ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যসেবার কৌশল by এ এম এম শওকত আলী

রকার ঘোষিত উন্নয়নের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্যান্য খাতসহ স্বাস্থ্য খাতের জন্য কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কৌশল হিসেবে রাষ্ট্রের পরিচালনায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান-সংক্রান্ত কৌশল চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, কয়েক দশক ধরে বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণে সার্বিকভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের একক ভূমিকা বা দায়িত্বের বিষয়টি স্বীকার করা হয় না।


সার্বিক সুশাসনের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রখাতসহ অন্যান্য রাষ্ট্রবহির্ভূত অঙ্গের অংশীদারি। এ কারণেই সরকার সর্বক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকে।
সরকারি খাতভুক্ত স্বাস্থ্যসেবার কৌশল বর্ণনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা হলেও বাস্তবতা বিদ্যমান। কারণ বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা অনেক। এ ছাড়া রয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডিসপেনসারি এবং প্রশিক্ষণকেন্দ্র। উপজেলা পর্যায়ে ৪০২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও চার হাজার পরিবার কল্যাণকেন্দ্রও চালু আছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং প্রায় ১৩ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক। বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যেতে পারে, সরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশাল অবকাঠামো বিদ্যমান। তবে প্রশ্ন হলো, এসব কেন্দ্রের সেবা জনগণ পায় কি না। উপজেলা ও তৎনিম্নপর্যায়ে যে কর্মরত অনেক চিকিৎসকই উপস্থিত থাকেন না বা ওইসব কেন্দ্রে বদলি হলেও কাজে যোগদান করেন না, এ কথা সর্বজনবিদিত। খোদ প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে এ বিষয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তা কতটুকু সফল হয়েছে সে বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য।
বিশ্বব্যাপী কয়েক বছর ধরে নগর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, আগামী দুই দশকের মধ্যে পল্লী ও নগরের জন্য সংখ্যার অনুপাত হবে ৫০:৫০। অর্থাৎ সমান সমান। এ ছাড়া নগরে স্বাস্থ্যের বিষয়ে অনেক সমস্যা বিদ্যমান, যা পল্লী অঞ্চলে কম। যেমন_সুপেয় পানির অভাবসহ দূষিত পানি। বিভিন্ন ধরনের দূষণ যেমন_বায়ু, বিকট শব্দের ব্যাপকতা, জলাবদ্ধতাসহ অন্যান্য সমস্যা। সাম্প্রতিককালে নগরসংলগ্ন নদী তীরবর্তী অঞ্চলের কারখানার বর্জ্যজনিত নদীর পানিদূষণ। এর সঙ্গে যোগ করা যায় নগরবাসীর জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য বা Life style| বর্তমানে যানজটের কারণে ঢাকা শহরে এক আবাসিক অঞ্চল থেকে অন্য আবাসিক অঞ্চল বা কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য যে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়, তাও স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে স্কুলে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের। গত সপ্তাহে একটি ইংরেজি দৈনিকে এ নিয়ে ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। কম বয়সের এক ছাত্র গাড়িতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। স্কুলে কখন পেঁৗছাচ্ছে এবং অক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরবে কি না তা নিয়েও বাবা টেনশনের শিকার হন। নগরবাসীকে প্রতিনিয়ত টেনশনের মধ্যে বাস করতে হয়। সহজেই তাঁরা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। এ জন্য হার্টফেল হওয়ারও আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অথবা হার্টের অসুখ হতে পারে। বেড়ে যায় চিকিৎসাজনিত খরচ। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগরিকদের জন্য নিঃসন্দেহে এটা কষ্টদায়ক। বিশেষ করে বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নগর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে খুব কমই গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তবে নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করার বিষয়ে কিছু কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, এনজিওদের অংশীদারির মাধ্যমে বর্তমান প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা অব্যাহত রাখা। স্থানীয় সরকার বিভাগের তত্ত্বাবধানে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় এ উদ্যোগ ১৯৯৮ সাল থেকেই চালু আছে।
এ বিষয়ে নগর স্বাস্থ্যসেবা কৌশল প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর আওতায় পাঁচটি সিটি করপোরেশনসহ দুটি পৌরসভায় মেয়রদের সভাপতিত্বে কর্মশালার মাধ্যমে সব পেশার নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে। সর্বশেষ সভা ঢাকায় অক্টোবর মাসের ১১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। নীতিনির্ধারকসহ উন্নয়ন সহযোগীরাও এতে উপস্থিত ছিলেন। নগর স্বাস্থ্য কৌশলের প্রাথমিক খসড়া এখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগের বিবেচনাধীন।
জাতীয় পর্যায়ে কর্মশালায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, নগরে রোগের প্রকোপ, বিশেষ করে উদরাময় বৃদ্ধি পেলেই সবাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দায়ী করেন। অথচ নিরাপদ খাবার পানির অভাবেই যে এটা হয় এবং এ সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যেসব মন্ত্রণালয় বা সংস্থার রয়েছে, তাদের দায়ী করা হয় না। এ অভিমত সম্পূর্ণ সঠিক নয়। নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য ওয়াসাকেও কম দায়ী করা হয় না। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে একটি বাস্তব সত্য দৃশ্যমান। তা হলো, রোগের প্রকোপ সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সব সংস্থারই দায়িত্ব রয়েছে। কাজেই নগর স্বাস্থ্য কৌশলে এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক।
পক্ষান্তরে এ কথাও বলা যায়, আবহমানকাল ধরে স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কিত নীতি ও কৌশলে এ বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়া হয়নি। এখন সময় এসেছে এ অসম্পূর্ণ কাজটির প্রতি গুরুত্ব প্রদান করার। উদরাময় রোগের প্রকোপ ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। যেমন_মশার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার সফলতা। এ সফলতায় কেন সিটি করপোরেশন ব্যর্থ সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। করপোরেশন প্রয়োজনীয় অর্থের অপ্রতুলতার কথা বলে। সরকারকে দায়ী করে এই বলে যে সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করে না। দোষারোপের রাজনীতির মতো এ ক্ষেত্রেও দোষারোপের প্রবণতা। করপোরেশন যে বছরের পর বছর নগর-সংক্রান্ত কর বৃদ্ধি বা আদায়ে ব্যর্থ, সে কথাও অস্বীকার করা যায় না। এ ছাড়া রয়েছে নাগরিকদের মানসিকতা। সব কিছুই সরকার করে দেবে, নাগরিকদের কোনো দায়িত্ব নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নাগরিক উদ্যোগেই স্বাস্থ্যসম্মত নগরী করলে তা টেকসই হবে। স্থায়িত্ব বেশি হবে। এদিকেও দৃষ্টি দেওয়া আবশ্যক।
অবশ্য এ কথা বলা যায় যে সাম্প্রতিককালে নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য দাবি জানিয়েছে। যেমন_পরিবেশ রক্ষা ও বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন। প্রায় সব রাজনৈতিক দলও এ দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণাও করেছিল। এমনকি হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগও ছিল দৃশ্যমান। কিন্তু সম্পূর্ণ সফলতা অর্জন এখনো সম্ভব হয়নি। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। এ কারণেই কাজের গতি বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় নগর স্বাস্থ্য অধিকতর হুমকির সম্মুখীন হবে। চিকিৎসার জন্য সরকার যে বিপুল অর্থ প্রতিবছর ব্যয় করে, তা অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব যদি রোগপ্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করা যায়।
অরবিন্দ কৃষ্ণ নামে এক গবেষক উপর্যুক্ত বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম One illness away : how to escape from poverty। অর্থাৎ দারিদ্র্যের সঙ্গে রোগবালাইয়ের সম্পর্ক নিবিড়। বৃহত্তর আঙ্গিকে দারিদ্র্য শুধু আর্থিক দারিদ্র্য নয়। মানসম্মত জীবনযাত্রার অভাবও দারিদ্র্য। সরকার কর্তৃক ২০১০ সালের দারিদ্র্যবিষয়ক সমীক্ষায় পল্লী ও নগর অঞ্চলের দারিদ্র্যের কিছু তথ্য রয়েছে। এ সমীক্ষার মতে, জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যর হার শতকরা ৩১.৫ শতাংশ। এর মধ্যে নগরের অংশ ২১.৩ ও পল্লীর হার ৩৫.২ শতাংশ।
এ চিত্র সম্পূর্ণ নয়। কারণ একই সমীক্ষায় বিভাগভিত্তিক চিত্রে কিছু আশঙ্কাজনক তথ্যও পাওয়া যায়। যেমন_বরিশাল নগর অঞ্চলের দারিদ্র্যের হার ৩৯.৯ এবং পল্লী অঞ্চলে ৩৯.২ শতাংশ। খুলনার চিত্র আরো আশঙ্কাজনক। সার্বিক দারিদ্র্য ৩২.১ শতাংশ অথচ নগরের দারিদ্র্য ৩৫.৮ শতাংশ। পল্লীতে এ হার ৩১ শতাংশ। অরবিন্দ কৃষ্ণের মতবাদ এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। নগরের দারিদ্র্য হার হ্রাস করতে না পারলে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাজনিত ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য তাদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করার জন্য অন্যান্য ব্যয় হ্রাস করতে হবে। অর্থাৎ সে দারিদ্র্যের বৃত্তেই আবদ্ধ থাকবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.