কালের পুরাণ-রাষ্ট্রপতির সংলাপ by সোহরাব হাসান
একটি সুসংবাদ ও একটি দুঃসংবাদ দিয়েই ১৬ ডিসেম্বর, এবারের বিজয় দিবসটি শুরু হয়েছে। আগে দুঃসংবাদটির কথা বলি। বিজয় দিবসের ভোরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মারামারি করেছেন। সকাল সাতটায় প্রধানমন্ত্রী যখন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বেরিয়ে আসবেন, তখনই এ ঘটনা ঘটে।
আগের রাতে স্মৃতিসৌধ চত্বরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ব্যানার টানায়। এর মধ্যে কে বা কারা বিএনপির ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। এই ব্যানার ছেঁড়া নিয়েই সকালে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়।
বহু বছর পর জাতীয় স্মৃতিসৌধের পবিত্র চত্বরে এই অঘটন ঘটল। সেনাশাসক এরশাদের আমলে প্রায়ই সেখানে মারামারির ঘটনা ঘটত। তাহলে আবার কি দেশে সেই অরাজক অবস্থা ফিরে এল? বিএনপি বলেছে, এর জন্য সরকারই দায়ী। আওয়ামী লীগ বলেছে, বিএনপি পরিস্থিতি তৈরি করার জন্যই সংঘর্ষ বাধিয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করেছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন গুম-খুনের রহস্য ভেদ করতে পারেন না। এমনকি গুম-খুন যে দেশে হচ্ছে, তাও নাকি জেনেছেন পত্রিকা পড়ে। এমনই যোগ্যতম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি। সবকিছুর পেছনে তিনি ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের ষড়যন্ত্র’ খোঁজেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি জানেনই কারা ষড়যন্ত্র করছে, তাহলে তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য তাদের ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করা, বক্তৃতাবাজি নয়। দেশে সরকার থাকবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকবেন, তাঁর পুলিশ বাহিনী, র্যাব বাহিনীকে জনগণ পুষবে আর এ রকম করে একেকটি লোক ‘নাই’ হয়ে যাবে, তা হতে পারে না।
২.
এবার সুসংবাদটি জানাব। গতকাল শুক্রবার বিজয় দিবসে প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘সংলাপ করবেন রাষ্ট্রপতি’। বঙ্গভবনের উচ্চপর্যায়ের সূত্রের বরাত দিয়ে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্ক এড়াতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। সব দলের মতামত নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে চান।’
বহুদিন আমরা রাজনীতিতে সংলাপ ও সমঝোতার কথা শুনি না। যদিও গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলো সংলাপ, আলোচনা, বিতর্ক। অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা হতে পারে, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলি নেতারাও মাঝেমধ্যে বসেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা মুখোমুখি হন না। এক দল আরেক দলকে চোর, বাটপার, দুশমন ও বিদেশি দালাল বলে সম্বোধন করে। আমাদের নেতা-নেত্রীরা কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলেন না। এঁদের থেকে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম কী শিক্ষা নেবে!
নব্বইয়ের দশকেও দেখেছি, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের কাছে আওয়ামী লীগের নেতারা যেতেন নালিশ জানাতে, প্রতিকার চাইতে। একইভাবে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে বিএনপির নেতারাও যেতেন, প্রতিকার চাইতেন। বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতাই রাখা হয়নি। সাহাবুদ্দীন আহমদ আক্ষেপ করে বলতেন, মিলাদ পড়া ও কবর জিয়ারত ছাড়া তাঁর কোনো কাজ নেই। তার পরও সবাই রাষ্ট্রপতি পদটিকে ইনস্টিটিউশন হিসেবে দেখতেন। এখন সেই সুযোগ নেই। দুই দলই রাষ্ট্রপতি পদটিকে দলীয় বৃত্তে বেঁধে ফেলেছে। খালেদা জিয়া বেছে বেছে এমন লোককে রাষ্ট্রপতি করেছেন, যাঁরা তাঁর হুকুম-বরদার হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘বঙ্গভবনে উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক চলাকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে যেতেন এবং ম্যাডামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে এসে সিদ্ধান্ত জানাতেন।’ শেখ হাসিনা ‘বাড়ির সামনে অনশন করার হুমকি’ দিয়ে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁর বিদায়টা সুখকর হয়নি। দলের হয়ে কেউ কাজ না করলেই প্রতিপক্ষের দালাল বা ষড়যন্ত্রকারী হয়ে যান।
৩.
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতিই নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেন এবং যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের ইচ্ছা পূরণ হয়। যেমন, বিগত চারদলীয় জোট সরকার বিরোধী দলের আপত্তি ও সংবিধান উপেক্ষা করে বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ নিয়োগ দিয়েছিল এম এ সাঈদকে। কিন্তু তাতে কারও শেষরক্ষা হয়নি। ২০০১ সালে এম এ সাঈদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আর এম এ আজিজ অতি চালাকি করায় ২০০৭ সালের নির্বাচনটাই ভেস্তে যায়।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করবেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও জাতির কাছে সে রকম ওয়াদা করেছিলেন। এখন রাষ্ট্রপতি যদি সত্যি সত্যি নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে সব দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেন, আমরা কায়মনোবাক্যে তাকে স্বাগত জানাব এবং সাফল্য কামনা করব।
যেকোনো দেশে গণতন্ত্রের জন্য চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন। এম এ আজিজ বা ‘সাদেকালি’ মার্কা নির্বাচন কমিশন দিয়ে চলবে না।
সংলাপের খবরটি একই সঙ্গে আমাদের মনে আশা জাগায় এবং শঙ্কা বাড়ায়। আশা জাগায় এ জন্য যে দেশবাসী বহুদিন পর ক্ষমতার জন্য প্রবলভাবে লালায়িত দুটি দলের নেতাদের একসঙ্গে বসতে দেখবে। তাঁরা আলোচনা ও হাসি বিনিময় করবেন। আমরা এও বিশ্বাস করি, উভয় পক্ষ চাইলে নির্বাচন কমিশন গঠন বা এই সাংবিধানিক পদের জন্য পাঁচজন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয় (খালেদা জিয়া এখন নিশ্চয়ই মানবেন, পাগল ও শিশু ছাড়াও দেশে নিরপেক্ষ লোক আছেন)।
আর রাষ্ট্রপতির সম্ভাব্য এই উদ্যোগ যদি সফল না হয়, তাহলে কী হতে পারে? আমাদের চোখের সামনে ২০০৬ সালের শেষার্ধের দৃশ্যাবলি ভেসে ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপটি যদি নিছক লোক দেখানো হয়, তাহলে কখনোই সমঝোতা হবে না।
আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনই হতে পারে ক্ষমতাসীনদের জন্য প্রথম মহাপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে দেশটি আপাতত ‘গৃহযুদ্ধ’ থেকে রেহাই পাবে। আর না হলে কী হবে, কেউ বলতে পারে না। দেশবাসী লোক দেখানো সংলাপ চায় না, চায় অর্থবহ সংলাপ, ফলপ্রসূ সংলাপ। ২০০৬ সালে ক্ষমতার পালাবদলের আগে সংলাপে বসেছিলেন বিএনপির নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল জলিল। তাঁরা ছিলেন পুতুলনাচের পুতুল মাত্র। সুতা ছিল দুই নেত্রীর হাতে। পরে মান্নান ভূঁইয়া অভিযোগ করেছিলেন, দলীয় চেয়ারপারসনের কারণেই সংলাপ সফল হয়নি। কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, সরকার যদি আগে ঠিকঠাক করে সংলাপে বসে কিংবা বিরোধী দল যদি ভাবে সংলাপে বসব, তবে তালগাছ আমার থাকতে হবে—এই জেদ ধরে, তাহলে সংলাপ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
৪.
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দেয় প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য। আর প্রতিশ্রুতি ভাঙে নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে ফের আকৃষ্ট করার জন্য।
ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের তীব্র বাদানুবাদ ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ যদি দুই দলকে এক টেবিলেও বসাতে পারে, তাও ভালো দৃষ্টান্ত হবে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেছেন, ‘সংলাপ হওয়া ভালো।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছেন, ‘সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।’ রাষ্ট্রপতি কাদের নিয়ে সংলাপ করবেন? জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এবং এখন প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও আগে ছিল—এমন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিলে সেই নির্বাচন কমিশনের প্রতি নিশ্চয়ই মানুষের আস্থা বাড়বে। বিতর্ক কম হবে।
প্রস্তাবিত সংলাপ নিয়ে শঙ্কাও কম নয়। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক ভালো পদক্ষেপও ভণ্ডুল হয়ে গেছে নেতাদের গলাবাজি ও আবোলতাবোল বচনে। আবার কখনো প্রতিশ্রুতি দেওয়াই হয়েছে প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য। যে কারণে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। এখন তো তাদের অবস্থান দুই মেরুতে। নির্বাচনের পর বিজয়ী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী (তখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেননি) শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করে বিরোধী দল থেকে সংসদের ডেপুটি স্পিকার নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে ক্ষমতাসীনেরা সেই অবস্থান থেকে সরে আসে। দলের একটি প্রভাবশালী মহল প্রধানমন্ত্রীকে বোঝালেন, বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকার পদ দিলে নাকি সংসদ চালানো যাবে না। যে সংসদে বিরোধী দলের আসনসংখ্যা ৪০টির বেশি নয়, সেই সংসদ নিয়ে সরকারি দলের এ আশঙ্কা কেবল অমূলক নয়, উদ্দেশ্যমূলকও। আমাদের গণতন্ত্রের মূল সমস্যা হলো, সরকারি দল সবকিছু দখলে নিতে চায়, আর বিরোধী দল সবকিছুতে বাদ সেধে পরবর্তী দখলের পথ পরিষ্কার করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ নেতাদের কাছে প্রশ্ন, এখন কি সংসদ খুব ভালোভাবে চলছে? মন্ত্রী-সাংসদেরা সংসদে যান না, গেলে কথা বলেন না। ড. কামাল হোসেন এর নাম দিয়েছেন ‘বোবা সংসদ’। বোবা সংসদ দিয়ে আর যা-ই হোক, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।
এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এমন কিছু বলা উচিত হবে না, যাতে বিরোধী দল সংলাপের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে পারলে অনেক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। এমনকি বিরোধী দল যেসব কারণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য মনে করছে, সেসব কারণ দূর করতে পারলে তাদের আন্দোলনও জনসমর্থন পাবে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
বহু বছর পর জাতীয় স্মৃতিসৌধের পবিত্র চত্বরে এই অঘটন ঘটল। সেনাশাসক এরশাদের আমলে প্রায়ই সেখানে মারামারির ঘটনা ঘটত। তাহলে আবার কি দেশে সেই অরাজক অবস্থা ফিরে এল? বিএনপি বলেছে, এর জন্য সরকারই দায়ী। আওয়ামী লীগ বলেছে, বিএনপি পরিস্থিতি তৈরি করার জন্যই সংঘর্ষ বাধিয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করেছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন গুম-খুনের রহস্য ভেদ করতে পারেন না। এমনকি গুম-খুন যে দেশে হচ্ছে, তাও নাকি জেনেছেন পত্রিকা পড়ে। এমনই যোগ্যতম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি। সবকিছুর পেছনে তিনি ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের ষড়যন্ত্র’ খোঁজেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি জানেনই কারা ষড়যন্ত্র করছে, তাহলে তাঁর প্রথম ও প্রধান কর্তব্য তাদের ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করা, বক্তৃতাবাজি নয়। দেশে সরকার থাকবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকবেন, তাঁর পুলিশ বাহিনী, র্যাব বাহিনীকে জনগণ পুষবে আর এ রকম করে একেকটি লোক ‘নাই’ হয়ে যাবে, তা হতে পারে না।
২.
এবার সুসংবাদটি জানাব। গতকাল শুক্রবার বিজয় দিবসে প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল: ‘সংলাপ করবেন রাষ্ট্রপতি’। বঙ্গভবনের উচ্চপর্যায়ের সূত্রের বরাত দিয়ে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিতর্ক এড়াতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবেন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। সব দলের মতামত নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করতে চান।’
বহুদিন আমরা রাজনীতিতে সংলাপ ও সমঝোতার কথা শুনি না। যদিও গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলো সংলাপ, আলোচনা, বিতর্ক। অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনা হতে পারে, ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলি নেতারাও মাঝেমধ্যে বসেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা মুখোমুখি হন না। এক দল আরেক দলকে চোর, বাটপার, দুশমন ও বিদেশি দালাল বলে সম্বোধন করে। আমাদের নেতা-নেত্রীরা কাউকে সম্মান দিয়ে কথা বলেন না। এঁদের থেকে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম কী শিক্ষা নেবে!
নব্বইয়ের দশকেও দেখেছি, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের কাছে আওয়ামী লীগের নেতারা যেতেন নালিশ জানাতে, প্রতিকার চাইতে। একইভাবে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে বিএনপির নেতারাও যেতেন, প্রতিকার চাইতেন। বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতাই রাখা হয়নি। সাহাবুদ্দীন আহমদ আক্ষেপ করে বলতেন, মিলাদ পড়া ও কবর জিয়ারত ছাড়া তাঁর কোনো কাজ নেই। তার পরও সবাই রাষ্ট্রপতি পদটিকে ইনস্টিটিউশন হিসেবে দেখতেন। এখন সেই সুযোগ নেই। দুই দলই রাষ্ট্রপতি পদটিকে দলীয় বৃত্তে বেঁধে ফেলেছে। খালেদা জিয়া বেছে বেছে এমন লোককে রাষ্ট্রপতি করেছেন, যাঁরা তাঁর হুকুম-বরদার হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন সাবেক উপদেষ্টা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘বঙ্গভবনে উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক চলাকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে যেতেন এবং ম্যাডামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে এসে সিদ্ধান্ত জানাতেন।’ শেখ হাসিনা ‘বাড়ির সামনে অনশন করার হুমকি’ দিয়ে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁর বিদায়টা সুখকর হয়নি। দলের হয়ে কেউ কাজ না করলেই প্রতিপক্ষের দালাল বা ষড়যন্ত্রকারী হয়ে যান।
৩.
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতিই নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক পদে নিয়োগ দেন এবং যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের ইচ্ছা পূরণ হয়। যেমন, বিগত চারদলীয় জোট সরকার বিরোধী দলের আপত্তি ও সংবিধান উপেক্ষা করে বিচারপতি এম এ আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেছিল। তার আগে আওয়ামী লীগ নিয়োগ দিয়েছিল এম এ সাঈদকে। কিন্তু তাতে কারও শেষরক্ষা হয়নি। ২০০১ সালে এম এ সাঈদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। আর এম এ আজিজ অতি চালাকি করায় ২০০৭ সালের নির্বাচনটাই ভেস্তে যায়।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করবেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারাও জাতির কাছে সে রকম ওয়াদা করেছিলেন। এখন রাষ্ট্রপতি যদি সত্যি সত্যি নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে সব দলের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেন, আমরা কায়মনোবাক্যে তাকে স্বাগত জানাব এবং সাফল্য কামনা করব।
যেকোনো দেশে গণতন্ত্রের জন্য চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন। এম এ আজিজ বা ‘সাদেকালি’ মার্কা নির্বাচন কমিশন দিয়ে চলবে না।
সংলাপের খবরটি একই সঙ্গে আমাদের মনে আশা জাগায় এবং শঙ্কা বাড়ায়। আশা জাগায় এ জন্য যে দেশবাসী বহুদিন পর ক্ষমতার জন্য প্রবলভাবে লালায়িত দুটি দলের নেতাদের একসঙ্গে বসতে দেখবে। তাঁরা আলোচনা ও হাসি বিনিময় করবেন। আমরা এও বিশ্বাস করি, উভয় পক্ষ চাইলে নির্বাচন কমিশন গঠন বা এই সাংবিধানিক পদের জন্য পাঁচজন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয় (খালেদা জিয়া এখন নিশ্চয়ই মানবেন, পাগল ও শিশু ছাড়াও দেশে নিরপেক্ষ লোক আছেন)।
আর রাষ্ট্রপতির সম্ভাব্য এই উদ্যোগ যদি সফল না হয়, তাহলে কী হতে পারে? আমাদের চোখের সামনে ২০০৬ সালের শেষার্ধের দৃশ্যাবলি ভেসে ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপটি যদি নিছক লোক দেখানো হয়, তাহলে কখনোই সমঝোতা হবে না।
আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলছি, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনই হতে পারে ক্ষমতাসীনদের জন্য প্রথম মহাপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে দেশটি আপাতত ‘গৃহযুদ্ধ’ থেকে রেহাই পাবে। আর না হলে কী হবে, কেউ বলতে পারে না। দেশবাসী লোক দেখানো সংলাপ চায় না, চায় অর্থবহ সংলাপ, ফলপ্রসূ সংলাপ। ২০০৬ সালে ক্ষমতার পালাবদলের আগে সংলাপে বসেছিলেন বিএনপির নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুল জলিল। তাঁরা ছিলেন পুতুলনাচের পুতুল মাত্র। সুতা ছিল দুই নেত্রীর হাতে। পরে মান্নান ভূঁইয়া অভিযোগ করেছিলেন, দলীয় চেয়ারপারসনের কারণেই সংলাপ সফল হয়নি। কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, সরকার যদি আগে ঠিকঠাক করে সংলাপে বসে কিংবা বিরোধী দল যদি ভাবে সংলাপে বসব, তবে তালগাছ আমার থাকতে হবে—এই জেদ ধরে, তাহলে সংলাপ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
৪.
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতি দেয় প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য। আর প্রতিশ্রুতি ভাঙে নতুন প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষকে ফের আকৃষ্ট করার জন্য।
ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের তীব্র বাদানুবাদ ও সাংঘর্ষিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ যদি দুই দলকে এক টেবিলেও বসাতে পারে, তাও ভালো দৃষ্টান্ত হবে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রপতির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেছেন, ‘সংলাপ হওয়া ভালো।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছেন, ‘সবার সঙ্গে আলোচনা করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে।’ রাষ্ট্রপতি কাদের নিয়ে সংলাপ করবেন? জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব আছে এবং এখন প্রতিনিধিত্ব না থাকলেও আগে ছিল—এমন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত নিলে সেই নির্বাচন কমিশনের প্রতি নিশ্চয়ই মানুষের আস্থা বাড়বে। বিতর্ক কম হবে।
প্রস্তাবিত সংলাপ নিয়ে শঙ্কাও কম নয়। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক ভালো পদক্ষেপও ভণ্ডুল হয়ে গেছে নেতাদের গলাবাজি ও আবোলতাবোল বচনে। আবার কখনো প্রতিশ্রুতি দেওয়াই হয়েছে প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য। যে কারণে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। এখন তো তাদের অবস্থান দুই মেরুতে। নির্বাচনের পর বিজয়ী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী (তখনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেননি) শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করে বিরোধী দল থেকে সংসদের ডেপুটি স্পিকার নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে ক্ষমতাসীনেরা সেই অবস্থান থেকে সরে আসে। দলের একটি প্রভাবশালী মহল প্রধানমন্ত্রীকে বোঝালেন, বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকার পদ দিলে নাকি সংসদ চালানো যাবে না। যে সংসদে বিরোধী দলের আসনসংখ্যা ৪০টির বেশি নয়, সেই সংসদ নিয়ে সরকারি দলের এ আশঙ্কা কেবল অমূলক নয়, উদ্দেশ্যমূলকও। আমাদের গণতন্ত্রের মূল সমস্যা হলো, সরকারি দল সবকিছু দখলে নিতে চায়, আর বিরোধী দল সবকিছুতে বাদ সেধে পরবর্তী দখলের পথ পরিষ্কার করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের বিজ্ঞ নেতাদের কাছে প্রশ্ন, এখন কি সংসদ খুব ভালোভাবে চলছে? মন্ত্রী-সাংসদেরা সংসদে যান না, গেলে কথা বলেন না। ড. কামাল হোসেন এর নাম দিয়েছেন ‘বোবা সংসদ’। বোবা সংসদ দিয়ে আর যা-ই হোক, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না।
এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এমন কিছু বলা উচিত হবে না, যাতে বিরোধী দল সংলাপের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে পারলে অনেক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। এমনকি বিরোধী দল যেসব কারণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য মনে করছে, সেসব কারণ দূর করতে পারলে তাদের আন্দোলনও জনসমর্থন পাবে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
No comments