বিশেষ সাক্ষাৎকার : সাদেক হোসেন খোকা-ঢাকাকে দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত শুভ নয় by মোস্তফা হোসেইন
ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মোস্তফা হোসেইন
কালের কণ্ঠ : ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিষয়টি কিভাবে দেখছেন?
সাদেক হোসেন খোকা : কোনো কথাবার্তা নেই, সরকার হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করে দেবে। এমন সিদ্ধান্তের কথা শোনার পর আমি তো হতবিহ্বল। ভাবতে অবাক লাগে, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভাগ করতে হবে এমন কোনো দাবি কি কোনো মহল থেকে করা হয়েছিল? কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এমন দাবি উঠেছে বলে কি কেউ বলতে পারবে? সরকারদলীয় কোনো এমপিও এমন দাবি করেননি। কিন্তু বজ্রপাতের মতোই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। বলা হলো, ঢাকা ভাগ হয়ে যাবে।
কালের কণ্ঠ : ভাগ হলে কি নাগরিক সেবার মান বাড়বে বলে আপনি মনে করেন?
সাদেক হোসেন খোকা : এটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা। এতে নাগরিক সেবার মান বাড়বে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ করে থাকে। কিন্তু এমন হলে সেবার মান ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।
কালের কণ্ঠ : প্রশাসনিক কিংবা অবকাঠামোগত দিক থেকে কোনো অসুবিধা হবে কি?
সাদেক হোসেন খোকা : একটি ঢাকা দুই ভাগ হবে। সম্পদ ভাগাভাগি করা কি এত সহজ হবে? জনবলকে কিভাবে ভাগাভাগি করা হবে? ঢাকার ব্যাপারে কিন্তু সাধারণ একটা আবেগ জড়িত আছে। বিষয়গুলো সবার আগে বিবেচনায় আনা উচিত ছিল। আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে ঢাকার যোগ আছে। ব্রিটিশ আমলের কথাই ধরুন না। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঢাকার যোগ আছে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি তৈরির ক্ষেত্রে এই ঢাকার ভূমিকা বিশাল। ভাষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনা হয়েছে এই ঢাকায়। এমন একটি ঢাকাকে ভাগ করে ফেলবেন একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে_এটা কিভাবে হয়? এমন আবেগ যার পেছনে কাজ করে তাকে বিভক্ত করার আগে জনমত যাচাই করার প্রয়োজন ছিল না কি?
কালের কণ্ঠ : এ বিষয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র কিংবা কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে সরকারকে কোনো মতামত দেওয়া হয়েছিল কি?
সাদেক হোসেন খোকা : ব্যক্তিগতভাবে আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। আমাদের কাউন্সিলররাও সবাই একমত। তাঁদের কেউই সরকারের এ সিদ্ধান্তকে শুভ বলে মনে করেন না। আমাদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক আছেন তাঁরাও প্রত্যেকে আমার মতের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। একটা বিষয় কিন্তু মনে রাখতে হবে। এই চেয়ারে আমি থাকি কিংবা না থাকি সেটা বড় কথা নয়। সর্বোচ্চ নাগরিকসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এই ঢাকা শহরে দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে। এখানে আমাদের দাতাদের অফিস-আদালত আছে। বিদেশি সংস্থার দপ্তর আছে। সবই কিন্তু আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সরকার বলছে, এই বিভাজনে ভালো হবে। আপনারা কেন মানতে চাইছেন না?
সাদেক হোসেন খোকা : আমরা সরকারকে আবারও আহ্বান জানাব, তারা যেন তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। দুটি ভাগে ভাগ করা হলে দুটিই অসাম্য অবস্থায় পড়বে। এখানে উন্নয়নের সঙ্গে কিন্তু রেভিনিউর সংযোগ আছে। সে দিকটি বিবেচনা করতে হবে। দেখুন, ভাগ হয়ে গেলে কত রকমের মামলা-মোকদ্দমার যে মুখোমুখি হতে হবে সিটি করপোরেশনকে তার ঠিক নেই। এই ঢাকা শহরে ১৯৮২ সালের আগে মিরপুর ও গুলশান আলাদা মিউনিসিপ্যালিটি ছিল। তখন দেখা গেল, একটি ঢাকা শহরকে তিন ভাগ করে সেবার ক্ষেত্রে উন্নত ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। কী করতে হবে তখন? তিনটি মিলিয়ে দেওয়া হলো। তখন কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংক একটা সমীক্ষা চালাল। তারা স্টাডি করল। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে তারা আলাপ করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল টোটাল ইউনিটারি অথরিটি তৈরি করতে হবে ঢাকার সেবা খাতকে নিশ্চিত করতে হলে। ২০০৮ সালে মন্ত্রিপরিষদেও সিদ্ধান্ত হলো। আর এখন এসবকে পাশে ঠেলে দিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা মোটেও ঠিক হবে না। তা ছাড়া এ বিষয় নিয়ে আমি একা বলেছি তা ঠিক নয়। অভিজ্ঞতার নিরিখে প্রত্যেকেই বলবেন। আমার আগে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা সিটি করপোরেশনে সাড়ে আট বছর মেয়র ছিলেন। তিনি সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছিলেন মেট্রোপলিটন গঠন করার জন্য। আমরা বলছি, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে চট্টগ্রাম কিংবা খুলনা সিটি করপোরেশনের মতো বিবেচনা করলে ঠিক হবে না। ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাজের সুবিধার জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীনে আনতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনার এই চিন্তার পেছনে যুক্তি কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আমাদের এখানে কাজ করতে গেলে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রণালয় যেভাবে রশি টানাটানি হয় তা কাজকে বিঘি্নত করে। অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি হয় এখানে। এক মন্ত্রণালয় অন্য মন্ত্রণালয়ের মতভেদ কখনো কখনো মনে হয় যেন অবন্ধুসুলভ। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে এর বিকল্প নেই।
কালের কণ্ঠ : ঢাকা সিটি করপোরেশনে নির্বাচন নিয়ে কথা উঠেছে। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
সাদেক হোসেন খোকা : আমরা দাবি জানাতে পারি নিয়মিত নির্বাচন হওয়ার জন্য। মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত তিন মাস আগে নির্বাচন শেষ হওয়া উচিত।
কালের কণ্ঠ : নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ আছে। কোথাও কোথাও সেবার মান কিংবা সেবাবঞ্চিত হওয়ার কথাও শোনা যায়। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আসলে ঢাকা সিটি করপোরেশন বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর। প্রায় দেড় কোটি মানুষ এই শহরে বাস করে। এই যে ক্ষমতায়নের কথা বলছি, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি বরাবরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার ওপর ম্যান্ডেট যতটুকু আছে তার মধ্যে থাকার চেষ্টা করি। আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। আমি কখনো সেই মন্ত্রণালয়ের কাজে হস্তক্ষেপ করি না। আমার যে কাজের সীমাবদ্ধতা আছে সেটা আমি বিবেচনায় রাখি। যে কারণে কেয়ারটেকার সরকার তার আগে বিএনপি সরকার কিংবা বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার কারো সঙ্গেই আমার কাজ করতে অসুবিধা হয়নি। কারো বিরোধিতার মুখে আমাকে পড়তে হয়নি। ঢাকা সিটি করপোরেশনে ২৫ জনের মতো কাউন্সিলর আছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। রাজপথে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মুখোমুখি সম্পর্ক থাকে, কিন্তু আমাদের মধ্যে তেমন নেই। এখানে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে তা নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি। ডিসিসির হয়ে যখন আমরা কাজ করি তখন আমরা একাট্টা।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের প্রত্যেকেরই রাজনৈতিক পরিচয় আছে।
সাদেক হোসেন খোকা : তার পরও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বজনীন। সেবা করা আমাদের কাজ। স্থানীয় সরকারের যে ধারণা তার শতভাগ আপনি ডিসিসিতে দেখতে পাবেন, যে কারণে আমাদের কাজের মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি।
কালের কণ্ঠ : আপনি কি মনে করেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নাগরিক সুবিধা শতভাগ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : কোনো সংস্থাই নেই যারা শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে অন্তত সেবার বিষয়ে যদি বলেন। আমরাও দাবি করতে পারি না যে আমরা মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পরিপূর্ণ সেবা নিশ্চিত করতে পেরেছি। কারণ এর পেছনে অনিবার্য প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : সেই প্রতিবন্ধকতাটা কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি আবার সেই কথাই বলব। মোহাম্মদ হানিফও সে কথাই বলে গেছেন। অর্থাৎ ক্ষমতায়ন। ক্ষমতায়ন না হলে আপনি সেবা খাতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবেন না। এখানে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। পরিধি বাড়ছে রাজধানীর। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ ধরনের বড় শহরের সেবাকে নিশ্চিত করতে হলে এক কেন্দ্র থেকে পরিচালনা করতে হবে। আমাদের বিষয়টা খেয়াল করুন। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বাজার, সরকারি অফিস-আদালতের সদর দপ্তর সবই তো ঢাকাকেন্দ্রিক। সুতরাং এখানকার চাপ কিন্তু থাকবেই।
কালের কণ্ঠ : নাগরিক সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার কথা বলা হয়, এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : প্রথম কথা হচ্ছে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে যে অর্থ প্রয়োজন তা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় না। কন্ট্রিবিউশন খুবই কম। ডিসিসির আয় বৃদ্ধির জন্য চিন্তা করে না। আবার অর্থ মন্ত্রণালয় কিছু ব্যাপারে রাজি হয়নি। বাংলাদেশের ৬২ শতাংশ গাড়ি চলে ঢাকায়। অথচ বিআরটিএর মাধ্যমে যে ট্যাঙ্ আদায় হয় তার শতভাগ চলে যায় কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে। ঢাকায় ভারী গাড়ি চলে প্রচুর। রাস্তা সেই মানের বানাতে হয়। সরকার যে রেভিনিউ আয় করে তা তো আমাদের দিচ্ছে না। আগে আমরা অকটো ট্যাঙ্ আদায় করতাম। বহু বছর আগে অকটো ট্যাঙ্ আদায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তখন আমরা আড়াই কোটি টাকা এই খাতে পেতাম। এটা ১৯৭০ সালের শেষের দিকের কথা। তখন আড়াই কোটি টাকা আমাদের সরকার দিতে শুরু করে আজও সেই আড়াই কোটি টাকাই রয়ে গেছে। সরকার ১২ শতাংশ কর নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা তো নাগরিকদের কাছ থেকে এর বেশি আদায় করতে পারছি না। মামলার কারণে সেই অ্যাসেসমেন্টও বন্ধ হয়ে গেছে।
কালের কণ্ঠ : ডিসিসি কি তাহলে ঋণগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : আমরা ঋণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। জানেন কি একসময় নগর ভবনও মর্টগেজ দেওয়া ছিল। আমরা বেতন দিতে পারতাম না কর্মচারীদের। এখন কিন্তু সেই অবস্থা নেই।
কালের কণ্ঠ : এর প্রতিফলন কি রাস্তাঘাটের উন্নয়ন কিংবা সংস্কারের ওপর গিয়ে পড়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : একসময় একটি সংস্থা রাস্তা কাটলে আরেকটি সংস্থা এসে আবার কাটত। সমন্বয়হীনতার কারণে সংস্কারকাজ বিঘি্নত হতো। এখন সেই অবস্থা নেই। আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস করলাম। তার পরও করলাম ঠিকাদারদের প্যানেল। ফলে কাজ দেরি হয় না এখন।
কালের কণ্ঠ : আপনি দীর্ঘদিন ধরে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আপনাকে যদি তা মূল্যায়নের কথা বলি তাহলে সাফল্য-ব্যর্থতাকে কিভাবে দেখবেন?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি যখন মেয়র হই তখন ঢাকার ৮০ শতাংশ রাস্তার অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। মৌচাক থেকে রামপুরা যে রাস্তা গিয়েছে সেখানে পানি জমে থাকত। রিকশা থেকে মানুষ পড়ে যাচ্ছে এমন ছবি পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে। নর্থ সাউথ রোড এলাকায় মানুষ চলাচল করতে পারত না। ডিসিসি ৬৩১ কোটি টাকার ঋণে জর্জরিত ছিল। মশার ওষুধ ছিল না। ঠিকাদাররা কাজ করে গিয়ে বিল পাচ্ছিলেন না। এমনও দেখা যেত দরপত্র নিয়ে গোলাগুলি হতো। এখন সেই অবস্থা নেই।
কালের কণ্ঠ : মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সড়কের নামকরণের ব্যাপারে আপনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা কি শেষ হয়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মান জানানো আমাদের দায়িত্ব। অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমরা সেই কাজটি করেছি। আমরা দলমতের ঊধর্ে্ব থেকে রাস্তার নামকরণ করেছি। সেখানে অনেক রাস্তার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হয়েছে সংগত কারণেই।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
সাদেক হোসেন খোকা : আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাদেক হোসেন খোকা : কোনো কথাবার্তা নেই, সরকার হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করে দেবে। এমন সিদ্ধান্তের কথা শোনার পর আমি তো হতবিহ্বল। ভাবতে অবাক লাগে, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ভাগ করতে হবে এমন কোনো দাবি কি কোনো মহল থেকে করা হয়েছিল? কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এমন দাবি উঠেছে বলে কি কেউ বলতে পারবে? সরকারদলীয় কোনো এমপিও এমন দাবি করেননি। কিন্তু বজ্রপাতের মতোই সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। বলা হলো, ঢাকা ভাগ হয়ে যাবে।
কালের কণ্ঠ : ভাগ হলে কি নাগরিক সেবার মান বাড়বে বলে আপনি মনে করেন?
সাদেক হোসেন খোকা : এটা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা। এতে নাগরিক সেবার মান বাড়বে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কাজ করে থাকে। কিন্তু এমন হলে সেবার মান ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।
কালের কণ্ঠ : প্রশাসনিক কিংবা অবকাঠামোগত দিক থেকে কোনো অসুবিধা হবে কি?
সাদেক হোসেন খোকা : একটি ঢাকা দুই ভাগ হবে। সম্পদ ভাগাভাগি করা কি এত সহজ হবে? জনবলকে কিভাবে ভাগাভাগি করা হবে? ঢাকার ব্যাপারে কিন্তু সাধারণ একটা আবেগ জড়িত আছে। বিষয়গুলো সবার আগে বিবেচনায় আনা উচিত ছিল। আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে ঢাকার যোগ আছে। ব্রিটিশ আমলের কথাই ধরুন না। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঢাকার যোগ আছে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি তৈরির ক্ষেত্রে এই ঢাকার ভূমিকা বিশাল। ভাষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনা হয়েছে এই ঢাকায়। এমন একটি ঢাকাকে ভাগ করে ফেলবেন একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে_এটা কিভাবে হয়? এমন আবেগ যার পেছনে কাজ করে তাকে বিভক্ত করার আগে জনমত যাচাই করার প্রয়োজন ছিল না কি?
কালের কণ্ঠ : এ বিষয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র কিংবা কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে সরকারকে কোনো মতামত দেওয়া হয়েছিল কি?
সাদেক হোসেন খোকা : ব্যক্তিগতভাবে আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। আমাদের কাউন্সিলররাও সবাই একমত। তাঁদের কেউই সরকারের এ সিদ্ধান্তকে শুভ বলে মনে করেন না। আমাদের মধ্যে যাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক আছেন তাঁরাও প্রত্যেকে আমার মতের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। একটা বিষয় কিন্তু মনে রাখতে হবে। এই চেয়ারে আমি থাকি কিংবা না থাকি সেটা বড় কথা নয়। সর্বোচ্চ নাগরিকসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এই ঢাকা শহরে দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে। এখানে আমাদের দাতাদের অফিস-আদালত আছে। বিদেশি সংস্থার দপ্তর আছে। সবই কিন্তু আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে।
কালের কণ্ঠ : সরকার বলছে, এই বিভাজনে ভালো হবে। আপনারা কেন মানতে চাইছেন না?
সাদেক হোসেন খোকা : আমরা সরকারকে আবারও আহ্বান জানাব, তারা যেন তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। দুটি ভাগে ভাগ করা হলে দুটিই অসাম্য অবস্থায় পড়বে। এখানে উন্নয়নের সঙ্গে কিন্তু রেভিনিউর সংযোগ আছে। সে দিকটি বিবেচনা করতে হবে। দেখুন, ভাগ হয়ে গেলে কত রকমের মামলা-মোকদ্দমার যে মুখোমুখি হতে হবে সিটি করপোরেশনকে তার ঠিক নেই। এই ঢাকা শহরে ১৯৮২ সালের আগে মিরপুর ও গুলশান আলাদা মিউনিসিপ্যালিটি ছিল। তখন দেখা গেল, একটি ঢাকা শহরকে তিন ভাগ করে সেবার ক্ষেত্রে উন্নত ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। কী করতে হবে তখন? তিনটি মিলিয়ে দেওয়া হলো। তখন কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংক একটা সমীক্ষা চালাল। তারা স্টাডি করল। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে তারা আলাপ করল। তারা সিদ্ধান্ত নিল টোটাল ইউনিটারি অথরিটি তৈরি করতে হবে ঢাকার সেবা খাতকে নিশ্চিত করতে হলে। ২০০৮ সালে মন্ত্রিপরিষদেও সিদ্ধান্ত হলো। আর এখন এসবকে পাশে ঠেলে দিয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা মোটেও ঠিক হবে না। তা ছাড়া এ বিষয় নিয়ে আমি একা বলেছি তা ঠিক নয়। অভিজ্ঞতার নিরিখে প্রত্যেকেই বলবেন। আমার আগে মোহাম্মদ হানিফ ঢাকা সিটি করপোরেশনে সাড়ে আট বছর মেয়র ছিলেন। তিনি সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছিলেন মেট্রোপলিটন গঠন করার জন্য। আমরা বলছি, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে চট্টগ্রাম কিংবা খুলনা সিটি করপোরেশনের মতো বিবেচনা করলে ঠিক হবে না। ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাজের সুবিধার জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীনে আনতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনার এই চিন্তার পেছনে যুক্তি কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আমাদের এখানে কাজ করতে গেলে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রণালয় যেভাবে রশি টানাটানি হয় তা কাজকে বিঘি্নত করে। অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি হয় এখানে। এক মন্ত্রণালয় অন্য মন্ত্রণালয়ের মতভেদ কখনো কখনো মনে হয় যেন অবন্ধুসুলভ। এ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে এর বিকল্প নেই।
কালের কণ্ঠ : ঢাকা সিটি করপোরেশনে নির্বাচন নিয়ে কথা উঠেছে। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়াকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
সাদেক হোসেন খোকা : আমরা দাবি জানাতে পারি নিয়মিত নির্বাচন হওয়ার জন্য। মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত তিন মাস আগে নির্বাচন শেষ হওয়া উচিত।
কালের কণ্ঠ : নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ আছে। কোথাও কোথাও সেবার মান কিংবা সেবাবঞ্চিত হওয়ার কথাও শোনা যায়। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আসলে ঢাকা সিটি করপোরেশন বাংলাদেশের বৃহত্তম শহর। প্রায় দেড় কোটি মানুষ এই শহরে বাস করে। এই যে ক্ষমতায়নের কথা বলছি, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি বরাবরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার ওপর ম্যান্ডেট যতটুকু আছে তার মধ্যে থাকার চেষ্টা করি। আমরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। আমি কখনো সেই মন্ত্রণালয়ের কাজে হস্তক্ষেপ করি না। আমার যে কাজের সীমাবদ্ধতা আছে সেটা আমি বিবেচনায় রাখি। যে কারণে কেয়ারটেকার সরকার তার আগে বিএনপি সরকার কিংবা বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার কারো সঙ্গেই আমার কাজ করতে অসুবিধা হয়নি। কারো বিরোধিতার মুখে আমাকে পড়তে হয়নি। ঢাকা সিটি করপোরেশনে ২৫ জনের মতো কাউন্সিলর আছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। রাজপথে বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মুখোমুখি সম্পর্ক থাকে, কিন্তু আমাদের মধ্যে তেমন নেই। এখানে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে তা নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি। ডিসিসির হয়ে যখন আমরা কাজ করি তখন আমরা একাট্টা।
কালের কণ্ঠ : আপনাদের প্রত্যেকেরই রাজনৈতিক পরিচয় আছে।
সাদেক হোসেন খোকা : তার পরও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বজনীন। সেবা করা আমাদের কাজ। স্থানীয় সরকারের যে ধারণা তার শতভাগ আপনি ডিসিসিতে দেখতে পাবেন, যে কারণে আমাদের কাজের মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি।
কালের কণ্ঠ : আপনি কি মনে করেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নাগরিক সুবিধা শতভাগ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : কোনো সংস্থাই নেই যারা শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে অন্তত সেবার বিষয়ে যদি বলেন। আমরাও দাবি করতে পারি না যে আমরা মানুষের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পরিপূর্ণ সেবা নিশ্চিত করতে পেরেছি। কারণ এর পেছনে অনিবার্য প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।
কালের কণ্ঠ : সেই প্রতিবন্ধকতাটা কী?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি আবার সেই কথাই বলব। মোহাম্মদ হানিফও সে কথাই বলে গেছেন। অর্থাৎ ক্ষমতায়ন। ক্ষমতায়ন না হলে আপনি সেবা খাতের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবেন না। এখানে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। পরিধি বাড়ছে রাজধানীর। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ ধরনের বড় শহরের সেবাকে নিশ্চিত করতে হলে এক কেন্দ্র থেকে পরিচালনা করতে হবে। আমাদের বিষয়টা খেয়াল করুন। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বাজার, সরকারি অফিস-আদালতের সদর দপ্তর সবই তো ঢাকাকেন্দ্রিক। সুতরাং এখানকার চাপ কিন্তু থাকবেই।
কালের কণ্ঠ : নাগরিক সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার কথা বলা হয়, এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?
সাদেক হোসেন খোকা : প্রথম কথা হচ্ছে, ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে যে অর্থ প্রয়োজন তা পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় না। কন্ট্রিবিউশন খুবই কম। ডিসিসির আয় বৃদ্ধির জন্য চিন্তা করে না। আবার অর্থ মন্ত্রণালয় কিছু ব্যাপারে রাজি হয়নি। বাংলাদেশের ৬২ শতাংশ গাড়ি চলে ঢাকায়। অথচ বিআরটিএর মাধ্যমে যে ট্যাঙ্ আদায় হয় তার শতভাগ চলে যায় কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে। ঢাকায় ভারী গাড়ি চলে প্রচুর। রাস্তা সেই মানের বানাতে হয়। সরকার যে রেভিনিউ আয় করে তা তো আমাদের দিচ্ছে না। আগে আমরা অকটো ট্যাঙ্ আদায় করতাম। বহু বছর আগে অকটো ট্যাঙ্ আদায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তখন আমরা আড়াই কোটি টাকা এই খাতে পেতাম। এটা ১৯৭০ সালের শেষের দিকের কথা। তখন আড়াই কোটি টাকা আমাদের সরকার দিতে শুরু করে আজও সেই আড়াই কোটি টাকাই রয়ে গেছে। সরকার ১২ শতাংশ কর নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা তো নাগরিকদের কাছ থেকে এর বেশি আদায় করতে পারছি না। মামলার কারণে সেই অ্যাসেসমেন্টও বন্ধ হয়ে গেছে।
কালের কণ্ঠ : ডিসিসি কি তাহলে ঋণগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : আমরা ঋণের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। জানেন কি একসময় নগর ভবনও মর্টগেজ দেওয়া ছিল। আমরা বেতন দিতে পারতাম না কর্মচারীদের। এখন কিন্তু সেই অবস্থা নেই।
কালের কণ্ঠ : এর প্রতিফলন কি রাস্তাঘাটের উন্নয়ন কিংবা সংস্কারের ওপর গিয়ে পড়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : একসময় একটি সংস্থা রাস্তা কাটলে আরেকটি সংস্থা এসে আবার কাটত। সমন্বয়হীনতার কারণে সংস্কারকাজ বিঘি্নত হতো। এখন সেই অবস্থা নেই। আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস করলাম। তার পরও করলাম ঠিকাদারদের প্যানেল। ফলে কাজ দেরি হয় না এখন।
কালের কণ্ঠ : আপনি দীর্ঘদিন ধরে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আপনাকে যদি তা মূল্যায়নের কথা বলি তাহলে সাফল্য-ব্যর্থতাকে কিভাবে দেখবেন?
সাদেক হোসেন খোকা : আমি যখন মেয়র হই তখন ঢাকার ৮০ শতাংশ রাস্তার অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। মৌচাক থেকে রামপুরা যে রাস্তা গিয়েছে সেখানে পানি জমে থাকত। রিকশা থেকে মানুষ পড়ে যাচ্ছে এমন ছবি পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে। নর্থ সাউথ রোড এলাকায় মানুষ চলাচল করতে পারত না। ডিসিসি ৬৩১ কোটি টাকার ঋণে জর্জরিত ছিল। মশার ওষুধ ছিল না। ঠিকাদাররা কাজ করে গিয়ে বিল পাচ্ছিলেন না। এমনও দেখা যেত দরপত্র নিয়ে গোলাগুলি হতো। এখন সেই অবস্থা নেই।
কালের কণ্ঠ : মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সড়কের নামকরণের ব্যাপারে আপনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা কি শেষ হয়েছে?
সাদেক হোসেন খোকা : বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মান জানানো আমাদের দায়িত্ব। অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমরা সেই কাজটি করেছি। আমরা দলমতের ঊধর্ে্ব থেকে রাস্তার নামকরণ করেছি। সেখানে অনেক রাস্তার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হয়েছে সংগত কারণেই।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
সাদেক হোসেন খোকা : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments