রাজস্ব-করারোপণের রাজনৈতিক অর্থনীতি by সাদিক আহমেদ

ন্নয়নশীল দেশে সচরাচর যে ধরনের বিক্ষোভ দেখা যায়, বর্তমানে শিল্পোন্নত দেশগুলোও সে ধরনের বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করছে। সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের আন্দোলনগুলোর তিক্ত অভিজ্ঞতা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে; এমনকি একটি বিতর্ক ইতিমধ্যে চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে, বাজার অর্থনীতি কি হুমকির মুখে?


বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের কর-ব্যবস্থার অন্যায্যতাকে তুলে ধরছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের ওয়ারেন বাফেট গত ১৪ আগস্ট প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বলেন, একজন মজুর তাঁর মজুরির যত অংশ কর দেন, এর তুলনায় ওয়ারেন বাফেট তাঁর আয়ের কম অংশ কর দেন। তাঁর মত, এ কর-ব্যবস্থায় বৈষম্য রয়েছে এবং এটিকে সংস্কার করা উচিত। অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্বের সময়ে মাঝারি আয়ের লোকদের ওপর করের বোঝা যুক্তরাষ্ট্রে গুরুতর বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে, যেখানে কর-ব্যবস্থাপনা অনেক শক্তিশালী এবং বেশির ভাগ রাজস্ব বিভিন্ন করপোরেট ও ব্যক্তিগত আয়কর থেকে আসে, সেখানেও কর-আইনের ফাঁক গলে ধনীরা গড় আয়ের মানুষ থেকে কম কর দেওয়ার রাস্তা খোঁজেন। এটি বিশ্বব্যাপী করারোপণের রাজনৈতিক অর্থনীতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা সংসদে বসেন, তাঁরা সাধারণত ধনিক শ্রেণীর এবং প্রভাবশালী। উপরন্তু, নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থ জোগানের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও ধনিক শ্রেণীর আধিপত্য দেখা যায়, যাঁরা অর্থ প্রদানের বিনিময়ে বিভিন্ন ধরনের কর-সুবিধা লাভ করেন।
এর সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি যথেষ্ট মেলে, প্রকৃত পক্ষে এখানে করারোপণের সমস্যা অনেক গভীর ও অন্যায্য। ২০১১ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ রাজস্ব কর থেকে সংগ্রহ করেছে। এই রাজস্বের ৩০ শতাংশ—যা জিডিপির তিন শতাংশ—আয়কর থেকে এসেছে (ব্যক্তিগত ও করপোরেট)। এর মধ্যে ব্যক্তিগত কর ছিল জিডিপির এক শতাংশ এবং করপোরেট লভ্যাংশ কর ছিল জিডিপির দুই শতাংশ। এটি যেকোনো মানদণ্ডে হতাশাব্যঞ্জক।
নিম্ন কর রাজস্ব বিভিন্ন ধরনের সরকারি কর্মকাণ্ডে অর্থায়নের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস করে। যেসব সরকারি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গরিব শ্রেণীর মানুষ সুবিধা ভোগ করতে পারে, এর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিশুদ্ধ পানি ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী অন্তর্ভুক্ত। এটা সরকারের অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষমতাকেও হ্রাস করে। এ কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান বাধা পায়। সরকারি সেবার নিম্নমানের কারণে উদ্ভূত জনরোষ সামলাতে সরকার বিদ্যুৎ, সার, খাদ্য এমনকি কিছু নিরাপত্তাবেষ্টনী পরিকল্পনায় ভর্তুকি দিচ্ছে। এ ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকার অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে। ঘাটতি অর্থায়নের জন্য সরকার সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতির দিকে ঝুঁকছে, যা যুক্তিযুক্ত মাত্রা অতিক্রম করে মূল্যস্ফীতির অবনতি ঘটাচ্ছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে, যা কিনা ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরের থেকে সর্বোচ্চ।
সরকারি খাত কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ফলে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতিবিদেরা ‘মূল্যস্ফীতি কর’ হিসেবে অভিহিত করেন। ল্যাটিন আমেরিকায় এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি সম্পদ আহরণের উৎস হিসেবে দুর্নাম কুড়ায়। বাংলাদেশ প্রথাগতভাবে এই মূল্যস্ফীতি করকে সম্পদ আহরণের হাতিয়ার হিসেবে নেয়নি এবং মূল্যস্ফীতিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মোকাবিলা করেছে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সরকার ২৪ মাস ধরে মূল্যস্ফীতিকে ক্রমাগত বাড়তে দিয়েছে।
সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে সরকারকে কিছু বিকল্পের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এসব বিকল্পের মধ্যে অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে সম্ভবত সবচেয়ে আকর্ষণীয় হাতিয়ার হলো আয়করকে শক্তিশালী করা। কর প্রশাসনের উন্নয়ন কেবল মধ্যবর্তী ও দীর্ঘ মেয়াদে ফল বয়ে আনবে। স্বল্প মেয়াদে আয়করের মাধ্যমে আয়বৃদ্ধির দ্রুততম উপায় হচ্ছে বিভিন্ন ফাঁকফোকর ও রেয়াতসুবিধা বন্ধ করা। বড় ফাঁকটি হলো রিয়েল এস্টেট লেনদেনের মাধ্যমে মূলধনী মুনাফা ও শেয়ারবাজারের আয়ের ওপর কার্যত করের অনুপস্থিতি। সরকার একইভাবে সম্পত্তির ওপর যথাযথ করারোপ করতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন কর রেয়াত প্রদান বন্ধ করতে পারে। এসব কাজ বিপুল রাজস্ব এনে দিতে পারে, বিশেষ করে প্রথম দুটি উপায়ে। এ করগুলো অন্যান্য করের তুলনায় প্রগতিশীল এবং ন্যায়ভিত্তিক।
দ্বিতীয়ত, সরকারপ্রদত্ত বিভিন্ন পণ্য ও সেবার সঠিক মূল্য আরোপ করে সরকার সম্পদ আহরণ করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে কেবল ত্বরিত কর্মোদ্যোগের অভাবেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকি এ অর্থবছরে চার বিলিয়ন ডলারে উত্তীর্ণ হয়েছে। এ ভর্তুকি রাজস্ব আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ, যা কোনোভাবেই টেকসই নয়। সরকার মূল্য সমন্বয় করে এটিকে অর্ধেকে কমিয়ে আনতে পারে। গরিব ভোক্তাদের জন্য সতর্কভাবে ভর্তুকি ঠিক করলে এটি আরও বেশি ন্যায়সংগত হবে।
ঘাটতি অর্থায়নের আরেকটি উপায় বেসরকারি খাত কর্তৃক অর্থায়ন। বাংলাদেশ বর্তমানে বিভিন্ন জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মাধ্যমে সামান্য সম্পদ আহরণ করছে। সরকার ট্রেজারি বিল বাজারের মাধ্যমে বেসরকারি খাত থেকে ঋণ সংগ্রহের এ খাতকে আরও বৃদ্ধি করতে পারে।
সবশেষ যে উপায়, সেটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সম্পদ ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি করের ব্যবহার। স্বল্প মেয়াদে এটিই সবচেয়ে সহজ পন্থা। একটি স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুপস্থিতিতে রাজস্ব বিভাগের এ ব্যবস্থায় অবাধ প্রবেশাধিকার আছে।
বাংলাদেশে দুর্বল কর আদায়ের প্রচেষ্টা এবং হতাশাব্যঞ্জক কর আদায় দুর্বল কর প্রশাসনের পরিচায়ক, আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই যে ধনিক শ্রেণীর অর্থ আয়ের উৎসগুলো—যেমন, রিয়েল এস্টেট লেনদেন এবং শেয়ারবাজার থেকে অর্জিত মুনাফা—প্রকৃত প্রস্তাবে করের আওতার বাইরে। সম্পদ করের মাধ্যমে অর্থ আহরণের ক্ষেত্রেও সুসংগঠিত কর-ব্যবস্থার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এসব দুর্বলতা ঠিক করার কোনো প্রস্তাব করা হলে তা যথেষ্ট বাধার মুখে পড়ে এবং রাজনৈতিক বিতর্কের জেরে তা ভণ্ডুল হয়ে যায়। আয়করের ভিত্তিকে আরও বাড়িয়ে আয়ের উৎস-নির্বিশেষে সব আয়কে ওই ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং উন্নত ও সুসংগঠিত সম্পদ কর-ব্যবস্থা চালু করা রাজস্ব-ব্যবস্থা সংস্কারের দুটি আর্থরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সহজ একটি হাতিয়ার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক লেনদেনের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ভারসাম্য রক্ষায় এটি নীতিনির্ধারণী পন্থা হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এর সাম্প্রতিক উদার ব্যবহার বেশ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের কর-ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে, যদিও কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে এবং কর প্রশাসনে কিছুটা উন্নতি হয়েছে; কিন্তু সংস্কার-প্রচেষ্টা এখনো দায়সারা। করারোপণের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতির অবর্তমানে সম্পদ আহরণের কৌশল হিসেবে মূল্যস্থিতি করের প্রয়োগ যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ, যা এড়িয়ে চলা উচিত। আধুনিক আয়কর-ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করা দরকার। এটির ভিত্তি হবে বিস্তৃত এবং স্বল্প রেয়াতভিত্তিক, যেটি রাজস্ব-ব্যবস্থা সংস্কারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতি ব্যবস্থার মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন করতে হবে, যা বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে আসবে।
জনগণকেও তাদের ওপর আরোপিত কর দেওয়ার সদিচ্ছা রাখতে হবে। এটি একটি অলিখিত সামাজিক চুক্তি। সমতা ব্যতিরেকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমাজে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশে যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল এবং অত্যন্ত ধীরগতিতে বিবর্তিত হচ্ছে, সেখানে অসম নীতি শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশি সমস্যার জন্ম দিতে পারে।
ড. সাদিক আহমেদ, ভাইস চেয়ারম্যান, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।
sahmed1952@live.com

No comments

Powered by Blogger.