জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি-শতবর্ষে ওবায়েদ উল হক by নার্গিস হোসনে আরা
বেঁচে থাকলে আজ শতবর্ষ পূরণ করতেন তিনি। ঘটা করে তাঁর সেঞ্চুরি উদ্যাপনের ইচ্ছা ছিল অনেকেরই। ২০০৬ সালে তাঁর ৯৬তম জন্মদিনে সে রকম ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম আমরা কয়েকজন। বলেছিলাম, 'আপনার সেঞ্চুরি দেখতে চাই।' এর আগের এক দশক ধরে প্রতি জন্মদিনে ফুল নিয়ে তাঁর বনানীর বাড়িতে গেছি। কী যে খুশি হতেন! আমাদের কথার উত্তরে বলেছিলেন, সে সুযোগ হয়তো হবে না। দেশের সাংবাদিকতাজগতের এক আলোকিত মানুষ ছিলেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে নিরহংকার, অথচ অসম্ভব দীপ্তিময় একজন মানুষ। ছিলেন প্রায় একটি শতাব্দীর সাক্ষী। বাংলাদেশের ফেনী জেলায় জন্ম ১৯১১ সালে, যখন সমাজ অনেক পেছনে। দেশ পরাধীন। সেই সময়ে জন্ম নেওয়া ওবায়েদ উল হক নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন স্বতন্ত্র এক মানুষ হিসেবে। অনেক গুণের অধিকারী, কিন্তু নিজেকে নিয়ে কখনো বড়াই করেননি। অসম্ভব বিনয়ী এই মানুষটিকে দেখলে, তাঁর সঙ্গে কথা বললে, নতুন কারো বুঝে ওঠা কঠিন ছিল যে এই মানুষটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এত প্রতিভা। প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন এই উপমহাদেশজুড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছিলেন ১৯৩৪ সালে। সে আমলের বাঙালি সমাজে যেমনটি স্বাভাবিক ছিল, আর দশজন বাঙালি সন্তানের মতোই যোগ দিয়েছিলেন সরকারি চাকরিতে। কিন্তু বেশিদিন নিয়ম বাঁধা সরকারি চাকরিতে মন বসেনি তাঁর। চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তাঁর অভিষেক 'হিমাদ্রী চৌধুরী' নামে। তাঁর ওই ছবির গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন প্রয়াত হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও তাঁর স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়। এরপর ওবায়েদ উল হক নির্মাণ করেন আরো দুটি চলচ্চিত্র_'দুই দিগন্ত' ও 'অন্তরঙ্গ'। ষাটের দশকে তাঁর কাহিনী নিয়ে 'আজান' নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মরহুম ফজলুল হক। কেবল চলচ্চিত্রেই থেমে থাকেননি, পরিচালনা করেছেন নিজের লেখা মঞ্চনাটক 'সায়াহ্নের সংলাপ'। তাঁর লেখা আরেকটি দর্শকপ্রিয় মঞ্চনাটক 'এই পার্কে'। টেলিভিশনের জন্যও নাটক লিখেছেন তিনি। দেশ বিভাগের পর কলকাতা ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯৫১ সালে যোগ দেন ওই সময়ের ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদকীয় বিভাগে। অবজারভারের সহকারী সম্পাদক, উপসম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন অবজারভারের সম্পাদক। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট গঠনের সময় তিনি এ প্রতিষ্ঠানটির গঠন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। দৈনিক বাংলা ও বাংলাদেশ টাইমস ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। ছিলেন ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের আপিল কমিটির চেয়ারম্যান। ওবায়েদ উল হক সত্যিকারের একজন সব্যসাচী লেখক। সাংবাদিকতা পেশার লেখার পাশাপাশি লিখেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস, রম্যরচনা ও নাটক। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদক। পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার, মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা, ইউনিসেফ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। শততম জন্মবার্ষিকীতে আজ তাঁকে স্মরণ করি পরম শ্রদ্ধায়।
নার্গিস হোসনে আরা
নার্গিস হোসনে আরা
No comments