সাত হাজার প্রিন্স! by আনোয়ার হোসেন
রাজার ছেলে রাজা হয়। বাদশাহর ছেলে বাদশাহ। তাদের প্রিন্স বা যুবরাজ বলা হয়। পুত্র সন্তান না থাকলে কন্যাদেরও সিংহাসনে বসার সৌভাগ্য হয়। কিন্তু সৌদি আরবে বাদশাহর ভাইয়েরা প্রিন্স বা যুবরাজ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকেন। তাদের বাইরেও প্রিন্স থাকেন। তবে সিংহাসনে বসার যোগ্যতা কেবল বাদশাহর কোনো ভাইয়ের। বর্তমান বাদশাহর ভাইয়েরা কেউ বেঁচে না থাকলে তখন এ ক্ষেত্রে নতুন ধারা আসবে।
সৌদি আরবের বর্তমান বাদশাহ আবদুল্লাহ। আর যুবরাজ বা প্রিন্স ছিলেন সুলতান। তিনি দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন ১৯৬২ সাল থেকে। ৪৯ বছর ধরেই এক দায়িত্ব। ২০০৫ সালে বাদশাহ ফাহাদের মৃত্যুর পর সে সময়ের যুবরাজ আবদুল্লাহ বাদশাহর পদে বসলে প্রিন্স সুলতান যুবরাজ পদে অভিষিক্ত হন। বাদশাহ পদে অভিষিক্ত হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হলো ৮০ বছর বয়সে। বর্তমান বাদশাহ তার চেয়েও কয়েক বছরের বড়। যুবরাজ বা প্রিন্স বলতে তরুণ বা যুবক বয়সী একটি চেহারাই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিশোর-বালক প্রিন্সও বিভিন্ন দেশে রয়েছে। সৌদি আরবে মোটেই তেমনটি দেখা যায় না। সেখানে কয়েক দশক ধরে আরও একটি ব্যতিক্রম_ উত্তরাধিকার প্রশ্নটি পারিবারিক পরিমণ্ডলে আলোচনা করেই নিষ্পত্তি হয়। কে যুবরাজ হবেন_ সেটা নির্ধারণে বাদশাহর উদ্যোগী ভূমিকা থাকে। তবে তিনি অনেকের মতামত নিয়ে এ কাজ করেন। নতুন যুবরাজ নির্ধারণেও সেটা করা হবে। এ পদে যার আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি তিনি প্রিন্স নায়েফ। ৩৬ বছর ধরে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। বাদশাহ আবদুল্লাহর পর তিনিই হবেন তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রটির কর্ণধার। তবে এ দেশটির তার চেয়েও বড় পরিচয়_ পবিত্র মক্কা ও মদিনার দেশ। কাবা শরিফের দেশ।
সৌদি আরবে প্রিন্স সংখ্যা কত_ তা নিয়ে নিশ্চিত ভাষ্য তেমন মেলে না। ২০০৫ সালে একটি হিসাবে এ সংখ্যা তিন থেকে চার হাজার উল্লেখ করা হয়। তারা সবাই বাদশাহ সউদের বংশধর। আরেকটি হিসাবে বলা হয়, বর্তমানে প্রিন্স রয়েছেন প্রায় সাত হাজার। প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ জন প্রিন্সের জন্ম হয়। প্রিন্স ভূমিষ্ঠ হলেই তার জন্য বছরে ৫ লাখ ডলার (প্রায় চার কোটি বাংলাদেশি টাকা) ভাতা বরাদ্দ হয়। এর বাইরেও তিনি নানা ধরনের সুবিধা ভোগ করে থাকেন। সৌদি প্রিন্সদের জীবন বিলাসিতায় পূর্ণ_ এমনটিই বলা হয়ে থাকে। দেশের আর সব নাগরিকের তুলনায় প্রিন্সরা প্রকৃতই অন্য জগতের মানুষ। তাদের অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যর সঙ্গে যুক্ত। ইউরোপ-আমেরিকাতেও তাদের রয়েছে ব্যবসা। কিন্তু সাধারণভাবে তারা থেকে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে।
হাল আমলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কোটি কোটি মানুষ অন্যভাবে চিন্তা করতে শুরু করছে। অনেক দেশে শাসকের পরিবর্তন ঘটছে প্রবল গণবিক্ষোভে। কেউ কেউ পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছেন। বর্তমান সৌদি বাদশাহ রয়েছেন এ দলে। তিনি জনগণকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করছেন নানাভাবে। যদি সেখানে পরিবর্তন আসে. তাহলে প্রিন্সদের জীবনধারাও হয়তো বদলে যাবে। কিন্তু আরব বিশ্বের এ অভিজ্ঞতাও মনে রাখা দরকার_ যারা ষাটের দশকে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্রের ধারণা নিয়ে এসেছিলেন, তাদের প্রায় সবাই উত্তরাধিকার হিসেবে পুত্রদের কাউকে মনোনীত করেছেন। মিসরের হোসনি মোবারক, লিবিয়ার মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি, সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদ, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন_ সবাই একই পথে চলেছেন। তাদের পুত্রদের দাপট-দৌরাত্ম্য অনেক ক্ষেত্রে রাজতন্ত্রকেও হার মানিয়েছে। তারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেননি, বরং অত্যাচারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এ সবই হাল আমলের নজির। সৌদি আরবে পরিবর্তন এলে তার পরের জমানা সেই আগের মতোই হবে না_ তার নিশ্চয়তা কী? রাজনীতিতে উত্তরাধিকার তো দক্ষিণ এশিয়াতেও দেখছি। ক্ষমতার মসনদ এখানেও আমজনতার জন্য উন্মুক্ত নয়।
No comments