নিত্যজাতম্-যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন নীতি by মহসীন হাবিব
অধিক ব্যবসায়ী মনোভাব মার্চেন্ট অব ভেনিসের শাইলকের জন্ম দেয়। এটি ব্যক্তি মানুষের জন্য যেমন সত্য, রাষ্ট্রের জন্যও তেমনি সত্য। ব্যক্তি মানুষের যেমন নীতি-নৈতিকতা থাকে, মায়া-মমতা থাকে, নিষ্ঠুরতা-স্বার্থপরতা থাকে; তেমনি রাষ্ট্রেরও এসব থাকে।
কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রটি গুটিকয়েক মানুষ দ্বারাই পরিচালিত হয়, কোনো যন্ত্র দ্বারা নয়। এসব অনেক পুরনো কথা। নতুন কথাটি হলো, বিশ্বের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিন দিন শেঙ্পিয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিসের নিষ্ঠুর চরিত্র শাইলকে পরিণত হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক সংস্কার ও পররাষ্ট্রনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সে চেহারাটি দিন দিন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিককালের একটি সংস্কার প্রস্তাব পর্যালোচনা করলে তাদের পুরো দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট সিনেটর চার্লস ই শুমার এবং রিপাবলিকান দলের সিনেটর মাইক লি যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য একটি বিস্তৃত অভিবাসন প্যাকেজের প্রস্তাব করেছেন। সে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যে বিদেশি পাঁচ লাখ ডলার যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন ক্রয়ে ব্যবহার করবে তাকে প্রথমেই তিন বছরের জন্য রেসিডেনশিয়াল ভিসা প্রদান করা হবে। এ ক্ষেত্রে নূ্যনতম দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার তাকে প্রাথমিকভাবে আবাসনে ব্যয় করতে হবে এবং বছরে ১৮০ দিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে। বলা হয়েছে, কাগজপত্র পরীক্ষার পর একবার অনুমোদন দেওয়া হলে সরকারের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা_এসব সুবিধা পাবে না। এ ক্ষেত্রে আবেদনকারীরা একাধিক বাড়ি কিনতে পারবে এবং একটিতে নিজে বসবাস করে অন্যটি বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিতে পারবে। শুমার ও লি মনে করছেন, এ ব্যবস্থার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন সংকট অনেকটাই লাঘব হবে।
বিলটি নিশ্চিতভাবেই গৃহীত হতে যাচ্ছে। কারণ ইউএস চেম্বার অব কমার্স, দি ইউএস ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন, আমেরিকান হোটেল অ্যান্ড লজিং অ্যাসোসিয়েশন এবং ইউএস অলিম্পিক কমিটি এতে সমর্থন দিয়েছে। বড় বিনিয়োগকারী ও রিয়াল এস্টেট কম্পানিগুলোও এতে সায় দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শুমার ডেমোক্রেটিক দলের একজন শক্তিশালী সিনেটর। তিনি ডেমোক্রেটিক সিনেটরিয়াল ক্যাম্পেইন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সিনেট ডেমোক্রেটিক কনফারেন্সের ভাইস চেয়ার ছিলেন। বর্তমানে তিনি ডেমোক্রেটিক পলিসি কমিটির প্রধান।
এই বিলে নানাভাবে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে লাভবান হবে তা খতিয়ে দেখা হয়েছে, ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই বিলের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে ব্যাপক প্রভাব পড়বে, সে কথা একটিবারের জন্যও ধর্তব্যে নেওয়া হয়নি।
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জীবনযাত্রার মান ও জীবনের নিরাপত্তায় একটি ব্যাপক পার্থক্য তৈরি হওয়ার পর থেকেই তৃতীয় বিশ্বের জনগণের একটি বড় অংশের স্বপ্ন হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসের। কখনো ক্ষুধা, দারিদ্র্য থেকে পালাতে, আবার কখনো পশ্চিমা ঢঙের জীবনযাপনের প্রতি আসক্তির কারণে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করেছি, যুক্তরাষ্ট্র ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। একটি হলো অর্থসম্পন্ন মানুষদের, আরেকটি একাডেমিক কেরিয়ারসম্পন্নদের। ফলে এ দেশ থেকে যারা যুক্তরাষ্ট্রে গেছে, সেখানে স্থায়ী বসবাসের জন্য কাঠখড় পুড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আইনি লড়াই করেছে, তাদের হয় বড় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রদর্শন করে অথবা নানাভাবে সে দেশে যাওয়ার যুক্তি দাঁড় করাতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কখনো এ দেশের কোনো সৎ স্কুলশিক্ষক বা কোনো কর্তব্যনিষ্ঠকে ভিসা দেয়নি। এ দেশে বেশির ভাগ অর্থশালী লোকের আয়ের উৎস কী তা যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভালো করে জানা আছে। কিন্তু তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজধানী ঢাকার একটি বিশেষ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে আছে মৌলবাদী সংগঠনের লোকেরা। এই সংগঠিত মৌলবাদীদের নেটওয়ার্ক প্রত্যেক সদস্যকেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। এসব লোক যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত করে অবাধে। তাদের সবাইকে সহজে ভিসা প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র, আর নিরাপত্তার নামে ভিসা আটকে দেয় প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনেককেই। এর অর্থ হলো, যতই নিরাপত্তার কথা বলা হোক, যুক্তরাষ্ট্র আসলে পেয়ার করে অর্থসম্পন্ন বিদেশিদের, আর কাউকে নয়।
তারই আরেকটি প্রমাণ মিলতে যাচ্ছে বাড়ি ক্রয়ের ওই নীতির মধ্য দিয়ে। তৃতীয় বিশ্বে বড় বড় অনিয়মকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী তাদের আত্মসাৎকৃত অর্থ কী করছে. তা কি যুক্তরাষ্ট্র জানে না? তারা এই নিয়মের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আত্মসাৎকৃত অর্থ নিরাপদ করার সুযোগ দিচ্ছে মাত্র। এই বাড়ি ক্রয় এবং ক্রয়ের সামর্থ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের এবং অনিয়ম করে পাড়ি জমানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে দেশে দেশে।
যুক্তরাষ্ট্র কোনো ঘনবসতিপূর্ণ দেশ নয়। তাদের ৫০টি রাজ্যের মধ্যে এমন অনেক রাজ্য রয়েছে, যেখানে আকারের দিক দিয়ে তিনটি বাংলাদেশ ঢুকিয়ে রাখা যায়। অথচ পুরো দেশে লোকসংখ্যা কমবেশি বাংলাদেশের দ্বিগুণ মাত্র। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে পুড়ছে, ডুবছে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে শিল্পোন্নয়নের সবচেয়ে বড় খেসারত দিতে হচ্ছে এবং হবে বাংলাদেশকে। অথচ জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে গালভরা বুলি আউড়ে তারপর ধনী দেশগুলো একটি আরেকটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। মানবতার কথা বাদ দিলাম, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশকে কিছুটা ক্ষতিপূরণ করার মানসিকতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ২০ লাখ মানুষকে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিলে এ দেশের ঝুঁকি অনেকটা লাঘব হতে পারত। না, তা করবে না। শুধু চুরির টাকা জায়েজ করার সুযোগ দেবে!
লক্ষ করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর ৯০ শতাংশ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে গালমন্দ করে। আবার তারাই ৯০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে যাওয়াটাকে স্বপ্ন বলে মনে করে। এর কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র যতটা অন্য দেশের ব্যাপারে নিকৃষ্ট, ততটাই নিজ দেশের জন্য অত্যন্ত উৎকৃষ্ট। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র হলো সেই মায়ের মতো, যে মা অন্যের শিশুর মুখ থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে নিজের বাচ্চাকে খাইয়ে সন্তুষ্ট হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশেও অসংখ্য নাগরিক সারা জীবন কাজ করে একটি বাড়ি কেনার জন্য পাঁচ লাখ ডলার জোগাড় করতে পারে না। আর তৃতীয় বিশ্ব থেকে অবলীলায় পাঁচ লাখ ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যারা যাবে তারা কারা, তাদের টাকার উৎস কী, সে ব্যাপারে জানতে চাওয়ার কোনো শর্ত কেন নেই? বিশ্বের বহু দেশে যুক্তরাষ্ট্র ডান হাত, বাম হাত গলিয়ে দিচ্ছে। এসব দেশের প্রতি কোনো প্রতিশ্রুতি নেই?
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এই গৃহনির্মাণ নীতি বাস্তবায়িত হলে সেখানে একটি বড় ধরনের নয়া বসতি তৈরি হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জনশক্তিকে যথেষ্ট ভারী করে তুলতে পারে। সেই সঙ্গে দেশটির আবাসন সমস্যায় একটি নতুন পরিসংখ্যান তৈরি হবে। সে পরিসংখানে জনগণের আবাসন সমস্যা মেটানোর একটি সফলতা দেখা যাবে। কিন্তু পর্দার পেছনের কথা হলো, ওই আবাসন তৈরি হবে তৃতীয় বিশ্বের একটি বড় অংশের শোষিত অর্থ দ্বারা। সুদূর ভবিষ্যতে এ অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষ যে সমাজ উপহার দেবে, তা কিন্তু দেশটির সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান না-ও
রাখতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, mohshinhabib@yahoo.com
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট সিনেটর চার্লস ই শুমার এবং রিপাবলিকান দলের সিনেটর মাইক লি যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য একটি বিস্তৃত অভিবাসন প্যাকেজের প্রস্তাব করেছেন। সে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যে বিদেশি পাঁচ লাখ ডলার যুক্তরাষ্ট্রে আবাসন ক্রয়ে ব্যবহার করবে তাকে প্রথমেই তিন বছরের জন্য রেসিডেনশিয়াল ভিসা প্রদান করা হবে। এ ক্ষেত্রে নূ্যনতম দুই লাখ ৫০ হাজার ডলার তাকে প্রাথমিকভাবে আবাসনে ব্যয় করতে হবে এবং বছরে ১৮০ দিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে। বলা হয়েছে, কাগজপত্র পরীক্ষার পর একবার অনুমোদন দেওয়া হলে সরকারের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা_এসব সুবিধা পাবে না। এ ক্ষেত্রে আবেদনকারীরা একাধিক বাড়ি কিনতে পারবে এবং একটিতে নিজে বসবাস করে অন্যটি বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দিতে পারবে। শুমার ও লি মনে করছেন, এ ব্যবস্থার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন সংকট অনেকটাই লাঘব হবে।
বিলটি নিশ্চিতভাবেই গৃহীত হতে যাচ্ছে। কারণ ইউএস চেম্বার অব কমার্স, দি ইউএস ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন, আমেরিকান হোটেল অ্যান্ড লজিং অ্যাসোসিয়েশন এবং ইউএস অলিম্পিক কমিটি এতে সমর্থন দিয়েছে। বড় বিনিয়োগকারী ও রিয়াল এস্টেট কম্পানিগুলোও এতে সায় দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শুমার ডেমোক্রেটিক দলের একজন শক্তিশালী সিনেটর। তিনি ডেমোক্রেটিক সিনেটরিয়াল ক্যাম্পেইন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। সিনেট ডেমোক্রেটিক কনফারেন্সের ভাইস চেয়ার ছিলেন। বর্তমানে তিনি ডেমোক্রেটিক পলিসি কমিটির প্রধান।
এই বিলে নানাভাবে যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে লাভবান হবে তা খতিয়ে দেখা হয়েছে, ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই বিলের ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে ব্যাপক প্রভাব পড়বে, সে কথা একটিবারের জন্যও ধর্তব্যে নেওয়া হয়নি।
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জীবনযাত্রার মান ও জীবনের নিরাপত্তায় একটি ব্যাপক পার্থক্য তৈরি হওয়ার পর থেকেই তৃতীয় বিশ্বের জনগণের একটি বড় অংশের স্বপ্ন হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসের। কখনো ক্ষুধা, দারিদ্র্য থেকে পালাতে, আবার কখনো পশ্চিমা ঢঙের জীবনযাপনের প্রতি আসক্তির কারণে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করেছি, যুক্তরাষ্ট্র ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। একটি হলো অর্থসম্পন্ন মানুষদের, আরেকটি একাডেমিক কেরিয়ারসম্পন্নদের। ফলে এ দেশ থেকে যারা যুক্তরাষ্ট্রে গেছে, সেখানে স্থায়ী বসবাসের জন্য কাঠখড় পুড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আইনি লড়াই করেছে, তাদের হয় বড় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট প্রদর্শন করে অথবা নানাভাবে সে দেশে যাওয়ার যুক্তি দাঁড় করাতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কখনো এ দেশের কোনো সৎ স্কুলশিক্ষক বা কোনো কর্তব্যনিষ্ঠকে ভিসা দেয়নি। এ দেশে বেশির ভাগ অর্থশালী লোকের আয়ের উৎস কী তা যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ভালো করে জানা আছে। কিন্তু তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। রাজধানী ঢাকার একটি বিশেষ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে আছে মৌলবাদী সংগঠনের লোকেরা। এই সংগঠিত মৌলবাদীদের নেটওয়ার্ক প্রত্যেক সদস্যকেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। এসব লোক যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত করে অবাধে। তাদের সবাইকে সহজে ভিসা প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র, আর নিরাপত্তার নামে ভিসা আটকে দেয় প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনেককেই। এর অর্থ হলো, যতই নিরাপত্তার কথা বলা হোক, যুক্তরাষ্ট্র আসলে পেয়ার করে অর্থসম্পন্ন বিদেশিদের, আর কাউকে নয়।
তারই আরেকটি প্রমাণ মিলতে যাচ্ছে বাড়ি ক্রয়ের ওই নীতির মধ্য দিয়ে। তৃতীয় বিশ্বে বড় বড় অনিয়মকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী তাদের আত্মসাৎকৃত অর্থ কী করছে. তা কি যুক্তরাষ্ট্র জানে না? তারা এই নিয়মের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আত্মসাৎকৃত অর্থ নিরাপদ করার সুযোগ দিচ্ছে মাত্র। এই বাড়ি ক্রয় এবং ক্রয়ের সামর্থ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসের এবং অনিয়ম করে পাড়ি জমানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে দেশে দেশে।
যুক্তরাষ্ট্র কোনো ঘনবসতিপূর্ণ দেশ নয়। তাদের ৫০টি রাজ্যের মধ্যে এমন অনেক রাজ্য রয়েছে, যেখানে আকারের দিক দিয়ে তিনটি বাংলাদেশ ঢুকিয়ে রাখা যায়। অথচ পুরো দেশে লোকসংখ্যা কমবেশি বাংলাদেশের দ্বিগুণ মাত্র। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে পুড়ছে, ডুবছে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশ। এর মধ্যে শিল্পোন্নয়নের সবচেয়ে বড় খেসারত দিতে হচ্ছে এবং হবে বাংলাদেশকে। অথচ জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে গালভরা বুলি আউড়ে তারপর ধনী দেশগুলো একটি আরেকটির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। মানবতার কথা বাদ দিলাম, শুধু জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশকে কিছুটা ক্ষতিপূরণ করার মানসিকতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ২০ লাখ মানুষকে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সেখানে বসবাসের সুযোগ করে দিলে এ দেশের ঝুঁকি অনেকটা লাঘব হতে পারত। না, তা করবে না। শুধু চুরির টাকা জায়েজ করার সুযোগ দেবে!
লক্ষ করলে দেখা যাবে, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে, বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোর ৯০ শতাংশ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে গালমন্দ করে। আবার তারাই ৯০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে যাওয়াটাকে স্বপ্ন বলে মনে করে। এর কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র যতটা অন্য দেশের ব্যাপারে নিকৃষ্ট, ততটাই নিজ দেশের জন্য অত্যন্ত উৎকৃষ্ট। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র হলো সেই মায়ের মতো, যে মা অন্যের শিশুর মুখ থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে নিজের বাচ্চাকে খাইয়ে সন্তুষ্ট হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতো অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশেও অসংখ্য নাগরিক সারা জীবন কাজ করে একটি বাড়ি কেনার জন্য পাঁচ লাখ ডলার জোগাড় করতে পারে না। আর তৃতীয় বিশ্ব থেকে অবলীলায় পাঁচ লাখ ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যারা যাবে তারা কারা, তাদের টাকার উৎস কী, সে ব্যাপারে জানতে চাওয়ার কোনো শর্ত কেন নেই? বিশ্বের বহু দেশে যুক্তরাষ্ট্র ডান হাত, বাম হাত গলিয়ে দিচ্ছে। এসব দেশের প্রতি কোনো প্রতিশ্রুতি নেই?
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এই গৃহনির্মাণ নীতি বাস্তবায়িত হলে সেখানে একটি বড় ধরনের নয়া বসতি তৈরি হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জনশক্তিকে যথেষ্ট ভারী করে তুলতে পারে। সেই সঙ্গে দেশটির আবাসন সমস্যায় একটি নতুন পরিসংখ্যান তৈরি হবে। সে পরিসংখানে জনগণের আবাসন সমস্যা মেটানোর একটি সফলতা দেখা যাবে। কিন্তু পর্দার পেছনের কথা হলো, ওই আবাসন তৈরি হবে তৃতীয় বিশ্বের একটি বড় অংশের শোষিত অর্থ দ্বারা। সুদূর ভবিষ্যতে এ অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী মানুষ যে সমাজ উপহার দেবে, তা কিন্তু দেশটির সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান না-ও
রাখতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, mohshinhabib@yahoo.com
No comments