সৈয়দ রিফাত হোসাইন-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সত্যিই কি উন্নতি হয়েছে?

পাকিস্তান ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক তেমন একটা হৈচৈ ফেলতে পারে না সাধারণত। কিন্তু গত সপ্তাহে নয়াদিলি্লতে যে বৈঠক হয়ে গেছে, তা ছিল আগের চেয়ে ব্যতিক্রম। আর সেটা ছিল ভুল একটি কারণে। ভারতীয় প্রচারমাধ্যম কোথায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো, বিশেষ করে দুটি দেশের পারমাণবিক অস্ত্র বিষয় প্রাধান্য দিয়ে প্রচার করবে, সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে তারা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৩৪ বছর বয়সের মিস হিনা রাব্বানি খার দেখতে কেমন, তাঁর চালচলন কেমন_এসব দিকে বেশি নজর দিয়েছে।


দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া তাঁকে উল্লেখ করেছে 'বেস্ট ফেইস' হিসেবে। নবভারত টাইমস বলেছে, 'মডেল লাইক মিনিস্টার'। দ্য মেইল টুডে তাঁর রুচিশীল দ্রব্যাদি নিয়ে লিখেছে। তারা লিখেছে, তিনি ব্যবহার করেছেন রবার্তো ক্যাভেলি সানগ্লাস, বেশ বড় আকারের হার্মস বার্কিন ব্যাগ। সুন্দর সুন্দর অলংকার তাঁকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। পাকিস্তানের সুদর্শনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের প্রবীণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণের তুলনা করতেও পত্রিকাগুলো ছাড়েনি। দ্য টেলিগ্রাফ এ ক্ষেত্রে নির্দয়ের মতো ভূমিকা পালন করেছে বলা যায়।
মিস খার কি তাঁর প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন? মনে হয় না। অন্তত তাঁদের বৈঠক শেষে যে যুক্ত বিবৃতি তাঁরা দিয়েছেন, তাতে তেমন মনে হয় না। যেমন_২১ দফার এই যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা মুম্বাই হামলার বিষয়টিতে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেননি। তাঁদের সেই বিবৃতিতে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার বিষয়টিও স্থান পায়নি, যতটা জোরালোভাবে পাওয়ার কথা ছিল। কাশ্মীরের বিষয়টিও তেমনই। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার বিষয়টি তিনবার উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরের বিষয়টি বলা হয়েছে মাত্র একবার। তাও এমন ভাসা ভাসা সেই শব্দ, যাকে অনুল্লেখ্য বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়।
কাশ্মীর সমস্যাটি সব সময়ের জন্যই শান্তির জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আর এই হুমকি নিরসনের জন্য দুটি পক্ষকেই শক্তিশালী প্রতিশ্রুতি দেওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল। একই সঙ্গে উভয় পক্ষকেই আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হতো। অন্যদিকে আরো কিছু অমীমাংসিত বিষয়, বিশেষ করে সিয়াচেন, স্যার ক্রিক, ওল্লার ব্যারাজ বা তালবুল নৌবন্দর প্রকল্প সম্পর্কেও বলা হয়েছে, দুটি পক্ষই যথাসম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে বিষয়গুলো সমাধানের জন্য আলোচনায় মিলিত হবে।
এমন অস্পষ্টতা যে বিবৃতিতে স্পষ্টত দৃশ্যমান, সেখানে মিস খার তাঁর ভারত সফরকে দুটি দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিপক্ষ ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আসলে দেশ দুটির মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ইঙ্গিত আগেই তিনি দেখেছেন। সত্যি বলতে কি, দেশ দুটির মধ্যে বিদ্যমান দীর্ঘকালীন সমস্যা সমাধানে সফল কোনো আলোচনাই চোখে পড়েনি। তার আগে দেশ দুটির শীর্ষ কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠকে বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা হয়। পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মনে হয়, তাঁদের উপরস্থদের বিষয়ে খুব একটা সন্তুষ্টি ছিল না। ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাও এই বৈঠককে আশাবাদী বলে উল্লেখ করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ মন্তব্য করার সময় তাঁর চেহারা দেখে মনে হয়নি তিনি খুব একটা সন্তুষ্ট চিত্তে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। মন্ত্রীদ্বয় তাঁদের দুটি দেশের বিদ্যমান যৌথ সমস্যাগুলো সমাধানের লক্ষ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যেতে একমত হয়েছেন। তাঁরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, এই আলোচনার মাধ্যমে দেশ দুটি সুপ্রতিবেশীসুলভ পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হবে। তাঁরা মনে করেন, উভয় পক্ষের প্রচেষ্টা থাকবে নিজ নিজ দেশে ও বহির্বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। তাঁরা মনে করেন, দেশ দুটির নাগরিকরা প্রত্যাশা করেন, তাঁদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিরাজ করবে এবং ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি পর্যায়েও সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগও স্থাপিত হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অদূরভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান শান্তি আলোচনা কোন দিকে মোড় নেবে? তিনটি বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য হতে পারে_
প্রথমত, মুম্বাই হামলায় অভিযুক্ত লস্কর-ই-তৈয়বা যে এই শান্তি প্রচেষ্টার পথে প্রতিবন্ধক হবে না, সে নিশ্চয়তা দেবে কে? দ্বিতীয়ত, কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে ভারত কি উদার মনোভাব দেখাবে? তৃতীয়ত, পাকিস্তান ও ভারত শান্তি আলোচনাকে আঞ্চলিক শান্তির লক্ষ্যে পরিচালিত করতে পারবে কি? আসলে ৬৫ বছর ধরে ভারত-পাকিস্তান শান্তির বিষয়টি প্রায়ই বহিঃশক্তি দ্বারা বিঘি্নত হয়েছে। পরাশক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে নাক গলিয়েছে সুযোগ পেলেই। এই মুহূর্তে পরিবেশই এমন যে তাদের শান্তি প্রচেষ্টার জন্য এটাকে অত্যন্ত যোগ্য সময় বলে মনে করা যায়। দেশ দুটি শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগের চেয়ে অধিকতর মনোযোগ দিতে পারে পারিপাশ্বর্িক কারণে।
আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দেশ দুটি আলোচনায় এগিয়ে আসতে পারে। আর এটা হতে পারে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তিন দশকের রক্তপাতের খেলায় মেতে ওঠা দেশটিতেও অবশেষে শান্তি আসতে পারে। আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় এই উদ্যোগ প্রত্যাশিতও বটে। অন্তত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের পাকিস্তান সফর পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে চাই। আর আশা করছি, তিনিও উভয়ের স্বার্থে আফগানিস্তান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন এবং সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারবেন, যা দুটি দেশের জন্যই সমানভাবে জরুরি।

লেখক : ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। দ্য ডন থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.