বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-ডিজিটাল বাংলাদেশ ও বাস্তবতা by আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সোহাগ

প্রযুক্তির গবেষণায় যেমন মনোযোগী হতে হবে, তেমনি তার চেয়েও শতগুণ বেশি মনোযোগী হতে হবে বিজ্ঞান গবেষণায়। বিজ্ঞান গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে শতগুণ। অন্যান্য দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় জিডিপির কত অংশ খরচ করছে সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। গবেষণায় সুযোগ বাড়ালে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবিষ্কার উদ্ভাবনে সাফল্য পাব ২০২১ সালে স্ব্বাধীন বাংলাদেশ তার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করবে।


২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করা হবে এক তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' হিসেবে। এটাই ছিল বর্তমান সরকারের আলোচিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটগুলো অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ, যা নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। এসব ওয়েবসাইট থেকে যে কেউ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা প্রদানকারী ফর্ম ডাউনলোড করতে পারেন। সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হচ্ছে, দেশের ৬৪টি জেলার ওয়েবপোর্টাল তৈরি করা, যেখানে প্রতিটি জেলার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জনপ্রতিনিধিদের ফোন নম্বর স্থান পেয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফর্ম এখন ইন্টারনেট থেকেই ডাউনলোড করা যাচ্ছে। দুই বছর থেকে আয়োজন করা হচ্ছে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা এবং সেখানে সরকারের সব মন্ত্রণালয় তাদের ডিজিটাল সেবার পসরা সাজিয়ে বসছে জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেওয়ার জন্য। সরকার ভূমি ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, যেখানে সব জমির রেকর্ড ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে। দেশের কোর্টগুলোতে বিদ্যমান মামলাগুলো ঠিক একইভাবে ডিজিটালাইজ করা হচ্ছে। জাতীয় তথ্য অধিকার আইন করার মাধ্যমে তথ্য পাওয়াকে যে কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকারে পরিণত করা হয়েছে।
এখানে দেখা যাচ্ছে, সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য নানাবিধ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে গবেষণা যে অন্যতম মুখ্য কাজ, সে বিষয়ে পিছিয়ে আছে এখনও। সেই সঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অপরিহার্য কারিগর তথা দক্ষ আইসিটি মানবসম্পদ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ-আয়োজনের দৈন্য রয়েছে। শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কম্পিউটার চালানো, ইন্টারনেট ব্যবহার ও ওয়েবসাইট তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং সীমিত সংখ্যক ইন্টার্নশিপ কর্মসূচির মাধ্যমে আইসিটি মানবসম্পদ তৈরির কাজে আমরা ব্যস্ত। কিন্তু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে জোরদার শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতিকে একটি দক্ষ আইটি মানবসম্পদ উপহার দেওয়ায় তেমন কোনো সাফল্য নেই। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান বড়মাপের একটা নেতিবাচক প্রবণতা হচ্ছে বিজ্ঞান বিষয়ে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়া। সম্প্র্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বিজ্ঞান শিক্ষায় পিছুটানের আত্মঘাতী প্রবণতার একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যারা ডিজিটাল বাংলাদেশ অভিধার সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন কিংবা দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, বারবার স্বপ্নভঙ্গের পরও যাদের স্বপ্ন দেখা থেমে নেই, তাদের নিশ্চিতভাবেই খবরটি উদ্বিগ্ন করবে। খবরটির শিরোনাম ছিল_ 'বাণিজ্য শিক্ষার দিকে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা : বিজ্ঞান পিছিয়ে'। খবরটিতে বলা হয়েছে, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এ দেশের শিক্ষার্থীরা। পরিবারের পক্ষ থেকেও এখন আর বিজ্ঞান পড়তে আগ্রহী করে তোলা হয় না। ফলে এ শিক্ষায় এক ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এই যদি হয় অবস্থা, তবে এ সংকটের অবসান না ঘটিয়ে কী করে সম্ভ্ভব হবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ পাওয়া! কোথায় পাব আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ জনবল? রিপোর্টটিতে এ সংকটের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগ কম। চাকরি পাওয়া কঠিন। অপরদিকে বাণিজ্য বিভাগে চাকরির সুযোগ বেশি। তাই সে বিভাগে ছাত্রসংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। চাকরির বাজারে এখন কদর এমবিএ আর বিবিএ ডিগ্রিধারীদের। রিপোর্টটিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, গত ৩ বছরে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কমেছে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অপরদিকে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া পরিসংখ্যান মতে, গত এক দশকে এসএসসি পর্যায়ে ব্যবসায় শিক্ষায় শিক্ষার্থী বেড়েছে ১৮ শতাংশ। এ সময়ে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থী কমেছে ১১ শতাংশ। এই বিষয় নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত এবং শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা অনস্বীকার্য।
সরকার অবশ্যই তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় আন্তরিক। কিন্তু ভুল দর্শন মাথায় নিয়ে সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে গেলে হোঁচট খাওয়া অসম্ভব নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকলেও সঠিক দর্শন আর দূরদৃষ্টি নিয়ে আমাদের বলা উচিত ছিল, 'চাই বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ'। তাহলে দেখা যেত 'বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ' পাওয়ার পাশাপাশি আমরা পেয়ে যেতাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি থাকলে আমাদের এ সত্য মানতেই হবে। বিজ্ঞানকে পাশে ঠেলে শুধু প্রযুক্তি নিয়ে আমরা মাতামাতি করি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বিজ্ঞান কোনো পণ্য তৈরি করে না। একটি মোবাইল ফোন উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু বিজ্ঞান আমাদের জানিয়ে দেয়। কিন্তু মোবাইল ফোন তৈরির কাজ বিজ্ঞানীর নয়। বিজ্ঞানীরা জ্ঞানদান করেন। প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদরা সেই জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করেন প্রযুক্তিপণ্য, যার ব্যবসায়িক মূল্য আছে। সে জন্যই বলা হয়, প্রযুক্তি হচ্ছে বিজ্ঞানের বাণিজ্যিক সম্প্র্রসারণ। বিজ্ঞান জন্ম দিতে পারে প্রযুক্তির, কিন্তু প্রযুক্তি জন্ম দিতে পারে না বিজ্ঞানের। প্রযুক্তি জন্ম দেয় প্রযুক্তিপণ্যের। বিজ্ঞান ছাড়া প্রযুক্তি অচল, প্রযুক্তি ছাড়া বিজ্ঞান অচল নয়। বিজ্ঞান বিকশিত হলে এর উপজাত হিসেবে প্রযুক্তিরই বিকাশ ঘটবে। পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভ্ভব হবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ। অতএব বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে, বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বাদ দিয়ে কখনও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভ্ভব নয়।
বিজ্ঞান সম্পর্কে দার্শনিক বার্টলম্যান বলেছেন, 'দর্শন যখন পথ হারায়, বিজ্ঞান তখন পথ দেখায়। আর বিজ্ঞান যখন পথ হারায়, দর্শন তখন পথ দেখায়'। তাই নানা মত, নানা পথ আর নানা দর্শনের ঠেলাঠেলিতে জাতি যখন আজ দিশেহারা, তখন উন্নয়নের হাতিয়ার করতে হবে আমাদের বিজ্ঞানকেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার হাতিয়ারও এ বিজ্ঞানই। সে জন্যই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় আমরা যারা আন্তরিক প্রয়াসী, তাদের প্রযুক্তির গবেষণায় যেমন মনোযোগী হতে হবে, তেমনি তার চেয়েও শতগুণ বেশি মনোযোগী হতে হবে বিজ্ঞান গবেষণায়। বিজ্ঞান গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে শতগুণ। অন্যান্য দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় জিডিপির কত অংশ খরচ করছে সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। গবেষণায় সুযোগ বাড়ালে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবিষ্কার উদ্ভাবনে সাফল্য পাব। যেমন আমাদের বিজ্ঞানীরাই আবিষ্কার করতে পেরেছেন পাটের জিনোম সিকুয়েন্স, কৃত্রিম কিডনি। তখন আমরা আর শুধু প্রযুক্তির ভেন্ডর হয়ে থাকব না, অন্যের প্রযুক্তি কিনে কিনে ফতুর হব না। নিজেদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি নিজেরাই ব্যবহার করব। ঘুচবে বাইরের প্রযুক্তি ব্যবহারের দৈন্য। হাতের মুঠোয় ২০২১ সালের আগেই পাব ডিজিটাল বাংলাদেশ। এ জন্য প্রয়োজন 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' স্লোগানের পাশাপাশি 'বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ' নামের স্লোগানটিও মনেপ্রাণে ধারণ।

আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সোহাগ : শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.