্রয়াস গোড়াতেই বিফল হতে পারত।
স্থিতিশীলতার জন্য?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :আমার কাছে এটি খুব বড় উদ্বেগের ঘটনা বলে মনে হয়নি। কারণ সেনা সদরে যখন ব্রিগেডিয়ার মাসুদ রাজ্জাক প্রেস ব্রিফিং করছিলেন_ তার কথা শুনে মনে হলো মাত্র কয়েকজন সেনাসদস্য এর সঙ্গে জড়িত, যারা আবার অবসরে আছেন। ফলে তাদের এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর মতো অস্ত্র বা সুযোগ-সুবিধা ছিল বলে মনে হয় না। উদ্বেগ অন্য কারণে, উগ্রবাদী অনুপ্রবেশ আমাদের একটি শক্তিশালী বাহিনীর মধ্যে, একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর মধ্যে_ এটি উদ্বেগের বিষয়। এই উগ্রবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দেখেছি, বিভিন্ন পেশাজীবীর মধ্যে দেখেছি। এই ধরনের প্রয়াস হলে, যদি বড় কিছু একটা হয়ে যায়, তবে তা আমাদের জন্য একটা দুঃখের বিষয় হবে।
বিবিসি : আবদুর রব খান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যেটা বলছিলেন, সেনাবাহিনীর ভেতরে এই উগ্রপন্থিদের অনুপ্রবেশের একটা প্রচেষ্টা চলছে। আমরা জানি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এই ধরনের অভিযোগ প্রায়ই ওঠে। তাদের ভেতরে এই ধরনের প্রবণতা রয়েছে। তো বাংলাদেশেও কি এই ধরনের কিছু ঘটতে যাচ্ছে? আপনার কী মনে হয়?
আবদুর রব খান : এখন যেভাবে যে পর্যায়ে এটা দেখা গেছে, মনে হয় না যে পাকিস্তানের মতো ওই ধরনের সমস্যা ও পরিস্থিতি আমরা অদূর ভবিষ্যতে ফেইস করতে যাব। তবে যেটা ড. মনজুরুল ইসলাম বলছিলেন, যে উগ্র আদর্শবাদ সেটা যদি অনুপ্রবেশ করে, তার সঙ্গে যদি আরেকটা জিনিস যোগ করতে চাই_ একজন প্রবাসী বাংলাদেশি এবং আর কতজন আছে তা আমরা জানি না। প্রবাসী বাংলাদেশির সংযোগ, এর সঙ্গে বিদেশি টাকা, বিদেশি ভাবধারা এবং টেকনোলজির সংযোগে এটা ঘটতে পারে। সেটাও কিন্তু একটা ডাইমেনশন যোগ করে। তারা অল্প কয়েকজন কিন্তু যদি এটা সফল প্রচেষ্টা হতো এবং ভবিষ্যতে তাদের কর্মকাণ্ডকে আরও এগিয়ে নিত তাহলে অবশ্যই উদ্বেগের কারণ বলে বিবেচিত হতো।
বিবিসি : কিন্তু এই ধরনের বাহিনীগুলো যদি সেনাবাহিনীর মতো একটা ডিসিপ্লিনড ফোর্স, তার মধ্যে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে, তবে সেটা প্রতিরোধ করার জন্য কী করা যেতে পারে, বাংলাদেশের জন্য কী করা সম্ভব?
আবদুর রব খান : এটার জন্য ডেফিনিটলি ইন্টেলিজেন্সকে আরও অ্যাকটিভেট করা এবং সমন্বিত ইন্টেলিজেন্স ব্যবস্থা। এ ছাড়াও আমার মনে হয় যে, সজাগ মিডিয়া এবং সজাগ সিভিল সোসাইটি, এগুলোও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা জানি, হিযবুত তাহ্রীরের নাম এসেছে, ইদানীং আমাদের মিডিয়ায় প্রচুর খবর দেখছি, তাদের অ্যাকটিভিটিজ এবং মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি বেশ সজাগ ভূমিকা পালন করছে। ইন্টেলিজেন্স যেভাবে কার সঙ্গে কার যোগাযোগ, কোথা থেকে কী ঘটছে, যেভাবে লিঙ্ক করতে পেরেছে, এতে বোঝা যায় তারাও বেশ ইফেক্টিভলি কাজ করেছে।
বিবিসি :সেনাবাহিনী আজ যে বক্তব্য দিয়েছে, তারা বলেছে, যখন এসব ঘটনা ঘটছে তখন বাংলাদেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলও এদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভিযোগ করেছে_ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারকে গুম করা হয়েছে। আপনার কী মনে হয়? এই যে অভিযোগ এর
কী প্রভাব পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :প্রভাব খুব বড় হবে বলে মনে হয় না। তবে আমার মনে হয় যে, বিরোধদলীয় নেত্রী আরও একটু খোঁজখবর নিয়ে মন্তব্য করলে ভালো হতো। তবে আমি বিশ্বাস করি এবং আজকের প্রেস ব্রিফিং যেটা প্রমাণ করেছে, সবগুলো যদি স্বচ্ছভাবে মোকাবেলা করা যায়, যদি দেশবাসীকে আস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিষয়গুলো নিয়ে যদি খোলামেলা আলোচনা হয়, তাহলে ড. রব খান যে কথাগুলো বললেন তা আরও শক্তিশালী হবে। শুধু ইন্টেলিজেন্সকে শক্তিশালী করে এ বিষয়গুলো আমরা মোকাবেলা করতে পারব না। সে জন্য দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে নামতে হবে। মিডিয়াকে আস্থায় নিতে হবে, সুশীল সমাজকে আস্থায় নিতে হবে। আজকের প্রেস ব্রিফিং প্রমাণ করে যে, আসলেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের মনে রাখতে হবে, এ ধরনের উগ্রবাদ দেশের খুব কমসংখ্যক মানুষই সমর্থন করে। বৃহৎ সংখ্যক মানুষ গণতান্ত্রিক ও প্রাগ্রসর চিন্তার অধিকারী এবং এ বিষয়গুলো এভাবেই নিষ্পত্তি
হতে পারে।
বিবিসি :সেনাবাহিনীর ভেতরে অতীতে যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে আড়াল করা বা চেপে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। আজকে আমরা দেখছি একেবারে উল্টো। সেনাবাহিনী আগ বাড়িয়ে জানাচ্ছে এবং সবিস্তারে গণমাধ্যমকে অবহিত করছে। পরিবর্তনটা আসলে কী হয়েছে যাতে সেনাবাহিনীকে এ বিষয়ে এতটা খোলামেলা আলোচনা করতে হয়েছে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :আমার মনে হয়েছে, পরিবর্তনটা খুব আস্তে আস্তে হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের যে বিশ্বাস ও আস্থা সে বিষয়ে দেশবাসী ঐকমত্য হয়েছে। আর কয়েক বছর আগে বিডিআরে যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল, তারপর থেকেই সেনাবাহিনী উপলব্ধি করেছে, এ বিষয়গুলো দেশবাসীকে জানানো উচিত। এ স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত। আর মাঝখানে ওয়ান-ইলেভেনে যে ঘটনা ঘটল সেখানে দেখা যায় যে, কিছু উচ্চাভিলাষী সামরিক কর্মকর্তার জন্য সামরিক বাহিনীকে বদনামের ভাগীদার হতে হয়েছে। এ বিষয়গুলো তাদেরও সতর্ক করেছে। সাধারণ মানুষকে আস্থায় নিয়ে, দেশবাসীকে আস্থায় নিয়ে এ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে হবে। আমার মনে হয়, এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি বিজয়।
বিবিসি : আবদুর রব খান, এই ঘটনার কী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে? বাংলাদেশে বিভক্তি যেখানে, বড় রাজনৈতিক দলগুলো কোনো বিষয়ে একমত হতে পারে না, সেখানে সেনাবাহিনীরও একটা ইঙ্গিত আছে যে, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এ ধরনের সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে। এমন একটা অবস্থায় রাজনীতিতে এর কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
আবদুর রব খান : প্রথমত আমরা যদি সরকারের প্রেক্ষিতও দেখি, রাজনীতিতে যে বিভাজন এবং সরকার ওভারঅল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে চাপের মুখে আছে, কাজেই এই পরিস্থিতিতে যে ঘটনা ঘটছে বা সেখানে সরকার যে পজিশন নিল এবং এটা প্রকাশ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বা স্বচ্ছতার মাধ্যমে জনসমক্ষে আনল, তাতে সরকারের ক্রেডিবিলিটি আরও বেড়ে যাবে। এখন এটার রিঅ্যাকশন অর্থাৎ বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া নিয়ে, যেটা নিয়ে কিছুক্ষণ আগে আলোচনা হচ্ছিল, অন্য ইস্যুতে শত বিভাজন সত্ত্বেও এই ইস্যুতে যদি বিরোধী দল এই ঘটনায় নিন্দা জানাত বা সরকারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করত, তবে বিষয়টা রাজনীতিতে সামান্য হলেও মোড় নিয়ে আনতে পারত। আরেকটা জিনিস আমি বলব যে, এই মুহূর্তে ঘটনা যা ঘটল, ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, কিছু কিছু জঙ্গিবাদ যেমন হুজি, হিযবুত তাহ্রীর এরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, কাজেই সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনাটা_ জঙ্গিবাদ সম্পর্কে আমাদের আরও অ্যাকটিভ হতে হবে, সেই সতর্কতা আমাদের মধ্যে জাগাতে হবে আর গণতন্ত্রের যে স্বচ্ছতা, বিশ্বাসযোগ্যতা তা ভালোভাবেই ভূমিকা রেখেছে। সরকার জনগণকে আরও আস্থায় নেওয়ার জন্য জনগণকে আরও ডিটেল জানিয়েছে, সেটা ভালো কাজ হয়েছে বলে আমি মনে করি। আর সামগ্রিকভাবে বলতে হবে, আমরা দুই কিস্তিতে সামরিক শাসনের মধ্যে ছিলাম, ২০০৭ সালেও আমরা প্রায় সামরিক সরকারের কাছে গিয়ে ফিরে এসেছি। সেখানে এমন একটা ঘটনা আমাদের গণতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করতে পারত, যত ছোটই হোক না কেন এবং উন্নয়ন ও নিরাপত্তাও বিঘি্নত হতে পারত। কাজেই সেদিক দিয়ে অনেকটা স্বস্তির কারণও বলা যায়।
বিবিসি : অধ্যাপক মনজুর, আপনারও কি তাই মনে হয় যে, বাংলাদেশে উগ্রবাদের যে ঝুঁকি পরাস্ত করা গেছে সেই ঝুঁকি আবারও কি ফিরে আসছে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমার বিশ্বাস, আমরা ধর্মীয় উগ্রবাদকে মোটামুটি ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছি। আর যেটুকু ঘটেছে তাকে আমরা উগ্রবাদীদের শেষ প্রচেষ্টা বলতে পারি, যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, বিরোধী দলকে সেই যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলেই মনে হচ্ছে। আমাদের এখন এই বিরোধী দলকে বলতে হবে, এই ইস্যুতে অন্তত সরকারের প্রতি তারা যেন সহমর্মিতা দেখায়।
বিবিসি : আপনার কী মনে হয়, বিরোধী দলের সভানেত্রী যে কথা বলেছেন অর্থাৎ সেনাবাহিনীর অফিসারদের গুম করা হচ্ছে, পুরো বিষয়টি না জেনে মন্তব্য করা কি সমীচীন হয়নি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :না, সমীচীন হয়নি। তবে তিনি হয়তো সরকারের অধীনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে সেটাকে একটু নাটকীয়ভাবে বলার উদ্দেশ্য ছিল তার। যেভাবেই তিনি বলে থাকেন না কেন, সেনাবাহিনীর প্রেস ব্রিফিং ও তদন্তের বিষয় থেকে উভয় দলকেই জ্ঞান নিতে হবে। এই বার্তাটি হচ্ছে সব ক্ষেত্রে যাতে দেশের স্বার্থ নিশ্চিত হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে এবং গণতন্ত্রের প্রতি যত ধরনের হুমকিই আসুক না কেন তা মোকাবেলা করতে হবে। ফলে আমাদের দেখাতে হবে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করার কোনো উপায় যাতে বাংলাদেশে না থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। গণতান্ত্রিক সরকার ভালো হতে পারে, মন্দ হতে পারে; কিন্তু সরকার বদলের একমাত্র বৈধ পথ হচ্ছে নির্বাচন। বিষয়গুলো যদি আমাদের সকলের ভেতর ঐকমত্য তৈরি করে, তাহলেও হয়তো এ ধরনের প্রয়াস গোড়াতেই বিফল হতে পারত।
No comments