নিত্যজাতম্‌-কেন পান্থ ক্ষান্ত হও, হেরি দীর্ঘ পথ by মহসীন হাবিব

দেশের নাগরিকদের, সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এবং রাষ্ট্রের একটি মুখ্য দায়িত্ব তার বয়োবৃদ্ধ নাগরিকদের খোঁজ রাখা; বিশেষ করে দীর্ঘ অভিজ্ঞ ও গুণী নাগরিকদের অভিজ্ঞতার সন্ধান করা। এ কর্তব্যের ব্যাপারে সচেতন করা এবং গুণী নাগরিকের সন্ধান দেওয়ার একটি মুখ্য দায়িত্ব গণমাধ্যমের। গণমাধ্যম নাগরিকদের কাছে তুলে ধরবে দেশের এই নাগরিকদের। মানুষটির অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান সমাজের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করবে সমৃদ্ধ।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করি, কেউ সেধে এসে নিজের পরিচয় না দিলে অথবা কারো 'ক্ষমতা-খ্যাতি' না থাকলে আমরা গুণী মানুষের সন্ধান করি না। ফলে অনেক অসংগতি সৃষ্টি হয় সমাজে; দরিদ্র হয়ে পড়ে সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্প। এ শুধু অন্যায়ই নয়, জাতির পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। আমাদের এসব দুর্বলতার কারণেই যুবসমাজের হাত থেকে গ্রন্থ খসে পড়ে মোবাইল-ইন্টারনেট উঠে এসেছে। শঙ্কা হয়, জ্ঞানবিমুখ, চিন্তাবিমুখ সৃষ্ট নব্যধারা নিয়ে কত দূর যেতে পারব আমরা? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর একটি গ্রন্থের উল্টো মলাটে লিখেছেন, ইতিহাস হলো তীরের মতো। ধনুকের পেছন দিকে যত টানা যায়, তীর তত বেশি সামনের দিকে গতি পায়। তাহলে যে তীর পেছন দিকে টানা হয় না, সে তীর তো ছুটবে না। পায়ের কাছেই মুখ থুবড়ে পড়বে!
সম্প্র্রতি একজন মানুষের সন্ধান পেয়েছি। অবাক হয়েছি মানুষটির গুণের খবর জেনে। তার চেয়ে বেশি হতাশ হয়ে ভাবছি, কেন দেশে এমন মানুষ সম্পর্কে কেউ বিশেষ খোঁজ রাখে না, কেউ তাঁর সম্পর্কে কিছু জানে না? দেশ পুরোটাই 'টেলিভিশনের মুখসর্বস্ব হয়ে গেছে?
তিনি থাকেন উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের কোনো একটি ফ্ল্যাটে। হয়তো বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে গ্রিলের ভেতর দিয়ে নীরবে বাংলাদেশকে দেখেন; নিজের দেখা দীর্ঘ ইতিহাস রোমন্থন করেন। ফেলে আসা দিনগুলোর সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশকে মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করেন। ভাবতে থাকেন, সুশীতল টলটলে বুড়িগঙ্গার পানি কী করে বিষে পরিণত হলো; কী করে ধানমণ্ডির ধানক্ষেত আর খালগুলো উধাও হয়ে সেখানে যানজট সৃষ্টি হলো। হয়তো সমাজের অবক্ষয়ের দিকে ভারী চশমার ভেতর দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। অস্থির এ সময়কে নিক্তিতে তুলে গত শতাব্দীর গোড়ার দিকের বিপরীতে ওজন করে দেখেন। নিভৃতচারী, নীরব দীর্ঘ ইতিহাসের এই সাক্ষীর নাম কর্নেল (অব.) এসডি আহমেদ বা শরফুদ্দিন আহমেদ।
সম্প্রতি এই মানুষটির চিন্তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে তাঁর লেখা একটি গ্রন্থ পড়ে। আমার এক পরমাত্মীয় আমাকে ছেড়ে গেছেন। তাঁর স্মৃতি-উপকরণ হাতিয়ে দেখতে গিয়ে ঢাউস একটি বই দেখতে পেলাম। খানিকটা অবহেলার সঙ্গে বইটি হাতে তুলে নিলাম। কতজনই তো লিখছে! ইদানীং যে বাক্য লিখতে পারে এবং বই প্রকাশ করার টাকা আছে, সে-ই তো বই প্রকাশ করছে। এটিও বোধ হয় তেমনই একটি বই। আত্মজীবনীমূলক এ গ্রন্থটির নাম 'ত্রিকাল ত্রিগুণ'। পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখলাম, ২০০৯ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি বয়োবৃদ্ধ লেখক উৎসর্গ করেছেন অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদকে। একটু কৌতূহল জাগল। পরের পৃষ্ঠায় দেখলাম এ জেড এম আবদুল আলীর একটি ভূমিকা। পড়লাম। তার পরের পৃষ্ঠা ওল্টাতেই যেন ফটক খুলে ঢুকে পড়েছি এক বিশাল ইতিহাসের জগতে। যেন এক সোনার খনির সন্ধান মিলল।
'ত্রিকাল ত্রিগুণ' হলো তিনটি যুগের এক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য। অদ্ভুত অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ একটি জীবন কাটিয়ে বার্ধক্যে পেঁৗছেছেন শরফুদ্দিন আহমেদ। জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯২২ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জে। ১৯৪১ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। যথারীতি ১৯৪৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি। এরপর বেঙ্গল-আসাম রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করেন (বর্তমান ডিপ্লোমা কোর্সের সঙ্গে তুলনীয় নয়)। এরপর ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিনি এমবিবিএস করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা থেকে বিএ পাস করেন, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৭৬ সালে ৫৪ বছর বয়সে ঢাকা থেকে এলএলবি পাস করেন। অর্থাৎ তিনি একাধারে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার ও উকিল। পেশাগত জীবনও একই রকম বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরে সেনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে মিলিটারি হাসপাতালে চাকরি করেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা কোর্ট ও ঢাকা হাইকোর্টে আইন পেশায় নিয়োজিত থাকেন। আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের অন্যতম পরিকল্পকও তিনি।
আমি তাঁর 'ত্রিকাল ত্রিগুণ' পড়ে প্রায় এক শ বছরের বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ক্ষয়প্রাপ্তি দেখতে পাই। আমাদের সমাজ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে! মানুষের প্রতি মানুষের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই, কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কোথা থেকে কোথায় নেমে গেছে মানুষের প্রবৃত্তি তা ভাবলে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে আমরা একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জনপদে বাস করছি, যা সত্যি জঙ্গলের চেয়েও অনিরাপদ। তিনি নিজে লিখেছেন, 'বর্তমানে চোরেরা হয়ে গেছে ডাকাত, পকেটমার হয়েছে ছিনতাইকারী, নারীদের বিরক্তকারীরা হয়েছে নারী ধর্ষক, পড়শির জমির সঙ্গে সীমানার বেড়া সরিয়ে নিজের কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া ব্যক্তিরা হয়ে গেছে পড়শিকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদকারী।' অসাধারণ উম্মুক্ত চিন্তার অধিকারী এই মানুষটি সমাজের অসংগতিগুলো দেখেছেন, এখনো দেখছেন। তাঁর দেখার সঙ্গে একমত না হয়ে কোনো উপায় নেই।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে একটি চমৎকার কথা লিখেছেন তিনি। ১৯৩৯ সাল। নৌকা নিয়ে তিনি গেছেন চাল কিনতে। চালের মণ ছিল দুই টাকা। কিন্তু বাজারে গিয়ে শোনেন, চালের মণ বেড়ে ৯ টাকা হয়েছে। অবাক হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন, যুদ্ধ লেগেছে, তাই চালের দাম রাতারাতি বেড়ে গেছে।
আজ বাংলাদেশে চালের মূল্য, দ্রব্যমূল্য বাড়ছে লাফিয়ে। কোনো যুদ্ধের দরকার হয় না। এখানে কারো কোনো জবাবদিহিতা নেই। দেশের মানুষ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে সরাসরি জিম্মি। যাঁরা জনগণের দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা সিন্ডিকেট ভাঙেন না, সিন্ডিকেটের দখল নেন। তাহলে কি ধরে নেব আমরা একধরনের যুদ্ধের মধ্যেই আছি? আমাদের রাজনীতিবিদরা আজ আমাদের অদৃশ্য শত্রুবাহিনীর অবস্থান গ্রহণ করছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে বেহায়াপনা আমরা দেখে আসছি, তা থেকে মুক্তির উপায় কোথায়? সুখী বিস্তীর্ণ ফসলের কৃষক এখন লাল চোখ নিয়ে শহরের গলি দিয়ে গায়ের ঘাম কংক্রিটে ফেলে রিকশা টানছে। মাইকের সামনে, টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দেওয়া রাজনৈতিক নেতাদের কাছে জানতে চাই, দায়ী কে? আজ শরফুদ্দিন আহমেদেই লেখা সীমাবদ্ধ থাকুক, পরের লেখায় এ নিয়ে কিছু বলার আছে।
ইকবালের সেই কবিতা, ষাটের দশকে বাংলাদেশের ছাত্র-যুবকরা গাইতেন। শরফুদ্দিন আহমেদের অনুবাদে সেটাই আবার উচ্চারণের সময় এসেছে_

ওঠো তোমরা, দুনিয়ার সব গরিবকে জাগিয়ে দাও,
আমিরদের প্রাসাদের সব দরজা-দেয়াল গুঁড়িয়ে দাও।
যে ক্ষেতের ফসলেতে মেটে নাকো কৃষকেরই পেটের ক্ষুধা,
সে ক্ষেতের সব ফসলের শীষে আগুন ধরিয়ে দাও

আজ শরফুদ্দিন আহমেদের জন্মদিন। এই বয়োজ্যেষ্ঠ সুনাগরিক আমাদের মাথার ওপর ছায়া হয়ে আরো দীর্ঘসময় থাকুন। শুভ কামনা রইল।
লেখক : সাংবাদিক, mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.