লেখার ভালোমন্দ by ফখরুজ্জামান চৌধুরী
লেখালেখির ভালোমন্দ নিয়ে পরস্পরের আলোচনা সচরাচর খুব কমই করে থাকি। কথাবার্তা যা হয় তা অনেকটা মোটা দাগের— ভালো লেগেছে, মন্দ লেগেছে জাতীয় ঢালাও মন্তব্য। এসব কথাবার্তায় কোনো পক্ষেরই লাভক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। পাঠচক্র বা স্টাডি সার্কেল বলে যে ছোটো ছোটো পরিসরে আলোচনার আয়োজন দেখি মাঝে মাঝে তাও নিয়মিত নয়।
এ জাতীয় আয়োজনের জন্য প্রয়োজন হয় আর্থিক সংশ্লেষ। নানা ধরনের আয়োজনের ব্যবস্থা।
ওয়ান টু ওয়ান আলোচনায় তৃতীয় পক্ষ থাকেন না। এ জাতীয় আয়োজনকে আদৌ আয়োজন বলা যায় না। দ্বিপাক্ষিক সংলাপ বড় জোর। কোনো লেখা নিয়ে একজনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্তিগত যদিও, সারবত্তা থাকলে এ ধরনের আলোচনা অবশ্যই ফলপ্রসু হতে পারে।
এ পর্যন্ত যা বললাম তাকে যদি গৌরচন্দ্রিকা বলি, এর একটা কারণ আছে। ব্যক্তিগত বিষয় যদিও, আমার ধারণা, প্রকাশ্য আলোচনার দ্বারা তা আর পুরোদস্তুর ব্যক্তিগত থাকে না।
আমরা যারা প্রায় নিয়মিতভাবে লেখালেখি করি, বিশেষ করে পত্র-পত্রিকার জন্য রুটিনভাবে কলাম লিখি, তারা যদি পরস্পরের লেখা নিয়ে মুক্ত মনে অন্তত টেলিফোনেও আলোচনা করি, তাহলে লাভবান হতে পারি দু’পক্ষই। একজনের মত যে অকাট্য কিংবা অভ্রান্ত হবে এমন তো নয়। অনেক সময় আমরা একটা ধারণার নিচে বাস করি। বিশেষ কোনো লেখা নিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করি।
সম্প্রতি পরলোকগত একজন সহৃদ সম্পর্কে দু’ছত্র লিখে ভেবেছিলাম, একটা কাজ করা হলো বটে। পরলোকগত মানুষটির প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানানো হলো আবার তার গুণাবলী, অবদানের কথাও নতুনভাবে আলোচিত হলো।
লেখাটি নিয়ে দু’একটি প্রশংসামূলক বাক্য বলাও হয়েছে। বিশেষ করে যারা পরলোকগত মানুষটিকে চিনতেন, তাদের দু’একজন তার চির বিদায়ে হায় আফসোস করে জানালেন, লেখাটা ভালোই হয়েছে! শুধু ভালো বললে প্রসন্নচিত্তে প্রশংসা গ্রহণ করা যেত, কিন্তু ‘ই’ প্রত্যয়ান্ত ‘ভালো’ যে খুব ভালো নয় তা বুঝতে পেরে খুব একটা উত্সাহ বোধ করি না প্রশংসাসূচক মন্তব্যেও!
কিন্তু অরুণাভ সরকার যখন লেখা নিয়ে আলোচনা করেন, উত্কর্ণ হই। তার বক্তব্যে আমার আস্থা বহুদিন থেকে।
সামাজিক সম্পর্কের নিরিখে যদি বলি তাহলে অবশ্যই কবুল করি, তার সঙ্গে আমার সখ্য খুব নিবিড় নয়। সামনাসামনি তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ হয়েছে হাতেগোনা যায় এমন অল্প কয়েকবার। আলোচনা যা হয়েছে তা সাহিত্য সম্পর্কিতই। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে জানাজানি তাও খুব বলার মতো নয়।
তার কবিতার আমি একজন অনুরাগী। গত শতকের ছয়ের দশকের অন্যতম উজ্জ্বল কবি অরুণাভ সরকার কবিতার পাশাপাশি নিয়মিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও কলাম লিখে থাকেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
বেশ কিছু লেখা তিনি লিখেছেন ভাষা ব্যবহারে বিভিন্ন রকম অশুদ্ধতার বিষয় নিয়ে। তিনি একজন ক্রুসেডারের মতো লেখায় ভুল নির্ণয়ের কাজে ব্যাপৃত আছেন। ধারণা করি, এ কাজটি দ্বারা তিনি এরই মধ্যে তার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন মিত্রের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি করে ফেলেছেন!
মানুষ প্রশংসা শুনে বিগলিত হয়। সামান্য সমালোচনা কিংবা নিন্দায় হন কূপিত। যথেষ্ট যৌক্তিক হলেও নিন্দা কিংবা সমালোচনা সহজভাবে মানুষ নিতে পারেন খুব কমই। এটাই মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।
অরুণাভ সরকার তার বাক্যে যথেষ্ট তীক্ষষ্ট হলেও শেষাবধি সামাজিক কারণেই বোধকরি বলেন, এতক্ষণ যা বললাম, শুধুই রসিকতা!
তিনি হয়তো ভেবেছেন, লেখার সমালোচনা করে তিনি আমাকে আহত করেছেন। কারণ, সরাসরি ছিল তার বক্তব্য, যদিও তা ছিল যথেষ্টভাবে মোলায়েম।
স্বীকার করি, কিছুটা যে খারাপ লাগেনি তা নয়। না, তার কথায় নয়। নিজের লেখার। ভ্রান্তিগুলোর জন্য। এ জাতীয় ভুল সহজেই পরিহার করা যেত। যেমন যখন লিখি : তিনি ছিলেন মিতবাক। কথা বলতেন কম, তখন কী দ্বিরুক্তির অভিযোগে অভিযুক্ত হই না? কম কথা বলেন বলেই তো মিতবাক।
অরুণাভ সরকার হয়তো ভেবেছেন...
বর্তমান সময়ে পরমতের প্রতি যে ধরনের অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে, তখন কী তার ব্যক্তিগতভাবে ত্রুটি নির্ণয়কে ‘অভিযুক্ত’ ব্যক্তি সহজভাবে নিতে পারবেন?
সবাইর কথা জানি না। অরুণাভ সরকারকে ধন্যবাদ। ব্যক্তিগতভাবে আমি উপকৃত হই তার গঠনমূলক সমালোচনায়।
তিনি আমার লেখারই ভুল-ত্রুটি নির্ণয় করেছেন। প্রশংসা করেননি আমার লেখার এমন কোনো অংশের যা ‘স্বীকরণে’র নামে অন্যের কাছ থেকে আত্মসাত্ করেছি।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চোর’ গল্পের লেখকের অবস্থা কল্পনা করুন। ট্রেনের অপেক্ষায় প্ল্যাটফর্মে লেখক ও তার পাঠকের মধ্যে আলোচনার এক পর্যয়ে পাঠক লেখকের এক গল্পের এমনসব অংশের প্রশংসা করছিলেন যা তিনি অন্যের লেখা থেকে চুরি করেছিলেন।
প্রশংসা শুনে লেখক ঢোক গিলছিলেন বারবার।
অরুণাভ সরকারের বক্তব্যে তা এ ধরনের ঢোক গিলতে হয়নি অন্তত!
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
ওয়ান টু ওয়ান আলোচনায় তৃতীয় পক্ষ থাকেন না। এ জাতীয় আয়োজনকে আদৌ আয়োজন বলা যায় না। দ্বিপাক্ষিক সংলাপ বড় জোর। কোনো লেখা নিয়ে একজনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্তিগত যদিও, সারবত্তা থাকলে এ ধরনের আলোচনা অবশ্যই ফলপ্রসু হতে পারে।
এ পর্যন্ত যা বললাম তাকে যদি গৌরচন্দ্রিকা বলি, এর একটা কারণ আছে। ব্যক্তিগত বিষয় যদিও, আমার ধারণা, প্রকাশ্য আলোচনার দ্বারা তা আর পুরোদস্তুর ব্যক্তিগত থাকে না।
আমরা যারা প্রায় নিয়মিতভাবে লেখালেখি করি, বিশেষ করে পত্র-পত্রিকার জন্য রুটিনভাবে কলাম লিখি, তারা যদি পরস্পরের লেখা নিয়ে মুক্ত মনে অন্তত টেলিফোনেও আলোচনা করি, তাহলে লাভবান হতে পারি দু’পক্ষই। একজনের মত যে অকাট্য কিংবা অভ্রান্ত হবে এমন তো নয়। অনেক সময় আমরা একটা ধারণার নিচে বাস করি। বিশেষ কোনো লেখা নিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করি।
সম্প্রতি পরলোকগত একজন সহৃদ সম্পর্কে দু’ছত্র লিখে ভেবেছিলাম, একটা কাজ করা হলো বটে। পরলোকগত মানুষটির প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানানো হলো আবার তার গুণাবলী, অবদানের কথাও নতুনভাবে আলোচিত হলো।
লেখাটি নিয়ে দু’একটি প্রশংসামূলক বাক্য বলাও হয়েছে। বিশেষ করে যারা পরলোকগত মানুষটিকে চিনতেন, তাদের দু’একজন তার চির বিদায়ে হায় আফসোস করে জানালেন, লেখাটা ভালোই হয়েছে! শুধু ভালো বললে প্রসন্নচিত্তে প্রশংসা গ্রহণ করা যেত, কিন্তু ‘ই’ প্রত্যয়ান্ত ‘ভালো’ যে খুব ভালো নয় তা বুঝতে পেরে খুব একটা উত্সাহ বোধ করি না প্রশংসাসূচক মন্তব্যেও!
কিন্তু অরুণাভ সরকার যখন লেখা নিয়ে আলোচনা করেন, উত্কর্ণ হই। তার বক্তব্যে আমার আস্থা বহুদিন থেকে।
সামাজিক সম্পর্কের নিরিখে যদি বলি তাহলে অবশ্যই কবুল করি, তার সঙ্গে আমার সখ্য খুব নিবিড় নয়। সামনাসামনি তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত্ হয়েছে হাতেগোনা যায় এমন অল্প কয়েকবার। আলোচনা যা হয়েছে তা সাহিত্য সম্পর্কিতই। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে জানাজানি তাও খুব বলার মতো নয়।
তার কবিতার আমি একজন অনুরাগী। গত শতকের ছয়ের দশকের অন্যতম উজ্জ্বল কবি অরুণাভ সরকার কবিতার পাশাপাশি নিয়মিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও কলাম লিখে থাকেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
বেশ কিছু লেখা তিনি লিখেছেন ভাষা ব্যবহারে বিভিন্ন রকম অশুদ্ধতার বিষয় নিয়ে। তিনি একজন ক্রুসেডারের মতো লেখায় ভুল নির্ণয়ের কাজে ব্যাপৃত আছেন। ধারণা করি, এ কাজটি দ্বারা তিনি এরই মধ্যে তার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন মিত্রের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি করে ফেলেছেন!
মানুষ প্রশংসা শুনে বিগলিত হয়। সামান্য সমালোচনা কিংবা নিন্দায় হন কূপিত। যথেষ্ট যৌক্তিক হলেও নিন্দা কিংবা সমালোচনা সহজভাবে মানুষ নিতে পারেন খুব কমই। এটাই মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।
অরুণাভ সরকার তার বাক্যে যথেষ্ট তীক্ষষ্ট হলেও শেষাবধি সামাজিক কারণেই বোধকরি বলেন, এতক্ষণ যা বললাম, শুধুই রসিকতা!
তিনি হয়তো ভেবেছেন, লেখার সমালোচনা করে তিনি আমাকে আহত করেছেন। কারণ, সরাসরি ছিল তার বক্তব্য, যদিও তা ছিল যথেষ্টভাবে মোলায়েম।
স্বীকার করি, কিছুটা যে খারাপ লাগেনি তা নয়। না, তার কথায় নয়। নিজের লেখার। ভ্রান্তিগুলোর জন্য। এ জাতীয় ভুল সহজেই পরিহার করা যেত। যেমন যখন লিখি : তিনি ছিলেন মিতবাক। কথা বলতেন কম, তখন কী দ্বিরুক্তির অভিযোগে অভিযুক্ত হই না? কম কথা বলেন বলেই তো মিতবাক।
অরুণাভ সরকার হয়তো ভেবেছেন...
বর্তমান সময়ে পরমতের প্রতি যে ধরনের অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে, তখন কী তার ব্যক্তিগতভাবে ত্রুটি নির্ণয়কে ‘অভিযুক্ত’ ব্যক্তি সহজভাবে নিতে পারবেন?
সবাইর কথা জানি না। অরুণাভ সরকারকে ধন্যবাদ। ব্যক্তিগতভাবে আমি উপকৃত হই তার গঠনমূলক সমালোচনায়।
তিনি আমার লেখারই ভুল-ত্রুটি নির্ণয় করেছেন। প্রশংসা করেননি আমার লেখার এমন কোনো অংশের যা ‘স্বীকরণে’র নামে অন্যের কাছ থেকে আত্মসাত্ করেছি।
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চোর’ গল্পের লেখকের অবস্থা কল্পনা করুন। ট্রেনের অপেক্ষায় প্ল্যাটফর্মে লেখক ও তার পাঠকের মধ্যে আলোচনার এক পর্যয়ে পাঠক লেখকের এক গল্পের এমনসব অংশের প্রশংসা করছিলেন যা তিনি অন্যের লেখা থেকে চুরি করেছিলেন।
প্রশংসা শুনে লেখক ঢোক গিলছিলেন বারবার।
অরুণাভ সরকারের বক্তব্যে তা এ ধরনের ঢোক গিলতে হয়নি অন্তত!
লেখক : কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক
No comments