কালের আয়নায়-আবার ক্যু-চক্রান্ত, আবার একজন মেজর জিয়া? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ক্যু-চক্রান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য গত ২৮ ডিসেম্বর একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে। এটা সেনাবাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তার অপরাধ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর নিজস্ব তদন্ত। কিন্তু এই রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্তের পেছনে যে অসামরিক অশুভ চক্র কাজ করেছে এবং এখনও করছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন ও চক্রান্তের বিষদাঁত উপড়ে ফেলার জন্য সরকারের উদ্যোগে একটি জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন এবং এই তদন্তের পর সঠিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এই 'ক্যান্টনমেন্ট রাজনীতি'র হোতাদের, তারা যতই শক্তিশালী হোক বিচার ও শাস্তি হওয়া দরকার।
বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা আর কতকাল ধৈর্যের পরীক্ষা দেবে? গণতন্ত্রকে বাঁচার স্বার্থে ই এবার প্রত্যাঘাতের নীতি গ্রহণ করতে হবে বাংলাদেশে আবারও একটি সামরিক ক্যু ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল। আবারও একজন মেজর জিয়া (মেজর সৈয়দ মোঃ জিয়াউল হক) এই ব্যর্থ ক্যু-প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি এখন পলাতক। তবে পলাতক অবস্থাতেই ষড়যন্ত্র এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনী তাকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়েছে। তাকেও অবিলম্বে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করা প্রয়োজন। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের সঙ্গে এই নতুন মেজর জিয়াকেও কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে এই রাষ্ট্রদ্রোহী তৎপরতার পেছনে কারা আছে, কারা ইন্ধন জুগিয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য কী ছিল তা জানা যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাব, তিনি বিডিআর বিদ্রোহের মতো অসীম সাহস ও প্রজ্ঞার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকেও ধন্যবাদ জানাব, এবার তারা কোনো 'জিয়া-কুহকে' মজেননি। বরং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি অনুগত থেকে কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেছেন।
ক্যুটি অঙ্কুরেই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, একজন পালের গোদা 'মেজর জিয়া' এখনও পলাতক এবং সক্রিয়। ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, সেসব সেনা কর্মকর্তার দু'একজন ছাড়া অন্যরা সম্ভবত এখনও মুক্ত আছেন (আমার এই লেখা শুরু করার সময় পর্যন্ত তাদের গ্রেফতার হওয়ার খবর পাইনি)। সেনা সদর দফতরের সংবাদ সম্মেলনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাসুদ রাজ্জাক বলেছেন, 'এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত কিছু সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। তদন্ত শেষে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
এই ব্যর্থ ক্যুটি যে কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় বরং একটি সুপরিকল্পিত অভ্যুত্থান চেষ্টা, তা বোঝা যায় এর সঙ্গে একজন জিওসি র্যাঙ্কের সেনা কর্মকর্তার জড়িত থাকার খবরে। গুজব, তিনি হয় গৃহবন্দি অথবা নজরবন্দি আছেন। খবরটি সঠিক হলে বলতে হবে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল দেশে আবার বন্দুকের সাহায্যে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানো এবং সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করা। এই উদ্দেশ্যের কথাটি সেনা সদর দফতরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাকও বলেছেন।
কোনো ক্যু ব্যর্থ করে দেওয়াটা বড় কথা নয়, যদি তার শিকড় উৎপাটন করা না যায়। পাকিস্তানের প্রথম লিয়াকত সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৫০ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল। তা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল আকবরকে অপসারণ করা হয় এবং কয়েকজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাসহ কিছু অসামরিক ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করে বিচারে দণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এই অভ্যুত্থানের পেছনের কার্যকারণ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা হয়নি। নেপথ্যের নায়কদেরও খুঁজে বের করা হয়নি। পরের বছর ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির সেনা দফতরের পাশের মাঠে জনসভায় বক্তৃতাদানরত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে খুলি করে হত্যা করে তার সরকারের পতন ঘটানো হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান ব্যর্থ ক্যুর পেছনে আরও একটি বড় ক্যুর ষড়যন্ত্র আড়াল করা নেই, তা কে বলবে? মেজর জিয়া বর্তমান ক্যু-প্রচেষ্টার একজন ফ্রন্টম্যান হতে পারেন; কিন্তু তার এবং তার সহযোগীদের পেছনে আসল পালের গোদা কারা এবং তাদের রাজনৈতিক মতলব কী ছিল তা ভালোভাবে খুঁজে বের করে দেশবাসীর কাছে মুখোশ খুলে দেওয়া এবং এই পৌনঃপুনিক চক্রান্ত শিকড়সমেত উপড়ে ফেলা প্রয়োজন। নইলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিরাপদ হবে না; রাজনৈতিক সন্ত্রাস বন্ধ হবে না। এই ধরনের ক্যু-চক্রান্ত চলতেই থাকবে। বাংলাদেশে অন্য কোনো পথে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব না হলে এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা থেকে সরকারকে নিবৃত্ত করতে না পারলে সেনাবাহিনীর একাংশকে উস্কে দিয়ে রক্তপাত ঘটিয়ে হলেও বর্তমান সরকারকে উৎখাতের যে চেষ্টা হবে, এটা হালে একেবারে ওপেন-সিক্রেট হয়ে উঠেছিল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই ধারণা, বিএনপি-জামায়াত, হিযবুত তাহ্রীর এবং সেনাবাহিনীতে তাদের অনুগত কিছু সেনা অফিসারের পরিকল্পনাটা ছিল একেবারে ছকবাঁধা। এই ছকবাঁধা কার্যক্রমটিই সরকার এবং সেনাবাহিনী ব্যর্থ করে দিয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের চক্রান্ত যেমন আগে দেশের সামরিক অথবা অসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আঁচ করতে পারেনি, এবার তা হয়নি।
এক শ্রেণীর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের এই ধারণাটি কতটা সঠিক তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে দুয়ে দুয়ে যেমন চার হয়, তেমনি এই ব্যর্থ ক্যুর আগে-পিছে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা কি একেবারে সম্পর্কহীন বলা যায়? গোলাম আযমকে এবার গ্রেফতার করা হবে এটা নিশ্চিত হয়ে উঠতেই বিএনপি-জামায়াতকে আবার মাঠে তৎপর হয়ে উঠতে দেখা যায়। গোলাম আযম নিজেই হুঙ্কার ছাড়েন, তাকে গ্রেফতার করার সাহস সরকারের হবে না। এই হুঙ্কার ছাড়ার খুঁটির জোরটি তার কোথায় ছিল?
বিএনপি নেত্রী এই সময়েই ঘোষণা দেন, তিনি সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করে ঘরে ফিরবেন না। তার কথা ছিল নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা নয়, সরকারকে তিনি উৎখাত করবেন। এই উৎখাত করার পন্থাটা কী তা তিনি বলেননি, কিন্তু এখন অনুমান করা যায়। ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি তিনি ছেড়েছেন, কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের রাজনীতি যে ছাড়েননি, এটা তার পরবর্তী রোডমার্চ শেষে চট্টগ্রামের ভাষণে বোঝা যায়। তিনি বলেন, 'সরকার সামরিক বাহিনীর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর লোক গুম হচ্ছে।' তখন তার বক্তব্যের তাৎপর্যটি তেমন বোঝা যায়নি। এখন বোঝা যাচ্ছে।
আসলে বর্তমান ব্যর্থ ক্যুর তৎপরতা তখন চলছে এবং তা ব্যর্থ হওয়ার আভাস পেয়ে মেজর জিয়া ২৩ ডিসেম্বর পালিয়ে যান। ক্যুর প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে মেজর পদবির এক সেনা কর্মকর্তাকে ৩১ ডিসেম্বর সেনা আইনের ধারায় গ্রেফতার করা হয়। ২৬ ডিসেম্বর মেজর জিয়া একটি তথাকথিত গ্রেফতার ও বর্ণিত সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নির্যাতন সংক্রান্ত একটি বানোয়াট কাহিনী ই-মেইলযোগে প্রচার করেন। দুটি ই-মেইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে প্রচার করা হয়, 'সেনাবাহিনীতে মধ্যম সারির অফিসাররা অচিরেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন। ৮ জানুয়ারি নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর সংগঠন মেজর জিয়ার ইন্টারনেট বার্তাটিকে ভিত্তি করে সামরিক অভ্যুত্থানের উস্কানিমূলক প্রচারপত্র ছড়ায়। ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জনসভায় খালেদা জিয়া সামরিক বাহিনীতে নির্যাতন ও গুমের ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেন। সামরিক বাহিনীকে তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে হয়েছিল।
সেনা দফতরের সংবাদ সম্মেলনেও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক ক্যু ঘটানোর চক্রান্তের বিশদ বিতরণ জানিয়ে বিএনপি বা খালেদা জিয়ার নামোচ্চারণ না করে বলেছেন, '৯ জানুয়ারি একটি রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীতে গুমের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করে, যা সেনাবাহিনীসহ সচেতন নাগরিকদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত উস্কানিমূলক বিতর্কের সৃষ্টি করে।' বলাবাহুল্য, ৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনীকে উস্কানি দিয়ে চট্টগ্রামের জনসভায় ভাষণ দেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। অনেকেরই এখন প্রশ্ন, ডিসেম্বর মাস থেকে সেনাবাহিনীর কিছু লোকের ক্যু ঘটানোর চক্রান্ত, এক সেনা কর্মকর্তার গ্রেফতার, মেজর জিয়ার পলায়ন ইত্যাদি কথা জানা না থাকলে বা এসবের সঙ্গে বিএনপি নেত্রীর যোগাযোগ না থাকলে সামরিক বাহিনীতে ক্যু ব্যর্থ করার জন্য যা অপ্রকাশ্যে ঘটছে, তাকে নির্যাতন ও গুমের ঘটনা হিসেবে সাজিয়ে ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে কী করে তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন? তার সেই ভাষণই এখন তার জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
জানা যায়, এই ব্যর্থ ক্যুর পেছনে বিদেশের কিছু বাংলাদেশির যোগাযোগ ও সহযোগিতা ছিল। তারা কারা তা তদন্ত করে বের করা দরকার। অনেকে সন্দেহ করেন, ব্রিটেনে ও আমেরিকায় জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে এবং ব্রিটেনে তারেক রহমান লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করলেও জামায়াতিদের সঙ্গে যুক্তভাবে সরকারবিরোধী নানা অনিয়মতান্ত্রিক তৎপরতায় লিপ্ত। একাত্তরের কিছু যুদ্ধাপরাধী এখনও ব্রিটেনে ঘাঁটি গেড়ে আছে এবং নানা অপতৎপরতায় জড়িত। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ দেওয়া এবং দুই সরকারের যৌথ কার্যক্রম গ্রহণ।
সেনা দফতরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনের খবরেই জানা যায়, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র সফল করার লক্ষ্যে মেজর জিয়া ৯ ও ১০ জানুয়ারি তার অপারেশন পরিকল্পনার কপি ই-মেইলে চাকরিরত সেনা কর্মকর্তাদের কাছে পাঠান। সেনা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি চলে ১০ ও ১১ জানুয়ারি। খালেদা জিয়া নোবাহিনীর জন্য উস্কানিমূলক বক্তৃতাটি দেন ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জনসভায়। এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠেকায় পড়ে অবশ্য বলেছেন, সেনা অভ্যুত্থানের চক্রান্তের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। সবই প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যা অভিযোগ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের নিন্দা করেছেন। কিন্তু এই ক্যু ঘটানোর চক্রান্তের নিন্দা জানাতে ভুলে গেছেন। থলের বিড়ালটি সম্ভবত লুকোতে চেয়েছেন।
সেনা সদর দফতরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ক্যু-চক্রান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য গত ২৮ ডিসেম্বর একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে। এটা সেনাবাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তার অপরাধ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর নিজস্ব তদন্ত। কিন্তু এই রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্তের পেছনে যে অসামরিক অশুভ চক্র কাজ করেছে এবং এখনও করছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন ও চক্রান্তের বিষদাঁত উপড়ে ফেলার জন্য সরকারের উদ্যোগে একটি জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন এবং এই তদন্তের পর সঠিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এই 'ক্যান্টনমেন্ট রাজনীতি'র হোতাদের তারা যতই শক্তিশালী হোক বিচার ও শাস্তি হওয়া দরকার। বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা আর কতকাল ধৈর্যের পরীক্ষা দেবে? গণতন্ত্রকে বাঁচার স্বার্থেই এবার প্রত্যাঘাতের নীতি গ্রহণ করতে হবে।
লন্ডন, ২০ জানুয়ারি ২০১২, শুক্রবার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাব, তিনি বিডিআর বিদ্রোহের মতো অসীম সাহস ও প্রজ্ঞার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকেও ধন্যবাদ জানাব, এবার তারা কোনো 'জিয়া-কুহকে' মজেননি। বরং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি অনুগত থেকে কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে একটি ভয়াবহ ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করেছেন।
ক্যুটি অঙ্কুরেই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, একজন পালের গোদা 'মেজর জিয়া' এখনও পলাতক এবং সক্রিয়। ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, সেসব সেনা কর্মকর্তার দু'একজন ছাড়া অন্যরা সম্ভবত এখনও মুক্ত আছেন (আমার এই লেখা শুরু করার সময় পর্যন্ত তাদের গ্রেফতার হওয়ার খবর পাইনি)। সেনা সদর দফতরের সংবাদ সম্মেলনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাসুদ রাজ্জাক বলেছেন, 'এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত কিছু সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন। তদন্ত শেষে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
এই ব্যর্থ ক্যুটি যে কোনো আকস্মিক ঘটনা নয় বরং একটি সুপরিকল্পিত অভ্যুত্থান চেষ্টা, তা বোঝা যায় এর সঙ্গে একজন জিওসি র্যাঙ্কের সেনা কর্মকর্তার জড়িত থাকার খবরে। গুজব, তিনি হয় গৃহবন্দি অথবা নজরবন্দি আছেন। খবরটি সঠিক হলে বলতে হবে এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল দেশে আবার বন্দুকের সাহায্যে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটানো এবং সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে ব্যাহত করা। এই উদ্দেশ্যের কথাটি সেনা সদর দফতরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাকও বলেছেন।
কোনো ক্যু ব্যর্থ করে দেওয়াটা বড় কথা নয়, যদি তার শিকড় উৎপাটন করা না যায়। পাকিস্তানের প্রথম লিয়াকত সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৫০ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল। তা ব্যর্থ করে দেওয়া হয়। সেনাপ্রধান জেনারেল আকবরকে অপসারণ করা হয় এবং কয়েকজন শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাসহ কিছু অসামরিক ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করে বিচারে দণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এই অভ্যুত্থানের পেছনের কার্যকারণ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা হয়নি। নেপথ্যের নায়কদেরও খুঁজে বের করা হয়নি। পরের বছর ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির সেনা দফতরের পাশের মাঠে জনসভায় বক্তৃতাদানরত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে খুলি করে হত্যা করে তার সরকারের পতন ঘটানো হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান ব্যর্থ ক্যুর পেছনে আরও একটি বড় ক্যুর ষড়যন্ত্র আড়াল করা নেই, তা কে বলবে? মেজর জিয়া বর্তমান ক্যু-প্রচেষ্টার একজন ফ্রন্টম্যান হতে পারেন; কিন্তু তার এবং তার সহযোগীদের পেছনে আসল পালের গোদা কারা এবং তাদের রাজনৈতিক মতলব কী ছিল তা ভালোভাবে খুঁজে বের করে দেশবাসীর কাছে মুখোশ খুলে দেওয়া এবং এই পৌনঃপুনিক চক্রান্ত শিকড়সমেত উপড়ে ফেলা প্রয়োজন। নইলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিরাপদ হবে না; রাজনৈতিক সন্ত্রাস বন্ধ হবে না। এই ধরনের ক্যু-চক্রান্ত চলতেই থাকবে। বাংলাদেশে অন্য কোনো পথে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব না হলে এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে গ্রেফতার করা থেকে সরকারকে নিবৃত্ত করতে না পারলে সেনাবাহিনীর একাংশকে উস্কে দিয়ে রক্তপাত ঘটিয়ে হলেও বর্তমান সরকারকে উৎখাতের যে চেষ্টা হবে, এটা হালে একেবারে ওপেন-সিক্রেট হয়ে উঠেছিল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই ধারণা, বিএনপি-জামায়াত, হিযবুত তাহ্রীর এবং সেনাবাহিনীতে তাদের অনুগত কিছু সেনা অফিসারের পরিকল্পনাটা ছিল একেবারে ছকবাঁধা। এই ছকবাঁধা কার্যক্রমটিই সরকার এবং সেনাবাহিনী ব্যর্থ করে দিয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের চক্রান্ত যেমন আগে দেশের সামরিক অথবা অসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আঁচ করতে পারেনি, এবার তা হয়নি।
এক শ্রেণীর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের এই ধারণাটি কতটা সঠিক তা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে দুয়ে দুয়ে যেমন চার হয়, তেমনি এই ব্যর্থ ক্যুর আগে-পিছে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা কি একেবারে সম্পর্কহীন বলা যায়? গোলাম আযমকে এবার গ্রেফতার করা হবে এটা নিশ্চিত হয়ে উঠতেই বিএনপি-জামায়াতকে আবার মাঠে তৎপর হয়ে উঠতে দেখা যায়। গোলাম আযম নিজেই হুঙ্কার ছাড়েন, তাকে গ্রেফতার করার সাহস সরকারের হবে না। এই হুঙ্কার ছাড়ার খুঁটির জোরটি তার কোথায় ছিল?
বিএনপি নেত্রী এই সময়েই ঘোষণা দেন, তিনি সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করে ঘরে ফিরবেন না। তার কথা ছিল নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা নয়, সরকারকে তিনি উৎখাত করবেন। এই উৎখাত করার পন্থাটা কী তা তিনি বলেননি, কিন্তু এখন অনুমান করা যায়। ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি তিনি ছেড়েছেন, কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের রাজনীতি যে ছাড়েননি, এটা তার পরবর্তী রোডমার্চ শেষে চট্টগ্রামের ভাষণে বোঝা যায়। তিনি বলেন, 'সরকার সামরিক বাহিনীর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর লোক গুম হচ্ছে।' তখন তার বক্তব্যের তাৎপর্যটি তেমন বোঝা যায়নি। এখন বোঝা যাচ্ছে।
আসলে বর্তমান ব্যর্থ ক্যুর তৎপরতা তখন চলছে এবং তা ব্যর্থ হওয়ার আভাস পেয়ে মেজর জিয়া ২৩ ডিসেম্বর পালিয়ে যান। ক্যুর প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে মেজর পদবির এক সেনা কর্মকর্তাকে ৩১ ডিসেম্বর সেনা আইনের ধারায় গ্রেফতার করা হয়। ২৬ ডিসেম্বর মেজর জিয়া একটি তথাকথিত গ্রেফতার ও বর্ণিত সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নির্যাতন সংক্রান্ত একটি বানোয়াট কাহিনী ই-মেইলযোগে প্রচার করেন। দুটি ই-মেইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে প্রচার করা হয়, 'সেনাবাহিনীতে মধ্যম সারির অফিসাররা অচিরেই বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন। ৮ জানুয়ারি নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর সংগঠন মেজর জিয়ার ইন্টারনেট বার্তাটিকে ভিত্তি করে সামরিক অভ্যুত্থানের উস্কানিমূলক প্রচারপত্র ছড়ায়। ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জনসভায় খালেদা জিয়া সামরিক বাহিনীতে নির্যাতন ও গুমের ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেন। সামরিক বাহিনীকে তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে হয়েছিল।
সেনা দফতরের সংবাদ সম্মেলনেও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রাজ্জাক ক্যু ঘটানোর চক্রান্তের বিশদ বিতরণ জানিয়ে বিএনপি বা খালেদা জিয়ার নামোচ্চারণ না করে বলেছেন, '৯ জানুয়ারি একটি রাজনৈতিক দল সেনাবাহিনীতে গুমের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ করে, যা সেনাবাহিনীসহ সচেতন নাগরিকদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত উস্কানিমূলক বিতর্কের সৃষ্টি করে।' বলাবাহুল্য, ৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনীকে উস্কানি দিয়ে চট্টগ্রামের জনসভায় ভাষণ দেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। অনেকেরই এখন প্রশ্ন, ডিসেম্বর মাস থেকে সেনাবাহিনীর কিছু লোকের ক্যু ঘটানোর চক্রান্ত, এক সেনা কর্মকর্তার গ্রেফতার, মেজর জিয়ার পলায়ন ইত্যাদি কথা জানা না থাকলে বা এসবের সঙ্গে বিএনপি নেত্রীর যোগাযোগ না থাকলে সামরিক বাহিনীতে ক্যু ব্যর্থ করার জন্য যা অপ্রকাশ্যে ঘটছে, তাকে নির্যাতন ও গুমের ঘটনা হিসেবে সাজিয়ে ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে কী করে তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন? তার সেই ভাষণই এখন তার জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
জানা যায়, এই ব্যর্থ ক্যুর পেছনে বিদেশের কিছু বাংলাদেশির যোগাযোগ ও সহযোগিতা ছিল। তারা কারা তা তদন্ত করে বের করা দরকার। অনেকে সন্দেহ করেন, ব্রিটেনে ও আমেরিকায় জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে এবং ব্রিটেনে তারেক রহমান লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করলেও জামায়াতিদের সঙ্গে যুক্তভাবে সরকারবিরোধী নানা অনিয়মতান্ত্রিক তৎপরতায় লিপ্ত। একাত্তরের কিছু যুদ্ধাপরাধী এখনও ব্রিটেনে ঘাঁটি গেড়ে আছে এবং নানা অপতৎপরতায় জড়িত। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাদের অপতৎপরতা বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ দেওয়া এবং দুই সরকারের যৌথ কার্যক্রম গ্রহণ।
সেনা দফতরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনের খবরেই জানা যায়, সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র সফল করার লক্ষ্যে মেজর জিয়া ৯ ও ১০ জানুয়ারি তার অপারেশন পরিকল্পনার কপি ই-মেইলে চাকরিরত সেনা কর্মকর্তাদের কাছে পাঠান। সেনা অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি চলে ১০ ও ১১ জানুয়ারি। খালেদা জিয়া নোবাহিনীর জন্য উস্কানিমূলক বক্তৃতাটি দেন ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামের জনসভায়। এখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠেকায় পড়ে অবশ্য বলেছেন, সেনা অভ্যুত্থানের চক্রান্তের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই নেই। সবই প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যা অভিযোগ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের নিন্দা করেছেন। কিন্তু এই ক্যু ঘটানোর চক্রান্তের নিন্দা জানাতে ভুলে গেছেন। থলের বিড়ালটি সম্ভবত লুকোতে চেয়েছেন।
সেনা সদর দফতরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ক্যু-চক্রান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য গত ২৮ ডিসেম্বর একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে। এটা সেনাবাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তার অপরাধ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর নিজস্ব তদন্ত। কিন্তু এই রাষ্ট্রদ্রোহী চক্রান্তের পেছনে যে অসামরিক অশুভ চক্র কাজ করেছে এবং এখনও করছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন ও চক্রান্তের বিষদাঁত উপড়ে ফেলার জন্য সরকারের উদ্যোগে একটি জাতীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন এবং এই তদন্তের পর সঠিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এই 'ক্যান্টনমেন্ট রাজনীতি'র হোতাদের তারা যতই শক্তিশালী হোক বিচার ও শাস্তি হওয়া দরকার। বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা আর কতকাল ধৈর্যের পরীক্ষা দেবে? গণতন্ত্রকে বাঁচার স্বার্থেই এবার প্রত্যাঘাতের নীতি গ্রহণ করতে হবে।
লন্ডন, ২০ জানুয়ারি ২০১২, শুক্রবার
No comments