বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-উত্তর থেকে সুবার্তা : কৃষিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে অভিনন্দন by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
'মঙ্গা' এ দেশে বহুল প্রচারিত ও পরিচিত একটি শব্দ। বাংলাদেশে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে সমাজের দুঃখ-দুর্দশার একটি প্রতিচ্ছবি নির্ণয় করে এই শব্দটি। মঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে নিকট অতীতেও পত্রপত্রিকায় অনেক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা ছিল নেতিবাচকতারই স্মারক। কিন্তু এবার সেই অর্থে নয়, মঙ্গা সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে অন্যভাবে এবং এর মধ্য দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠেছে।
আশ্বিন-কার্তিক মাসে ওই অঞ্চলে মঙ্গা ছিল একটি নিয়মিত বিষয়, যা দূর অতীতের নয়। মনে পড়ছে অস্থি-চর্মসার রিকশাচালক রমিজ আলীর কথা, যিনি কুড়িগ্রাম থেকে মঙ্গার তাড়া খেয়ে ঢাকায় এসেছিলেন জীবিকা নির্বাহ করতে। ২০০৮ সালের বিজয় দিবসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রিকশায় চড়ে রমিজ আলীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এবং কথা হয়েছিল, কিভাবে অভাবের তাড়না ওই অঞ্চলের মানুষকে পিষে মারছিল। জানি না, রমিজ আলী এখন কোথায় আছেন, কী করছেন। এ-ও জানি না, মঙ্গা জয়ের যুদ্ধে অগণিত উত্তরাঞ্চলবাসীর সঙ্গে রমিজ আলী জয়ী হয়েছেন কি না। সংগ্রামী মানুষরা হারে না।
আশ্বিন-কার্তিক মাসে যে অঞ্চলের (সাধারণত উত্তরবঙ্গের রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী) মানুষ মঙ্গাকে তাদের জীবন ও ভাগ্যের অপরিহার্য সঙ্গী বলে মনে করত, বর্তমান চিত্র এর বিপরীত। এখন তারা আর কর্মহীন হয়ে বসে নেই। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে তাদের ভাগ্য বদলে ফেলেছে সরকারি সহযোগিতায়। কৃষকরা সরকারের সহায়তায় নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা বিলম্বে হলেও উপলব্ধি করেছেন, ভাতের বিকল্প আরো পুষ্টিকর খাবার আছে। আর শুধু ধান চাষ নয়, সেই সঙ্গে তাঁরা সম্পূরক খাদ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিয়েছেন এবং জয়ীও হয়েছেন। ওই অঞ্চলের কৃষকদের সার্বিক অবস্থা এরই মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে, অনেকেরই আর্থিক ক্ষেত্রে সচ্ছলতাও ফিরে এসেছে এবং একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের বিপ্লবী হিসেবে তাঁরা অভিহিত হতে পারেন। উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখন আর আশ্বিন-কার্তিক মাসে কর্মহীন থাকে না, তারা ধানের পাশাপাশি শাকসবজিসহ সব ধরনের কৃষিপণ্য আবাদে আত্মনিয়োগ করে। তারা প্রমাণ করেছে, পরিকল্পিত উপায়ে পদক্ষেপ নিলে কৃষিনির্ভর এই দেশে অনেক অর্জনই সম্ভব এবং তারা এও দেখিয়ে দিল, এ দেশের কৃষককে সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে দেশের কৃষিব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। 'এ দেশের মাটি সোনা ফলায়'_পুরনো এই বাক্যের সার্থকতাও পরিস্ফুটিত হয়েছে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ জয় করে। যে অঞ্চলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আমন ধান কাটার আগে অসংখ্য মানুষ থাকত কর্মহীন এবং এর বিরূপ প্রভাব জনজীবনে ভয়ংকর ছাপ ফেলত, তা এখন অতীত। ক্ষুধা-দারিদ্র্য-দুর্ভোগের যে চিত্রটি মঙ্গা শব্দের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠত, তা কি অদম্য মানুষের অসামান্য চেষ্টায় সত্যিই জাদুঘরে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' মেলা সম্ভব, যদি আমাদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রকরা তাঁদের 'নয়ছয়' কাণ্ডকীর্তি বন্ধ করেন, মুখোশধারীরা তথাকথিত দরিদ্রবান্ধব সেজে 'দারিদ্র্য দূরীকরণ'-এর সাজানো নাটক না করেন, নিজেদের উদরপূর্তির লজ্জাহীন কাণ্ডকীর্তির যবনিকাপাত ঘটান।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষির ওপর আন্তর্জাতিকভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু কৃষিপ্রধান দেশ, সেহেতু এ ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বের দাবিদার। বিভিন্ন মহল থেকে এ কথা বহুবার বলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে_এ দেশের অগ্রগতি এবং স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কৃষি ও কৃষিনির্ভর শিল্প স্থাপনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এই বক্তব্য যে অসার নয়, এরই প্রমাণ মিলেছে উত্তরের জনপদে। কিন্তু অতীতে এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে যথাযথ দূরদর্শী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বললেই চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে 'সিন্ধুর মাঝে বিন্দু'র মতো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও চাটার দল তাও চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। কিন্তু সম্প্রতি এর ব্যত্যয় ঘটে এবং এ ক্ষেত্রে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছেন। গত বছর মঙ্গাকবলিত জেলাগুলোতে কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ কৃষি ও উন্নয়নকাজের জন্য সরকার দুই হাজার ৪৮০ কোটি এবং ২০০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এই কর্মসূচির আওতায় ছিল অভাবী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি উৎপাদনে সহায়তা প্রদান, কৃষককে আর্থিক সহায়তা দান এবং বিনা মূল্যে সার ও বীজসহ কৃষি উপকরণ প্রদান। এই প্রকল্পের সুফল হিসেবে এখন দেখা যাচ্ছে, ওই অঞ্চলে কোথাও অনাবাদি জমি নেই বললেই চলে। শুধু ধান নয়, উৎপাদন হচ্ছে নানা ধরনের কৃষিজাত পণ্য। এসব কৃষকের ওপর ভর করে এখন অনেকেই নানাবিধ কাজের সন্ধান পেয়েছেন। কৃষির পাশাপাশি মৎস্য-পোলট্রি-ডেইরি খাতেও উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখন সম্পৃক্ত এবং এর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব তাদের সমাজ ও পারিবারিক জীবনে পড়েছে। জাতীয় অর্থনীতিও এর রস টানতে পারছে এবং যে আঙ্গিকেই হোক, অর্থনীতিতে এর অবদান লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। এই দৃষ্টান্ত সারা দেশের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে এবং দেশের অন্য এলাকায়ও তা অনুসরণ করা যেতে পারে। যেসব অঞ্চলে এক বা দুই ফসলি কৃষিকাজের মধ্যেই মাটিকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, সেই মাটিকে আরো ব্যবহার করে এগিয়ে যাওয়ার, সমৃদ্ধির রাস্তা প্রশস্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে কৃষিবিজ্ঞানীদের পরামর্শক্রমে।
আমরা জানি, আবহমানকাল থেকে বগুড়া অঞ্চলে আলুসহ নানা ধরনের সবজির চাষ হতো। ওই অঞ্চলে মঙ্গাকবলিত এলাকা থেকে মানুষ দল বেঁধে গিয়ে সস্তা শ্রমে কাজ করত। কিন্তু এখন মঙ্গাকবলিত এলাকায় ব্যাপক হারে অন্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন হয় এবং তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অধিক হারে সবজি রপ্তানির বিষয়টিও সামনে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের ফলে ব্যাংকগুলো কৃষিভিত্তিক বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি রক্তচোষা সুদি ব্যবসায়ী এবং অর্থলগি্নকারী এনজিওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ব্যাংকমুখী হয়েছেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর যেসব অসাধু ব্যক্তি এত দিন মানুষের পকেট কেটে কিংবা ঋণদানের আগেই দফারফা করে প্রদেয় ঋণের একাংশ নিজেদের পকেটে পুরত, তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে পরিবর্তিত ব্যবস্থাপনাগত কারণে। ব্যবস্থা বদলালে অবস্থা যে এমনিতেই পাল্টে যেতে বাধ্য, এটা এরই সুদৃষ্টান্ত। আগেই উল্লেখ করেছি, এ জন্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বিশেষভাবে অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশে প্রকল্প মানেই যেখানে ক্ষমতাবান অসাধুদের রমরমা বাণিজ্য, লুটপাট কিংবা দুর্নীতি বলে এত দিন চিহ্নিত ছিল, অন্তত একটি ক্ষেত্রে এর বহুলাংশে অবসান ঘটেছে, এটা যেমন সত্য, তেমনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা অনেক বড় অর্জনও। বিশ্বের অন্য অঞ্চলে যা-ই হোক, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ কিংবা মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা নতুন কিছু নয়। দাদন ব্যবসা, গ্রামের বিত্তবান ক্ষমতাশালী মহাজনদের সুদি ব্যবসা কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো কোনো মহলের সহায়তায় কোনো কোনো এনজিওর রক্তচোষা ঋণ ব্যবসার হাত থেকে দরিদ্রদের রক্ষা করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার মতো উদ্যোগ যদি দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সরকার আরো নেয় কিংবা এর ক্রমবিস্তার ঘটায়, তাহলে এ দেশের অবয়বে লেপ্টে থাকা মলিন দাগ মুছে ফেলা কোনো দুরূহ বিষয় নয়। চাই শুধু দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা এবং উৎপাদনশীল কর্মমুখী পরিকল্পনা।
দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা নতুন ধরনের শস্যবীজ উদ্ভাবন করেছেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে কৃষিসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক কৃষিঋণ দানের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি সহজে ঋণপ্রাপ্তির পথও অনেকটা কণ্টকমুক্ত করেছে। বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণের কারণে এখন উত্তরের মানুষের কাজের তো অভাব নেই-ই, উপরন্তু শ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে তথাকথিত দরিদ্রবান্ধবরা দারিদ্র্য ও খাদ্যাভাব দূর তো করতে পারেইনি, বরং তাদের চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের জাঁতাকলে অনেক জীবন বিপন্ন হয়েছে। উত্তরাঞ্চলও এর ব্যতিক্রম নয়। মঙ্গা দূরীকরণে অতীতে উত্তরাঞ্চলে কম-বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও এর সুফল মেলেনি। ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে অবস্থার পরিবর্তন তো হয়ইনি, মাঝখান দিয়ে কিছু ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজ আরো আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। কিন্তু এই নাগপাশ থেকে দেশের একটি অঞ্চলকে যাঁরা মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, ইতিহাসে তাঁদের নাম লেখা হবে অন্যভাবে। মানুষ রক্তচোষাদের কবল থেকে বেরিয়ে ব্যাংকের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই ব্যাংকমুখী হয়েছে। এই বক্তব্য উত্তরাঞ্চলের অনেকেরই। রংপুর, পীরগঞ্জ ও নীলফামারী সদরসহ ওই এলাকায় কর্মরত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কৃষিক্ষেত্রে তাঁদের বিনিয়োগের আগ্রহ সংগত কারণেই বেড়ে গেছে। কৃষকদের জন্য অবশ্যই এটা সুবার্তা। এখন কথা হলো, উত্তরাঞ্চলকে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে রেখে দেশের সর্বত্র কৃষির ওপর পরিকল্পিত উপায়ে জোর দিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়সহ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বশীলদের দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতার পাঠ অনুশীলন করে দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে হবে। খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে উদ্যোগ নানামুখী করতে হবে। পাশাপাশি দেশের কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে, সেটা হতে হবে বড় লক্ষ্য। কৃষির পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে নারীদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অনেক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এটাও সুসংবাদ বটে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো যেসব মৌসুমি অভাব আছে, তা দূরীকরণে উত্তরাঞ্চলের প্রীতিকর অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে গেলে ব্যর্থতার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। আবারও অভিনন্দন কৃষিমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে, তাঁরা কথায় নয়, কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন, সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে অর্জনের ক্ষেত্র বিস্তৃত করা কঠিন কিছু নয়।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
আশ্বিন-কার্তিক মাসে যে অঞ্চলের (সাধারণত উত্তরবঙ্গের রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী) মানুষ মঙ্গাকে তাদের জীবন ও ভাগ্যের অপরিহার্য সঙ্গী বলে মনে করত, বর্তমান চিত্র এর বিপরীত। এখন তারা আর কর্মহীন হয়ে বসে নেই। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে তাদের ভাগ্য বদলে ফেলেছে সরকারি সহযোগিতায়। কৃষকরা সরকারের সহায়তায় নিজেদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা বিলম্বে হলেও উপলব্ধি করেছেন, ভাতের বিকল্প আরো পুষ্টিকর খাবার আছে। আর শুধু ধান চাষ নয়, সেই সঙ্গে তাঁরা সম্পূরক খাদ্য উৎপাদনের দিকে নজর দিয়েছেন এবং জয়ীও হয়েছেন। ওই অঞ্চলের কৃষকদের সার্বিক অবস্থা এরই মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে, অনেকেরই আর্থিক ক্ষেত্রে সচ্ছলতাও ফিরে এসেছে এবং একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের বিপ্লবী হিসেবে তাঁরা অভিহিত হতে পারেন। উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখন আর আশ্বিন-কার্তিক মাসে কর্মহীন থাকে না, তারা ধানের পাশাপাশি শাকসবজিসহ সব ধরনের কৃষিপণ্য আবাদে আত্মনিয়োগ করে। তারা প্রমাণ করেছে, পরিকল্পিত উপায়ে পদক্ষেপ নিলে কৃষিনির্ভর এই দেশে অনেক অর্জনই সম্ভব এবং তারা এও দেখিয়ে দিল, এ দেশের কৃষককে সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে দেশের কৃষিব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। 'এ দেশের মাটি সোনা ফলায়'_পুরনো এই বাক্যের সার্থকতাও পরিস্ফুটিত হয়েছে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ জয় করে। যে অঞ্চলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর মাসে আমন ধান কাটার আগে অসংখ্য মানুষ থাকত কর্মহীন এবং এর বিরূপ প্রভাব জনজীবনে ভয়ংকর ছাপ ফেলত, তা এখন অতীত। ক্ষুধা-দারিদ্র্য-দুর্ভোগের যে চিত্রটি মঙ্গা শব্দের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠত, তা কি অদম্য মানুষের অসামান্য চেষ্টায় সত্যিই জাদুঘরে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' মেলা সম্ভব, যদি আমাদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রকরা তাঁদের 'নয়ছয়' কাণ্ডকীর্তি বন্ধ করেন, মুখোশধারীরা তথাকথিত দরিদ্রবান্ধব সেজে 'দারিদ্র্য দূরীকরণ'-এর সাজানো নাটক না করেন, নিজেদের উদরপূর্তির লজ্জাহীন কাণ্ডকীর্তির যবনিকাপাত ঘটান।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষির ওপর আন্তর্জাতিকভাবেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ যেহেতু কৃষিপ্রধান দেশ, সেহেতু এ ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বের দাবিদার। বিভিন্ন মহল থেকে এ কথা বহুবার বলা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে_এ দেশের অগ্রগতি এবং স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কৃষি ও কৃষিনির্ভর শিল্প স্থাপনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এই বক্তব্য যে অসার নয়, এরই প্রমাণ মিলেছে উত্তরের জনপদে। কিন্তু অতীতে এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে যথাযথ দূরদর্শী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বললেই চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে 'সিন্ধুর মাঝে বিন্দু'র মতো পদক্ষেপ নেওয়া হলেও চাটার দল তাও চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। কিন্তু সম্প্রতি এর ব্যত্যয় ঘটে এবং এ ক্ষেত্রে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছেন। গত বছর মঙ্গাকবলিত জেলাগুলোতে কর্মক্ষম মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ কৃষি ও উন্নয়নকাজের জন্য সরকার দুই হাজার ৪৮০ কোটি এবং ২০০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এই কর্মসূচির আওতায় ছিল অভাবী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষি উৎপাদনে সহায়তা প্রদান, কৃষককে আর্থিক সহায়তা দান এবং বিনা মূল্যে সার ও বীজসহ কৃষি উপকরণ প্রদান। এই প্রকল্পের সুফল হিসেবে এখন দেখা যাচ্ছে, ওই অঞ্চলে কোথাও অনাবাদি জমি নেই বললেই চলে। শুধু ধান নয়, উৎপাদন হচ্ছে নানা ধরনের কৃষিজাত পণ্য। এসব কৃষকের ওপর ভর করে এখন অনেকেই নানাবিধ কাজের সন্ধান পেয়েছেন। কৃষির পাশাপাশি মৎস্য-পোলট্রি-ডেইরি খাতেও উত্তরাঞ্চলের মানুষ এখন সম্পৃক্ত এবং এর ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব তাদের সমাজ ও পারিবারিক জীবনে পড়েছে। জাতীয় অর্থনীতিও এর রস টানতে পারছে এবং যে আঙ্গিকেই হোক, অর্থনীতিতে এর অবদান লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। এই দৃষ্টান্ত সারা দেশের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনতে পারে এবং দেশের অন্য এলাকায়ও তা অনুসরণ করা যেতে পারে। যেসব অঞ্চলে এক বা দুই ফসলি কৃষিকাজের মধ্যেই মাটিকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে, সেই মাটিকে আরো ব্যবহার করে এগিয়ে যাওয়ার, সমৃদ্ধির রাস্তা প্রশস্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে কৃষিবিজ্ঞানীদের পরামর্শক্রমে।
আমরা জানি, আবহমানকাল থেকে বগুড়া অঞ্চলে আলুসহ নানা ধরনের সবজির চাষ হতো। ওই অঞ্চলে মঙ্গাকবলিত এলাকা থেকে মানুষ দল বেঁধে গিয়ে সস্তা শ্রমে কাজ করত। কিন্তু এখন মঙ্গাকবলিত এলাকায় ব্যাপক হারে অন্য কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন হয় এবং তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অধিক হারে সবজি রপ্তানির বিষয়টিও সামনে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের ফলে ব্যাংকগুলো কৃষিভিত্তিক বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অসংখ্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি রক্তচোষা সুদি ব্যবসায়ী এবং অর্থলগি্নকারী এনজিওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ব্যাংকমুখী হয়েছেন। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর যেসব অসাধু ব্যক্তি এত দিন মানুষের পকেট কেটে কিংবা ঋণদানের আগেই দফারফা করে প্রদেয় ঋণের একাংশ নিজেদের পকেটে পুরত, তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে পরিবর্তিত ব্যবস্থাপনাগত কারণে। ব্যবস্থা বদলালে অবস্থা যে এমনিতেই পাল্টে যেতে বাধ্য, এটা এরই সুদৃষ্টান্ত। আগেই উল্লেখ করেছি, এ জন্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বিশেষভাবে অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশে প্রকল্প মানেই যেখানে ক্ষমতাবান অসাধুদের রমরমা বাণিজ্য, লুটপাট কিংবা দুর্নীতি বলে এত দিন চিহ্নিত ছিল, অন্তত একটি ক্ষেত্রে এর বহুলাংশে অবসান ঘটেছে, এটা যেমন সত্য, তেমনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা অনেক বড় অর্জনও। বিশ্বের অন্য অঞ্চলে যা-ই হোক, দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ কিংবা মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা নতুন কিছু নয়। দাদন ব্যবসা, গ্রামের বিত্তবান ক্ষমতাশালী মহাজনদের সুদি ব্যবসা কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো কোনো মহলের সহায়তায় কোনো কোনো এনজিওর রক্তচোষা ঋণ ব্যবসার হাত থেকে দরিদ্রদের রক্ষা করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার মতো উদ্যোগ যদি দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সরকার আরো নেয় কিংবা এর ক্রমবিস্তার ঘটায়, তাহলে এ দেশের অবয়বে লেপ্টে থাকা মলিন দাগ মুছে ফেলা কোনো দুরূহ বিষয় নয়। চাই শুধু দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা এবং উৎপাদনশীল কর্মমুখী পরিকল্পনা।
দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা নতুন ধরনের শস্যবীজ উদ্ভাবন করেছেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে কৃষিসহ অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক কৃষিঋণ দানের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি সহজে ঋণপ্রাপ্তির পথও অনেকটা কণ্টকমুক্ত করেছে। বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণের কারণে এখন উত্তরের মানুষের কাজের তো অভাব নেই-ই, উপরন্তু শ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, দারিদ্র্য বিমোচনের নামে তথাকথিত দরিদ্রবান্ধবরা দারিদ্র্য ও খাদ্যাভাব দূর তো করতে পারেইনি, বরং তাদের চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের জাঁতাকলে অনেক জীবন বিপন্ন হয়েছে। উত্তরাঞ্চলও এর ব্যতিক্রম নয়। মঙ্গা দূরীকরণে অতীতে উত্তরাঞ্চলে কম-বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও এর সুফল মেলেনি। ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে অবস্থার পরিবর্তন তো হয়ইনি, মাঝখান দিয়ে কিছু ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজ আরো আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। কিন্তু এই নাগপাশ থেকে দেশের একটি অঞ্চলকে যাঁরা মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, ইতিহাসে তাঁদের নাম লেখা হবে অন্যভাবে। মানুষ রক্তচোষাদের কবল থেকে বেরিয়ে ব্যাংকের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই ব্যাংকমুখী হয়েছে। এই বক্তব্য উত্তরাঞ্চলের অনেকেরই। রংপুর, পীরগঞ্জ ও নীলফামারী সদরসহ ওই এলাকায় কর্মরত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কৃষিক্ষেত্রে তাঁদের বিনিয়োগের আগ্রহ সংগত কারণেই বেড়ে গেছে। কৃষকদের জন্য অবশ্যই এটা সুবার্তা। এখন কথা হলো, উত্তরাঞ্চলকে দৃষ্টান্ত হিসেবে সামনে রেখে দেশের সর্বত্র কৃষির ওপর পরিকল্পিত উপায়ে জোর দিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়সহ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বশীলদের দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতার পাঠ অনুশীলন করে দূরদর্শী পদক্ষেপ নিতে হবে। খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে উদ্যোগ নানামুখী করতে হবে। পাশাপাশি দেশের কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে, সেটা হতে হবে বড় লক্ষ্য। কৃষির পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে নারীদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে অনেক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এটাও সুসংবাদ বটে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনো যেসব মৌসুমি অভাব আছে, তা দূরীকরণে উত্তরাঞ্চলের প্রীতিকর অভিজ্ঞতা নিয়ে এগিয়ে গেলে ব্যর্থতার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। আবারও অভিনন্দন কৃষিমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে, তাঁরা কথায় নয়, কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন, সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে অর্জনের ক্ষেত্র বিস্তৃত করা কঠিন কিছু নয়।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments